বাংলাদেশ

মতামত

খেলা

বিনোদন

জীবনযাপন

তারুণ্য

কিড জোন

অন্যান্য

রেস-জেন্ডার

ফ্যাক্ট চেক

স্বাস্থ্য

আন্তর্জাতিক

শিক্ষা

অর্থ-বাণিজ্য

বিজ্ঞান-প্রযুক্তি

আমরা নিঃশ্বাস নিতে পারব তো?

  • এরশাদুল আলম প্রিন্স   
  • ২৫ অক্টোবর, ২০২১ ১৩:১১

সংবিধানে উল্লিখিত সংখ্যাগরিষ্ঠের মর্যাদা মানে সংখ্যালঘিষ্ঠের মর্যাদাহানি নয়। ইসলাম কখনও সংখ্যালঘিষ্ঠের অমর্যাদা করেনি। সংবিধানও সে কথা বলে না। ইসলামের বিশ্ববিজয়ের মূল কারণই ছিল ‘সংখ্যালঘু’ বা অন্য ধর্মের মানুষের প্রতি এর মর্যাদাবোধ। মুহাম্মদ (সা.) ছিলেন মানুষের জন্য সর্বোত্তম আদর্শ। তিনি বলেছেন- “কোনো মুসলিম যদি অমুসলিম নাগরিকের ওপর নির্যাতন-নিপীড়ন করে, তার কোনো অধিকারের ওপর হস্তক্ষেপ করে, তার কোনো জিনিস বা সহায়-সম্পদ জোরপূর্বক কেড়ে নেয়; তবে কেয়ামতের দিন আল্লাহর বিচারের কাঠগড়ায় আমি তাদের বিপক্ষে অবস্থান করব (দাউদ শরিফ)।

ধর্ম অবমাননার রেশ ধরে অন্য ধর্মের উৎসব পণ্ড করে দেয়া বাংলাদেশে নজিরবিহীন। শুধু উৎসব পণ্ড করে দেয়ার মধ্যেই বিষয়টি সীমাবদ্ধ থাকেনি, এ উন্মাদনা সহিংসতায় রূপ নেয়। মন্দির, ঘরবাড়ি ও ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানে তাণ্ডব চালিয়ে, আগুনে পুড়িয়ে ছাই করে দেয়া হয়। ‘সংখ্যালঘু’ হিন্দু সম্প্রদায়ের হয়তো ঘরবাড়ি পুড়েছে, কিন্তু এতে প্রকৃত মুসলমানদের হৃদয়ে কি একটুও আঁচ লাগেনি? ‘সংখ্যালঘু’ সম্প্রদায়ের ভিটেমাটিতে হয়ত সহসাই আবার ঘরবাড়ি তৈরি হবে, কিন্তু সংখ্যাগুরু সম্প্রদায়ের হৃদয়ের এ রক্তক্ষরণ সহসাই বন্ধ হবে কি? স্বাধীনতা-উত্তর বাংলাদেশের ইতিহাসে কি এই ঘটনা একটি চিরস্থায়ী কালো অধ্যায় হিসেবে থেকে যাবে না?

যুগ যুগ ধরে এদেশের মানুষ সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির সঙ্গে বসবাস করে আসছে। কিছু বিচ্ছিন্ন ঘটনা যে এখানে ঘটেনি তা নয়। তবে সবসময় পারস্পরিক সম্প্রীতি যে বজায় ছিল এটাই সত্যি। কোনো অঘটন ঘটে থাকলেও মানুষ এর প্রতিবাদ করেছে, ‘সংখ্যালঘু’দের পাশে দাঁড়িয়েছে। স্থানীয় অথবা জাতীয়ভাবে কোনো সম্প্রদায় একে অপরের মুখোমুখি দাঁড়ায়নি। কিন্তু কুমিল্লার ঘটনায় এবারের চিত্র যেন অনেকটাই ভিন্নরকম, অচেনা। এর মধ্য দিয়ে প্রশ্নবিদ্ধ হয়েছে আমাদের চিরচেনা ‘সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি’র দাবি।

এতদিন যে ‘সংখ্যালঘু’ নির্যাতন হয়েছে তার একটি বড় কারণ ছিল রাজনৈতিক প্রতিহিংসা। রাজনৈতিক প্রতিহিংসার শিকার যে সাধারণ মানুষকেও হতে হয়, সে কথা অজানা নয়। পরাজিত দল, দলের নেতা ও ভোটারদের এলাকাছাড়া করা, মামলা-হামলা করে দৌড়ের ওপর রাখা নতুন কিছু নয়। এ বিবেচনায় ‘সংখ্যালঘু’দের ওপরও নির্যাতন করা হয়েছে। বিভিন্ন সময় তারা রাজনৈতিক প্রতিহিংসার শিকারে পরিণত হয়েছে। ২০০১-এর সহিংসতা সে কথাই মনে করিয়ে দেয়।

এবারের ঘটনা ধর্মীয় সহিংসতার মাত্রা ছাড়িয়ে গেছে। এর পেছনে কোনো পক্ষের রাজনৈতিক দুরভিসন্ধি আছে কি না তা এখনও জানা যায়নি। তবে, রাজনৈতিক মোটিভ এর পেছনে না থাকলেও যে এর রাজনৈতিক ফায়দা তোলার চেষ্টা হবে, এর লক্ষণ ইতোমধ্যে দেখা গেছে। দেশের বড় দুটি রাজনৈতিক দল এ ঘটনার জন্য পরস্পরকে দুষছে। অতীতেও তাই হয়েছে। ফলে আসল অপরাধী ও মাস্টারমাইন্ডরা থেকে গেছে ধরাছোঁয়ার বাইরে।

এদেশের মানুষ যতটা না ধর্মপরায়ণ এর চেয়ে বেশি ধর্মের ব্যাপারে স্পর্শকাতর। এই অতি স্পর্শকাতর অনুভূতিকে কাজে লাগিয়ে ফায়দা তুলতে চায় অনেক পক্ষ। ধর্মের অপব্যবহার রাজনীতি থেকে শুরু করে অর্থনীতি ও সমাজেও বিস্তার লাভ করেছে। নাসিরনগর, শাল্লা ও রামুতে আমরা ধর্মের অপব্যবহারই দেখেছি। যা কুমিল্লা ও রংপুরে এবার দেখা গেল।

একটি ধর্ম অবমাননার দায়ে আরেকটি ধর্মাবলম্বী মানুষের ধর্ম পালনের সাংবিধানিক অধিকারটুকুও কেড়ে নেয়া হলো এবার। এ দেশের সংবিধান বলছে-

“প্রজাতন্ত্রের রাষ্ট্রধর্ম ইসলাম, তবে হিন্দু, বৌদ্ধ, খ্রীষ্টানসহ অন্যান্য ধর্ম পালনে রাষ্ট্র সমমর্যাদা ও সমঅধিকার নিশ্চিত করিবেন।” (প্রথম ভাগ, ধারা ২ক) এই বাক্যে দুটি কথা আছে। প্রথমত, প্রজাতন্ত্রের রাষ্ট্রধর্ম ইসলাম এবং দ্বিতীয়ত, হিন্দু, বৌদ্ধ, খ্রীষ্টানসহ অন্যান্য ধর্মপালনে রাষ্ট্র সমমর্যাদা ও সমঅধিকার নিশ্চিত করিবেন।

কুমিল্লায় পূজামণ্ডপের প্রবেশদ্বারে একটি মূর্তির পায়ের ওপর পবিত্র কোরআন রাখা হয়েছে। এই অভিযোগে ইকবাল নামক একজনকে গ্রেপ্তার করেছে পুলিশ। ঘটনার তদন্ত এখনও চলছে। কে প্রকৃত অপরাধী, কে পেছনের কারিগর, কী তার বা তাদের মোটিভ এসব বিষয়ে এখনই শেষ কথা বলার সময় আসেনি। আদৌ এর শেষটা দেখা যাবে কি না তাও জানা নেই। কিন্তু এর আগেই শেষ দৃশ্যের অবতারণা করা হয়ে গেছে। একটি সম্প্রদায়ের অধিকারকে চরমভাবে মাটিতে মিশিয়ে দেয়া হয়েছে।

প্রজাতন্ত্রের রাষ্ট্রধর্ম ইসলামের অবমাননা হয়েছে। এক্ষেত্রে যে বা যারা অবমাননা করেছে তাদেরকে আইনের আওতায় এনে বিচার করা প্রজাতন্ত্রের কাজ। প্রজাতন্ত্রের রাষ্ট্রধর্মের অবমাননা হলে সে ধর্মের অনুসারীরা অন্য ধর্মের অনুসারীদের আক্রমণ করবে, এটা প্রজাতন্ত্রের কোন আইনে আছে?

কোথাও ইসলামের অবমাননা হলে রাষ্ট্রের সাংবিধানিক দায়িত্ব ওই অবমাননাকারীদের বিচার করা। কিন্তু সে দায়িত্ব নিজেদের কাঁধে তুলে নেয়ার এখতিয়ার সহিংসতাকারীদের কে দিল? কুমিল্লায় ইসলামের অবমাননা করা হয়েছে। কাজেই অবমাননাকারী ও ‘সংখ্যালঘু’দের ওপর হামলাকারীদের ফৌজদারি আইনে সোপর্দ করে তাদের বিচার নিশ্চিত করতে হবে।

আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো- সংবিধানের একই অনুচ্ছেদ আরও বলছে- “রাষ্ট্র ধর্ম ইসলাম হলেও, রাষ্ট্র হিন্দু, বৌদ্ধ, খ্রীষ্টানসহ অন্যান্য ধর্ম পালনে সমমর্যাদা ও সমঅধিকার নিশ্চিত করবে।” একটি ধর্মের অবমাননা হলে সেই অবমাননা ঠেকানো বা অবমাননাকারীদের বিচার করা রাষ্ট্রের কাজ যা আগেই বলেছি। কিন্তু অবমাননার অজুহাতে অন্য ধর্ম পালনের সমমর্যাদা ও সমঅধিকার লঙ্ঘন করা হবে কেন? কুমিল্লা, রংপুরসহ অন্যান্য আরও জায়গায় পূজামণ্ডপে হামলা করে হিন্দুদের ধর্ম পালনের সমঅধিকার লঙ্ঘন করা হলো কেন? কাজেই যারা কাজটি করেছে তারা দুক্ষেত্রেই সংবিধান লঙ্ঘনকারী। কিন্তু এরচেয়েও বড় বিষয় হচ্ছে, হামলাকারীরা রাষ্ট্রকেই চ্যালেঞ্জ করেছে। কাজেই রাষ্ট্রকে কঠোরভাবে এই চ্যালেঞ্জের জবাব দিতে হবে।

সংবিধানে উল্লিখিত সংখ্যাগরিষ্ঠের মর্যাদা মানে সংখ্যালঘিষ্ঠের মর্যাদাহানি নয়। ইসলাম কখনও সংখ্যালঘিষ্ঠের অমর্যাদা করেনি। সংবিধানও সে কথা বলে না। ইসলামের বিশ্ববিজয়ের মূল কারণই ছিল ‘সংখ্যালঘু’ বা অন্য ধর্মের মানুষের প্রতি এর মর্যাদাবোধ। মুহাম্মদ (সা.) ছিলেন মানুষের জন্য সর্বোত্তম আদর্শ। তিনি বলেছেন-

“কোনো মুসলিম যদি অমুসলিম নাগরিকের ওপর নির্যাতন-নিপীড়ন করে, তার কোনো অধিকারের ওপর হস্তক্ষেপ করে, তার কোনো জিনিস বা সহায়-সম্পদ জোরপূর্বক কেড়ে নেয়; তবে কেয়ামতের দিন আল্লাহর বিচারের কাঠগড়ায় আমি তাদের বিপক্ষে অবস্থান করব (দাউদ শরিফ)। কাজেই কুমিল্লায় কোরআন অবমাননার দায় কোনোরকম বিচার ছাড়া পুরো হিন্দু সম্প্রদায়ের ওপর চাপানো মহা অন্যায়। বরং ইসলামের নাম নিয়ে এধরনের কাজ করাই বেশি ইসলামের অবমাননা।

ইসলাম বিচার ছাড়া কারো ওপর দোষ চাপায় না। একজনের অপরাধের জন্য আরেকজনকে বা পুরো সম্প্রদায়কে দোষী সাব্যস্ত করে তাদের বাড়িঘরে লুটপাট করে আগুন লাগিয়ে দিতে বলে না। তাই বলা যায়, হামলাকারীরা সুস্পষ্টভাবে নবীর বিরুদ্ধে দাঁড়িয়েছে। ইসলামি শরীয়ত মতেও তারা অপরাধী। একজনের অপরাধের দায়ে অন্য ধর্মের মানুষের ঘরবাড়িতে আগুন দেয়া, পূজামণ্ডপ গুড়িয়ে দেয়া তো পরের কথা, মহান আল্লাহ অন্য ধর্মের দেব-দেবিদের গালি দিতেও নিষেধ করেছেন (সুরা আনআম, ১০৮)। হামলাকারীরা আদতে কার অবমাননা করেছে? এরাই কি ইসলামের অবমাননা করেনি?

কুমিল্লার ঘটনাকে কোনোভাবেই বিচ্ছিন্ন ঘটনা হিসেবে দেখার সুযোগ নেই। কে বা কারা মূর্তির পায়ের কাছে পবিত্র কোরআন রেখেছে তা খুঁজে বের করতেই হবে। এর উদ্দেশ্য যত নগণ্যই হোক, এরকম একটি ঘটনার পরণতি যে কতটা ভয়াবহ হতে পারে; তা তো দেশের মানুষ দেখেছে। তাই ভবিষ্যতে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকে আরও তৎপর হতে হবে। সেই সঙ্গে প্রত্যেক সম্প্রদায়ের লোকদেরই সতর্ক থাকতে হবে। সবধরনের উসকানিদাতা ও অবমাননাকারীদের বিরুদ্ধে প্রতিটি ধর্মের মানুষদেরই সাবধান হতে হবে। বুঝতে হবে এরা সব ধর্ম-বর্ণ, রাষ্ট্র সর্বোপরি মানবজাতির শত্রু।

‘সংখ্যালঘু’ নির্যাতন বিশ্বে নতুন নয়। এশিয়া, ইউরোপ, আফ্রিকা সবখানেই আছে বর্ণবাদের কালো ইতিহাস। গণতন্ত্রের সূতিকাগার বলে খ্যাত ব্রিটেন অথবা আধুনিক গণতন্ত্র ও কথিত উদার রাষ্ট্র যুক্তরাষ্ট্র, ‘সংখ্যালঘু’ নিষ্পেষণে কেউ কম যায় না। কিছুদিন আগেও যুক্তরাষ্ট্রের মিনেসোটা অঙ্গরাজ্যের পুলিশ প্রকাশ্যে জর্জ ফ্লয়েড নামে এক কৃষ্ণাঙ্গের গলা হাঁটু দিয়ে চেপে ধরেছে। মৃত্যু যন্ত্রণায় ফ্লয়েড বার বার বলছে-

“আমি নিঃশ্বাস নিতে পারছি না।” বুটের চাপে তার মুখ দিয়ে ফেনা বেরিয়ে এসেছে। এমনকি মৃত্যুর আগে ফ্লয়েড পানি খেতে চেয়েছিল। পানি পায়নি। তার মৃত্যুযন্ত্রণা পাশে দাঁড়িয়ে থাকা অন্য পুলিশ সদস্যদেরও টলাতে পারেনি। এভাবে কাতরাতে কাতরাতে ফ্লয়েড মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়ে। পুরো বিশ্ব সে দৃশ্য দেখেছে। তবে এ ঘটনার পর যুক্তরাষ্ট্রের সাদা-কালো সবাই রাস্তায় নেমে আসে। সবার মুখে ছিল ফ্লয়েডেরই শেষ কথার প্রতিধ্বনি- ‘উই ক্যান্ট ব্রিথ’।

যুক্তরাষ্ট্রে ফ্লয়েডের মৃত্যুই প্রথম নয়। আর ধর্ম, বিশেষ করে ইসলামোফোবিয়া যে ইউরোপ-আমেরিকার সবচেয়ে বড় মহামারি তা তো সবারই জানা। মুসলিমরা সেখানে ‘সংখ্যালঘু’। কালোরা সেখানে ‘সংখ্যালঘু’। তাই ‘সংখ্যালঘু’ নির্যাতন স্থানভেদে রূপ বদলায় মাত্র। আসল চরিত্র একই। আমরা শুধু চাই আমাদের অসাম্প্রদায়িক চরিত্রটি বহাল থাকুক। এটাই বাংলাদেশের ভিত্তি। সামাজিক সাম্যই রাষ্ট্রের অক্সিজেনের জোগান দেয়, ধর্মকে পানি দেয়। এমন একটি সমাজেই আমরা মুসলমান-হিন্দু, বৌদ্ধ-খ্রিস্টান সবাই নিঃশ্বাস নিতে চাই। তা না হলে, সবারই নিঃশ্বাস নিতে কষ্ট হবে।

লেখক: আইনজীবী, কলাম লেখক

এ বিভাগের আরো খবর