বাংলাদেশ

মতামত

খেলা

বিনোদন

জীবনযাপন

তারুণ্য

কিড জোন

অন্যান্য

রেস-জেন্ডার

ফ্যাক্ট চেক

স্বাস্থ্য

আন্তর্জাতিক

শিক্ষা

অর্থ-বাণিজ্য

বিজ্ঞান-প্রযুক্তি

কলঙ্কিত জেলহত্যা দিবস

  • ড. কাজী এরতেজা হাসান   
  • ৩ নভেম্বর, ২০২১ ১৮:৫৬

বঙ্গবন্ধু ও জাতীয় চার নেতার হত্যাকাণ্ড ছিল একই ষড়যন্ত্রের ধারাবাহিকতা। বিশ্বাসঘাতক খুনিদের পরিকল্পনা, উদ্দেশ্য জাতির সামনে পরিষ্কার। হত্যাকারী এবং তাদের দোসর চেয়েছিল পাকিস্তান ভাঙার প্রতিশোধ নিতে। রক্তক্ষয়ী মুক্তিযুদ্ধ ও সীমাহীন ত্যাগের মাধ্যমে স্বাধীনতা অর্জনকারী দেশটিকে হত্যা ও ষড়যন্ত্রের আবর্তে নিক্ষেপ করতে। উদ্দেশ্য ছিল পুনর্গঠন ও গণতান্ত্রিকতার পথ থেকে সদ্য স্বাধীন দেশটিকে বিচ্যুত করা এবং বাংলাদেশের মধ্যে থেকে একটি মিনি পাকিস্তান সৃষ্টি করা।

১৯৭৫-এর ১৫ আগস্ট জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে সপরিবারে হত্যার পর ৩ নভেম্বর মধ্যরাতে ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারের নির্জন প্রকোষ্ঠে জাতীয় চার নেতা- বাংলাদেশের প্রথম অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি সৈয়দ নজরুল ইসলাম, প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দিন আহমেদ, মন্ত্রিসভার সদস্য ক্যাপ্টেন এম মনসুর আলী এবং এএইচএম কামারুজ্জামানকে নৃশংসভাবে হত্যা করা হয়।

স্বাধীনতা ও মুক্তিযুদ্ধের শত্রুরা সেদিন দেশমাতৃকার সেরা সন্তান, জাতীয় চার নেতাকে শুধু গুলি চালিয়েই ক্ষান্ত হয়নি, কাপুরুষের মতো গুলিবিদ্ধ দেহকে বেয়নেট দিয়ে খুঁচিয়ে ক্ষতবিক্ষত করে মৃত্যু নিশ্চিত করে। প্রগতি-সমৃদ্ধির অগ্রগতি থেকে বাঙালিকে পিছিয়ে দেয়া হয়। ইতিহাসের এই নিষ্ঠুর হত্যাযজ্ঞের ঘটনায় শুধু বাংলাদেশের মানুষই নয়, স্তম্ভিত হয়েছিল বিশ্ব।

স্বাধীন বাংলাদেশের যে কটি দিন চিরকাল কালো দিন হিসেবে চিহ্নিত হয়ে থাকবে, তার একটি ৩ নভেম্বর। যে কটি ঘটনা বাংলাদেশকে কাঙ্ক্ষিত অর্জনের পথে বাধা তৈরি করে, এর মধ্যে অন্যতম ঘটনাটি ঘটে ১৯৭৫-এর এই দিনে। কারাগারের নিরাপদ আশ্রয়ে থাকা অবস্থায় এমন জঘন্য, নৃশংস ও বর্বরোচিত হত্যাকাণ্ড পৃথিবীর ইতিহাসে বিরল।

বঙ্গবন্ধুকে হত্যার পর তার ঘনিষ্ঠ এই চার সহকর্মীকে গ্রেপ্তার করে কারাগারে পাঠানো হয়। পরবর্তীকালে অস্থিতিশীল রাজনৈতিক পরিস্থিতিতে ক্যু পাল্টা ক্যুর রক্তাক্ত অধ্যায়ে মানবতার শত্রু ও বঙ্গবন্ধুর হন্তারক ওই একই পরাজিত শক্তির দোসর, বিপথগামী কিছু সেনাসদস্য নিজেদের আখের গোছাতে এই হত্যাকাণ্ড ঘটায়। সেই থেকে প্রতি বছরের মতো এ দিনটি জেলহত্যা দিবস হিসেবে পালিত হয়ে আসছে।

বঙ্গবন্ধু ও জাতীয় চার নেতার হত্যাকাণ্ড ছিল একই ষড়যন্ত্রের ধারাবাহিকতা। বিশ্বাসঘাতক খুনিদের পরিকল্পনা, উদ্দেশ্য জাতির সামনে পরিষ্কার। হত্যাকারী এবং তাদের দোসর চেয়েছিল পাকিস্তান ভাঙার প্রতিশোধ নিতে। রক্তক্ষয়ী মুক্তিযুদ্ধ ও সীমাহীন ত্যাগের মাধ্যমে স্বাধীনতা অর্জনকারী দেশটিকে হত্যা ও ষড়যন্ত্রের আবর্তে নিক্ষেপ করতে। উদ্দেশ্য ছিল পুনর্গঠন ও গণতান্ত্রিকতার পথ থেকে সদ্য স্বাধীন দেশটিকে বিচ্যুত করা এবং বাংলাদেশের মধ্যে থেকে একটি মিনি পাকিস্তান সৃষ্টি করা।

ষড়যন্ত্র এখানেই শেষ হয়নি। ৭৫-এর পর থেকে বছরের পর বছর বঙ্গবন্ধুর নাম-নিশানা মুছে ফেলার চেষ্টা চলে। বঙ্গবন্ধু ও জেল হত্যাকাণ্ডের নেপথ্যের কুশীলব হিসেবে জেনারেল জিয়াউর রহমানের প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ জড়িত থাকার প্রমাণ আত্মস্বীকৃত ঘাতকদের মুখ থেকেই বেরিয়ে আসে।

এই হত্যাকাণ্ডের পর ওই সময়ই লালবাগ থানায় একটি মামলা করা হয়। কিন্তু বঙ্গবন্ধুকে সপরিবারে হত্যার পর দীর্ঘ ২১ বছর এ হত্যাকাণ্ডের তদন্ত ও বিচারপ্রক্রিয়া বন্ধ থাকে। ১৯৯৬ সালে ক্ষমতায় এসে আওয়ামী লীগ সরকার জেলহত্যা মামলার প্রক্রিয়া পুনরুজ্জীবিত করে।

এর পর দীর্ঘ আট বছরেরও বেশি সময় বিচারকাজ চলার পর বিগত চারদলীয় জোট সরকারের আমলে ২০০৪-এর ২০ অক্টোবর ঢাকা মহানগর দায়রা জজ আদালত মামলাটির রায় ঘোষণা করেন। রায়ে ২০ আসামির মধ্যে ১৫ সাবেক সেনা কর্মকর্তার শাস্তি এবং অপর ৫ জনকে খালাস দেয়া হয়। সাজাপ্রাপ্তদের মধ্যে পলাতক তিন আসামির মৃত্যুদণ্ড এবং অপর ১২ জনের যাবজ্জীবন কারাদণ্ড হয়।

মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্তরা হলো- দফাদার মারফত আলী শাহ, রিসালদার মোসলেম উদ্দিন ওরফে হিরন খান ও এলডি দফাদার মো. আবুল হাসেম মৃধা। যাদের যাবজ্জীবন কারাদণ্ড দেয়া হয় তারা হলো- কর্নেল (অব.) সৈয়দ ফারুক রহমান, কর্নেল (অব.) সৈয়দ শাহরিয়ার রশীদ, মেজর (অব.) বজলুল হুদা, লে. কর্নেল খন্দকার আবদুর রশীদ (বরখাস্ত), লে. কর্নেল (অব.) শরিফুল হক ডালিম, লে. কর্নেল (অব.) এমএইচএমবি নূর চৌধুরী, লে. কর্নেল (অব.) একেএম মহিউদ্দিন আহমেদ, লে. কর্নেল (অব.) এএম রাশেদ চৌধুরী, মেজর (অব্যাহতিপ্রাপ্ত) আহম্মদ শরিফুল হোসেন, ক্যাপ্টেন (অব.) আবদুল মাজেদ, ক্যাপ্টেন (অব্যাহতিপ্রাপ্ত) মো. কিসমত হোসেন এবং ক্যাপ্টেন (অব.) নাজমুল হোসেন আনসার।

খালাসপ্রাপ্তরা হলো- বিএনপি নেতা মরহুম কেএম ওবায়দুর রহমান, জাতীয় পার্টি নেতা শাহ মোয়াজ্জেম হোসেন, সাবেক মন্ত্রী প্রয়াত তাহেরউদ্দিন ঠাকুর, নুরুল ইসলাম মঞ্জুর এবং মেজর (অব.) খায়রুজ্জামান।

২০০৮-এর ২৮ আগস্ট হাইকোর্টের রায়ে কেবল রিসালদার মোসলেম উদ্দিনের মৃত্যুদণ্ড বহাল রেখে মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত দফাদার মারফত আলী শাহ ও এলডি দফাদার মো. আবুল হাসেম মৃধা এবং যাবজ্জীবন কারাদণ্ডপ্রাপ্ত অপর চার আসামি লে. কর্নেল (বরখাস্ত) সৈয়দ ফারুক রহমান, লে. কর্নেল (অব.) শাহরিয়ার রশীদ খান, মেজর (অব.) বজলুল হুদা ও লে. কর্নেল (অব.) একেএম মহিউদ্দিন আহমেদকে মামলা থেকে খালাস দেয়া হয়। নিম্ন আদালতের রায়ের বিরুদ্ধে যাবজ্জীবনপ্রাপ্ত ওই চার আসামির চারটি আপিল ও রাষ্ট্রপক্ষের ডেথ রেফারেন্স নিষ্পত্তি করে বিচারপতি নজরুল ইসলাম চৌধুরী ও বিচারপতি আতাউর রহমান খানের সমন্বয়ে গঠিত হাইকোর্টের একটি বেঞ্চ এ রায় দেন।

জেল হত্যাকাণ্ডের দীর্ঘ সময় পর এর বিচারের রায় হলেও জাতীয় চার নেতার পরিবারের সদস্যসহ বিভিন্ন মহল থেকে ওই সময়ই রায়টিকে ‘রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিত’ ও ‘প্রহসনের রায়’ বলে আখ্যায়িত করা হয়। পাশাপাশি রায়টি প্রত্যাখ্যানও করা হয়। তাদের অভিযোগ, জেলহত্যা ষড়যন্ত্রের দায়ে কাউকে শাস্তি দেয়া হয়নি। জাতির ইতিহাসের নৃশংসতম এই হত্যাকাণ্ডের পুনঃতদন্ত ও পুনর্বিচার দাবি করে তারা।

অবশ্য জেলহত্যা মামলায় খালাস পেলেও লে. কর্নেল (বরখাস্ত) সৈয়দ ফারুক রহমান, লে. কর্নেল (অব.) শাহরিয়ার রশীদ খান, মেজর (অব.) বজলুল হুদা ও লে. কর্নেল (অব.) একেএম মহিউদ্দিন আহমেদ- এই চার জন বঙ্গবন্ধুহত্যা মামলায় মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত হওয়ায় ২০১০-এর ২৭ জানুয়ারি এদের ফাঁসির রায় কার্যকর হয়। অপরদিকে হাইকোর্টের রায়ে পলাতক অপর আট যাবজ্জীবন কারাদণ্ডপ্রাপ্ত আসামি সম্পর্কে কোনো মতামত না দেয়ায় তাদের দণ্ড বহাল আছে বলে আইনজীবীরা ব্যাখ্যা দেন।

২০০৮-এর ২৯ ডিসেম্বরের নির্বাচনে আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন মহাজোট ক্ষমতাসীন হওয়ায় জেল হত্যাকাণ্ডের পুনর্বিচারের সুযোগ আসে। ২০১১-এর ১১ জানুয়ারি আপিল বিভাগ সরকার পক্ষের আপিল আবেদন মঞ্জুর করে আদেশ দেন। আদেশে নিম্ন আদালতে মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত, তবে হাইকোর্টের রায়ে খালাস পাওয়া দফাদার মারফত আলী শাহ ও এলডি (দফাদার) আবুল হাসেম মৃধাকে অবিলম্বে আত্মসমর্পণের নির্দেশ দেয়া হয়। আত্মসমর্পণ না করলে তাদের গ্রেপ্তার করতে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকে নির্দেশ দেয়া হয়।

২০১৩-এর ৩০ এপ্রিল আপিল বিভাগের চূড়ান্ত সংক্ষিপ্ত রায়ে ২০০৮-এর হাইকোর্টের রায় বাতিল করে ২০০৪-এর নিম্ন আদালতের রায় বহাল রাখা হয়। অর্থাৎ, পলাতক তিন আসামি রিসালদার মোসলেম উদ্দিন ওরফে হিরন খান, দফাদার মারফত আলী শাহ ও এলডি দফাদার মো. আবুল হাসেম মৃধাকে মৃত্যুদণ্ড এবং অন্য ১২ জনের যাবজ্জীবন কারাদণ্ড দেয়া হয়।

৭৫-এর এ নির্মম ঘটনার ৪৭ বছর পর এসেও বিচার পাওয়া যায়নি। আইনমন্ত্রী আনিসুল হক বলেছেন, বিচারকার্য দ্রুত শেষ করা হবে। এটা সবার প্রত্যাশাও। যেমনভাবে বঙ্গবন্ধুহত্যা এবং যুদ্ধাপরাধীদের বিচার হয়েছে, সেভাবেই জাতীয় চার নেতা-হত্যারও বিচার হবে।

লেখক: সদস্য, কেন্দ্রীয় শিল্প-বাণিজ্য উপকমিটি, বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ। পরিচালক, এফবিসিসিআই।

এ বিভাগের আরো খবর