বাংলাদেশ

মতামত

খেলা

বিনোদন

জীবনযাপন

তারুণ্য

কিড জোন

অন্যান্য

রেস-জেন্ডার

ফ্যাক্ট চেক

স্বাস্থ্য

আন্তর্জাতিক

শিক্ষা

অর্থ-বাণিজ্য

বিজ্ঞান-প্রযুক্তি

বিচারকের ভুল কি ‘সরল বিশ্বাসে’ হয়?

  •    
  • ২১ সেপ্টেম্বর, ২০২১ ১৮:০৫

একজন নারীকে পর পর তিন দফায় রিমান্ডে নেয়া যায় কি না— তা নিয়ে নানা মহলেই প্রশ্ন ওঠে। সোশ্যাল মিডিয়ায়ও বিষয়টির সমালোচনা শুরু হয়। পরীমনি বর্তমানে জামিনে রয়েছেন। প্রশ্ন হলো- বিচারক এমন কাজ কেন করবেন যে, তাকে ক্ষমা চাইতে হবে? রিমান্ড কখন কাকে কোন পরিস্থিতিতে দেয়া যায়, সেটা না জেনেই কি তারা বিচারক হয়েছেন? আদালতে বসে বিচারকরা ক্ষমা চাওয়ার মতো আর কী কী করেন?

চিত্রনায়িকা পরীমনিকে দ্বিতীয় ও তৃতীয় দফা রিমান্ডে পাঠানো নিম্ন আদালতের দুই বিচারক হাইকোর্টে ক্ষমা চেয়ে বলেছেন, তারা কাজটি করেছেন সরল বিশ্বাসে। দাবি করেছেন, ‘এটি অনিচ্ছাকৃত ভুল’।

প্রসঙ্গত, গত ৪ আগস্ট রাতে প্রায় চার ঘণ্টার অভিযান শেষে বনানীর বাসা থেকে পরীমনি ও তার সহযোগী দীপুকে আটক করে র‌্যাব। পরদিন মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ আইনে পরীমনি ও তার সহযোগীর বিরুদ্ধে বনানী থানায় মামলা করে আইনশৃঙ্খলারক্ষাকারী বাহিনী। এর পর ৩ দফায় মোট ৭ দিনের রিমান্ডে নেয়া হয় তাকে। কিন্তু বাসায় মাদক পাওয়া গেছে— এমন অভিযোগে দায়ের করা মামলায় একজন নারীকে পর পর তিন দফায় রিমান্ডে নেয়া যায় কি না— তা নিয়ে নানা মহলেই প্রশ্ন ওঠে। সোশ্যাল মিডিয়ায়ও বিষয়টির সমালোচনা শুরু হয়।

পরীমনি বর্তমানে জামিনে রয়েছেন। প্রশ্ন হলো- বিচারক এমন কাজ কেন করবেন যে, তাকে ক্ষমা চাইতে হবে? রিমান্ড কখন কাকে কোন পরিস্থিতিতে দেয়া যায়, সেটা না জেনেই কি তারা বিচারক হয়েছেন? আদালতে বসে বিচারকরা ক্ষমা চাওয়ার মতো আর কী কী করেন?

সরকারি কর্মচারীদের আত্মরক্ষার সবচেয়ে বড় অস্ত্রের নাম ‘সরল বিশ্বাসে কৃত অপরাধ’। যদি আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর কোনো সদস্য প্রকাশ্যে কোনো নাগরিককে গুলি করে এবং তার বিরুদ্ধে মামলা হয়, তাহলে তদন্ত রিপোর্টে উক্ত অপরাধকে ‘সরল বিশ্বাসে কৃত’ কিংবা ‘আত্মরক্ষার্থে পাল্টা গুলি’ বলে উল্লেখ করে অভিযুক্তকে দায়মুক্তি দেয়া সম্ভব।

মূলত সব আইনের শেষাংশে এই ‘সরল বিশ্বাসে কৃত অপরাধ’ বিষয়টি যুক্ত করে গণকর্মচারীদের সুরক্ষা দেয়া হয়। এমনকি নাগরিককে তথ্য দিতে বাধ্য করার বিধান ‘তথ্য অধিকার আইন’ও যদি কোনো কর্মকর্তা জেনে-বুঝে এবং অসৎ উদ্দেশ্যে লঙ্ঘন করেন, তারপরও তার এই কাজকে সরল বিশ্বাসে কৃত অপরাধ বলে প্রমাণ করা সম্ভব এবং অভিযুক্ত কর্মকর্তা আইনের এই ধারাবলে সুরক্ষা পেতে পারেন। যেহেতু সব আইনের খসড়া সরকারি কর্মকর্তারাই করেন, ফলে তারা আত্মরক্ষা ও সুরক্ষার জন্য একটি পথ সব সময়ই খোলা রাখেন। আইনের এই বিধানের সবচেয়ে বড় দুর্বলতা হলো, ‘সরল বিশ্বাস’ বলতে কী বোঝায়, তা আইনে সুস্পষ্ট নয়।

যে কারণে দুর্নীতি দমন কমিশনের সাবেক চেয়ারম্যান ইকবাল মাহমুদ একবার বলেছিলেন, ‘পেনাল কোড অনুযায়ী সরল বিশ্বাসে সরকারের কোনো কর্মচারী অপরাধ করলে সেটি অপরাধ নয়’। ওই সময়ে তার বক্তব্য নিয়ে সোশ্যাল মিডিয়ায় সমালোচনার ঝড় বইলেও আসলে এটি নতুন কিছু নয়। ইকবাল মাহমুদ একটি পুরোনো কথাই নতুন করে বলেছেন। তবে কোনো সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারী দুর্নীতি করলেও যে তিনি সরল বিশ্বাসে পার পেয়ে যাবেন— দুদক চেয়ারম্যান তা বলেননি।

বাস্তবতা হলো- যেকোনো আইন যতই শক্তিশালী হোক না কেন, সেখানে ‘সরল বিশ্বাসে কৃত অপরাধ’ বলে এই যে ধারাটি থাকে, সেখানে সরকারি কর্মচারীদের দায়মুক্তির সুযোগ এত বেশি থাকে যে, যেকেউ চাইলে এটির অপপ্রয়োগ করতেই পারেন।

হালের সবচেয়ে বিতর্কিত ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনেও এই সরল বিশ্বাসে কৃত অপরাধের বিধান যুক্ত আছে। ৫৭ ধারায় বলা হয়েছে, ‘এই আইনের অধীন দায়িত্ব পালনকালে সরল বিশ্বাসে কৃত কোনো কার্যের ফলে কোনো ব্যক্তি ক্ষতিগ্রস্ত হইলে বা ক্ষতিগ্রস্ত হইবার সম্ভাবনা থাকিলে, তজ্জন্য দায়িত্বপ্রাপ্ত কোনো কর্মচারী বা ব্যক্তির বিরুদ্ধে কোনো দেওয়ানি বা ফৌজদারি মামলা বা অন্য কোনো আইনগত কার্যক্রম গ্রহণ করা যাইবে না।’ অর্থাৎ বায়বীয় অভিযোগে পুলিশ যদি কারো বিরুদ্ধে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে মামলা নেয় এবং সংশ্লিষ্ট ব্যক্তি হয়রানির শিকার হন, তাতে পুলিশের বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নেয়া যাবে না। কারণ তিনি এটা প্রমাণ করে দেবেন যে, কাজটি তিনি সরল বিশ্বাসে করেছেন।

প্রশ্ন হলো, সরল বিশ্বাসের সংজ্ঞা কী এবং এটা কে ঠিক করবেন যে, সংশ্লিষ্ট ব্যক্তি কাজটি না বুঝে করেছেন? আইনে সরল বিশ্বাসের কোনো ব্যাখ্যা নেই। এটা নির্ভর করে যিনি ঘটনাটি তদন্ত করবেন এবং যিনি বিচার করবেন, তাদের ওপর। ফলে পুলিশ বা অন্য কোনো বাহিনীর সদস্য অথবা প্রজাতন্ত্রের অন্য যেকোনো পর্যায়ের কোনো কর্মচারী যদি কোনো নাগরিককে হয়রানি করেন, বিপদে ফেলেন, ফাঁসিয়ে দিয়ে পয়সা খান অথবা কোনো কর্মকর্তা-কর্মচারীর কারণে একজন নাগরিকের জীবন বিপন্ন হয়, তারপরও ওই কর্মকর্তা বা কর্মচারীকে সুরক্ষা দেয়ার বিধান আইনেই রয়েছে। বাস্তবতা হলো- আমাদের সব আইন সরকারি কর্মচারী এবং আইন প্রয়োগকারীদের সুরক্ষা দিতে যতটা আন্তরিক, নাগরিককে সুরক্ষা দিতে ততটা নয়।

এই বাস্তবতা মাথায় রেখেও এটি বলা যায় যে, জগতের সবাই ভুল করলেও বিচারক ভুল করবেন না; সবাই অন্যায় ও দুর্নীতির সঙ্গে যুক্ত হলেও বিচারকরা এর ঊর্ধ্বে থাকবেন— এটিই প্রত্যাশা। কিন্তু এই চাওয়া ও পাওয়ার মাঝখানে ব্যবধান যে বিস্তর, সেটি নানা সময়ে নানা ঘটনায় দৃশ্যমান হয়। সুতরাং বিচারকের ভুলকে ‘সরল বিশ্বাসে কৃত অপরাধ’ বলে গণ্য করার সুযোগ রয়েছে কি না— সে প্রশ্নও তোলা দরকার। কারণ তিনি বিচার করেন যুক্তি-তর্ক ও তথ্যপ্রমাণের ভিত্তিতে।

অন্য যেকোনো পেশার মানুষের ভুল আর বিচারকের ভুল এক জিনিস নয়। একজন বিচারক কোনো নিরপরাধ ব্যক্তিকে ফাঁসির দণ্ড দিয়ে বলতে পারেন না যে তিনি সরল বিশ্বাসে এই দণ্ড দিয়েছেন। বরং তাকে যুক্তি তর্ক ও তথ্যপ্রমাণের ভিত্তিতেই দণ্ড অথবা খালাস দিতে হয়।

এখানে আইনের বাইরে যাওয়ার সুযোগ নেই। সম্ভবত এ কারণেই পরীমনিকে রিমান্ড দেয়া ওই দুই বিচারকের ব্যাখ্যায় সন্তুষ্ট হতে পারেননি হাইকোর্ট। বরং উচ্চ আদালত মনে করছেন যে, তাদের ব্যাখ্যায় হাইকোর্টকে উল্টো হেয় করা হয়ছে। ফলে তাদের কাছে আবার ব্যাখ্যা চেয়ে আদেশের জন্য ২৯ সেপ্টেম্বর দিন ঠিক করা হয়েছে। দেখা যাক, ওইদিন দুই বিচারক আবার কী ব্যাখ্যা দেন এবং এর পরিপ্রেক্ষিতে হাইকোর্ট কী আদেশ দেন।

ঘটনাটি পরীমনির জামিন ইস্যুতে হলেও রিমান্ড নিয়ে নাগরিক সমাজ ও মানবাধিকারকর্মীদের উদ্বেগ ও প্রশ্ন অনেক পুরোনো। রিমান্ডে নেয়া কোনো ব্যক্তিকে নির্যাতনের বিরুদ্ধে সুস্পষ্ট আইন রয়েছে। এ ব্যাপারে উচ্চ আদালতেরও নির্দেশনা আছে। কিন্তু আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী সেই নির্দেশনা উপেক্ষা করে—এমন অভিযোগও ভুরি ভুরি।

রিমান্ডে নিয়ে আসামিদের সঙ্গে কী আচরণ করা হয়, তা মোটামুটি সবাই জানেন। না জানারও কোনো কারণ নেই। প্রভাবশালী রাজনীতিবিদদের অনেকেই রিমান্ডে নির্যাতনের বর্ণনা দিয়েছেন, সাক্ষাৎকার দিয়েছেন। কেউ কেউ এ নিয়ে বইপত্রও লিখেছেন। বিএনপি নেতা ব্যারিস্টার মওদুদ আহমদের একটি বইয়ের নাম ‘কারাগারে কেমন ছিলাম’। অধ্যাপক হারুন-অর-রশিদের একটা বইয়ের নাম ‘ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় আগস্টের ঘটনা গ্রেপ্তার রিমান্ড ও কারাগারের দিনগুলি’। অধ্যাপক ড. মো আনোয়ার হোসেনের বইয়ের নাম ‘কাঠগড়ায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় : রিমান্ড ও কারাগারের দিনলিপি’। এরকম আরও অনেকেই বই লিখেছেন।

সুতরাং রিমান্ডে কী হয়, সেটি কারো অজানা নয়। দেশের অত্যন্ত সম্মানজনক মানুষ ও প্রভাবশালী রাজনীতিবিদদেরও রিমান্ডে নিয়ে যে ভয়াবহ নির্যাতন করা হয়, সেটিও নতুন কোনো খবর নয়।

সন্দেহভাজন আসামি বা ব্যক্তিকে গ্রেপ্তার ও রিমান্ডে নেয়ার বিষয়ে ২০০৩ সালের ৭ এপ্রিল ১৫ দফা নির্দেশনাসহ একটি যুগান্তকারী রায় দেন হাইকোর্ট, যা ২০১৬ সালে বহাল রাখেন আপিল বিভাগও। রায়ে আসামি গ্রেপ্তারের বিষয়ে ফৌজদারি কার্যবিধির ৫৪ এবং রিমান্ডে নেয়ার বিষয়ে ১৬৭ ধারা সংশোধনের নির্দেশ দেয়া হয়েছিল; কিন্তু উল্লিখিত দুটি ধারা সংশোধন করে আপিল বিভাগের নির্দেশনা এখনও যুক্ত করা হয়নি।

ফলে পুলিশ নানা অজুহাতে আসামিদের রিমান্ডে নিয়ে নির্যাতন করছে; কখনও জোর করে আসামিকে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দিতে বাধ্য করছে। নির্যাতনে অনেক সময় আটক ব্যক্তির মৃত্যুও হচ্ছে। প্রশ্ন হলো- রিমান্ডে নির্যাতনের বিষয়ে সুপ্রিমকোর্টের নির্দেশনা যদি আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী অমান্য করে, তাহলে সেটি আদালত অবমাননার পর্যায়ে পড়ে কি না?

সুতরাং চিত্রনায়িকা পরীমনির ইস্যু নিয়ে যে আলোচনা ও বিতর্ক নতুন মাত্রা পেল, এবার এর একটি বিহিত হোক। রিমান্ড যে চাইলেই পাওয়া যায় না; যে কাউকে রিমান্ড দেয়া যায় না; রিমান্ডে যে কিছু নিয়ম-নীতি মেনে চলতে হয়; একজন অপরাধীকে রিমান্ডে নিলেও যে তার মানবাধিকারের বিষয়ে সচেতন থাকতে হয়— সে বিষয়টি সংশ্লিষ্টদের নতুন করে মনে করিয়ে দেয়া দরকার। সেসঙ্গে রিমান্ডে নিয়ে মারধর না করার শর্তে ভুক্তভোগী বা তার পরিবারের কাছ থেকে মোটা অঙ্কের টাকা হাতিয়ে নেয়ার বিষয়টি সবার জানা— সেটিরও অবসান হওয়া দরকার।

লেখক: সাংবাদিক, কলাম লেখক

এ বিভাগের আরো খবর