ডিসেম্বর বাঙালির জাতীয় জীবনে যেমন পরম প্রাপ্তি ও অনন্য গৌরবে উজ্জ্বল, তেমনই মর্মান্তিকতায় আচ্ছন্ন। এবারের ১৬ ডিসেম্বর মহান বিজয়ের পঞ্চাশ বছর পূর্ণ হচ্ছে। ঐতিহাসিক বিজয়ের পঞ্চাশতম বার্ষিকী উদযাপন করতে উদগ্রীব বাংলাদেশ। বিজয়ের আনন্দে উদ্ভাসিত একাত্তরের সেই ঐতিহাসিক অর্জনের মুহূর্তকে জাতি স্মরণ করবে গভীর উচ্ছ্বাসে। তবে আজ এই লেখা যখন লিখছি তখন বিজয়ের সে আনন্দকে যেন ম্লান করে শোকাবহ শহীদ বুদ্ধিজীবী দিবস। যা স্মৃতিকে ভারাক্রান্ত করে তুলছে।
দেশের শ্রেষ্ঠ সন্তানদের হারানোর বেদনাময় স্মৃতি নিয়েই প্রতিবছর উপনীত হয় ১৪ ডিসেম্বর। গভীর শ্রদ্ধায় এই দিনটিতে স্মরণ করা হয় জাতির সেই শ্রেষ্ঠ সন্তানদের। যারা তাদের বর্তমানকে চিরতরে উৎসর্গ করে গিয়েছেন এদেশের ভবিষ্যৎ ও মহান স্বাধীনতার জন্য।
শহীদ বুদ্ধিজীবী দিবস বলতে ১৯৭১-এর ১৪ ডিসেম্বরকে চিহ্নিত করা হলেও, মহান মুক্তিযুদ্ধের পুরো নয় মাসই পাকিস্তানি হানাদারবাহিনী ও ওদের এদেশীয় দোসর গণহত্যা চালিয়েছিল। গণহত্যার পাশাপাশি পরিকল্পিতভাবেও এদেশের বিভিন্ন শ্রেণিপেশার জ্ঞানী-গুণী ও মুক্তবুদ্ধিসম্পন্ন শত শত মানুষকে হত্যা করেছে পাকিস্তানি বাহিনী ও ওদের সশস্ত্র সহযোগী রাজাকার-আলবদর ও আল শামস বাহিনী।
১৯৭১-এর ডিসেম্বরের শুরুতে যখন ভারত ও ভুটান বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দেয় এবং মুক্তি বাহিনীর সঙ্গে মিত্রবাহিনীও পাকিস্তানি হানাদারদের বিরুদ্ধে অভিযান শুরু করে; মূলত তখন থেকেই পরাজয় নিশ্চিত জেনে পাকিস্তানি বাহিনী বুদ্ধিজীবী হত্যার নীলনকশা প্রণয়ন করে। যে কারণে দেখা যায়, ডিসেম্বরের প্রথম সপ্তাহ থেকে ১৪ ডিসেম্বরের মধ্যে তালিকা ধরে ধরে দেশের শ্রেষ্ঠ সন্তানদের হত্যা করতে থাকে পাকিস্তানি বাহিনীর সহযোগী আলবদররা।
শেষপর্যায়ে এসে পাকিস্তানি হানাদারবাহিনী যখন বুঝতে শুরু করে যে, তাদের বিপক্ষে যুদ্ধে জেতা আর সম্ভব নয়; মূলত তখন থেকেই তারা বাংলাদেশকে মেধাশূন্য করা তথা সাংস্কৃতিক-সামাজিক ও শিক্ষার দিক থেকে পঙ্গু করে দেয়ার জন্য পরিকল্পনা করতে থাকে। সেই পরিকল্পনা অনুযায়ী দেশের শ্রেষ্ঠ সন্তানদের নিজ বাড়ি-ঘর থেকে তুলে নিয়ে বিভিন্ন টর্চার সেলে নির্মম নির্যাতনের পর হত্যা করে বধ্যভূমিত লাশ ফেলে দেয়। এই পরিকল্পিত বুদ্ধিজীবী হত্যা শুধু বাংলার ইতিহাসে নয়, মানব সভ্যতার ইতিহাসেও জঘন্যতম হত্যাকাণ্ড বলে বিবেচিত হতে পারে।
১৬ ডিসেম্বর দেশ হানাদারমুক্ত হওয়ার পর যখন সারা দেশ আনন্দে উদ্বেল, দেশের বিভিন্ন দিক থেকে মুক্তিযোদ্ধারা ‘জয় বাংলা’ স্লোগানে আকাশ-বাতাস প্রকম্পিত করে ফিরে আসছিলেন মুক্ত মাতৃভূমিতে; যখন আনন্দের ঢল নেমেছে বাংলাদেশে তখনই বুদ্ধিজীবীদের পরিবারের সামনে এক ভয়ংকর দৃশ্য হয়ে আসে নিখোঁজ বুদ্ধিজীবীদের লাশের সন্ধান। তাদের ক্ষত-বিক্ষত ও বিকৃত লাশ ঢাকার রায়েরবাজার ও মিরপুর বধ্যভূমিতে দেখে কান্নার রোল পড়ে যায়। অনেকের লাশ শনাক্তও করা যায়নি, খুঁজে পাওয়া যায়নি অনেকের লাশ।
১৯৭১-এর ১৪ ডিসেম্বরের এই হত্যাকাণ্ডের কথা স্মরণ করে প্রতিবছর ১৪ ডিসেম্বর বাংলাদেশে পালিত হয় শহীদ বুদ্ধিজীবী দিবস। বুদ্ধিজীবীহত্যার স্মরণে ঢাকায় বুদ্ধিজীবী স্মৃতিসৌধ স্থাপনসহ অনেক কর্মসূচি রাষ্ট্রীয়ভাবে গ্রহণ করা হয়েছে।
সব স্তরের মানুষ এই দিনটিকে স্মরণ করে শহীদদের স্মৃতির প্রতি শ্রদ্ধা নিবেদনের মধ্য দিয়ে। কিন্তু দিনটির মর্মার্থ কিংবা গুরুত্ব কত গভীর, এর প্রতিফলন সমাজে বড় একটা দেখা যায় বলে মনে হয় না। যদি সেই ভয়ংকর ক্ষতির প্রভাব অনুধাবন করার মতো বোধ থাকত, তাহলে স্বাধীনতাবিরোধী ও এদের সহযোগীদের এত আস্ফালন মুক্তিযুদ্ধে বিজয়ের ৫০ পঞ্চাশ বছর পরও দেখা যেত না।
এসবের পরেও সেই মর্মান্তিক ইতিহাসের কাছে আমাদের ফিরে যেতেই হবে। শহীদ বুদ্ধিজীবী দিবসের তাৎপর্য আর সেই হত্যাকাণ্ডের স্মৃতি ভোলার নয়।
যখন চারদিক থেকে মুক্তিযোদ্ধারা সাঁড়াশি অভিযানের মাধ্যমে পাকিস্তানি হানাদারদের কোণঠাসা করে ফেলেছিল, ঠিক তখনই সেই নারকীয় পরিকল্পনায় হাত দেয় হানাদার বাহিনী ও ওদের সহযোগী আল বদর, আল শামস আর রাজাকাররা।
৪ ডিসেম্বর থেকে ঢাকায় নতুন করে আবার কারফিউ জারি করে পাকিস্তানি বাহিনী। ১০ ডিসেম্বর থেকেই একসঙ্গে বিপুলসংখ্যক বুদ্ধিজীবীকে হত্যার প্রস্তুতি নিতে থাকে এরা। ১৪ ডিসেম্বর বুদ্ধিজীবী হত্যাপরিকল্পনার মূল অংশটি বাস্তবায়ন করা হয়।
শিক্ষাবিদ-সাহিত্যিক, সাংবাদিক-শিল্পী, চিকিৎসক-আইনজীবী ও প্রকৌশলীসহ বিভিন্ন পেশার বুদ্ধিজীবীদের পাকিস্তানি বাহিনীর দোসররা জোরপূর্বক অপহরণ করে নিয়ে যায়। ১৪ ডিসেম্বরেই প্রায় ২০০ জনের মতো বুদ্ধিজীবীকে নিজবাসা থেকে ধরে নিয়ে যাওয়া হয় চোখে কাপড় বেঁধে। মিরপুর, মোহাম্মদপুর, নাখালপাড়া ও রাজারবাগসহ অন্যান্য আরও অনেক জায়গার নির্যাতনকেন্দ্রে নিয়ে তাদের ওপর বীভৎস নির্যাতন চালিয়ে হত্যা করা হয়। পরে মিরপুর ও রায়েরবাজারসহ বিভিন্ন বধ্যভূমিতে লাশ ফেলে দেয়।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের অধ্যাপক আনোয়ার পাশা, অধ্যাপক ডক্টর মুনীর চৌধুরী, ডাক্তার মোহাম্মদ ফজলে রাব্বী, ডাক্তার আলীম চৌধুরী, সাংবাদিক সিরাজুদ্দীন হোসেন, নিজাম উদ্দিন আহমেদ, আনম গোলাম মোস্তফা, সেলিনা পারভীন কী উজ্জ্বল আর নক্ষত্রপ্রতিম কিছু দেশবরেণ্য নাম! ঘাতকেরা অকালে নিভিয়ে দেয় যাদের জীবনপ্রদীপ।
ড. জ্যোতির্ময় গুহ ঠাকুরতা, অধ্যাপক মোফাজ্জল হায়দার চৌধুরী, ড. জিসি দেব, অধ্যাপক রাশিদুল হাসান, ইতিহাস বিভাগের অধ্যাপক আবুল খায়ের; এমন শিক্ষক কি যুগে যুগে আসেন?
আব্দুল গাফফার চৌধুরী রচিত ‘আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙানো একুশে ফেব্রুয়ারী’ গানের কালজয়ী সুরকার আলতাফ মাহমুদের মতো সংগীতব্যক্তিত্ব আর কি খুঁজে পাওয়া যাবে? স্বাধীনতার বেদিমূলে অকালেই বিসর্জিত হয়েছে তাদের মূল্যবান জীবন। শুধু ঢাকা কিংবা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় নয়, পুরো বাংলাদেশের বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়-কলেজসহ অগণিত শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের এমন অনেক উজ্জ্বল নক্ষত্রের প্রাণপ্রদীপ নিভিয়ে দেয়া হয়েছে।
চট্টগ্রামের সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব বেগম মুশতারী শফি এবং ডাক্তার শফী মুক্তিযুদ্ধের দীপশিখা জ্বালিয়ে দেয়া প্রথম সারির সাংস্কৃতিক কর্মী। কী নির্মমভাবে হত্যা করা হয়েছে ডাক্তার শফীকে! বেগম মুশতারী শফী তার ‘স্বাধীনতা আমার রক্ত ঝরানো দিন’ স্মৃতিচারণমূলক গ্রন্থে ভাই ও স্বামীসহ স্বজনহারানোর মর্মস্পর্শী বিবরণ দিয়েছেন।
নতুন প্রজন্মের কজন জানে একাত্তরের সেসব বুদ্ধিজীবীর অবদানের কথা? ডক্টর মুনীর চৌধুরীর মতো অসামান্য প্রতিভাবান শিক্ষাবিদ, নাট্যকার ও অন্যান্য সাংস্কৃতিকব্যক্তিত্বের পরিচয় বর্তমান প্রজন্মকে কতটুকু জানানো হয়েছে? এমন বরেণ্য ব্যক্তিত্বদের কথা বিশেষভাবে জানানো উচিত ছিল প্রতিটি শ্রেণির শিক্ষার্থীকে। কজন তরুণ জানে অধ্যাপক মোফাজ্জল হায়দার চৌধুরী কিংবা অধ্যাপক আনোয়ার পাশার মতো শিক্ষাবিদের কৃতিত্বের কথা?
বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে প্রথম উপন্যাসটি লিখেছিলেন অবরুদ্ধ ঢাকায় বসে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের অধ্যাপক আনোয়ার পাশা। ‘রাইফেল রোটি আওরাত’- এই বিখ্যাত উপন্যাস তাকে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে লেখা উপন্যাসের পথিকৃতের মর্যাদা দিয়েছে। অধ্যাপক মুনীর চৌধুরী একজন ভাষাসংগ্রামী যিনি বায়ান্ন সালে কারাগারে বসেই রচনা করেছিলেন তার বিখ্যাত নাটক ‘কবর’।
মুক্তিযুদ্ধের মধ্য দিয়ে স্বাধীন বাংলাদেশ রাষ্ট্র অর্জিত হয়েছে কিন্তু যা হারিয়েছে তা কোনোদিন পূরণ হওয়ার নয়। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগে অনেক শিক্ষক এসেছেন অর্ধশতাব্দীতে। ভবিষ্যতেও অনেকে আসবেন, কিন্তু একজন আনোয়ার পাশা কিংবা একজন মুনীর চৌধুরী মতো শিক্ষাবিদ কি পাবে এই বিশ্ববিদ্যালয় কিংবা বাংলাদেশ? ডাক্তার আলীম চৌধুরীর মতো দেশপ্রেমিক-মেধাবী চক্ষু চিকিৎসক ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ডাক্তার শুধু নন, ছিলেন জাতিরও সম্পদ। স্বনামখ্যাত লেখক-সাংবাদিক শহীদুল্লা কায়সার ও সিরাজুদ্দীন হোসেনের মতো নক্ষত্রপ্রতিম সাংবাদিকের শূন্যতা কোনোদিন পূরণ হওয়ার নয়।
হানাদার বাহিনী ও তাদের দোসর রাজাকার-আলবদর এবং আলশামস বাহিনীর ঘাতকরা শুধু যে ১৪ ডিসেম্বর পর্যন্ত বুদ্ধিজীবীদের হত্যা করেছে তা নয়, এমনকি ১৬ ডিসেম্বর পাকিস্তানি বাহিনীর আত্মসমর্পণ এবং যুদ্ধের আনুষ্ঠানিক সমাপ্তির পরেও এরা বিভিন্ন স্থানে গোলাগুলি করেছে। বিজয় অর্জনের পরেও এদের সহযোগিতায় সশস্ত্র হয়ে এগিয়ে এসেছে মোহাম্মদপুর-মিরপুরের বিহারীরা। এমনই এক ঘটনায় ১৯৭২-এর ৩০ জানুয়ারি স্বনামধন্য চলচ্চিত্র-নির্মাতা ও সাংবাদিক-সাহিত্যিক জহির রায়হান প্রাণ হারান। তিনি তার নিখোঁজ ভাই শহীদুল্লা কায়সারের খোঁজে মিরপুর ১২ নম্বর সেকশনে গিয়েছিলেন। তার লাশটিও আর খুঁজে পাওয়া যায়নি।
শহীদ বুদ্ধিজীবীদের প্রাণ যারা কেড়ে নিয়েছিল সেই ঘাতকদের অনেকেই এখনও বেঁচে আছে। সেই খুনিদের আজও দেশে ফিরিয়ে আনা যায়নি। দেশের ভেতরেও অনেকে ছিল। মাওলানা আব্দুল মান্নান তো বহু বছর জীবিত থাকল এবং মন্ত্রীও হয়েছিল এরশাদ সরকারের। সুখ-শান্তিতে জীবন ভোগ করে ডাক্তার আলীম চৌধুরীর ঘাতক এই মান্নান স্বাভাবিকভাবে মারা গেল।
এরকম আরও অনেকের কথা বলা যায়। চৌধুরী মঈনুদ্দীনের মতো ঘাতক এখনও লন্ডনে বহাল তবিয়তে আছে। তাদের বিচারের আওতায় এনেও শাস্তি কার্যকর করা যাচ্ছে না, এটাই সবচেয়ে দুঃখের বিষয়।
বাংলা একাডেমি একটি সিরিজ গ্রন্থমালা প্রকাশ করেছিল ‘স্মৃতি ১৯৭১’ শিরোনামে। কথাসাহিত্যিক রশিদ হায়দারের সম্পাদনায় শহীদের স্বজনদের স্মৃতিচারণমূলক বেশ কয়েকটি বই বেরিয়েছে। বিশ্বাস করি, বইগুলো বাংলাদেশের প্রতিটি স্কুল-কলেজ ও উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠানে পাঠ্য করা হলে প্রজন্মের পর প্রজন্ম ধরে তরুণসমাজ জানতে পারত তাদের পূর্বপুরুষেরা কী অসীম মূল্য দিয়ে গেল এই স্বাধীনতার জন্য।
ঘাতকের নাম-পরিচয় ইতিহাসে চিরস্থায়ী হয়ে থাকত কলঙ্কের চিহ্ন হিসেবে। ১৯৭৫-এ স্বাধীনতার স্থপতি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে হত্যার মধ্য দিয়ে বাংলাদেশ যে অন্ধকারের পথে ২১ বছর ধাবিত হয়েছিল, এই দীর্ঘ সময়ে অন্তত দু-তিনটি প্রজন্ম মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস থেকে অনেক দূরে, এমনকি উল্টো পথে চলে গেছে! তাদের পথে ফিরিয়ে আনা আজ প্রায় অসম্ভব। আমরা কি আমাদের গৌরব আর ত্যাগের ইতিহাস তুলে ধরতে পারি না আগামী প্রজন্মের কাছে? এই প্রশ্ন রেখেই শহীদ বুদ্ধিজীবী দিবসে শ্রদ্ধা নিবেদন করতে চাই বাংলার শ্রেষ্ঠ সন্তানদের বিদেহী আত্মার প্রতি।
লেখক: কবি ও সিনিয়র সাংবাদিক। সাবেক পরিচালক (বার্তা), বাংলাদেশ টেলিভিশন।