বাংলাদেশ

মতামত

খেলা

বিনোদন

জীবনযাপন

তারুণ্য

কিড জোন

অন্যান্য

রেস-জেন্ডার

ফ্যাক্ট চেক

স্বাস্থ্য

আন্তর্জাতিক

শিক্ষা

অর্থ-বাণিজ্য

বিজ্ঞান-প্রযুক্তি

অভিশপ্ত ইনডেমনিটি ও বিচারহীনতার সংস্কৃতি

  • আহমেদ রিয়াজ   
  • ২৬ সেপ্টেম্বর, ২০২১ ১৮:৩৯

পৃথিবীর ইতিহাসে ঘৃণ্যতম নরহত্যায় যে টিক্কার কাছে হিটলার পর্যন্ত লজ্জা পাবে, সেই টিক্কার ঘৃণা থেকেও রেহাই পায়নি বঙ্গবন্ধুর খুনিরা। বঙ্গবন্ধুর খুনিদের কাছে টিক্কাও নস্যি। আর তার চেয়ে নস্যি যারা খুনিদের আশ্রয়-প্রশ্রয় দেয় ও পুরস্কৃত করে।

১৯৭৫-এর ১৫ আগস্ট জাতির পিতাকে নির্মমভাবে হত্যা করা হয়। তারপর বাংলাদেশের ইতিহাসে ঘটতে থাকে একের পর এক ন্যক্কারজনক ঘটনা। এতই ন্যক্কারজনক যে, জাতি হিসেবে দুনিয়ার কাছে বাঙালি হয়ে যায় ‘মীরজাফর’। যদিও সত্যিকার মীরজাফরদের সংখ্যা অতি নগণ্য। তবুও পুরো জাতির গায়ে মীরজাফরি কাদা লেগে যায়। সে মীরজাফরি কাদা সরাতে হয় জাতির পিতার কন্যা শেখ হাসিনার সরকারকে।

সপরিবারে জাতির পিতার নির্মম হত্যাকাণ্ডের পর ‘স্বঘোষিত’ রাষ্ট্রপতি হয় নব্য মীরজাফর খন্দকার মোশতাক আহমদ। তার এ ক্ষমতা দখলের পেছনে ছিল সেনাবাহিনীর একদল কর্মকর্তার সমর্থন। খন্দকার মোশতাকের রাজনীতির হাতেখড়ি হয় বঙ্গবন্ধুর হাতে। বঙ্গবন্ধুই তাকে বিপদে-আপদে আগলে রাখেন বটবৃক্ষের মতো। তার চাওয়া কোনোকিছু যথাসম্ভব অপূর্ণ রাখেননি বঙ্গবন্ধু। এমনকি একসময় যখন খন্দকার মোশতাকের রাজনৈতিক ক্যারিয়ার প্রায় ধ্বংসের মুখে, তখনও তাকে টেনে তোলেন শেখ মুজিবুর রহমান।

বঙ্গবন্ধুকে হত্যার মাত্র ৯ দিনের মাথায় ১৯৭৫-এর ২৪ আগস্ট সেনাবাহিনীর প্রধান করা হয় জিয়াউর রহমানকে। তারপর জাতির পিতাকে হত্যার একমাস দশদিন পর ২৬ সেপ্টেম্বর মানব সভ্যতা ও ইতিহাসের কলঙ্কতম আইন ইনডেমনিটি অধ্যাদেশ জারি করে। ‘দি বাংলাদেশ গেজেট, পাবলিশড বাই অথরিটি’ শিরোনামের ওই দায়মুক্তি অধ্যাদেশটিতে ছিল খন্দকার মোশতাক আহমদ ও সংসদ বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের সচিব এএইচ রহমানের স্বাক্ষর। অধ্যাদেশটির দুভাগের প্রথম অংশে বলা হয়-

১৯৭৫-এর ১৫ আগস্ট ভোরে বলবৎ আইনের পরিপন্থি যা-ই ঘটুক না কেন, এ ব্যাপারে সুপ্রিম কোর্টসহ কোনো আদালতে মামলা, অভিযোগ বা কোনো আইনি প্রক্রিয়ায় যাওয়া যাবে না।

দ্বিতীয় অংশে ছিল-

রাষ্ট্রপতি উল্লিখিত ঘটনার সঙ্গে সম্পৃক্ত বলে যাদের প্রত্যয়ন করবেন তাদের দায়মুক্তি দেওয়া হলো। অর্থাৎ তাদের বিরুদ্ধে কোনো আদালতে মামলা, অভিযোগ বা কোনো আইনি প্রক্রিয়ায় যাওয়া যাবে না।

এই বিশ্বাসঘাতক খুনি বেশিদিন ক্ষমতায় থাকতে পারেনি। তার সে যোগ্যতাই ছিল না। কাজ হাসিলের পর তাকে ক্ষমতার চেয়ার থেকে ছুড়ে ফেলে দেয় এ দেশের পাকিস্তানপ্রেমীরা। পর্দার আড়ালে থাকা আসল পাকিস্তানপ্রেমীদের মুখোশ খুলতে শুরু করে ধীরে।

সামরিক অভ্যুত্থান-পাল্টা অভ্যুত্থানের পর ১৯৭৬-এর ১৯ নভেম্বর প্রধান সামরিক আইন প্রশাসকের দায়িত্ব নেন জিয়াউর রহমান। ১৯৭৭-এর ২১ এপ্রিল বিচারপতি আবু সায়েমকে কৌশলে হটিয়ে রাষ্ট্রপতি হিসেবে ক্ষমতা দখল করে এতদিন পর্দার আড়ালে থাকা বঙ্গবন্ধু হত্যার মূল কারিগর।

রাষ্ট্রপতি হয়ে একটুও দেরি করল না জিয়াউর রহমান। ক্ষমতার জোরে খন্দকার মোশতাকের ওই অধ্যাদেশকে আইনে পরিণত করল। কারণটা খুবই সহজ। বঙ্গবন্ধু হত্যার বিচারপ্রক্রিয়া যদি আটকানো না যায়, তাহলে তো মূল কারিগরের মুখোশ উন্মোচিত হয়ে যাবে জাতির কাছে, বিশ্বের কাছে।

শুধু আইন করেই ক্ষান্ত হয়নি জিয়া। বঙ্গবন্ধুর নাম মুখে নেয়াটাকেও ‘পাপ’ পর্যায়ে নিয়ে যায় সে। আর এজন্য একের পর এক গুজব ছড়ায়, সত্য কোনো ঘটনার সঙ্গে মিথ্যা মিশিয়ে প্রপাগান্ডা চালায়। গুজবপ্রিয় জাতি সেসব প্রপাগান্ডায় এতটাই হেলে পড়ে যে, ওসব যে মিথ্যা, গুজব, প্রপাগান্ডা এটা বুঝতেই জাতির সময় লাগে ২১ বছর।

যাহোক, ১৯৭৯-এর ১৮ ফেব্রুয়ারি দ্বিতীয় সংসদ নির্বাচনে সংসদের দু-তৃতীয়াংশ আধিপত্য দখল করে জিয়া সরকার এবং ১৯৭৯-এর ৯ এপ্রিল জাতীয় সংসদে সংবিধানের ৫ম সংশোধনী পাস করানো হয়। সংশোধনীতে ১৯৭৫-এর ১৫ আগস্ট থেকে ১৯৭৯-এর ৯ এপ্রিল পর্যন্ত দায়মুক্তি অধ্যাদেশসহ ৪ বছরে সামরিক আইনের আওতায় সব অধ্যাদেশ, ঘোষণাকে বৈধতা দেয়া হয়। আইনটির নাম ছিল ‘সংবিধান (পঞ্চম সংশোধনী) আইন, ১৯৭৯’। এ সংশোধনীতে বলা হয়-

“১৯৭৫-এর ১৫ আগস্ট হইতে ১৯৭৯-এর ৯ এপ্রিল তারিখের (উভয় দিনসহ) মধ্যে প্রণীত সকল ফরমান, ফরমান আদেশ, সামরিক আইন প্রবিধান, সামরিক আইন আদেশ, ও অন্যান্য আইন, উক্ত মেয়াদের মধ্যে কোনো ব্যক্তি বা কর্তৃপক্ষ কর্তৃক প্রণীত আদেশ, কৃত কাজকর্ম, গৃহীত ব্যবস্থা বা কার্যধারাসমূহ, অথবা প্রণীত, কৃত বা গৃহীত বলিয়া বিবেচিত আদেশ, কাজকর্ম, ব্যবস্থা বা কার্যধারাসমূহ এতদ্বারা অনুমোদিত ও সমর্থিত হইল এবং ঐ সকল আদেশ, কাজকর্ম, ব্যবস্থা বা কার্যধারাসমূহ বৈধভাবে প্রণীত, কৃত বা গৃহীত হইয়াছে বলিয়া ঘোষিত হইল, এবং তৎসম্পর্কে কোনো আদালত, ট্রাইব্যুনাল বা কর্তৃপক্ষের নিকট কোনো কারণেই কোনো প্রশ্ন উত্থাপন করা যাইবে না।”

এ সংশোধনীর উদ্দেশ্য ছিল ১৯৭৫-এর ১৫ আগস্টের হত্যাকারীদের পাকাপোক্তভাবে দায়মুক্ত করা। কিন্তু ১৯৭৯-এর ৯ এপ্রিল সামরিক আইন প্রত্যাহারের কারণে ১৯৭৫-এর ২৬ সেপ্টেম্বর অঘোষিত রাষ্ট্রপতি মোশতাকের জারি করা ইনডেমনিটি বা দায়মুক্তি অধ্যাদেশটি কার্যকারিতা হারিয়ে ফেলে। ফলে বঙ্গবন্ধুর খুনিদের বিরুদ্ধে আইনি ব্যবস্থা নিতে বাধা ছিল না।

সে পথ আটকাতেই জিয়া সরকার জাতীয় সংসদকে কলঙ্কিত করে ৫ম সংশোধনী আনে। তখন তারা এটাকে চিরস্থায়ী বন্দোবস্তে পরিণত করেছিল আইনের মাধ্যমে এবং তাদের ধারণা ছিল সংসদের দু-তৃতীয়াংশ সমর্থন ছাড়া এ আইন যেহেতু পরিবর্তন করা যাবে না এবং সংসদে দু-তৃতীয়াংশের সমর্থন পাওয়া সহজ কথাও নয়- কাজেই বাংলাদেশে জাতির পিতা হত্যার বিচার করা সহজ হবে না।

এখানেই থেমে থাকেনি খুনিচক্র। এমনিতেই রাষ্ট্রের সর্বোচ্চ আইন প্রণয়নকারী প্রতিষ্ঠান সংসদের মাধ্যমে খুন করেও রেহাই পেল খুনিরা। আর বোনাস হিসেবে পেল অপ্রত্যাশিত উপহার। যা পাওয়ার যোগ্যতা নিয়েও প্রশ্ন থেকে যায়।

লে. কর্নেল শরিফুল হক ডালিম চীনের প্রথম সচিব, লে. কর্নেল আজিজ পাশা আর্জেন্টিনায় প্রথম সচিব, মেজর একেএম মহিউদ্দিন আহমেদ আলজেরিয়ায় প্রথম সচিব, মেজর বজলুল হুদা পাকিস্তানের দ্বিতীয় সচিব, মেজর শাহরিয়ার রশিদ ইন্দোনেশিয়ায় দ্বিতীয় সচিব, মেজর রাশেদ চৌধুরী সৌদি আরবে দ্বিতীয় সচিব, মেজর নূর চৌধুরী ইরানে দ্বিতীয় সচিব, মেজর শরিফুল হোসেন কুয়েতে দ্বিতীয় সচিব, কর্নেল কিসমত হাশেম আবুধাবিতে তৃতীয় সচিব, লে. নাজমুল হোসেন কানাডায় তৃতীয় সচিব এবং লে. আবদুল মাজেদকে সেনেগালে তৃতীয় সচিব বানিয়ে পুরস্কৃত করা হলো খুনিদের।

এর মধ্য দিয়ে জাতি হিসেবে বিশ্বের দরবারে বাংলাদেশকে আরও কলঙ্কিত করে বাঙালি জাতির ভাবমূর্তি ধুলোয় মিশিয়ে দেয়া হলো। দক্ষিণ এশিয়ার ইতিহাসে প্রথমবারের মতো নির্মম হত্যাকাণ্ডের বিচার বন্ধ করে বাংলাদেশে শুরু করা হলো বিচারহীনতার সংস্কৃতি।

দেখা যায় যে, পাকিস্তানপ্রীতির কারণে পঁচাত্তরের ১৫ আগস্ট পরবর্তী সরকারগুলো বঙ্গবন্ধুর খুনিদের আইনের মাধ্যমে রক্ষা করে, এটি খোদ পাকিস্তানের কসাই টিক্কা খানের অভিমত।

মুক্তিযুদ্ধের সময় পূর্ব পাকিস্তানের গভর্নর হিসেবে বাঙালিদের হত্যা করে রক্তের বন্যা বইয়ে দেয় টিক্কা খান। পরে পাকিস্তানের পাঞ্জাব প্রদেশের গভর্নর হয় টিক্কা। তার সঙ্গে দেখা করেন এক মুজিবভক্ত ও বাংলাদেশি সরকারি কর্মকর্তা মুসা সাদিক। এক সাক্ষাৎকারে মুসা সাদিককে টিক্কা জানায়-

“২৬ মার্চ (১৯৭১) আমি নিজে পূর্ব পাকিস্তানের গভর্নর হিসেবে আমার ফ্ল্যাগ কারে করে তোমাদের জাতির জনক শেখ মুজিবুর রহমানকে ঢাকা ক্যান্টনমেন্ট থেকে তেজগাঁও এয়ারপোর্টে নিয়ে গিয়ে একজন জাতীয় নেতার মর্যাদায় সসম্মানে তাঁকে আমি করাচিগামী পিআইএ’র বিমানে তুলে দেই। তুলে দেবার সময় তাঁকে আমি সামরিক কায়দায় স্যালুট করে বলি: স্যার, আমাকে নিজগুণে মার্জনা করবেন, আমি একজন অনুগত গভর্নর হিসেবে পাকিস্তানের প্রেসিডেন্টের হুকুম তামিল করেছি মাত্র। আমি আশা করি, সেখানে পৌঁছে পাকিস্তানের প্রেসিডেন্টের সাথে আপনার সাক্ষাৎ হবে এবং আপনি আপনার ভাগ্য নির্ধারণ করতে পারবেন।”

এরপর টিক্কা খান হ্যান্ডশেক করার জন্য প্রস্তুত ছিল, কিন্তু বঙ্গবন্ধু তার দিকে না তাকিয়ে সোজা বিমানে উঠে যান। পরে টিক্কা খানকে এদেশে গণহত্যা ও নারী নির্যাতনের বিষয়ে প্রশ্ন করেছিলেন মুসা সাদিক। বার বার করা প্রশ্নে টিক্কা খান হঠাৎ উত্তেজিত হয়ে ওঠে। তারপর বলে, “তোমার বড় বড় বুলি বন্ধ করো। তোমাদের জাতির জনককে তোমরা যে খুন করেছো, সেজন্য তোমাদের ঘৃণিত বাঙালি জাতি নিয়ে জাহান্নামে যাও। আমি তো তাঁকে ঢাকা বিমানবন্দরে সর্বোচ্চ সম্মান প্রদর্শন করে সামরিক কায়দায় অভিবাদন জানিয়ে জীবিত অবস্থায় পাকিস্তানে পাঠিয়ে দিয়েছিলাম। সেই পুণ্যের জন্য আর তোমার শিক্ষার জন্য, তুমি আমার জুতোজোড়া তোমার মাথার মুকুট বানিয়ে এশিয়ান হাইওয়ে ধরে ঢাকার দিকে রওনা দাও এবং মহাসড়কের দুধারের সকল পথচারীর উদ্দেশে চিৎকার করে বলতে বলতে যাও যে, জেনারেল টিক্কা খান একজন মহামানব, শেখ মুজিবকে যিনি বাঁচিয়ে রেখেছিলেন, কিন্তু বাঙালি জারজ সন্তানেরা এত বড় নরাধম যে, তারা শেখ মুজিবকে খুন করেছে।”

(১৫ই আগস্ট ট্র্যাজেডি ও বঙ্গভবনের অজানা অধ্যায়: মুসা সাদিক)

পৃথিবীর ইতিহাসে ঘৃণ্যতম নরহত্যায় যে টিক্কার কাছে হিটলার পর্যন্ত লজ্জা পাবে, সেই টিক্কার ঘৃণা থেকেও রেহাই পায়নি বঙ্গবন্ধুর খুনিরা। বঙ্গবন্ধুর খুনিদের কাছে টিক্কাও নস্যি। আর তার চেয়ে নস্যি যারা খুনিদের আশ্রয়-প্রশ্রয় দেয় ও পুরস্কৃত করে।

যদিও শেষ পর্যন্ত ১৯৯৬-এর ১২ নভেম্বর ‘ইনডেমনিটি অধ্যাদেশ রহিতকরণ বিল’ জাতীয় সংসদে পাস হয়। ১৪ নভেম্বর রাষ্ট্রপতি বিলটিকে স্বাক্ষর করার পর এটি পরিপূর্ণ আইনে পরিণত হয়। আর এর পরই শুরু হয় বঙ্গবন্ধু হত্যার বিচার। জাতি হয় কলঙ্কমুক্ত। জাতির গা থেকে খসে পড়ে ‘মীরজাফরি কাদা’। কিন্তু ইতিহাসে ঘৃণ্যতম একটি অধ্যায় হিসেবেই রয়ে যাবে ‘ইনডেমনিটি অধ্যাদেশ’।

লেখক: শিশুসাহিত্যিক, প্রাবন্ধিক

এ বিভাগের আরো খবর