বাংলাদেশ

মতামত

খেলা

বিনোদন

জীবনযাপন

তারুণ্য

কিড জোন

অন্যান্য

রেস-জেন্ডার

ফ্যাক্ট চেক

স্বাস্থ্য

আন্তর্জাতিক

শিক্ষা

অর্থ-বাণিজ্য

বিজ্ঞান-প্রযুক্তি

জাতীয় চারনেতা হত্যা ও রাষ্ট্রকে নেতৃত্বশূন্য করার অপচেষ্টা

  •    
  • ৩ নভেম্বর, ২০২১ ১৭:৩৬

বাংলাদেশ আবার আগের জায়গায় ফিরে যাওয়ার সুযোগ পাবে। সেটি যাতে ঘটতে না পারে সে ব্যাপারে ১৫ আগস্টের কুশীলবরা বিশেষভাবে সতর্ক ছিল। সেই সতর্কতারই প্রথম ছক ছিল সৈয়দ নজরুল ইসলাম, তাজউদ্দীন আহমেদ, ক্যাপ্টেন এম মনসুর আলী এবং এএইচএম কামারুজ্জামানকে বাঁচতে না দেয়া।

৩ নভেম্বর মধ্যরাতে ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে বন্দি জাতীয় চারনেতা সৈয়দ নজরুল ইসলাম, তাজউদ্দীন আহমেদ, ক্যাপ্টেন এম মনসুর আলী এবং এএইচএম কামারুজ্জামানকে নৃশংসভাবে হত্যা করা ইতিহাসের অন্যতম পৈশাচিক ঘটনা। ১৫ আগস্ট বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানসহ, শেখ মণি পরিবার এবং আব্দুর রব সেরনিয়াবাতের পরিবারের সদস্যসহ মোট ১৮ জনের হত্যাকারী যারা ছিল, তারা জেলের ভেতর জাতীয় চারনেতাকে একই উদ্দেশ্যে হত্যা করে।

এটি বাংলাদেশকে মুক্তিযুদ্ধে নেতৃত্বদানকারী রাজনৈতিক দল ও নেতৃত্বকে হত্যার মাধ্যমে রাষ্ট্রক্ষমতা দখল করা এবং একইসঙ্গে দেশীয় এবং আন্তর্জাতিক বিভিন্ন শক্তি- যারা এই হত্যাকাণ্ড ও অভ্যুত্থান সংঘটিত করার পেছনে পরিকল্পনা, ব্যক্তি ও গোষ্ঠীকে যুক্ত করাসহ সব ধরনের সমর্থন আর সহযোগিতায় নিজেদের দায়িত্ব পালন করে, তাদেরই চূড়ান্ত লক্ষ্য বাস্তবায়নের ভিন্ন ভিন্ন ধাপ।

প্রথম ধাপ ছিল রক্তাক্ত ১৫ আগস্ট। সেটি তাদের পরিকল্পনা মোতাবেক সফল হওয়ায় খন্দকার মোশতাক এবং অন্যান্য ব্যক্তি ও গোষ্ঠী ক্ষমতায় বসে। পরে দেশি-বিদেশি পরিকল্পনাকারীদের লক্ষ্য বাস্তবায়নে একের পর এক কাজ করে যেতে থাকে। তারা মূলত বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর কিছু কর্মকর্তা ও সদস্যকে দিয়ে অস্ত্র এবং সামরিক শক্তি ব্যবহারের মাধ্যমে তাদের পরিকল্পনা বাস্তবায়ন করে। আন্তর্জাতিক ষড়যন্ত্রকারী শক্তি এ ধরনের রাষ্ট্রীয় অভ্যুত্থান এবং রক্তপাতে দেশীয় বিভিন্ন ব্যক্তি ও গোষ্ঠীকে ব্যবহার করার ক্ষেত্রে দীর্ঘ অভিজ্ঞতা সঞ্চয় করে। প্রতিটি ঘটনার মধ্যে অভিজ্ঞতার ভিন্নতা ছিল।

দূর থেকে ঘটনা-পরবর্তীকালে দেশের ভেতর তাদের নিয়োজিত সংস্থার সার্বক্ষণিক পর্যবেক্ষণ এবং বিদেশের হেডকোয়ার্টারের সঙ্গে সংযোগ রক্ষার মাধ্যমে তারা দেশের পরিস্থিতি, ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়া, পাল্টা অভ্যুত্থান ইত্যাদিতেও কীভাবে ও কাদেরকে দিয়ে রিমোট কন্ট্রোলের মাধ্যমে নিয়ন্ত্রণ করা যেতে পারে এর নানা ভ্যারিয়েন্ট তাৎক্ষণিকভাবে বাস্তবায়ন করার মেকানিজম কার্যকর করতে অভিজ্ঞ ছিল।

১৯৭৫-এর ১৫ আগস্টের পর পরিস্থিতি তাদের নিয়ন্ত্রণে রাখার জন্য ক্ষমতায় বসানো এবং হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে জড়িত ব্যক্তি ও গোষ্ঠীকে রক্ষার জন্য নানা নিরাপত্তা বেষ্টনী গড়ে তোলে।যেকোনো পরিস্থিতি মোকাবিলা করা ও এর জন্য যেসব স্থানীয় প্রভাবশালী ব্যক্তিকে কাজে লাগানো প্রয়োজন সেটিও ষড়যন্ত্রকারী শক্তি নেপথ্যে থেকে তৈরি করে রাখে।

কেননা তারা দেখতে পায় খন্দকার মোশতাকের ক্ষমতা আরোহণের কিছুদিন পরেই তার অবস্থান রাজনৈতিকভাবে দুর্বল হতে থাকে- বিশেষত অক্টোবরে তাকে রাষ্ট্রপতি হিসেবে চ্যালেঞ্জ করা, তার বিরুদ্ধে স্লোগান দেয়ার ঘটনা বাড়তে থাকে।

একইভাবে সেনাবাহিনীর ভেতরে খন্দকার মোশতাকের জনপ্রিয়তা কমে যায়। ফলে ১৫ আগস্টের হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে জড়িতদের বিরুদ্ধে সেনাবাহিনীর উচ্চপদস্থ কর্মকর্তাদের মধ্যে ক্ষোভ-বিক্ষোভ বাড়তে থাকে এবং এটিকে সেনাবাহিনীর চেইন অব কমান্ড ভাঙার নজির হিসেবেও দেখা হতে থাকে।

এর বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়ার জন্য সেনাবাহিনীর ভেতরে বাহিনীর ঊর্ধ্বতনের কাছে সব কর্মকর্তারা দাবি জানাতে থাকে। সেনাবাহিনীর ভেতর এক ও পৃথক পরস্পরবিরোধী দ্বন্দ্ব আর অনাস্থা বেড়ে যায়। কিন্তু খন্দকার মোশতাক কিংবা সেনাপ্রধান জিয়াউর রহমান কোনো আইনগত ব্যবস্থা গ্রহণ করছিলেন না।

এর প্রেক্ষাপটে ২ নভেম্বর সেনানিবাসে খন্দকার মোশতাক এবং বঙ্গভবনে অবস্থানকারী ১৫ আগস্টের হত্যাকারীদের বিরুদ্ধে খালেদ মোশাররফের নেতৃত্বে সেনাবাহিনীর সিনিয়র কর্মকর্তারা সংগঠিত ও বঙ্গভবনের বিরুদ্ধে স্বতঃস্ফূর্তভাবে একত্রিত হন। এটি খালেদ মোশাররফের নেতৃত্বে সেনাবাহিনীর বিদ্রোহ হিসেবে পরিচিত হলেও এর পূর্বপরিকল্পনা কিংবা পরবর্তী ক্ষমতা গ্রহণ ও নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠাকে সামগ্রিক পরিকল্পনা বাস্তবায়ন হিসেবে জোরদার করা হয়।

খন্দকার মোশতাক ও ১৫ আগস্টের হত্যাকারীরা বুঝতে পারে যে, সেনাবাহিনীর বৃহত্তর অংশ তাদের অবস্থানকে আর মেনে নিচ্ছে না। সেনাবাহিনীর দ্রুত এই অবস্থানটি সংহত হওয়ার প্রেক্ষাপটে মোশতাক এবং তার সহযোগীরা বুঝতে পারে যেকোনো মুহূর্তে ক্ষমতার পরিবর্তন ঘটে যেতে পারে। সেকারণে তারা দুটো ছক তৈরি করে।

প্রথম ছকটি ছিল অত্যন্ত গোপনীয়। সেটি জানত শুধু খন্দকার মোশতাক এবং তার সহযোগী যারা ১৫ আগস্টের হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে জড়িত ছিল। তারা কাল বিলম্ব না করে ৩ নভেম্বর রাতের অন্ধকারে ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে বন্দি চারনেতাকে কারাবিধি এবং দেশীয়-আন্তর্জাতিক সব নিয়ম ভেঙে কারাগারের ভেতর প্রবেশ করে নৃশংসভাবে হত্যা করে। এক্ষেত্রে খন্দকার মোশতাক রাষ্ট্রপতি পদের মর্যাদার তোয়াক্কা না করে খুনিদের কারাগারের ভেতরে প্রবেশের নির্দেশ দেয়। এই হত্যাকাণ্ড সম্পূর্ণরূপে গোপন রাখা হয়।

ছকের দ্বিতীয় অংশটি ছিল ১৫ আগস্ট এবং জেলহত্যায় জড়িত ঘাতকদের দেশ থেকে পালিয়ে যাওয়ার ব্যবস্থা করা। এটি ৩ তারিখ দিনের বেলায়ই বাস্তবায়নের সব উদ্যোগ গোপন রেখে নেয়া হয়। এক্ষেত্রে জেনারেল এমএজি ওসমানীকে মধ্যস্থতাকারী করা হয়। হত্যাকারীদের অনেকেই তখন সেনা অভ্যুত্থানকারীদের সঙ্গে সমোঝতার ভিত্তিতে বিদেশে পাড়ি জমানোর ব্যবস্থার আলোচনায় অংশও নেয়। কিন্তু অভ্যুত্থানকারীরা তখনও জেলহত্যার খবর জানতে পারেনি।

ফলে ১৫ আগস্টের হত্যাকারী হিসেবে এদেরকে বিদেশে পাঠিয়ে রক্তপাত এড়ানোর বেশি কিছু তারা ভাবতে পারেনি। সে কারণে অনুমতি পাওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই হত্যাকারীরা সপরিবারে বিমানযোগে ঢাকা থেকে থাইল্যান্ড চলে যায়। পরে জানাজানি হয়ে যাওয়ার আগে এরা জাতীয় চারনেতাকে জেলের ভিতরে খন্দকার মোশতাকের সহযোগিতায় হত্যা করে।

১৫ আগস্টের হত্যাকারীদের প্রত্যক্ষ অংশগ্রহণে ৩ নভেম্বর রাতে চারনেতার হত্যাকাণ্ডটি আকস্মিকভাবে সংঘটিত করা হয়। এটি ছিল সুদূরপ্রসারী পরিকল্পনার পূর্বপরিকল্পিত অংশ। খন্দকার মোশতাক এবং আরও কিছু সামরিক কর্মকর্তা এই হত্যাকাণ্ডের প্রত্যক্ষ অংশীদার না হয়েও এর বিরোধিতা করেনি কিংবা অন্যদেরকেও জানতে দেয়নি। ফলে জেলহত্যার বিষয়টিও ছিল গভীরে লুকিয়ে থাকা পরিকল্পনার অংশ।

মূলত, বঙ্গবন্ধুকে হত্যা করার পর আগস্টেই জাতীয় চারনেতাসহ অনেক রাজনৈতিক নেতাকে জেলে আটকে রাখার উদ্দেশ্য ছিল আওয়ামী লীগের রাজনীতিকে জেলবন্দি করে রাখা নয় বরং বঙ্গবন্ধুর যোগ্য উত্তরসূরিদের বন্দি করে রাখার মাধ্যমে যেকোনো সময়ে তাদেরকে হত্যা করা। যাতে ১৫ আগস্টের পর ক্ষমতায় বসা ব্যর্থ হলে কিংবা রাষ্ট্রক্ষমতায় এই অপশক্তির বিরুদ্ধে নতুন কোনো শক্তির উত্থান ঘটতে দেখলে জেলে বন্দি থাকা নেতাদের বাছাই করে হত্যা করা যায়।

কেননা তেমন পরিস্থিতি তৈরি হলে বঙ্গবন্ধুর যোগ্য উত্তরসূরিরা ক্ষমতায় ফিরে আসার সুযোগ পাবে। সেক্ষেত্রে ১৫ আগস্ট হত্যাকাণ্ডের পরিকল্পনাকারীদের চূড়ান্ত লক্ষ্য ব্যর্থ হবে। বাংলাদেশ আবার আগের জায়গায় ফিরে যাওয়ার সুযোগ পাবে। সেটি যাতে ঘটতে না পারে সে ব্যাপারে ১৫ আগস্টের কুশীলবরা বিশেষভাবে সতর্ক ছিল। সেই সতর্কতারই প্রথম ছক ছিল সৈয়দ নজরুল ইসলাম, তাজউদ্দীন আহমেদ, ক্যাপ্টেন এম মনসুর আলী এবং এএইচএম কামারুজ্জামানকে বাঁচতে না দেয়া।

কারণ এরাই ১৯৭১-এ ২৫ মার্চ পরবর্তী সময়ে বঙ্গবন্ধুর অবর্তমানে মুক্তিযুদ্ধের সফল নেতৃত্ব দেয়। তারা শুধু বঙ্গবন্ধুর প্রতি বিশ্বস্তই ছিলেন না- নিজেরাও ছিলেন যোগ্য, মেধাবী, দেশপ্রেমিক এবং একটি রাষ্ট্রকে কীভাবে আধুনিক, গণতান্ত্রিক ও মুক্তিযুদ্ধের আদর্শে পরিচালিত করা যায় সেরকম রাষ্ট্রচিন্তার অধিকারী।

এটি ১৯৭১-এ প্রমাণিত হয়। সেকারণেই ৩ তারিখ যখন মোশতাক এবং ১৫ আগস্টের হত্যাকারীদের ক্ষমতা সম্পূর্ণরূপে চলে যাওয়ার পরিস্থিতি তৈরি হয়, তখন তারা জেলের ভেতর তাদের আওতায় রাখা জাতীয় চারনেতাকে নির্মমভাবে হত্যা করে। এই হত্যাকাণ্ডের মধ্য দিয়ে বাংলাদেশ যাতে আর মুক্তিযুদ্ধের আদর্শে কিংবা বঙ্গবন্ধুর অনুসৃত রাষ্ট্রচিন্তায় পরিচালিত হতে না পারে সে উদ্দেশ্য সাধন করতে চেষ্টা করে।

দুঃখজনক হলো- সেসময়ে যারা ক্ষমতার পরিবর্তনটি চেয়েছিলেন তারা রাজনৈতিক অভিজ্ঞতায় সমৃদ্ধ ছিলেন না। তাদের দেখা ও বোঝার সীমাবদ্ধতা ছিল। তাই তারা উদ্যোগের ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়া কী হতে পারে তা আগে থেকে হিসাব করেনি। জেনারেল এমএজি ওসমানীর ভূমিকাও বুঝতে পারেনি। খন্দকার মোশতাককে এবং তার নেপথ্যের কুশীলবরা চেষ্টা করছিল বাংলাদেশ রাষ্ট্র কীভাবে নেতৃত্বশূন্য ও আতুর করা যেতে পারে।

জেলখানায় জাতীয় চারনেতার মরদেহ ৪ তারিখ পর্যন্ত পড়ে রইল। এরপর কেবল পরিবারের সদস্যদের জানিয়ে লাশ দাফনের তড়িঘড়ি ব্যবস্থা করা হয়। অথচ তখন মোশতাকের ক্ষমতা ছিল নড়বড়ে, অভ্যুত্থানকারীরাও সংহত ছিল না। তাদেরকে মরণোত্তর শ্রদ্ধা জানানোর কোনো ব্যবস্থা রাজনীতি, রাষ্ট্র, প্রশাসনের দিক থেকে কেউ নিতে পারল না। এই ব্যর্থতা সবার। অথচ এরা ৭১-এ হাল না ধরলে বাংলাদেশ হতো না। ইতিহাসে এমন বিপর্যয়ের পরিস্থিতি সৃষ্টি ও পরিণতি কারো জন্যই মঙ্গলজনক হয় না।

জাতীয় চারনেতাকে জেলহত্যার দিনে স্মরণ করা হয়। কিন্তু সবাই করে না। তাতে কী? ইতিহাসে তাদের অবস্থান এখন যতটুকু দেয়া হচ্ছে এর চাইতেও অনেক বড় স্থান তাদের প্রাপ্য। তাদেরকে সেভাবেই স্মরণ করা, শিক্ষা নেয়া, ইতিহাসের স্থান অনুযায়ী বোঝা ও মর্যাদা দেয়া অপরিহার্য। বঙ্গবন্ধুর পাশে কেবল এই নেতাদেরই থাকার কথা। সেভাবেই ১৫ আগস্ট ও ৩ নভেম্বরের জেলহত্যা, বঙ্গবন্ধু ও জাতীয় চারনেতা হত্যার বিষয়গুলো ইতিহাসে নির্মোহভাবে স্থান দিতে হবে।

লেখক: গবেষক ও অধ্যাপক

এ বিভাগের আরো খবর