বাংলাদেশ

মতামত

খেলা

বিনোদন

জীবনযাপন

তারুণ্য

কিড জোন

অন্যান্য

রেস-জেন্ডার

ফ্যাক্ট চেক

স্বাস্থ্য

আন্তর্জাতিক

শিক্ষা

অর্থ-বাণিজ্য

বিজ্ঞান-প্রযুক্তি

শিক্ষার্থীদের দাবি মানলে কী ক্ষতি?

  • দীপংকর গৌতম   
  • ২৬ নভেম্বর, ২০২১ ১৪:৪৪

১৯৬৯ সালের জানুয়ারিতে সর্বদলীয় ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের হাত ধরে আসে ১১ দফা দাবি। পশ্চিম পাকিস্তানি স্বৈরাচারী শাসকদের বিরুদ্ধে শিক্ষার্থীদের ঘোষিত এ ১১ দফা দাবির একটি ছিল শিক্ষার্থীদের জন্য অর্ধেক ভাড়া রাখা। সেটা কীভাবে বদলে গেল আমরা জানি না। সেটা ছাড়াও সাম্প্রতিক সবচেয়ে বড় আন্দোলনগুলোর একটি শিক্ষার্থীদের আন্দোলন ২০১৮ সালের নিরাপদ সড়ক আন্দোলনের দাবি। তখন ঢাকা অবরোধ করা শিক্ষার্থীদের ৯ দফা দাবির ভেতরে অন্যতম ছিল, ‘শুধু ঢাকা নয়, সারা দেশের শিক্ষার্থীদের জন্য হাফ ভাড়ার ব্যবস্থা করতে হবে।’ এটার কোনো সুরাহা হয়নি।

রাস্তার উপরের স্টলে দাঁড়িয়ে পত্রিকা পড়া আমার পুরোনো অভ্যেস। এটা আমি যেখানেই যাই সেখানেই করে থাকি। গত বুধবার পত্রিকা দেখতে দেখতে এটা পত্রিকার ওপর আমার চোখ থেমে গেল। পত্রিকার ওপরের ছবিতে দেখা গেল একদল তরুণের রণপ্রস্তুতি। আমি মোহাম্মদপুর, ঢাকা কলেজের ওদিকে মঙ্গলবার দেখলাম ছাত্ররা রাস্তা আটকে যেভাবে আন্দোলন করে ওভাবেই আন্দোলন করছে।

আমি কজন ছাত্রের সঙ্গে কথাও বললাম। তারা বলেছে সব সময় সব কালে ছাত্রদের জন্য সব গণপরিবহনে অর্ধেক ভাড়া নেয়। কিন্তু এবার ভাড়া বাড়ানোর পরে ছাত্রছাত্রীদের সঙ্গে বাসের হেলপার কন্ডাকটরদের দুর্ব্যবহার গাড়িতে দেখেছি। বিভিন্ন সময় কথাও বলেছি। বেগতিক হয়ে ছাত্ররা আন্দোলনে নেমেছে আর তাদের ঠেকাতে সরকার দলের ছাত্র সংগঠন আন্দোলনরত ছাত্রদের সঙ্গে কথা না বলে তাদের পেটাতে মহড়া দিচ্ছে। খবরটি পড়ে খুব মনঃপীড়ায় আছি। কোনো ছাত্র আন্দোলনে নামলে আমি আমার ফেলে আসা জীবনটাকে ফিরে পাই। এরশাদবিরোধী আন্দোলন।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শামসুন্নাহার হল আন্দোলন, একাত্তরের ঘাতক-দালালবিরোধী আন্দোলন- কোনোটাই ভুলবার নয়। কিন্তু এবারে ছাত্রদের অপরাধ কী? অপরাধ তারা গণপরিবহনে অর্ধেক ভাড়ার দাবিতে রাস্তায় নেমেছে। গণপরিবহনে ছাত্রছাত্রীদের হাফ ভাড়ার বিষয়টি নতুন নয়। দেশে কোনো সময়ই ছিল না যে, ছাত্রছাত্রীরা বাসে-লঞ্চে হাফ ভাড়ায় চলেনি। অনেক সময় ছাত্রছাত্রীদের হাতে বইখাতা থাকলেও কন্ডাকটর ভাড়াই চাইত না। কিন্তু সম্প্রতি তেলের মূল্যবৃদ্ধির কারণে বাসের ভাড়া বাড়ানো হয়েছে।

ছাত্রছাত্রীদের হাফ ভাড়ার বিষয়টিও তখন বাদ দেয়া হয়েছে। এর আগেও বাস মালিকদের এই পাঁয়তারা লক্ষ করা গেছে। ইতিপূর্বেও বিভিন্ন বাসে দেখা গেছে হাফ ভাড়া নেয়া হয় না বা হাফ ভাড়া চালু হয়নি লেখা। হাফ বা অর্ধেক ভাড়া নিয়ে আন্দোলনটা বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ারও আগের। মানে ৫২ বছরের পুরোনো।

১৯৬৯ সালের জানুয়ারিতে সর্বদলীয় ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের হাত ধরে আসে ১১ দফা দাবি। পশ্চিম পাকিস্তানি স্বৈরাচারী শাসকদের বিরুদ্ধে শিক্ষার্থীদের ঘোষিত এ ১১ দফা দাবির একটি ছিল শিক্ষার্থীদের জন্য অর্ধেক ভাড়া রাখা। সেটা কীভাবে বদলে গেল আমরা জানি না। সেটা ছাড়াও সাম্প্রতিক সবচেয়ে বড় আন্দোলনগুলোর একটি শিক্ষার্থীদের আন্দোলন ২০১৮ সালের নিরাপদ সড়ক আন্দোলনের দাবি। তখন ঢাকা অবরোধ করা শিক্ষার্থীদের ৯ দফা দাবির ভেতরে অন্যতম ছিল, ‘শুধু ঢাকা নয়, সারা দেশের শিক্ষার্থীদের জন্য হাফ ভাড়ার ব্যবস্থা করতে হবে।’ এটার কোনো সুরাহা হয়নি।

বর্ধিত ভাড়া চালুর কয়েক দিন ধরে শিক্ষার্থীরা দাবি জানাচ্ছে তাদের জন্য অর্ধেক ভাড়া চালুর। তার মানে ছাত্রছাত্রীদের হাফ ভাড়ার যে ৫২ বছরের রীতি সেটা ভাঙতে চাচ্ছে পরিবহন মালিকরা। যে কারণে গত রোববারও ঢাকার সায়েন্সল্যাব, ফার্মগেটে এ দাবিতে বাস ভাঙচুর হয়েছে। তবু নীরব সরকার।

শিক্ষার্থীদের আন্দোলন চলছে। গাড়ি ভাঙচুরের ঘটনাও ঘটেছে। ছাত্রদের এ আন্দোলন থামাতে যেখানে সরকারের একটি ঘোষণাই যথেষ্ট সেখানে আন্দোলন এত সময় নেয়, সেটা ভাবাই যায় না। দেশের গণপরিবহনে হাফ পাস বা অর্ধেক ভাড়াসহ পাঁচ দফা দাবি মেনে নিতে সরকারকে ৪৮ ঘণ্টা সময় বেঁধে দিয়েছে আন্দোলনরত শিক্ষার্থীরা। তাদের দাবি বাস্তবায়ন না হলে বৃহস্পতিবার থেকে কঠোর আন্দোলনের কর্মসূচি দেয়া হবে বলেও জানিয়েছে ছাত্ররা। কিন্তু এ আন্দোলনে কী হবে তা কিন্তু আমরা আঁচ করতে পেয়েছি ইতোমধ্যে। এবারও হেলমেট বাহিনী না হোক অন্য কোনো বাহিনী নামবে।

গত মঙ্গলবার দুপুরে রাজধানীর ধানমণ্ডির নীলক্ষেত ও সায়েন্সল্যাবের সড়ক কর্মসূচি চলাকালে ৫০-৬০ তরুণ লাঠিসোঁটা নিয়ে আন্দোলনরত শিক্ষার্থীদের ওপর হামলা চালিয়েছিল। কিছুক্ষণ ধাওয়া-পাল্টাধাওয়া চলার পর আন্দোলনরত শিক্ষার্থীরা রাস্তা থেকে সরে যায়। সেখানে মিছিল থেকে আইডিয়াল কলেজের এক ছাত্রকে তুলে নেয়ার অভিযোগ মিলেছে। এর প্রায় ৫ ঘণ্টা পর ওই ছাত্র ছাড়া পায়। প্রশ্ন উঠেছে সাধারণ ছাত্রদের ওপর হামলাকারীরা কারা? শিক্ষার্থীদের দাবি, হামলাকারীরা ছাত্রলীগের নেতাকর্মী।

ছাত্রলীগের নেতাকর্মী কেন এ আন্দোলনে হামলা করবে? ছাত্রলীগের বিরুদ্ধে অভিযোগ কত তা সরকারও জানে। কিন্তু তারপরও ছাত্রদের আন্দোলনের দাবি না মেনে ছাত্রলীগকে কেন নামানো হলো এটা প্রশ্ন আসে। এই আন্দোলন ইতোমধ্যে সারা দেশে ছড়িয়ে পড়ছে। যে পদ্ধতিতে আন্দোলন থামানোর চেষ্টা করা হচ্ছে তাতে আন্দোলন থামবে না, হয়ত আরও বড় হবে। গত কয়েকদিন ধরে চলা শিক্ষার্থীদের এ আন্দোলন ইতোমধ্যে ঢাকার বাইরেও ছড়িয়ে পড়ছে। গণপরিবহনে সাধারণ শিক্ষার্থীদের হাফ ভাড়াসহ ৫ দফা দাবিতে বন্দরনগরী চট্টগ্রাম ও সাভারে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়েও সমাবেশ ও মানববন্ধন হয়েছে।

ছাত্রদের বক্তব্যের বরাত দিয়ে গণমাধ্যমে প্রকাশ হয়েছে যে, ছাত্ররা বলেছে- আমরা সড়ক ছেড়ে দিয়েছি, সরকার ও বাস মালিকদের ৪৮ ঘণ্টা সময় দিয়েছি, তারা বসে সিদ্ধান্ত নিয়ে এই সময়ের মধ্যে আমাদের দাবি বাস্তবায়ন করবে। এটা হলো আন্দোলনরত ছাত্রছাত্রীদের কথা।

যখন শামসুন্নাহার হল আন্দোলন হয়েছে, সেসময় বিএনপির ক্যাডাররা ক্যাডাররা যার পর নাই বিরক্ত করেছে আন্দোলনকারীদের। আমাকে একদিন এক ক্যাডার একটা পিস্তল দেখিয়ে রাজু ভাস্কর্য থেকে নিয়ে যেতে চেয়েছিল। আমাদের আন্দোলনরত ছাত্রদের সহমর্মিতা জানানো শিক্ষকদের লাঞ্ছিত করেছে। তাতে আন্দোলন থামেনি। আন্দোলন এভাবে থামানো যায় না। কিন্তু আন্দোলন থামাতে যে পদক্ষেপ নেয়া হয়েছে, মানে পত্রিকায় যে পদক্ষেপের বর্ণনা শুনেছি তা রীতিমতো ভীতিকর।

আন্দোলনরত ছাত্রদের পেটানো হলে আন্দোলন থামে না। চলমান আন্দোলন থেকে ছাত্রছাত্রীদের নিবৃত্ত করতে সরকারে উচিত তাদের দাবি মেনে নেয়া। কারণ আন্দোলনরত এই ছাত্রছাত্রীরা আমাদেরই সন্তান, ভাইবোন এটা ভুললে চলবে না। এখানে শক্তি প্রদর্শন মোটেও সমাধান আনবে না।

সরকারকে ভুললে চলবে না ২০১৮ সালে নিরাপদ সড়ক আন্দোলনের মধ্য দিয়ে একটা প্রজন্মের আন্দোলনকে সরকার সঠিকভাবে নিবৃত্ত করতে পারেনি। যার মধ্য দিয়ে ওই আন্দেলনকারীদের হেলমেট বাহিনীর ওপর ভালো ধারণা হয়নি। বরং ওই সময় বিরোধীরা অপপ্রচার করেছিল অনেকেই তা বিশ্বাস করেছিল। বিশ্বাসের সে সুযোগও তাদের করে দেয়া হয়েছিল। এবারেও কি সেই পথ ধরা হবে? সেটা তাহলে আরেকটি ভুল হবে।

সরকারে মধ্যে এমন সব ব্যক্তিত্ব আছেন যারা ১৯৬৯ সালের গণঅভ্যুত্থানে নেতৃত্ব দিয়েছেন। আজ তারা কথা বলছেন না কেন? ছাত্রছাত্রী কতজন প্রতিদিন গণপরিবহনে ওঠে? তাদের থেকে হাফ ভাড়া নিলে এমন কী ক্ষতি? সরকার হাফ ভাড়া নিয়ে মালিক সমিতির সঙ্গে বসে একটা ঘোষণা দিলে এ সমস্যা আর থাকবে বলে মনে হয় না। কিন্তু ইতোমধ্যে বিভিন্ন সড়ক আটকে দেয়ায় পথচারীদের দুর্ভোগ ছিল অবর্ণনীয়।

কদিন আগে বাস মালিক- শ্রমিক নেতাদের কারণে মানুষের দুর্ভোগের অন্ত ছিল না। মানুষের পক্ষে দাঁড়াতে তখন কোনো লাঠিয়ালকে দেখা যায়নি, তাহলে এখন ছাত্রদের পেটানো হবে কেন? কেউ আন্দোলন করতে পারবে না? তার দাবির কথা বলতে পারবে না? সরকার মালিকদের কথায় ভাড়া বাড়াতে বাধ্য হলেন। আর ছাত্রদের কথা শুনবেন না এটা হয় না। কী এমন বিশাল দাবি এটা! মেনে নিলে কী হবে? ক্ষমতায় গিয়ে আন্দোলন সংগ্রামকে এভাবে ভুলতে নেই। দমানোর চেষ্টা করতে হয় না। মেনে নেয়া যুক্তিযুক্ত।

লেখক: গবেষক, প্রাবন্ধিক-সাংবাদিক।

এ বিভাগের আরো খবর