আদিতে রাষ্ট্র ছিল না। রাষ্ট্রের আগেই সম্প্রদায় ছিল, সমাজ ছিল। রাষ্ট্র গড়ে উঠেছে অনেক অনেক পরে। সমাজে সম্প্রদায়সমূহের সুশৃঙ্খল বিন্যাসের নিমিত্তেই রাষ্ট্রের প্রয়োজনীয়তা দেখা দেয়। তাই বিভিন্ন সম্প্রদায়ের মানুষের মঙ্গলের জন্য সাধারণ ইচ্ছার ফল হিসেবে সামাজিক চুক্তির বাস্তব রূপই রাষ্ট্র।একবিংশ শতাব্দীর এই সময়ে বিভিন্ন সম্প্রদায়ের একত্রিত মঙ্গলার্থে কাজ করতে রাষ্ট্রগুলো আর ইচ্ছুক নয়। এখন দেশে দেশে অতিমাত্রায় আগ্রাসী, উগ্র ও জাতীয়তাবাদী সরকার রাষ্ট্র ক্ষমতায়। তারা বিভিন্ন বিভাজনে বিভাজন করছে রাষ্ট্রের মানুষদের। এসব কর্তৃত্ববাদী সরকারের কারণে বিভিন্ন ধর্ম-বর্ণ, সম্প্রদায়, গোত্রের মানুষ অনিরাপদ হয়ে পড়ছে। সৃষ্টি হচ্ছে মানুষে মানুষে বিভেদ-প্রভেদ, সংঘাত। মানুষ অস্তিত্বের সংকটে ভুগছে, তৈরি হচ্ছে আস্থাহীনতা। মানুষ ভাবতে শুরু করেছে যেকোনো মেরুকরণের কারণে সে হতে পারে নির্যাতিত, নিপীড়িত, বাস্তুহীন, এমনকি রাষ্ট্রহীন।এ কথা অস্বীকার করার উপায় নেই যে, সারা পৃথিবীতে যুগে যুগে সংখ্যালঘুরা নিগৃহীত, নির্যাতিত, নিপীড়িত, উপেক্ষিত। তা সে জাতিগত বা ধর্মীয় সংখ্যালঘু যা-ই হোক না কেন । জিন্নাহ-নেহেরুর ধর্মের ভিত্তিতে দেশভাগের কুফল সরাসরি ভোগ করছে মানুষই।শুধু ধর্মের কারণে দুটি ভূখণ্ড যে এক থাকতে পারে না, সেটাও একাত্তরে ফায়সালা হয়ে গেছে। হাজার বছরের বাঙালি সংস্কৃতি, এদেশের মাটি-পানি, বায়ুতে বেড়ে ওঠা মানুষেরা কখনোই আলাদা সত্তা নয়। তারা একই হৃদয়ের অভিন্ন মানুষ। যুগে যুগে রাজনীতি এবং অর্থনীতির নোংরা খেলায় পর্যুদস্ত হয়েছে জীবন, জীবনের বোধ, মর্যাদা।
সুজলা-সুফলা শ্যামল বাংলার সবুজে আচ্ছাদিত এই দেশটিতে গত শতাব্দীর শেষের দিকেও দেখেছি সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির চমৎকার সহাবস্থান। ধর্ম-বর্ণ, গোত্র নির্বিশেষে একজন আরেকজনের পরম বন্ধু, আত্মার আত্মীয়। বিভিন্ন ধর্মীয় উৎসবে একত্রিত হওয়া, ঈদে পুজোয় অন্য ধর্মের বন্ধুদের বাড়িতে নেমন্তন্ন খাওয়া, মণ্ডপে মণ্ডপে পুজো দেখতে যাওয়ার চমৎকার রেওয়াজ ছিল। ধর্ম নিয়ে বাড়াবাড়ি করতে, উগ্র হতে দেখিনি। ভারতের বাবরি মসজিদ ইস্যুতেও অনেকটাই সুস্থির ছিল আমাদের এই ভূখণ্ড। সেটিও ছিল রাজনৈতিক চক্রান্ত।চোখের সামনেই পাল্টে গেল দেশটা। ক্রমান্বয়ে স্বার্থ হাসিলের সবচেয়ে বড় পুঁজি হয়ে দাঁড়াল ধর্মীয় অনুভূতি। বিবেকহীন হতে হতে উন্মত্ততা বাসা বাঁধল মগজে। মানুষকে কুপোকাৎ, ঘায়েল করার পুরোনো মোক্ষম অস্ত্র ধর্মীয় অনুভূতিকেই বার বার কাজে লাগায় স্বার্থান্বেষীরা। এবারও এর ব্যতিক্রম হয়নি। মাঝখান থেকে ঝোঁকের মাথায় বুঝে উঠতে না পারা অকারণ কিছু প্রাণ গেল।কিছু মানুষের খোলসের ভেতর এখন দানবের অবয়ব। আমাদের সামাজিক-সাংস্কৃতিক পরিবেশটা ভয়াবহ দানবে ছেয়ে গেছে। অশিক্ষা-কুশিক্ষা মানুষকে কতটা রুচিহীন-দায়িত্বহীন-সংস্কৃতিহীন ও বোধহীন করেছে; চারপাশে চোখ বোলালেই বোঝা যায়। মনুষ্যত্বের জায়গাটা বড়ই নড়বড়ে হয়ে গেছে, ভয়াবহ অবক্ষয় বাসা বেঁধেছে মানুষের মনোজগতে।এক অন্ধকার সময়ে, অন্ধকার পৃথিবীতে আলো খুঁজে ফিরছি আমরা যারা শুভবুদ্ধিসম্পন্ন মানুষ। কিন্তু কোথাও আলো নেই। চারদিকে শুধু বিষাদাচ্ছন্ন অন্ধকার।সনাতন ধর্মাবলম্বীদের সবচেয়ে বড় ধর্মীয় উৎসব দুর্গাপূজা উদযাপনের সময়ে পবিত্র ধর্মগ্রন্থ নিয়ে সাম্প্রদায়িক ঘটনাটি একেবারেই উদ্দেশ্যপ্রণোদিত, তা দিনের আলোর মতোই স্পষ্ট। কারণ যাদের ধর্মীয় উৎসব চলছে; তারা নিজের ধর্মকে রক্ষা করতে, ধর্মের পবিত্রতা অটুট রাখতে, উৎসব উদযাপন ক্ষুণ্ন করতে এ কাজটি করবে না, নিশ্চিত করেই বলা যায়। খুব স্বল্প বুদ্ধির মানুষও বুঝতে পারবে, এটি ব্যক্তিগত দ্বন্দ্ব, গোষ্ঠীগত দ্বন্দ্ব, রাজনৈতিক স্বার্থ হাসিল অথবা অন্য যেকোনো কারণে হলেও অবশ্যই ধর্মীয় কারণে নয়। ধর্মপ্রাণ মুসলমান বা হিন্দুদের দ্বারা কাজটি কোনোভাবেই সম্ভব নয়।কোনো বিশেষ পরিস্থিতির প্রথম শিকার সংখ্যালঘু মানুষ। বাড়িঘরে আগুন দিয়ে, খেতের ফসল পুড়িয়ে, শারীরিক নির্যাতন করে, ব্যবসা প্রতিষ্ঠান পুড়িয়ে দিয়ে, এমনকি হত্যাকাণ্ডের মতো ঘটনা ঘটিয়ে বিভীষিকা তৈরি করে তাদের দেশছাড়া করার চক্রান্ত করা হয়। ব্যক্তি বা গোষ্ঠীস্বার্থকেন্দ্রিক এই কাজটা সুকৌশলে করার জন্য রাজনৈতিক অস্থিরতা অথবা সংবেদনশীল সময়ের অপেক্ষা করে সুযোগ সন্ধানীরা। এক্ষেত্রে শুধু ধর্মীয় সংখ্যালঘু বিবেচ্য নয়, আদিবাসী বা রাজনৈতিকভাবে পিছিয়ে পড়া জনগোষ্ঠীও এর শিকার হয়।
ধনী-দরিদ্র, মুসলিম-অমুসলিম, সংখ্যাগুরু-সংখ্যালঘুতে, ‘উঁচু-নিচু’ বংশ, স্থানীয়-বহিরাগত, পুরুষ-নারীতে এবং এমন আরও অসংখ্য কারণে সাম্প্রদায়িকতা হয়। সুবিধাজনক অবস্থানে থাকা বেশিরভাগ মানুষের ভেতরই সাম্প্রদায়িকতা স্পষ্টভাবে বা সুপ্তাবস্থায় বিরাজমান থাকে।এ কারণেই এই দেশে হিন্দু নির্যাতন হয়, ভারতে মুসলিম নির্যাতন হয়, মিয়ানমারে রোহিঙ্গা নির্যাতন হয়, চায়নায় উইঘুর জনগোষ্ঠী নির্যাতন হয়, ইউরোপ-আমেরিকায় কালো নির্যাতন হয়। যদিও সবখানে ভিন্ন মাত্রা বা কৌশল যোগ করা হয়।বিশ্বায়নের কালে প্রতিনিয়ত আমরা একদেশ থেকে আরেক দেশে ছোটাছুটি করি। তাই কেউ একদেশে সংখ্যাগুরু হলেও অন্যদেশে সে সংখ্যালঘু। বাংলাদেশে মুসলিম হিসেবে কেউ সংখ্যাগুরু হলেও ভারত বা আমেরিকায় কিংবা শ্রীলঙ্কায় সে সংখ্যাল। বাংলাদেশে বাঙালি হিসেবে কেউ সংখ্যাগুরু হলেও ইউরোপে সে সংখ্যালঘু।রামুর বৌদ্ধ মন্দির ভাঙা, গাইবান্ধার সাঁওতাল পল্লিতে আগুন, ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় রসরাজ নামের নিরীহ ছেলেকে ফাঁসিয়ে দিয়ে বাড়ি ও মন্দিরে আগুন দেয়ার ঘটনাগুলো ঘুরেফিরে দেখতে হচ্ছে। মসজিদ- মন্দির, গির্জা, প্যাগোডা, প্রতিমা ভাঙার ঘটনাও বার বার দেখতে হচ্ছে। মৌলবাদী স্বার্থান্বেষী গোষ্ঠীর সাম্প্রদায়িক উস্কানিতে আর একটা প্রাণেরও বিনাশ দেখতে চাই না।আমরা শুধু মুসলিম, হিন্দু, বৌদ্ধ,খ্রিস্টান হতে চাই না। আমাদের আদি এবং অকৃত্রিম পরিচয় বাঙালি। আমাদের কৃষ্টি-সংস্কৃতি, লোকাচার-ঐতিহ্য সবই বাঙালিত্বকে ঘিরে। এই জীবনবোধই আমাদের শেখায় ভিন্ন ধর্ম, জাতি, ভাষার মানুষের প্রতি সহনশীলতা, সহমর্মিতা, ভালোবাসা।
আমাদের মহান মুক্তিযুদ্ধের মূলমন্ত্রও ছিল অসাম্প্রদায়িকতা। ’৭২ সালের সংবিধানেও রাষ্ট্রীয় চারনীতির একটি ছিল ধর্মনিরপেক্ষতা। তবুও অস্থিরতার এই সময়ে প্রতিমা ভাঙচুর, ভূমি দখলসহ বেশকিছু অপ্রীতিকর ঘটনা ধারাবাহিকভাবে ঘটেই চলেছে। এসব অপরাধের সঙ্গে জড়িতদের বিচারের আওতায় আনার নজিরও কম। যে কারণে সংখ্যালঘুরা সবসময় নিরাপত্তার অভাব বোধ করে। তাদের মনে অনিরাপদবোধ ও পলায়নপর মনোভাব কাজ করে, সেগুলো দূর করার জন্য সরকারের দৃঢ় পদক্ষেপ গ্রহণ করা প্রয়োজন। বিশৃঙ্খলা সৃষ্টিকারীদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির আওতায় আনলে, আস্থার ক্ষেত্র প্রস্তুত হলে সংখ্যালঘুরা আর নিজেদের সংখ্যালঘু মনে করবে না।
সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির এক উজ্জ্বল ক্ষেত্র আমাদের এই প্রিয় বাংলাদেশ। ছোট ভূখণ্ডের বড় জনসংখ্যার এই দেশে সবাই নিরাপদে থাকুক, স্বস্তিতে থাকুক, শান্তিতে থাকুক। মানুষে মানুষে সৌহার্দ্য-সম্প্রীতির বন্ধন আরও গভীর হোক। ভালো থাকার জন্য, নিরাপদে থাকার জন্য, বিশ্বাসের জন্য এ বন্ধন খুবই জরুরি।এই দেশ, এই মাটি সবার। এই ভূমিতে জন্ম নেয়া প্রতিটি মানুষই এ দেশের নাগরিক। কেউ এখানে সংখ্যালঘু নয়। এখানে সবার সমানাধিকার রয়েছে। নিশ্চিতভাবে যার যার ধর্ম সে সে পালন করবে।মানুষকে মানুষ হিসেবে মূল্যায়ন করতে হলে, ভালোবাসতে হলে সভ্যতার আলোয় নিজেকে আলোকিত করতে হবে। সংস্কৃতিগতভাবে নিজেকে পরিশুদ্ধ করার মাঝেই নিহিত আছে সাম্প্রদায়িকতার বিষ ক্ষয়ের উপায়। ‘অন্তর মম বিকশিত করো অন্তরতর হে’…লেখক: প্রাবন্ধিক-শিক্ষক