বাংলাদেশ

মতামত

খেলা

বিনোদন

জীবনযাপন

তারুণ্য

কিড জোন

অন্যান্য

রেস-জেন্ডার

ফ্যাক্ট চেক

স্বাস্থ্য

আন্তর্জাতিক

শিক্ষা

অর্থ-বাণিজ্য

বিজ্ঞান-প্রযুক্তি

ধর্ষণ-প্রমাণে বিচারব্যবস্থার আমূল সংস্কার জরুরি

  • চিররঞ্জন সরকার   
  • ১৪ নভেম্বর, ২০২১ ১৪:১৭

ধর্ষণের শিকার মেয়েরা মামলা করেও কোনো প্রতিকার পাবেন না? ধর্ষকরাই আদালত থেকে ‘নির্দোষ’ সার্টিফিকেট বাগিয়ে এনে ঘাড় ফুলিয়ে ঘুরে বেড়াবে? এ ব্যাপারে আমাদের কারোরই কিছু করা নেই? বিষয়টি নিয়ে সব শুভবুদ্ধিসম্পন্ন মানুষকে ভাবতে হবে। একটা সমাজ ধর্ষকদের জন্য অভয়ারণ্য হতে পারে না।

দেশে ধর্ষণের ঘটনা অহরহ ঘটলেও সব ঘটনা আদালত পর্যন্ত গড়ায় না। সামাজিক-সাংস্কৃতিক ও অন্যান্য কারণে অনেকেই ঘটনা চেপে যান। মুখ বুজে সব সহ্য করেন, মেনে নেন। যেসব ধর্ষণের ঘটনা আদালত পর্যন্ত গড়ায় সেগুলোও তেমন পরিণতি পায় না। বছরের পর বছর ধরে অনেক ধর্ষণ মামলা চলে। তথ্য-প্রমাণের অভাবে আসামিরা খালাসও পেয়ে যায় অথবা এজাহার থেকে অনেকের নাম বাদ দেয়া হয়।

ধর্ষণের মামলা তদন্তের ক্ষেত্রে একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হচ্ছে ফরেনসিক এভিডেন্স, যেটি আসে ভিকটিমের মেডিক্যাল টেস্টের মাধ্যমে। সেজন্য ঘটনার পর অতিদ্রুত অভিযোগ দায়ের এবং মেডিক্যাল টেস্টের পরামর্শ দেয়া হয় ভিকটিমদের। কিন্তু এক্ষেত্রেও দেখা যায়, নির্দিষ্ট সময়ের পর ডিএনএ ও মেডিক্যাল টেস্ট করার কারণে তেমন কোনো আলামত পাওয়া যায় না।

আদালত সাজা দেয় সাক্ষ্য-প্রমাণের উপর ভিত্তি করে। তবে আইনের দৃষ্টিতে পারিপার্শ্বিক অবস্থা এবং প্রমাণ বলে একটি বিষয় রয়েছে। সেটিকেও সংশ্লিষ্টরা গুরুত্ব দেন না। অভিযোগ দায়ের, তদন্ত, সাক্ষ্য-প্রমাণ সংগ্রহ সব কিছুতে এক ধরনের অদক্ষতা ও দায়সারা ভাব থাকে। ফলে অনেক ক্ষেত্রেই অপরাধ প্রমাণ করা যায় না। অভিযুক্তরা বেকসুর খালাস পেয়ে যায়।

ধর্ষণের ঘটনা তদন্তে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যদের সক্ষমতা নিয়ে প্রশ্ন রয়েছে। ধর্ষণের মামলায় শাস্তি নিশ্চিত করতে হলে প্রথমে সঠিকভাবে তদন্তকাজ শেষ করতে হবে। যথাসময়ে তদন্তকাজ করার পর রাষ্ট্রপক্ষের আইনজীবীকে তা আদালতে সঠিকভাবে উপস্থাপন এবং সাক্ষ্যগ্রহণ নিশ্চিত করতে হবে।

পারিপার্শ্বিক অবস্থা এবং প্রমাণকে অভ্রান্তভাবে প্রতিষ্ঠিত করতে হবে। কিন্তু সেই কাজটি কখনই হয় না। আর এতে করে ধর্ষণের শিকার নারীরা বিচার পান না। অভিযুক্তরা বেকসুর খালাস পেয়ে যান। যেমন খালাস পেয়েছেন বনানীর রেইনট্রি হোটেলে চার বছর আগে দুই তরুণীকে ধর্ষণের আলোচিত মামলার রায়ে আপন জুয়েলার্সের মালিকের ছেলে সাফাত আহমেদসহ পাঁচ আসামি।

আসলে আদালতে ধর্ষণ মামলা প্রমাণ করা অত্যন্ত কঠিন ব্যাপার। কারণ ধর্ষণের শিকার মেয়েটি প্রমাণ হাতে নিয়ে ঘোরেন না। অনেকেই মুষড়ে পড়েন। অনেকে মানসিকভাবে বিপর্যস্ত হয়ে যান। সীমাহীন শারীরিক ও মানসিক যন্ত্রণা শেষে ধর্ষণ মামলার প্রতিকার চেয়ে অনেক নারী মামলা করেন।

নানা প্রক্রিয়া শেষে আদালত রায় ঘোষণা করেন। অনেক সময় পর্যবেক্ষণ দেন। তদন্তকারী কর্মকর্তাকে ভর্ৎসনা করেন। কিন্তু তাতে ধর্ষণের মতো মারাত্মক অপরাধের প্রতিকার হয় না। অভিযুক্ত ব্যক্তিদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি হয় না। তথ্যপ্রমাণের অভাব দেখিয়ে অভিযুক্ত ধর্ষণকারীদের খালাস দেয়া হয়। আমাদের দেশে ধর্ষণ ও নারী নির্যাতন মামলাগুলোর ক্ষেত্রে এটা একটা বড় সীমাবদ্ধতা।

ধর্ষণের ঘটনার বিচার না হওয়ায় দেশের আইন ও বিচার ব্যবস্থার ওপর সাধারণ মানুষের ক্ষোভ ও অনাস্থা বাড়ছে। কোনো নারী বা শিশু ধর্ষণের শিকার হয় তখন সেই ভুক্তভোগী এবং তার নিকটজনেরা প্রথম চেষ্টা করেন তাকে বাঁচানোর জন্য, তারপর চায় ধর্ষকের বিচার। ধর্ষণের মামলা করা হয় মূলত ধর্ষককে উপযুক্ত শাস্তি দিতে, যাতে করে আর কেউ ধর্ষণের শিকার না হন। কিন্তু বাস্তবতা হচ্ছে ধর্ষণকারীদের বিচার বা শাস্তির আওতায় আনা যাচ্ছে না।

অথচ আমাদের দেশে ধর্ষণ সম্পর্কিত যে আইন রয়েছে এবং ধর্ষণের যে সাজা রয়েছে তাতে কোনো ধর্ষকের রেহাই পাওয়ার সুযোগ তো নেই-ই বরং শাস্তির ভয়ে কারো এমন অপকর্মের কথা ভাবতে চাওয়ারও কথা নয়। কিন্তু এত কিছুর পরেও কেন তার উল্টোটাই হচ্ছে౼ এই প্রশ্নের জবাব খুঁজে পাওয়া দরকার।

বাংলাদেশের সামাজিক প্রেক্ষাপটে ধর্ষণের পর একটি মেয়ের মানসিক অবস্থা স্বাভাবিক হতে যে সময় লাগে এবং তার পারিপার্শ্বিক অবস্থা যতটা এলোমেলো হয়ে যায় সেই সময়টুকু ব্যবহার করেই মূলত একজন ধর্ষক আইনের ফাঁক-ফোকর দিয়ে বেঁচে যায়। কারণ, বাংলাদেশের সামাজিক চিত্রের দিকে খেয়াল করলে দেখা যাবে, ভিক্টিম ধর্ষণের পর মামলা করতে এবং মেডিক্যাল টেস্ট অবধি যে সময় ব্যয় হয় তাতে করে ভিক্টিমের শরীরে ধর্ষকের রেখে যাওয়া প্রায় সব নমুনাই নষ্ট হয়ে যায়। আর এই নমুনা একবার নষ্ট হয়ে গেলে তখন ধর্ষণ প্রমাণ কঠিন হয়ে হয়ে যায়।

ধর্ষক প্রমাণের আরেকটি উপায় থাকে সাক্ষী। দুঃখজনক হলেও এটাই সত্যি আমাদের দেশের বেশিরভাগ ধর্ষণগুলো এমন জায়গায় হয়ে থাকে যা সাধারণত নির্জন এবং জনমানবহীন হয়ে থাকে। তাছাড়া এসব ক্ষেত্রে তেমন কোনো মানুষ চাক্ষুষ সাক্ষীও হয় না। আর যেসব ক্ষেত্রে হাতেগোনা কিছু সাক্ষী পাওয়া যায় তাও বিবাদী পক্ষের আইনজীবীর কৌঁসুলি জেরার কারণে দুর্বল হয়ে পড়ে।

আমরা সবাই ধর্ষকের বিচার চাই। কিন্তু ধর্ষককে চিনব কীভাবে, সে যে ধর্ষক, তা প্রমাণ করব কীভাবে? এসব বিষয় নিয়ে তেমন ভাবি না। বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে ধর্ষকের সঠিক বিচার না হওয়ার পেছনে আইনের যে দুর্বলতাটি রয়েছে তার কারণ ধর্ষণ সাধারণত একটি ফৌজদারি অপরাধ। আর ফৌজদারি আইনের দর্শন হলো: এই আইনের অধীনে কোনো মামলা হলে তা সাক্ষ্যপ্রমাণ দিয়ে শতভাগ প্রমাণ করতে হয়৷ কোনো সন্দেহ রেখে কাউকে শাস্তি দেয়া যায় না। আসামিরা সব সময়ই ‘বেনিফিট অফ ডাউট’-এর সুযোগ পেয়ে থাকেন। আর বাংলাদেশে ধর্ষণের ক্ষেত্রে ‘শতভাগ’ পূরণ শর্ত কতটা কঠিন তা আমাদের জানা।

তাহলে কি ধর্ষণ মামলার অভিযুক্তরা প্রমাণের অভাবে বেকসুর খালাস পেয়েই যাবে? ধর্ষণের শিকার মেয়েরা মামলা করেও কোনো প্রতিকার পাবেন না? ধর্ষকরাই আদালত থেকে ‘নির্দোষ’ সার্টিফিকেট বাগিয়ে এনে ঘাড় ফুলিয়ে ঘুরে বেড়াবে? এ ব্যাপারে আমাদের কারোরই কিছু করা নেই? বিষয়টি নিয়ে সব শুভবুদ্ধিসম্পন্ন মানুষকে ভাবতে হবে। একটা সমাজ ধর্ষকদের জন্য অভয়ারণ্য হতে পারে না।

একটি কঠোর আইন থাকার পরেও কেবল প্রক্রিয়াগত অদক্ষতা ও প্রয়োগের অভাবে নিষ্ফল হতে পারে না। এ জন্য ত্রুটি ও দুর্বলতাগুলো খুঁজে বের করে সেগুলো দূর করার ব্যাপারে মনোনিবেশ করতে হবে। ধর্ষণ মামলার সুরাহা ও ধর্ষকদের শাস্তি নিশ্চিত করতে সবার আগে দরকার ‘নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইন, ২০০০’-এর যথার্থ প্রয়োগের জন্য পর্যাপ্ত ট্রাইবুন্যাল গঠন, পাশাপাশি সরকারিভাবে বিশেষ ও চৌকস টিম গঠন, যার মাধ্যমে যথাযথ তদন্ত ও তথ্যপ্রমাণের ভিত্তিতে ধর্ষক নির্ধারণ সহজ হবে। কোনো ধর্ষক যেন প্রমাণ ও সাক্ষীর অভাবে পার পেয়ে না যায়౼ সেটা নিশ্চিত করতে হবে।

প্রয়োজনে বিচারব্যবস্থার আমূল পরিবর্তন করতে হবে। প্রতিদিন প্রতি মুহূর্তে ধর্ষণের মতো পাশবিক ঘটনার দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি নিশ্চিত করতে হবে, যা সমাজের কাছে উদাহরণ হয়ে থাকবে। ধর্ষকের কাছে সেই শাস্তি, তা মৃত্যুদণ্ড কিংবা যাবজ্জীবন౼যাই হোক না কেন, যেন দুঃস্বপ্নের মতো হয়ে থাকে।

যে ধর্ষণের ঘটনার পর গোটা দেশ মুখর হয়েছিল, যে প্রতিবাদের আগুন এখনও ধিকি-ধিকি জ্বলছে সেই ধর্ষণের অভিযোগে অভিযুক্ত ব্যক্তিদের খালাস পাবার ঘটনা একটা বড় আঘাত। এমন ঘটনা যেকোনো মূল্যে বন্ধ করতে হবে।

লেখক: সাবেক ছাত্রনেতা, প্রবন্ধকার।

এ বিভাগের আরো খবর