বাংলাদেশ

মতামত

খেলা

বিনোদন

জীবনযাপন

তারুণ্য

কিড জোন

অন্যান্য

রেস-জেন্ডার

ফ্যাক্ট চেক

স্বাস্থ্য

আন্তর্জাতিক

শিক্ষা

অর্থ-বাণিজ্য

বিজ্ঞান-প্রযুক্তি

জনগণের কেন এই ‘ভাড়াদণ্ড’

  • এরশাদুল আলম প্রিন্স   
  • ১৩ নভেম্বর, ২০২১ ১৭:৪৬

আন্তর্জাতিক বাজারে তেলের দাম বাড়লে এদেশে তেলের দাম সমন্বয় করা হয় কিন্তু দাম কমলে তখন আর কমানো হয় না। বাসের ভাড়াও একবার বাড়লে তা আর কমতে দেখা যায়নি। এদেশে তেলের দামের অজুহাতে ভাড়া বাড়ানো হয়। কিন্তু তেলের দাম যদিও দুই-একবার কমানো হয়, বর্ধিত বাস ভাড়া কখনও কমেনি। তখন হয়ত বলা হয়- বাসগুলো সিএনজিতে চলে। এভাবেই দেশে মানুষের জীবনযাত্রা ক্রমে ব্যয়বহুল হয়ে যাচ্ছে।

৩ নভেম্বর রাতে জ্বালানি মন্ত্রণালয় ডিজেল ও কেরোসিনের দাম ২৩ শতাংশ অর্থাৎ লিটারে ১৫ টাকা বাড়িয়ে ৮০ টাকা করে। জ্বালানি তেলের দাম বাড়লে বাজারে এর প্রভাব পড়বে এটাই স্বাভাবিক। সব পরিবহন মালিক যেন এই সুযোগেরই অপেক্ষায় ছিল। কারো সঙ্গে কোনো আলোচনা নয়- আগে ধর্মঘট, পরে কথা। টানা তিন দিন গণপরিবহন বন্ধ। বাস মালিক কর্তৃপক্ষ ২৩ শতাংশ বর্ধিত জ্বালানির বিপরীতে বাসভাড়া বাড়িয়ে দেয় ২৭ থেকে ২৮ শতাংশ। আর নিরুপায় জনগণকে সবকিছু দেখে-শুনে মেনে নিতে হলো।

হঠাৎ কেন জ্বালানি তেলের দাম বৃদ্ধি? সরকারের পক্ষ থেকে এর দুটি কারণ জানানো হয়- আন্তর্জাতিক বাজারে জ্বালানি তেলের দাম বৃদ্ধি ও প্রতিবেশী দেশে তেলের পাচাররোধ। এ বিষয়ে জ্বালানি বিশেষজ্ঞরা প্রশ্ন তুলেছেন, বিস্তর কথা বলেছেন। কিন্তু সরকারের তরফ থেকে এর বেশি কিছু জানা যায়নি, পাওয়া যায়নি কোনো সদুত্তর।

গত ৭ বছরে বাংলাদেশ পেট্রোলিয়াম করপোরেশন (বিপিসি) জ্বালানি তেল আমদানি ও রপ্তানি করে ৪৩ হাজার কোটির বেশি টাকা লাভ করে। সরকার যখন আন্তর্জাতিক বাজারের সঙ্গে তেলের দাম সমন্বয়ের কথা বলে- তখন প্রথম প্রশ্ন জাগে, সাত বছরেও বাড়তি দামের সমন্বয় হয়নি কেন? কেন বাড়তি দামে তেল বিক্রি করা হলো।

দ্বিতীয়ত, আগের বাড়তি লাভের টাকা এখন সমন্বয় করলেই তো ল্যাঠা চুকে যায়। সরকারের দাবি- দাম কমিয়ে সমন্বয় করলে (দাম না বাড়ালে) তেল পাচার হওয়ার সম্ভাবনা থাকে। তাহলে আগের ৭ বছর সরকার যখন আন্তর্জাতিক বাজারের চেয়ে চড়া দামে দেশে তেল বিক্রি করল তখন প্রতিবেশী দেশ থেকে তো এদেশে তেল পাচার হয়ে আসার কথা শোনা যায়নি।

তেলের তেলেসমাতি নিয়ে এর আগেও বহু আলোচনা-সমালোচনা হয়েছে। বছর পাঁচেক আগে অযৌক্তিকভাবে তেলের দাম বাড়ানো হলে সমালোচনার মুখে সরকার তখন ডিজেল ও কেরোসিনের দাম লিটারে মাত্র ৩ টাকা কমিয়েছিল। কিন্তু জনগণ এবার সমালোচনারও সুযোগ পায়নি। তিন দিনের মধ্যে জ্বালানি তেল ও বাস ভাড়া বাড়ানো হয়েছে। জনগণ কিছু বুঝে ওঠার আগেই তাদের ওপর ভাড়াদণ্ড কার্যকর!

সরকারের দাবি তেলের জন্য বর্তমানে মাসিক লোকসান ২২৯ কোটি টাকা। কিন্তু আগের সাত বছরে যে লাভ হয়েছে ৪৩ হাজার কোটি টাকা, এ নিয়ে কোনো রা নেই। হিসাব করলে দেখায় যা, আগের লাভের টাকা দিয়ে বর্তমান লোকসান অন্তত আরও একযুগ ধরে সমন্বয় করা যাবে। কাজেই সমন্বয় কেবল দাম বাড়ানোর ক্ষেত্রে করা হয়, দাম কমানোর ক্ষেত্রে সমন্বয়ের কথা ভাবা হয় না।

রাষ্ট্রীয় তহবিল বাড়ানোর একটি বড় খাত হচ্ছে জ্বালানি তেল, গ্যাস ও বিদ্যুতের দাম বাড়ানো। করোনার সময় আন্তর্জাতিক বাজারে তেলের দাম অনেক কমে আসে। তখনও তেলের দাম কমানো হয়নি। বোঝা যায়, তেল এখন একটি লাভজনক পণ্য হয়ে দাঁড়িয়েছে। এর প্রমাণ হচ্ছে, বিপিসির তহবিল থেকে সরকারও অর্থ নিয়ে থাকে। তা নিক। কিন্তু এখন জনগণের উপর বাড়তি দাম না চাপিয়ে আগের লাভের টাকা থেকে কিছু টাকা ভর্তুকি দেয়ার কথাও ভাবা যেত।

জ্বালানি তেল, বিশেষ করে ডিজেলের দাম বৃদ্ধি মানে বাস মালিক সমিতির পোয়াবারো। মধ্যরাতে জ্বালানি তেলের দাম বাড়ানোর পরদিন থেকেই বাস মালিক সমিতি ভাড়া বাড়ানোর দাবিতে ধর্মঘট শুরু করে। মানুষের দুর্দশাকে পুঁজি করে, সরকারকে জিম্মি করে দাবি আদায়ের কৌশল কোনোভাবেই মেনে নেয়া যায় না। সরকারের এদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া উচিত। তাদের কোনো দাবি-দাওয়া থাকলে তা নিয়ে আলোচনা-পর্যালোচনা হতে পারে। সে দাবির যৌক্তিকতা নিরূপণের চূড়ান্ত এখতিয়ার সরকারের হাতেই থাকতে হবে। মালিক সমিতির কাছে নয়।

এমনিতে দেশের গণপরিবহন বেহাল। আন্তজেলা বাসগুলোর সেবার মান যেমন তেমন, ঢাকায় যেসব বাস চলাচল করে সেসব দেখে মনে সহসাই প্রশ্ন জাগে- একটি দেশের রাজধানীতে এ ধরনের বাস কীভাবে চলে! পৃথিবীর কোনো দেশেই এমন মানহীন বাস চলাচল করে বলে মনে হয় না। একদিকে নিজেদেরকে এশিয়ান টাইগার বলে দাবি করা হবে, অপরদিকে রাজধানীতে জনগণ বাসে বাদুড়ঝোলা হয়ে চলাচল করবে; এ কেমন দ্বিচারিতা?

সময়ের সঙ্গে সঙ্গে দেশের সড়ক ও যোগাযোগ ব্যবস্থার উন্নয়ন হয়েছে। কিন্তু পরিবহন ব্যবস্থা আগের অবস্থাতেই পড়ে আছে। এই খাতে বিশেষ কোনো ব্যবস্থাপনা চোখে পড়ে না। পৃথিবীর বিভিন্ন দেশ সময়ের সঙ্গে সঙ্গে তাদের গণপরিবহন ব্যবস্থা সহজ, আধুনিক ও জনবান্ধব করেছে। কিন্তু ‍এখানে এর তেমন কিছুই হয়নি। একটি দেশের রাজধানীতে এখনও কোনো সমন্বিত গণপরিবহন ব্যবস্থাপনা নেই! ঢাকার গণপরিবহন খাতে এক চরম নৈরাজ্য চলছে। এ নিয়ে অনেক লেখালেখি, আলাপ-আলোচনা হয়েছে। কিন্তু অবস্থার তেমন কোনো পরিবর্তন হয়নি।

জ্বালানি তেলের দাম বাড়ানোর অজুহাতে বাস ভাড়া বাড়ানোও সে অব্যবস্থাপনারই অংশ। ঢাকার অধিকাংশ বাস চলাচল করে সিএনজিতে। অথচ জ্বালানি তেলের দাম বাড়ানোর অজুহাতে রাতারাতি সব বাসের ভাড়া বাড়িয়ে দেয়া হয়। মালিকপক্ষের দাবি- মাত্র দুই-তিন শতাংশ বাস নাকি সিএনজি-চালিত। বাস্তব চিত্র ঠিক তার বিপরীত। বড়জোর দুই/তিন শতাংশ বাস ডিজেল-চালিত হতে পারে। এ অনিয়ম দেখার কেউ নেই।

এদেশে যদি কোনো পণ্য বা সেবার দাম একবার বাড়ানো হয়, তা আর কখনও কমে না। আন্তর্জাতিক বাজারে তেলের দাম বাড়লে এদেশে তেলের দাম সমন্বয় করা হয় কিন্তু দাম কমলে তখন আর কমানো হয় না। বাসের ভাড়াও একবার বাড়লে তা আর কমতে দেখা যায়নি।

এদেশে তেলের দামের অজুহাতে ভাড়া বাড়ানো হয়। কিন্তু তেলের দাম যদিও দুই-একবার কমানো হয়, বর্ধিত বাস ভাড়া কখনও কমেনি। তখন হয়ত বলা হয়- বাসগুলো সিএনজিতে চলে। এভাবেই দেশে মানুষের জীবনযাত্রা ক্রমে ব্যয়বহুল হয়ে যাচ্ছে। আর আমরা নিজের অজান্তেই বড়লোক হয়ে যাচ্ছি।

একথা ঠিক যে, এভাবে নিজের অজান্তে কিছু লোক ‘বড়লোক’ হচ্ছে ঠিকই। হয়ত সরকার ও রাষ্ট্রের অর্থনীতিও বড়লোক হয়ে যাচ্ছে। কিন্তু দেশের নিম্নবিত্ত খেটে খাওয়া মানুষগুলো যে দিনকে দিন আরও প্রান্তিক হয়ে পড়ছে তা থেকে যাচ্ছে সবার অজানা।

যখন জ্বালানি তেলের দাম ২৩ শতাংশ বাড়ার অজুহাতে বাস ভাড়া ৪০ শতাংশ বাড়ানোর দাবি ওঠে ও শেষমেশ ২৭ শতাংশে ফয়সালা হয় তখন বুঝতে হবে জনস্বার্থ এখানে গৌণ, মুনাফাই আসল। ২৩ শতাংশের বিপরীতে দূরপাল্লার বাস ভাড়া ২৬ দশমিক ৭৬ শতাংশ, ঢাকা ও চট্টগ্রামে চলাচলরত বাসভাড়া ২৮ শতাংশ ও লঞ্চভাড়া বেড়েছে ৩৫ দশমিক ২৯ শতাংশ।

কোথাও কোথাও দূরপাল্লার বাস ভাড়া দ্বিগুণ করা হয়েছে এমন অভিযোগও শোনা যায়। এটা জনগণের সঙ্গে প্রতারণা করে যতটুকু সম্ভব ভাড়া বাড়িয়ে নেয়ার ফন্দি। একে তো সিএনজি-চালিত বাস, এর উপর তেলের দাম বাড়ার অজুহাতে সে বাস ভাড়ার অযৌক্তিক বৃদ্ধি জনস্বার্থকে বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখানোর শামিল। ডিজেলের বর্ধিত দামের সঙ্গে বর্ধিত ভাড়া সংগতিপূর্ণ নয়। এটি ডিজেলের দাম বৃদ্ধির অজুহাতে মুনাফা লুটপাট।

ঢাকার গণপরিবহনের আরেক প্রতারণার নাম সিটিং সার্ভিস। সিটিং সার্ভিস মানে একই রুটে অন্যান্য বাসের চেয়ে বর্ধিত ভাড়া আদায়। কিন্তু ঢাকার এমন কোনো সিটিং সার্ভিস বাস কি আছে যেগুলো দাঁড়িয়ে যাত্রী নেয় না? অন্যান্য বাস যদি ৩০ যাত্রী দাঁড়িয়ে নেয়, সিটিং সার্ভিস হয়ত নেয় ১৫ জন। তাও যাত্রীরা অনেক হইচই, প্রতিবাদ করে বলেই এ বাসগুলো কিছু কম যাত্রী দাঁড়িয়ে নিতে বাধ্য হয়।

ঢাকাবাসীর কাছে এই সিটিং সার্ভিস বাসগুলো ‘চিটিং সার্ভিস’ নামেই বেশি পরিচিত। কিন্তু তাতেও তাদের চিটিংবাজি কিছু কমেনি। এমন অবস্থায় ঢাকা মেট্রোপলিটন এলাকায় সিটিং সার্ভিস এবং গেইটলক সার্ভিস থাকবে না বলে জানিয়েছেন বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন মালিক সমিতির মহাসচিব। এ যেন আরেক প্রহসন। যেখানে প্রকৃত অর্থে কোনো সিটিং সার্ভিস ছিলই না, সেখানে তা বন্ধ করার ঘোষণা প্রহসন ছাড়া আর কী হতে পারে!

কোনোকিছুর দাম বাড়লে ব্যবসায়ীরা সহজেই ক্রেতা বা প্রান্তিক ভোক্তাদের উপর চাপিয়ে দিতে পারে। ক্রেতা, ভোক্তা বা যাত্রীসাধারণকে সবকিছুই মেনে নিতে হয়। এছাড়া তাদের আর কিছু্ই করার নেই।

লেখক: আইনজীবী ও কলাম লেখক।

এ বিভাগের আরো খবর