বাংলাদেশ

মতামত

খেলা

বিনোদন

জীবনযাপন

তারুণ্য

কিড জোন

অন্যান্য

রেস-জেন্ডার

ফ্যাক্ট চেক

স্বাস্থ্য

আন্তর্জাতিক

শিক্ষা

অর্থ-বাণিজ্য

বিজ্ঞান-প্রযুক্তি

৩ নভেম্বরের নাটের গুরু

  • আহমেদ রিয়াজ   
  • ৩ নভেম্বর, ২০২১ ১৮:৪৩

বাংলাদেশের ইতিহাসে চরম ঘৃণার পাত্র হিসেবে টিকে আছে খন্দকার মোশতাক। স্বাধীন দেশে নব্য মীরজাফর হিসেবে তার ঠিকানা হয়েছে ইতিহাসের আস্তাকুঁড়েয়। বঙ্গবন্ধুহত্যা থেকে শুরু করে জাতীয় চার নেতা হত্যার মধ্য দিয়ে লোকাল বা দেশি হিটলার হিসেবে নিজের স্বরূপ চিনিয়েছে মোশতাক।

১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে সপরিবারে নৃশংস হত্যার পর, দেশের রাজনৈতিক পরিস্থিতি ঘোলাটে হতে শুরু করে। তারচেয়েও ঘোলাটে পরিস্থিতি তৈরি হয় ঢাকা ক্যান্টনমেন্টে। বঙ্গভবনের ঘাড়ে চেপে বসা বঙ্গবন্ধুর খুনি চক্র সশস্ত্র বাহিনীর ভেতরেই ছড়ি ঘোরাতে লাগল।

যেখানে বঙ্গবন্ধু হত্যাকেই মেনে নিতে পারছিলেন না, সেখানে পদমর্যাদায় অনেক নিচে থাকা এসব খুনিদের এই ছড়ি ঘোরানোকে সহজ ও স্বাভাবিকভাবে নিতে পারেননি অনেক সামরিক কর্তা। বঙ্গভবনকে কেন্দ্র করে শুরু হয়ে গেল ক্ষমতার দ্বন্দ্ব, অভ্যুত্থান, পাল্টা অভ্যুত্থান। এসব সামাল দেয়ার ক্ষমতা ও ব্যক্তিত্ব কুচক্রী খন্দকার মোশতাকের ছিল না মোটেই। তাকে তখন পরিচালনা করত বঙ্গবন্ধুর খুনি ফারুক-রশীদ গং।

বঙ্গবন্ধুর তুমুল ব্যক্তিত্বের সামনে বিশাল ক্ষমতাধরও যেখানে মিইয়ে যেত, সেখানে সামান্য দুই মেজরের কথায় (কান ধরেও) উঠতে বসতে হচ্ছিল প্রেসিডেন্ট পদাধিকারী খন্দকার মোশতাককে। কিন্তু এ নিয়ে খন্দকার মোশতাকের কোনো বিকার ছিল না। যতই ক্ষমতাধর হোক না কেন, ব্যক্তিত্বহীন মানুষের এই বিকার থাকে না। খন্দকার মোশতাকের চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য ছিল পাকিস্তানের ভ্রষ্ট রাজনীতিক জুলফিকার আলী ভুট্টোর মতো। ভুট্টোর মতো মোনাফেক, ছলনাকারী দ্বিতীয়টা নেই। সৈয়দ মুজতবা আলী তো তার ‘বাংলাদেশ’ নামের বইতে ভুট্টোকে সোজা সাপ্টা বলেছেন ‘হিটলার দ্য থার্ড’।

ভুট্টো যেমন উপস্থিত অভিনয় করে সত্যকে মিথ্যা বানিয়ে ফেলত, তেমনি পারদর্শী খন্দকার মোশতাক। যেন ভাজা মাছটিও উল্টে খেতে জানে না। ভাবটা এমন- আমি কিছুই জানি না। বন্দুকের নলের ভয় দেখিয়ে আমাকে ধরে বেঁধে এনে প্রেসিডেন্টের চেয়ারে বসিয়ে দিয়েছে- আমি কী করব, জান বাঁচানো তো ফরজ!

অথচ ইতিহাস জানে, খন্দকার মোশতাকের সঙ্গে খুনি চক্রের যোগাযোগ অনেক আগে থেকেই ছিল। ইতিহাস খুঁড়ে আরও জানা যায় মুক্তিযুদ্ধের সময় আমেরিকার সঙ্গে আঁতাত করে খন্দকার মোশতাক মুক্তির জন্য লড়াইরত বাংলাদেশের বিরুদ্ধেও ষড়যন্ত্র পাকিয়েছিল।

রাষ্ট্রপতির চেয়ারের দখল খন্দকার মোশতাকের ছিল ঠিকই, কিন্তু চেয়ারে পা তুলে শান্তিতে বসতে পারছিল না। সবসময় তার মনে নানা সন্দেহ, নানা কূটচিন্তা।

সাংবাদিক অ্যান্থনি মাসকারেনহাসের বিখ্যাত একটি বই ‘বাংলাদেশ: অ্যা লিগ্যাসি অব ব্লাড’। সেখানে অ্যান্থনি উল্লেখ করেছেন-

“১৫ আগস্টের অভ্যুত্থানের সঙ্গে জড়িত পরিকল্পনা, কুমন্ত্রণা, হত্যা ইত্যাদি সকল কাজের জন্য মেজরদের এবং তাদের সংশ্লিষ্ট লোকজনকে ‘বেকসুর মাফ’ করে দেয়া হলো। যারা এই নতুন দেশটির প্রতিষ্ঠাতা, একটা জাতির পিতা আর তার পরিবার ও আত্মীয়স্বজন ২১ জনকে নৃশংসভাবে হত্যা করে, তাদের জন্যে ক্ষমা ঘোষণা আসলেই উদ্দেশ্যপ্রণোদিত।

খন্দকার মোশতাক যেভাবে শেখ মুজিবের বুকের তাজা রক্তের ওপর দিয়ে খালি পায়ে হেঁটে এসে গদিতে বসে। সেই অবস্থায় অবশ্য কেউ প্রত্যাশা করেনি যে, সে শেখ মুজিবের হত্যাকারীদের বিচার করবে। কিন্তু আনুষ্ঠানিকভাবে তাদেরকে ক্ষমা করে দেয়া স্পষ্টতই একটা আলাদা ব্যাপার।...

হত্যাকারীদের ক্ষমা ঘোষণা, ফারুক আর রশীদকে প্রমোশন দিয়ে লে. কর্নেলে উন্নীতকরণ এবং সর্বোপরি ৩ অক্টোবর এক বেতার ভাষণে তাদেরকে ‘সেনাবাহিনীর সূর্যসন্তান’ বলে প্রশংসার যে বন্যা বইয়ে দেয় মোশতাক তাতে সেনাবাহিনীর মনোবল আর শৃঙ্খলায় ভয়ংকর প্রভাব ফেলে। পরিষ্কার প্রতিষ্ঠিত হয়ে যায় যে, বিদ্রোহ, ধ্বংস, হত্যা সেনাবাহিনীর অফিসার আর জোয়ানদের জন্যে অনুমোদনযোগ্য। কেবল ধরা না পড়লেই হলো! ...

সেই সময়ের মধ্যেই মোশতাক রাজনৈতিক ক্ষেত্রে তার সম্ভাব্য সকল প্রতিদ্বন্দ্বীকে সরিয়ে দেয়ার ধূর্ত ও ভয়ংকর পদক্ষেপ গ্রহণ করে। সে হিসেব কষে দেখল যে সেনাবাহিনীকে বাদ দিলে আসল হুমকি আসছে তারই পুরোনো পার্টি আওয়ামী লীগের পক্ষ থেকে। আওয়ামী লীগ নেতৃবৃন্দ বিরোধীদলীয় শক্তি হিসেবে গড়ে উঠতে পারে।

কাজেই যখন মোশতাক বুঝতে পারল দেশ শেখ মুজিবের হত্যায় নিশ্চুপ, তখনই আর বিলম্ব না করে মুজিবনগর সরকারের চারজন প্রখ্যাত ব্যক্তিত্বকে পাকড়াও করার বন্দোবস্ত পাকা করে ফেলল। ওই চারজন হচ্ছেন- তাজউদ্দিন আহমদ, সৈয়দ নজরুল ইসলাম, মনসুর আলী এবং কামারুজ্জামান। এখানে আবারও মোশতাক তার স্বভাবজাত ছল-চাতুরির আশ্রয় নিল যাতে করে জনগণের আক্রোশ তার উপর এসে না পড়ে।

মনসুর আলী তখনও প্রধানমন্ত্রী। তাকে বঙ্গভবনে ডেকে পাঠানো হলো। খন্দকার মোশতাক সেখানে তাকে উচ্ছ্বাসভরে গ্রহণ করে। অথচ টেলিভিশনে যখন এই উচ্ছ্বাসভরা আন্তরিকতার ছবি জনগণকে দেখানো হচ্ছে, তখন বেচারা মনসুর আলীকে ঠেলে নিয়ে সংগোপনে জেলে ঢুকিয়ে দেয়া হচ্ছে। সৈয়দ নজরুল ইসলাম, কামারুজ্জামান আর তাজউদ্দিন আহমদের ভাগ্যেও তাই ঘটল।

এই চারনেতা জেলে থেকে এক ‘আকস্মিক ষড়যন্ত্রের’ শিকার হলেন। এই ষড়যন্ত্রের ফলেই মাত্র দুমাস পরে এই জেলখানার ভিতরেই তাদেরকে পৈশাচিকভাবে খুন করা হয়।”

১৯৭৫ সালের ২ নভেম্বর দিবাগত রাত। ঘড়ির কাঁটার হিসাবে সেটা ৩ নভেম্বর। রাত তখন তিনটা পেরিয়ে গেছে। ওই সময় ঢাকা সেনানিবাসের স্টেশন কমান্ডার লে. কর্নেল এমএ হামিদ চলমান ঘটনাগুলো প্রত্যক্ষ করার সুযোগ পেয়েছিলেন। ‘তিনটি সেনা অভ্যুত্থান ও কিছু না বলা কথা’ গ্রন্থে তিনি লিখেছেন-

রিসালদার মোসলেমউদ্দিনের নেতৃত্বে সেনাদলটি গাড়ি নিয়ে সেন্ট্রাল জেলে পৌঁছে যায়। তারা ভিতরে ঢুকে অন্তরীণ আওয়ামী লীগ নেতাদের বাইরে নিয়ে যেতে চায়। জেলার আবদুল আওয়াল সশস্ত্র সৈন্য দেখে ভিতরে ঢোকার অনুমতি দিতে অস্বীকার করেন। এ নিয়ে ঘাতক দলের সঙ্গে অনেকক্ষণ কথাকাটাকাটি হলো। তারা জোর করে ঢুকে যেতে চাচ্ছিল। কারাগারে পাগলাঘণ্টা বেজে উঠল। অবশেষে ডিআইজিকে বাসা থেকে ডেকে আনা হলো।

তাকে মোসলেম উদ্দিন ও তার লোকজন জানাল যে, ফারুক ও রশীদ তাদের পাঠিয়েছে। তারা তাজউদ্দিন, সৈয়দ নজরুল ইসলাম, মনসুর আলী ও কামারুজ্জামানকে তাদের হাতে তুলে দিতে বলল। ডিআইজ প্রিজন বিনয়ের সঙ্গে বুঝিয়ে বলেন, এটা জেল আইনের পরিপন্থী। চার নেতাকে তাদের হাতে এভাবে তিনি তুলে দিতে পারেন না। প্রায় আধঘণ্টা কথাকাটাকাটির পর মোসলেম উদ্দিন তাঁকে বঙ্গভবনে মেজর রশীদকে ফোন করতে বলে। টেলিফোনে রশীদ ডিআইজি প্রিজনকে নির্দেশ দেয় যেন মোসলেম উদ্দিনের কথামতো কাজ করে।

এ নির্দেশের পরও ডিআইজি প্রিজন তাঁর সিদ্ধান্তে অটল থাকেন। তিনি তাঁর কয়েকজন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তার সঙ্গে আলোচনার পর বঙ্গভবনে প্রেসিডেন্ট মোশতাকের সঙ্গে সরাসরি ফোন করে তার নির্দেশ জানতে চান। মেজর রশিদের নির্দেশ মতোই কাজ করতে বলে মোশতাক। এর ফলে মোসলেম উদ্দিন ও তার দল চারনেতার সেলে যাওয়ার অনুমতি পেয়ে যায়। খোদ প্রেসিডেন্ট নির্দেশ দিলে বেচারা ডিআইজি কিইবা করতে পারে?

তাজউদ্দিন এবং নজরুল ইসলাম ১নং সেলে ছিলেন। পরবর্তী সেলে ছিলেন মনসুর আলী ও কামারুজ্জামান। তাদেরকে তাজউদ্দিনের সেলে এনে জড়ো করা হয়। তারপর খুব কাছে থেকে অস্ত্র দিয়ে তাদের গুলি করা হয়। তাদের মধ্যে তিনজন সঙ্গে সঙ্গেই মারা যান। তাজউদ্দিনের পায়ে ও হাঁটুতে গুলি লাগে, প্রচণ্ড রক্তক্ষরণে ধীরে ধীরে মারা যান। তিনি ‘পানি পানি’ বলে কাৎরাচ্ছিলেন। কিন্তু ভীত বিহ্বল পরিবেশে কেউ একফোঁটা পানি এগিয়ে দিতেও সাহস পায়নি। পাশের সেলে ছিলেন আবদুস সামাদ আজাদ। তার নাম লিস্টে না থাকায় ঘাতকরা তাকে ছেড়ে দেয়। বেঁচে গেলেন আজাদ। কেউ কিছু ভালো করে বুঝে উঠবার আগেই আকস্বিকভাবে ঘটে গেল এই হত্যাকাণ্ড।

ঘটনাটি এতই বর্বরোচিত ছিল যে, মুখ খুলে কেউ কিছু বলতেও সাহস পায়নি। ... কারাগারের অভ্যন্তরে এরকম নির্মম ঘটনা ইতিপূর্বে আর কখনো ঘটেনি।”

ঢাকা ক্যান্টনমেন্টের ভিতরে থেকে এসব ঘটনা প্রত্যক্ষ করা আরেকজন সেনা কর্মকর্তা ব্রিগেডিয়ার (অব.) সাখাওয়াত হোসেন এনডিসি, পিএসসি। সেই সময়ের ঘটনা নিয়ে তিনি লিখেছেন- ‘বাংলাদেশ: রক্তাক্ত অধ্যায়’ নামের গ্রন্থ। এ গ্রন্থে তিনি জানিয়েছেন একবার নয়, সে রাতে দুবার ফোন করা হয়েছিল রাষ্ট্রপতি খন্দকার মোশতাককে। আর ভণ্ড মোশতাক এ ঘটনার নির্দেশদাতা হয়েও সেটা না জানার ভান করে ছিল। ব্রিগেডিয়ার সাখাওয়াতের গ্রন্থ থেকে জানা যায়-

‘এ ঘটনা খন্দকার মোশতাক আর রশীদ ছাড়াও ৩ নভেম্বর সকালে যে আর একজন ব্যক্তি জেনেছিলেন তিনি ছিলেন মেজর জেনারেল খলিলুর রহমান। মেজর জেনারেল খলিলকে সংবাদটি দেয় আইজি পুলিশ এবং সাথে সাথেই খলিলুর রহমান রাষ্ট্রপতির সচিব মাহবুবুল আলম চাষীর মাধ্যমে রাষ্ট্রপতিকে জানাতে বলেন। মাহবুবুল আলম চাষী সংবাদটি মোশতাক আহমেদকে দিতেই রাষ্ট্রপতির অভিব্যক্তি থেকে বুঝতে পারেন যে এ হত্যা সম্বন্ধে তিনি ওয়াকেবহাল।”

কিন্তু খন্দকার মোশতাক যতই না জানার ভান করে থাকুক, অনেকেই বুঝে গিয়েছিল যে মোশতাকের অগোচরে কিছুই ঘটেনি। পরদিন অর্থাৎ ৪ নভেম্বর খন্দকার মোশতাক বঙ্গভবনে কেবিনেট মিটিং ডাকে। মন্ত্রিসভার সে বৈঠকে নৃশংস জেলহত্যার খবর নিয়ে ছুটে আসেন ফোর্সেস ইন্টেলিজেন্স-এর ডিরেক্টর।

অ্যান্থনি মাসকারেনহাস লিখেছেন-

“মোশতাক একজন চমৎকার অভিনেতা। তিনিও অন্যান্যদের মতো সজোরে বিলাপ শুরু করলেন। ভাবখানা এই রকম, যেন তিনি এই সংবাদ শুনে একেবারে আকাশ থেকে পড়লেন।”

‘বাংলাদেশ: রক্তাক্ত অধ্যায়’ বইতে ব্রিগেডিয়ার সাখাওয়াত লিখেছেন-

“যখন খালেদ মোশারফের পদোন্নতি নিয়ে আলোচনা এবং অনুমোদন দেয়া হয় ঠিক সে সময়েই এনএসআই-এর চিফ কেবিনেট রুমেই খন্দকার মোশতাককে জেলহত্যার ঘটনা জানালেন, তাও ২৪ ঘণ্টা বেশি সময় অতিবাহিত হওয়ার পর। খবর শুনে খন্দকার মোশতাক হতবাক হবার অভিনয় করতে থাকেন এবং এ চার নেতার এ ধরনের মৃত্যুর জন্য কপট ক্ষোভ প্রকাশ করেন।

সাফায়াত জামিলও খবর শুনে স্থির থাকতে পারলেন না বিশেষ করে যখন এত বড় একটা ঘটনা সবাই চেপে গিয়েছিলেন। সাফায়াত জামিল এমনিতেই খন্দকার মোশতাককে অশ্রদ্ধা করতেন তার ওপর এ ধরনের হটকারিতা সহ্য করতে না পেরে তার সাথে কয়েকজন অফিসার নিয়ে ঝড়ের বেগে কেবিনেট রুমে প্রবেশ করে খন্দকার মোশতাকের দিকে তাকিয়ে চিৎকার করে বলে ওঠেন, You are a murderer and userper. You can not remain as President and I put you under arrest you have no right to remain in power and you have to resign now.Õ

সেদিন সাফায়াত জামিল যখন মোশতাককে হুমকি দিয়ে বলেছিলেন-আপনাকে এখনই পদত্যাগ করতে হবে- মোশতাক নাকি মাথা নেড়ে রাজি হয়েছিল।

ক্ষমতায় থাকার জন্য কোনো প্রতিদ্বন্দ্বী যাতে বেঁচে থাকতে না পারে, সে কারণে জাতীয় চার নেতাকে নৃশংসভাবে হত্যা করে খন্দকার মোশতাক। কিন্তু মোশতাক এমন একটা ভাব ধরেছিল যেন সে কিছুই জানে না। কিন্তু জাতীয় চার নেতার মৃত্যুর পর খন্দকার মোশতাক বেশি দিন ক্ষমতায় থাকতে পারেনি। ৬ নভেম্বর সকালেই নতুন রাষ্ট্রপতি হিসেবে শপথ নেন দেশের প্রধান বিচারপতি আবু সাদাত মোহাম্মদ সায়েম। চতুর মোশতাক বুঝে গিয়েছিল তার সময় শেষ। আর সে কারণেই বঙ্গবন্ধুর খুনিরা যখন দেশত্যাগের তোরজোড় করছিল, তখন চরম ভীত মোশতাক রশীদ-ফারুককে কাঁদো কাঁদো কণ্ঠে আকুতি জানিয়েছিল, তাহলে বাবা আমাকেও তোমাদের সাথে বাইরে যেতে দাও। (সূত্র: ‘তিনটি সেনা অভ্যুত্থান ও কিছু না বলা কথা’)

বাংলাদেশের ইতিহাসে চরম ঘৃণার পাত্র হিসেবে টিকে আছে খন্দকার মোশতাক। স্বাধীন দেশে নব্য মীরজাফর হিসেবে তার ঠিকানা হয়েছে ইতিহাসের আস্তাকুঁড়েয়। বঙ্গবন্ধুহত্যা থেকে শুরু করে জাতীয় চার নেতা হত্যার মধ্য দিয়ে লোকাল বা দেশি হিটলার হিসেবে নিজের স্বরূপ চিনিয়েছে মোশতাক।

মিথ্যা ও ছলনার আশ্রয় নিয়ে রাষ্ট্রীয় ক্ষমতায় যাওয়ার দক্ষতাও সে দেখিয়েছে। যেমন করে ক্ষমতার লোভে ইয়াহিয়াকে বাংলাদেশে নৃসংশ গণহত্যার ইন্ধন জুগিয়েছিল জুলফিকার আলী ভুট্টো। তারচেয়েও নৃশংসতা দেখিয়েছে মোশতাক। জাতীয় চার নেতা হত্যার বিষয়ে অ্যান্থনি মাসকারেনহাস পর্যন্ত লিখতে বাধ্য হয়েছেন-

“১৯৭১-এর ডিসেম্বরে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী বুদ্ধিজীবী বাঙালিদের যেমন করে নৃশংসভাবে হত্যা করেছিল, এই হত্যাকাণ্ডও ঠিক সেভাবেই সংঘটিত হয়েছিল। অথচ বুদ্ধিজীবীদের জাতীয়ভাবে বছরে একবার স্মরণ করা হলেও, ওই চার নেতার ভাগ্যে সেটুকুও জুটল না।”

‘বাংলাদেশ: অ্যা লিগ্যাসি অব ব্লাড’ বইটি লেখা হয়েছে ১৯৭১ থেকে ১৯৮৬ পর্যন্ত বাংলাদেশের রাজনৈতিক ঘটনা নিয়ে। প্রথম প্রকাশিত হয় ১৯৮৭ সালে ফেব্রুয়ারিতে। বঙ্গবন্ধু হত্যা থেকে ১৯৮৬ পর্যন্ত দেশের শাসন ক্ষমতায় কারা ছিল, সেটা তো সবারই জানা।

বাংলাদেশে যখন মানবতাবিরোধী কাজের জন্য যুদ্ধাপরাধীদের বিচার হয়, তখন যুদ্ধাপরাধীদের সাঙ্গপাঙ্গরা যতই গলা ফাটিয়ে রাজাকারের পক্ষে সাফাই গায়, তাতে কিছু মানুষ হয়ত বিভ্রান্ত হয়। ওই যুদ্ধাপরাধীদের জন্য যখন পাকিস্তানের জাতীয় সংসদ আফসোসে আর্তনাদ করে, তখন কিন্তু আর সেই বিভ্রান্তিটা থাকে না। চ্যালা হারানোর শোক শয়তানও করে।

জাতীয় চার নেতাকে স্মরণ না করার মানেই হচ্ছে- নিজের অপরাধ ঢাকা। আর সে কারণেই অ্যান্থনি মাসকারেনহাস অমন মন্তব্য করেছেন। আর এ থেকে কিন্তু প্রমাণ হয়ে যায় এতসব ঘটনার নাটের গুরুটা আসলে কে?

লেখক: শিশুসাহিত্যিক, প্রবন্ধকার।

এ বিভাগের আরো খবর