বাংলাদেশ

মতামত

খেলা

বিনোদন

জীবনযাপন

তারুণ্য

কিড জোন

অন্যান্য

রেস-জেন্ডার

ফ্যাক্ট চেক

স্বাস্থ্য

আন্তর্জাতিক

শিক্ষা

অর্থ-বাণিজ্য

বিজ্ঞান-প্রযুক্তি

সাম্প্রদায়িক সন্ত্রাসীদের মুখোশ খুলছে

  • মমতাজ লতিফ   
  • ২৬ অক্টোবর, ২০২১ ১৮:৪৮

এবারের পুজোয় তাণ্ডব চালানোর একটি পরিকল্পনা হবার সম্ভাবনা আগে থেকেই ছিল বলেই মনে হয়- যা নিয়ে গোয়েন্দা তথ্যের ভিত্তিতে জোরালো একটা আগাম প্রস্তুতি নেয়া যেত। যার ফলে এই সরকার, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী এবং মুসলিম সম্প্রদায়কে লজ্জায় পড়ার হাত থেকে রক্ষা করা যেত।

অত্যন্ত পরিকল্পিতভাবে ধর্মের লেবাসধারী চক্রান্তকারীরা সরকারের মুখে কালিমা লেপন করবে বা করেছে এমন তথ্যটি গোয়েন্দা বাহিনীর নজরে কেন থাকবে না- এ প্রশ্ন অনেকের। আমাদের দেশের চৌকষ গোয়েন্দা বাহিনী কত গোপন আস্তানা থেকে জঙ্গি নাশকতাকারীদের খুঁজে বের করে তাদের গ্রেপ্তার করেছে। কৃতিত্বপূর্ণ এই ধরনের ঘটনার সংখ্যাতো নেহায়েত কম নয়।

জঙ্গি দমনে তাদের দক্ষতা ২০১৬ সালের পর থেকে গৌরবোজ্জ্বল। কিন্তু দেখা যায়, যখনি কোনো ধর্মান্ধ গোষ্ঠী ধর্মকে, পবিত্র গ্রন্থকে অবমাননা করে এর দায় হিন্দু-বৌদ্ধ, বা অন্য কোনো ধর্মীয় সম্প্রদায়ের ওপর চাপিয়ে দিয়ে এটি প্রচারের মাধ্যমে একটি তাণ্ডব সৃষ্টি করে। তারপর হিন্দু বা ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীদের বাড়িঘর লুট, ভাঙচুর, মন্দির ও প্রতিমা ভাঙার মাধ্যমে অস্থিতিশীল পরিস্থিতির সৃষ্টি করে! তখন তাণ্ডব লুটপাট-ভাঙচুর শেষ হওয়ার পর আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী অকুস্থলে তাদের কাজ শুরু করে! এমনটা নিয়েও কম বিতর্কের সৃষ্টি হয়নি।

৪/৫ বছর আগে সংঘটিত নাসিরনগরে সাম্প্রদায়িক তাণ্ডবে হিন্দুদের জেলে পাড়ার তরুণ রসরাজের ওপর এই ইসলাম অবমাননার দায় চাপানোকে কেন্দ্র করে তাণ্ডব চালানোর সময়ে ওই সব হেফাজত-জামায়াতকর্মীদের গ্রেপ্তার না করার ফল হয় ভুক্তভোগী সমাজের অসহায় ক্ষমতাহীন তরুণদের অহেতুক অন্যায় মামলার মুখে পরা। রামুর উত্তম বড়ুয়া বা নাসিরনগরে রসরাজ বা সুনামগঞ্জে ঝুমন দাস- এরা এবং অনেক পরিচিত হিন্দু তরুণ-বয়স্কদের কাছে এই ভণ্ড অমানুষগুলো ইসলাম ধর্মকে নিয়ে দুষ্টবুদ্ধির খেলা করল, তাদের উপযুক্ত শাস্তি কেন হয় না? সে প্রশ্ন অনেকের।

আমাদের সমাজে কর্মহীন অলস মস্তিষ্কের ব্যক্তি-গোষ্ঠী যারা কিছু টাকার বিনিময়ে ইসলাম ধর্মের নবী, কোরআনকে নিয়ে অসৎ খেলায় মেতে উঠতে পারে তারা প্রকৃত ধর্ম বা কোরআনের বাণীর অনেক কিছুই জানে না। বিশ্বাস করে না এসব অসৎ অন্যায় কাজের কোনো পারলৌকিক পরিণাম আছে কি না, বা দেরিতে হলেও পুলিশের হাতে ইহলৌকিক শাস্তি নিয়েও ভাবে না!

জামায়াত-হেফাজতে এমন অনেক মানুষ আছে যারা হিন্দুবিদ্বেষী এবং ভ্রান্তভাবে বিশ্বাস করে- ইসলামের একটি মূলনীতি- হিন্দুবিদ্বেষ! এদের এই বিদ্বেষনীতি তাদের পরিবারের সদস্যদের ছাড়িয়ে প্রতিবেশীদের মধ্যে ছড়িয়ে পড়ে। এর অনেক উদাহরণ আশপাশে দেখতে পেয়ে মন ভারাক্রান্ত হয়।

১৯৫৫ থেকে ’৬৪, তারপর ’৭১, ও ’৭৫-এর পর হিন্দু সম্প্রদায়ের বড় একটি অংশ মুসলিম প্রতিবেশীদের কাছ থেকে যথাযোগ্য সম্মান, সাহায্য-সমর্থন না পেয়ে বরং তাদের বসতভিটা ও জমি-সম্পদের ওপর মুসলিম প্রতিবেশীদের লোভের কারণে হত্যা-ধর্ষণের শিকার হয়ে দেশত্যাগ করেছে! আমাদের বাল্য-কৈশোরে প্রতি শ্রেণিতে অন্তত চল্লিশজনের মধ্যে দশজন হিন্দু-বৌদ্ধ শিক্ষার্থীদের বন্ধু হিসেবে পেতাম।

তাদের সঙ্গে একসঙ্গে পড়া-খেলা, নাচ-গান, নাটকাভিনয়, টিফিন খাওয়া, গার্হস্থ্যবিজ্ঞানের বিরিয়ানিসহ নানা রান্নার ক্লাস করে সে খাবার এক থালায় খাওয়া- কত কিছুতেই না জড়িয়ে ছিল আমাদের সবধর্মের মানুষের অন্তরঙ্গ জীবন। পুজো শুরু হলে অপেক্ষায় থাকতাম কবে দূরের পুজো মণ্ডপ থেকে ভেসে আসবে প্রিয় সেই হেমন্ত মুখার্জী, সন্ধ্যা মুখার্জী, লতা মুঙ্গেশকর, কিশোর কুমার, সতীনাথ, শ্যামল মিত্রদের গান।

ওই গানগুলো পুজোর সঙ্গে এতটা মিশে গিয়েছিল যে- এখনও ভাবি, কেন পুজো উদ্যোক্তারা পুজোর প্রথম দিন থেকে মাইকে গানগুলো বাজায় না? এখনও নিশ্চয় বাজাতে পারে। এ গানগুলো যদি বাজে তাহলে নিশ্চিতভাবে বলা যায়- এ গান মুসলমান তরুণ-বয়স্ক, এমনকি মোল্লা-মৌলবিদের মনকেও স্পর্শ করবে।

পুজোর মঞ্চে গান-নাচের অনুষ্ঠান হয়, এটি আনন্দদায়ক। কিন্তু পুজোর সকাল-দুপুরে মাইকে দূর থেকে ভেসে আসা গানের মন-সঞ্জীবনী ক্ষমতা আজও বড্ড মিস করি।

হিন্দু সম্প্রদায়ের বছরের সবচেয়ে বড় উৎসব দেবী দুর্গার পুজোতে অন্তত কোনো হিন্দু যুবক-বয়স্ক, কারো দ্বারা হনুমানের কোলে কোরআন যেটি অন্য ধর্মের ধর্মগ্রন্থ, সেটি রেখে নিজেদের পুজোর পবিত্রতা বিনষ্ট করতে পারে না। তাছাড়া, হিন্দুরাই খুব ভালো জানে কীভাবে তাদের কাউকে পরিকল্পিত অপবাদ দিয়ে বার বার হামলা-লুটপাট, মন্দির, দেবী প্রতিমা ভাঙচুর, মারপিট, ধর্ষণের শিকার তাদের হতে হয়েছে! সুতরাং এ কাজটি কোনো হিন্দু, আদিবাসী বা অন্য কোনো ধর্মীয় সম্প্রদায়ের মানুষের দ্বারা করা সম্ভব নয়।

সম্ভব একমাত্র যারা ধর্মকে রাজনীতির হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করেছে, ’৭১- থেকে চেনা সেই ধর্ম-ব্যবসায়ী জামায়াত-হেফাজত এবং এদের নেপথ্যের সূত্রধর অর্থের দ্বারাই এ অপকর্মটি করেছে। জনগণ জানে এ ধরনের হীন কাজ, একটি ধর্ম সম্প্রদায়ের বড় উৎসবকে কেন্দ্র করে সাম্প্রদায়িক অস্থিতিশীলতা সৃষ্টির দ্বারা সবচাইতে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয় মুক্তিযুদ্ধের অসাম্প্রদায়িক চেতনাধারী সরকার!

একইভাবে সরকারের ভাবমূর্তি বিনষ্ট হলে এর সুবিধা ভোগ করে বিএনপি-জামায়াত, হেফাজত। তাই এ অপকর্ম এই সুবিধাভোগী ধর্ম ব্যবসায়ী, নীতিহীন, দেশপ্রেমহীন, অপরাজনৈতিক জোটের দ্বারা সংঘটিত এতে কোনো সন্দেহ নেই।

সরকারকে একটি বিষয়ে মনোযোগ দিতে হবে। দেশের অর্থনৈতিক-কৃষি, শিল্প-যোগাযোগ ব্যবস্থার উন্নয়ন ঘটছে, কিন্তু শিক্ষাক্ষেত্রে শিক্ষাক্রমে ধর্মনিরপেক্ষ, অসাম্প্রদায়িক আদর্শ চেতনা গঠনে সেভাবে কাজ হয়নি যেটি পাঠ্য বিষয়ের পাশে সংস্কৃতিচর্চা, নাটক, যাত্রাপালায় খুব ভালোভাবে অনুশীলন করা দরকার।

এবারের পুজোয় তাণ্ডব চালানোর একটি পরিকল্পনা হবার সম্ভাবনা আগে থেকেই ছিল বলেই মনে হয়- যা নিয়ে গোয়েন্দা তথ্যের ভিত্তিতে জোরালো একটা আগাম প্রস্তুতি নেয়া যেত। যার ফলে এই সরকার, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী এবং মুসলিম সম্প্রদায়কে লজ্জায় পড়ার হাত থেকে রক্ষা করা যেত। একটা কথা বলি- কোনো শিশু কি মায়ের গর্ভে থেকে আল্লাহ বা ভগবানকে বলতে পারে যে- হে আল্লাহ- ভগবান! তুমি আমাকে মুসলমানের ঘরে জন্ম দিও বা হিন্দুর ঘরে জন্ম দিও? সুতরাং ধর্ম আসলে আমরা সবাই উত্তরাধিকারসূত্রে বাবা, মা’র কাছ থেকেই পাই।

এই স্বধর্মের প্রতি অতি প্রীতি বা ভিন্নধর্মের প্রতি বিদ্বেষের যৌক্তিক কোনো কারণ নেই। কিছু ধর্মান্ধ দুষ্ট ও অসৎ ব্যক্তি ধর্মকে রক্ষার পাহারাদার দাবি করে সমাজে সাম্প্রদায়িক উসকানি দিয়ে যাচ্ছে। সরকারের উচিত এদের কঠিন দণ্ডের ব্যবস্থা করা, কারণ তারাই প্রকৃতপক্ষে পবিত্র ইসলাম ধর্মকে চূড়ান্তভাবে অপমানিত করেছে, ভিন্ন ধর্মজীবীরা নয়। তারাই মুক্তিযুদ্ধপন্থি সরকারকে অসুবিধায় ফেলার জন্য বার বার হিন্দু সম্প্রদায়ের ওপর আঘাত হেনে বিশ্বকে দেখায়- আওয়ামী লীগ সরকার সংখ্যালঘুকে রক্ষা করতে পারে না!

লেখক: শিক্ষাবিদ ও গবেষক

এ বিভাগের আরো খবর