বাংলাদেশ

মতামত

খেলা

বিনোদন

জীবনযাপন

তারুণ্য

কিড জোন

অন্যান্য

রেস-জেন্ডার

ফ্যাক্ট চেক

স্বাস্থ্য

আন্তর্জাতিক

শিক্ষা

অর্থ-বাণিজ্য

বিজ্ঞান-প্রযুক্তি

হারিয়ে গেল কি শহীদ বুদ্ধিজীবীদের চেতনা

  • চিররঞ্জন সরকার   
  • ১৪ ডিসেম্বর, ২০২১ ১৭:৩৭

ধর্মনিরপেক্ষতা ও অসাম্প্রদায়িকতা চর্চাকারী কোনো কোনো রাজনৈতিক দলও বুদ্ধিজীবী ও মুক্তিযোদ্ধাদের রক্তঋণ ভুলে ধর্মান্ধদের সঙ্গেই আপস করে। সমাজে মুক্তচিন্তা, প্রগতিমুখী সাংস্কৃতিক জাগরণ ও বিজ্ঞানচেতনার ধস নামে। অন্যদিকে রাজনৈতিক নেতৃত্বের পশ্চাৎপসরণ সেই পাকিস্তানি আমলে পরিত্যক্ত ধর্মীয় রাজনীতিকেই আবার শক্তপোক্ত করে তোলে। সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষের ধর্মপরিচয়কে সামনে তুলে ধরে অত্যন্ত কৌশলে ধর্মীয় রাজনীতিকেই আবার ফিরিয়ে আনা হয়েছে। আর তাই অনিবার্যভাবেই আবার ফিরে এসেছে মুক্তচিন্তা ও মুক্তবুদ্ধির মানুষের ওপর আঘাত।

স্বাধীনতার আগের তিন দশক ধরে জাতির বিবেককে জাগিয়ে তুলতে যারা লেখা-গান, চিকিৎসা, অভিনয় ও শিক্ষার মাধ্যমে দেশের মানুষকে উদ্দীপ্ত রেখেছিলেন, তাদেরই পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠী নিশ্চিহ্ন করতে চেয়েছিল। মুক্তিযুদ্ধে বিজয়ের প্রাক্কালে, পাকিস্তানি বাহিনী ও তার দোসররা নিশ্চিত পরাজয়ের আগমুহূর্তে, দেশের বরেণ্য বুদ্ধিজীবীদের ঠান্ডা মাথায় নৃশংসভাবে হত্যা করে। হত্যার পর ছিন্নভিন্ন রক্তাক্ত শবদেহগুলো বুড়িগঙ্গা নদীতীরের পরিত্যক্ত ইটের ভাটায় গাদাগাদি করে ফেলে রাখে।

১৪ ডিসেম্বর ১৯৭১-এ যে বুদ্ধিজীবীদের বেছে বেছে ঘর থেকে তুলে নিয়ে হত্যা করা হয়েছে, সেটা জানা যায় বিজয় অর্জনের পর। তিন দিন খোলা আকাশের নিচে পড়ে থাকা ক্ষতবিক্ষত অনেক লাশ শনাক্ত করা যায়নি। অনেকের লাশের কোনো সন্ধান আর মেলেনি, হয়তো খুবলে খেয়েছে শকুন কিংবা কুকুর, কিংবা ফেলে দেয়া হয়েছে কোনো গর্তে, যা আর কেউ কখনও খুঁজে পায়নি। এমন নৃশংসতার নজির ইতিহাসে বড় বেশি খুঁজে পাওয়া যায় না। এর পেছনে কাজ করেছে ফ্যাসিবাদী মনস্তত্ত্ব।

জার্মানিতে হিটলারের নাৎসি পার্টির রাজনৈতিক দর্শন ছিল কোনো একটি জাতিকে যদি অনুগত ও পদানত রাখতে হয়, তাহলে তাদের স্বাধীনচেতা, মুক্তমনা ও আদর্শনিষ্ঠ বুদ্ধিজীবীদের আগে ধ্বংস কর। হিটলারের জার্মানিতে অসংখ্য বুদ্ধিজীবীকে হত্যা করা হয়। অনেককে জেলে ঢোকানো হয়। অনেকের বই পুড়িয়ে দেয়া হয়। বিশ্ববিখ্যাত সাহিত্যিক ও দার্শনিক রোমা রলাঁ হিটলারের কারাগারেই বসে লিখেছিলেন ‘আমি ক্ষান্ত হব না’ (I will never rest)। ফ্যাসিবাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধে তিনি কখনও ক্ষান্ত হননি।

ইতালিতে ফ্যাসিস্ট মুসোলিনির রাজত্বের সময়ে অসংখ্য শিল্পী, সাহিত্যিক ও বুদ্ধিজীবীকে হত্যা করা হয়। বিখ্যাত ঔপন্যাসিক আলবার্তো মোরাভিয়া দেশ থেকে পালিয়ে গিয়ে দশ বছর পাহাড়ে জঙ্গলে ঘুরে বেড়িয়েছেন। উল্লেখ্য, পাকিস্তানে আইয়ুবের স্বৈরাচারী শাসনের সময়ে তার পৃষ্ঠপোষকতায় গঠিত রাইটার্স গিল্ডের সভায় আলবার্তো মোরাভিয়াকে আমন্ত্রণ জানানো হয়েছিল। তিনি তা প্রত্যাখ্যান করে লিখেছিলেন- ‘আমি দ্বিতীয় মুসোলিনীর দেশে আসতে চাই না।’ হিটলারের গ্যাস চেম্বারের গণহত্যার চেয়েও ভয়ংকর ছিল বর্বর পাকিস্তানি শাসক এবং তাদের দেশীয় অনুচরদের দ্বারা সংঘটিত বুদ্ধিজীবী হত্যাকাণ্ড।

কারণ, এই হত্যাকাণ্ডের মাধ্যমে শুধু কয়েকটি প্রাণ নেয়া হয়নি, পঙ্গু করে দেয়ার পরিকল্পনা ছিল পুরো একটি জাতিকে। বাংলাদেশকে মেধাশূন্য করার পাশাপাশি মুক্তবুদ্ধির চর্চা আটকাতেই একাত্তরে সাম্প্রদায়িক শক্তি বেছে বেছে বুদ্ধিজীবীদের হত্যা করেছিল। বায়ান্নর ভাষা আন্দোলন থেকে একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধের পেছনে ‘একটি উদারনৈতিক, অসাম্প্রদায়িক মানবিক গুণাবলি’র চেতনা কাজ করে। এই চেতনানির্মাণে মুখ্য ভূমিকা পালন করেছিলেন বুদ্ধিজীবীরা। রাজনীতিবিদরাও সেই চেতনাকেই সামনে এগিয়ে নেয়ার চেষ্টা করেছিলেন।

ধর্মীয় মৌলবাদের বিষবাষ্প থেকে মুক্ত হয়ে সব মানুষের জন্য একটি অসাম্প্রদায়িক স্বাধীন বাংলাদেশ গঠনে বুদ্ধিজীবীদের অবদান অপরিসীম। একাত্তরের ২৫ মার্চ ও ১৪ ডিসেম্বর দেশসেরা বুদ্ধিজীবীদের হত্যার মধ্য দিয়ে বাঙালি জাতিকে বুদ্ধিবৃত্তিকভাবে ধ্বংস করে দেয়ার যে নীলনকশা পাকিস্তানি সামরিক জান্তা করেছিল, তা অনেকাংশেই সফল হয়েছিল।

স্বাধীনতার পর রাজনৈতিক নেতৃত্ব যেমন প্রত্যাশা পূরণ করতে পারেননি, পরবর্তীকালের বুদ্ধিজীবীরাও জাতির মানস গঠনে কার্যকর ভূমিকা পালন করতে পারেননি। অল্প কিছু ব্যতিক্রম ছাড়া মুক্তস্বর, মুক্তকণ্ঠ তেমনভাবে আর দেখা যায়নি।

১৯৭৫ সালে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে সপরিবারে হত্যার মধ্য দিয়ে সামরিক বাহিনীর ছত্রছায়ায় দেশের রাজনীতিতে আবার পাকিস্তানি প্রেতাত্মারা ফিরে আসে। সমাজ ও রাজনীতিতে আবারও ফিরে আসে ধর্মীয় ভেদবুদ্ধি, অসহিষ্ণু ধর্মান্ধ প্রতিক্রিয়াশীলতা।

ধর্মনিরপেক্ষতা ও অসাম্প্রদায়িকতা চর্চাকারী কোনো কোনো রাজনৈতিক দলও বুদ্ধিজীবী ও মুক্তিযোদ্ধাদের রক্তঋণ ভুলে ধর্মান্ধদের সঙ্গেই আপস করে। সমাজে মুক্তচিন্তা, প্রগতিমুখী সাংস্কৃতিক জাগরণ ও বিজ্ঞানচেতনার ধস নামে। অন্যদিকে রাজনৈতিক নেতৃত্বের পশ্চাৎপসরণ সেই পাকিস্তানি আমলে পরিত্যক্ত ধর্মীয় রাজনীতিকেই আবার শক্তপোক্ত করে তোলে। সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষের ধর্মপরিচয়কে সামনে তুলে ধরে অত্যন্ত কৌশলে ধর্মীয় রাজনীতিকেই আবার ফিরিয়ে আনা হয়েছে। আর তাই অনিবার্যভাবেই আবার ফিরে এসেছে মুক্তচিন্তা ও মুক্তবুদ্ধির মানুষের ওপর আঘাত।

একাত্তরে যেভাবে বুদ্ধিজীবীদের হত্যা করে দেশকে মেধা ও মননে পিছিয়ে দেয়া হয়েছিল, স্বাধীনতার প্রায় পাঁচ দশকে এসেও দেশে মুক্তবুদ্ধির মানুষের ওপর হামলা থেমে থাকেনি। মৌলবাদী রাজনীতির সমর্থকরা গত সাত-আট বছরে ‘ধর্মবিরোধিতা’র অভিযোগ এনে দেশের অনেক প্রগতিশীল তরুণকে চাপাতি দিয়ে কুপিয়ে, গলা কেটে হত্যা করেছে।

ধারাবাহিক এসব হত্যাকাণ্ডের পর অনেকে প্রাণভয়ে বিভিন্ন দেশে আশ্রয় নিয়েছেন। দেশের মধ্যে যারা আছেন, তাদের মধ্যেও অনেকে ভয়ে ভয়ে থাকেন। এমনভাবে গা-বাঁচিয়ে চলেন যেন, মৌলবাদীদের কোপানলে পড়তে না হয়। এই মৌলবাদী গোষ্ঠী এখন এতটাই শক্তিশালী যে তারা প্রকাশ্যে জাতির পিতার ভাস্কর্য গুঁড়িয়ে দেয়ার হুমকি দেয়। দেশের মানুষের বড় একটা অংশও এখন এই মৌলবাদী ভাবধারার সমর্থক বনে গেছে।

কী বিপুল দ্রুততায় বাংলাদেশের সমাজ মুক্তচিন্তা থেকে ধর্মমুখী চিন্তার কানাগলিতে নিমজ্জিত হয়ে পড়ল, তা ভাবলে আশ্চর্য হতে হয়। গত কয়েক শতকের প্রচেষ্টায় যা কিছু অর্জন ঘটেছিল, কোনো এক অদৃশ্য শক্তির কাছে তা যেন হাতছাড়া হতে বসেছে। ইতোমধ্যে সমাজে ছাত্র-শিক্ষক-বুদ্ধিজীবী গোষ্ঠীর মধ্য থেকে সরাসরি একটি প্রত্যাখ্যানের স্বর উঠে এসেছে। মুক্তচিন্তার আত্মপ্রকাশের প্রত্যাখ্যান। সংগত কারণেই সবাই ভীত বোধ করছেন। প্রকাশ্যে মত জানাতে অস্বীকার করছেন।

ফেইসবুক-টুইটার ইত্যাদি নব-গণমাধ্যমের দ্বারা তারা যে ধর্মনিরপেক্ষতা ও যুক্তিবাদের সংস্কৃতি প্রসারের কথা ভেবেছিলেন, তা থেকে নিজেদের সরিয়ে নিচ্ছেন। নিজেকে ও পরিবারকে সুরক্ষিত রাখতে নিজেকেই যেন লুকিয়ে ফেলছেন। তাদের অপরাধ, তারা ধর্মীয় গোঁড়ামিতে বিশ্বাস করেন না। যুক্তি-বুদ্ধি-গ্রাসকারী অন্ধ মতবাদের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াতে চান। ঘোর অপরাধ, সন্দেহ কী! চতুর্দশ শতকে তো এমন অপরাধের জন্য অগ্নিদগ্ধ করা হতো। একবিংশ শতকেও হচ্ছে। মাঝে কিছু আলো এসেছিল, তা এখন আবার নিভছে! প্রশাসন দায়িত্ব পালনে ব্যর্থ। অমনোযোগী।

সরকারের কর্তাব্যক্তিরা যা বলছেন, তাতে মুক্তচিন্তা নয়, একমুখী ধর্মাশ্রয়ী চিন্তা এমনকি হিংস্রতাও সমর্থন পাচ্ছে। অপরাধীদের ধরা, বিচার, শাস্তি প্রদান কিছুই যথাযথভাবে ঘটছে না। ক্ষমতাসীনদের এই ‘নিষ্ক্রিয়তা’র পেছনে যে লাগাতার বহুমুখী ও বহুবিধ, আন্তর্জাতিক ও অভ্যন্তরীণ, বিরুদ্ধ-দলসম্ভূত এবং নিজদল-অন্তর্গত চাপ আছে, তা ঠিক। কিন্তু সেই চাপের ঊর্ধ্বে উঠে অসাম্প্রদায়িক প্রগতিমুখী অবস্থানকে ঊর্ধ্বে তুলে ধরার দায়টি পালনের প্রয়োজন কোথাও দেখা যাচ্ছে না। মতাদর্শগত লড়াই থেকে সরে এসে প্রচলিত ধর্মবিশ্বাসের স্রোতে শামিল হওয়ার কারণে অন্ধকারের শক্তি সবল হচ্ছে।

এখন আমাদের জীবনের লক্ষ্য হচ্ছে ধর্মের জন্য বাঁচা, ধর্মপালনের জন্য বাঁচা! এর বাইরে গেলেই গলাকাটা লাশ! কী বাংলাদেশ নির্মাণ করলাম আমরা? দেশের শহীদ বুদ্ধিজীবীদের চেতনা কোথায় হারিয়ে গেল?

লেখক: সাবেক ছাত্রনেতা, প্রবন্ধ লেখক

এ বিভাগের আরো খবর