বাংলাদেশ

মতামত

খেলা

বিনোদন

জীবনযাপন

তারুণ্য

কিড জোন

অন্যান্য

রেস-জেন্ডার

ফ্যাক্ট চেক

স্বাস্থ্য

আন্তর্জাতিক

শিক্ষা

অর্থ-বাণিজ্য

বিজ্ঞান-প্রযুক্তি

বিশ্বব্যাংক ধোয়া তুলসী পাতা নয়

  • আবদুর রহিম হারমাছি   
  • ২০ সেপ্টেম্বর, ২০২১ ১৩:১৬

কোনো প্রকল্পে অর্থায়ন না করেই, ঋণের টাকা ছাড় না করেই মোড়লের মতো এই সংস্থার মাতব্বরি শুরু করে দেয়ার ঘটনা আমরা চোখের সামনে দেখতে পেয়েছি কবছর আগে। বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় অবকাঠামো প্রকল্প পদ্মা সেতুতে ঋণ দিতে চেয়েছিল সংস্থাটি; চুক্তিও করেছিল সরকারের সঙ্গে। কিন্তু অর্থ ছাড় না দিয়েই, প্রকল্পের কাজ শুরু না হতেই পদ্মা সেতু প্রকল্পে দুর্নীতি হয়েছে বলে কাল্পনিক অভিযোগ করে বসে সংস্থাটি। এই প্রকল্পে কোনো ধরনের দুর্নীতি হয়নি- বলে চ্যালেঞ্জ ছুড়ে দেয় বাংলাদেশ সরকার। বিষয়টি কানাডার আদালত অবধি গড়ায়। দেড় বছর ধরে চলা দীর্ঘ টানাপোড়েনের পর ২০১২ সালের ৩১ জানুয়ারি পদ্মা সেতুতে বিশ্বব্যাংকের ঋণ নেবে না বলে নিজস্ব অর্থে সেতুটি নির্মাণের ঘোষণা দেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।

দুর্নীতি মানে শুধু টাকা এ হাত-ও হাত করা নয়। দুর্নীতির মানে ক্ষমতার অপব্যবহার। ক্ষমতার অপব্যবহার করে তথ্য এ দিক-ও দিক করে কোনো রিপোর্ট বা প্রতিবেদন বিশ্বববাসীর কাছে তুলে ধরা কোন ধরনের দুর্নীতি- তা আমার জানা নেই। আর সেই প্রতিবেদনের কারণে যদি কোনো দেশের রাষ্ট্রপ্রধান ক্ষমতাচ্যুত হন বা পদত্যাগ করতে বাধ্য হন- তাহলে সেটা দুর্নীতির মধ্যে পড়বে কি না, সে বিষয়েও আমার কোনো ধারণা নেই।

কিন্তু, এই কাজটি যদি বিশ্ব আর্থিক খাতের মোড়ল সংস্থা বিশ্বব্যাংক করে থাকে তাহলে কিন্তু আমার কথা আছে। যে সংস্থাটি উঠতে-বসতে বাংলাদেশসহ তামাম দুনিয়ার মানুষকে দুর্নীতির বিরুদ্ধে সবক দেয়, আর্থিকসহ নানা খাতের স্বচ্ছতা-জবাবদিহি নিশ্চিত করার কথা বলে; তাদের কথামতো না চললে বা কাজ না করলে কোনো দেশকে ঋণ দেয় না। নানা শর্ত মেনে কোনো প্রকল্পে ঋণ দিলেও একটু এদিক-সেদিক হলেই সেই টাকা আবার ফেরত নিয়ে গিয়ে বিপদে ফেলে দেয়া হয় সেই দেশের সরকারকে; অনিশ্চিত হয়ে পড়ে প্রকল্পটির ভবিষৎ। উন্নয়নের ছোঁয়া থেকে বঞ্চিত হন সেই দেশ বা প্রকল্প এলাকার জনগণ।

শুধু কি তাই, কোনো প্রকল্পে অর্থায়ন না করেই, ঋণের টাকা ছাড় না করেই মোড়লের মতো এই সংস্থার মাতব্বরি শুরু করে দেয়ার ঘটনা আমরা চোখের সামনে দেখতে পেয়েছি কবছর আগে। বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় অবকাঠামো প্রকল্প পদ্মা সেতুতে ঋণ দিতে চেয়েছিল সংস্থাটি; চুক্তিও করেছিল সরকারের সঙ্গে। কিন্তু অর্থ ছাড় না দিয়েই, প্রকল্পের কাজ শুরু না হতেই পদ্মা সেতু প্রকল্পে দুর্নীতি হয়েছে বলে কাল্পনিক অভিযোগ করে বসে সংস্থাটি। এই প্রকল্পে কোনো ধরনের দুর্নীতি হয়নি- বলে চ্যালেঞ্জ ছুড়ে দেয় বাংলাদেশ সরকার। বিষয়টি কানাডার আদালত অবধি গড়ায়। দেড় বছর ধরে চলা দীর্ঘ টানাপোড়েনের পর ২০১২ সালের ৩১ জানুয়ারি পদ্মা সেতুতে বিশ্বব্যাংকের ঋণ নেবে না বলে নিজস্ব অর্থে সেতুটি নির্মাণের ঘোষণা দেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। বাকিটা ইতিহাস; সবারই জানা…!

এই তো আর কমাস! তারপরই স্বপ্নপূরণ। পদ্মা সেতুর ওপর দিয়ে বাস চলবে; চলবে ট্রেন। উন্নয়নের আরেক মহাসড়কে উঠবে বাংলাদেশ। জিডিপিতে যোগ হবে এক থেকে দেড় শতাংশ। দুই অঙ্কের (১০ শতাংশ) জিডিপিতে অগ্রসর হওয়ার পথে আরেক ধাপ এগিয়ে যাবে।

এরই মধ্যে থলের বিড়াল বের হতে শুরু করেছে। যে সংস্থার এত বড় কথা; কত মাতব্বরি- সেই বিশ্বব্যাংকের বিরুদ্ধেই এখন গুরুতর অনিয়মের অভিযোগ প্রমাণিত হয়েছে। আর সেই অভিযোগটি হচ্ছে, চিলির সমাজতান্ত্রিক সরকারের বদনাম করতে অনিয়মের আশ্রয় নিয়ে বিশ্বব্যাপী বহুল আলোচিত ‘ডুয়িং বিজনেস রিপোর্ট’ বা ‘ব্যবসা করার সূচক-বিষয়ক প্রতিবেদন’ তৈরি করেছিল বিশ্বব্যাংক।

ব্যবসা করার পরিবেশ কোথায় সবচেয়ে অনুকূল, এর নিরিখে ২০০৬ সাল থেকে প্রতিবছর বিশ্বের ১৯০ দেশের একটি তুলনামূলক তালিকা ও রিপোর্ট প্রকাশ করে আসছে বিশ্বব্যাংক। এ রিপোর্টকে ভিত্তি করেই বহু বিদেশি বিনিয়োগকারী কোন দেশে বিনিয়োগ করবে বা কোন দেশ থেকে সরে আসবে, সেই সিদ্ধান্ত নেয়। গুরুত্বপূর্ণ সেই প্রতিবেদন তৈরিতেই নানা অনিয়মের কথা স্বীকার করে এই রিপোর্ট আর না করার ঘোষণা দিয়েছে বিশ্বব্যাংক।

গত বছরের আগস্টে প্রথম অনিয়মের বিষয়টি টের পায় সংস্থাটি। এ কারণে ওই বছরের অক্টোবরে ‘ডুয়িং বিজনেস রিপোর্ট’ প্রকাশ করা হবে না বলে জানায় তারা। এ ছাড়া পাঁচটি প্রকাশিত রিপোর্টের তথ্যও ফরেনসিক অডিটরকে দিয়ে পরীক্ষা করানোর কথা বলা হয় সেসময়।

গত বৃহস্পতিবার এক আকস্মিক ঘোষণায় সংস্থাটি জানায়, ‘ডুয়িং বিজনেস রিপোর্ট’ আর দেয়া হবে না। যুক্তরাষ্ট্রের রাজধানী ওয়াশিংটন ডিসিতে অবস্থিত বিশ্বব্যাংকের সদর দপ্তর থেকে এই ঘোষণা দেয়া হয়। এ বিষয়ে নিজেদের ওয়েবসাইটে একটি বিবৃতিও দেয় সংস্থাটি।

প্রতিবছর বিশ্বব্যাংক গ্রুপের সহযোগী প্রতিষ্ঠান ইন্টারন্যাশনাল ফাইন্যান্স করপোরেশন (আইএফসি) বাংলাদেশসহ বিশ্বব্যাংকের সদস্য দেশগুলোর ডুয়িং বিজনেস রিপোর্ট তৈরি করে। ব্যবসা শুরু, বিদ্যুৎ-সংযোগ, সম্পত্তি নিবন্ধন, কর ব্যবস্থাসহ কয়েকটি নির্দেশক বা মানদণ্ডের প্রতিটির ওপর ১০০ নম্বরের মধ্যে প্রাপ্ত নম্বর গড় করে চূড়ান্ত স্কোর নির্ণয় করা হয়। স্কোরের ভিত্তিতে দেশগুলোর অবস্থানের তালিকা করা হয়।

২০১৪ সালে বিশ্বব্যাংকের ডুয়িং বিজনেস সূচকে চিলির অবস্থান ছিল ৩৪তম। ২০১৭ সালে এসে সেই চিলি পিছিয়ে চলে যায় ৫৫তম অবস্থানে। বিষয়টি ভালোভাবে নেননি চিলির তখনকার রাষ্ট্রপতি মিশেল বাশলে। ডুয়িং বিজনেস প্রতিবেদনের পদ্ধতিগত পরিবর্তন নিয়ে প্রশ্ন তোলেন তিনি। এর জেরে বিশ্বব্যাংকের এ সূচক তৈরির অনিয়ম প্রথম ধরা পড়ে।

ওয়াল স্ট্রিট জার্নালের এক প্রতিবেদনে বলা হয়, ২০১৪ সালে চিলি ৩৪তম অবস্থানে ছিল। ২০১৭ সালে তা পিছিয়ে ৫৫তম অবস্থানে নেমেছে। এরপর চিলির রাষ্ট্রপতি ডুয়িং বিজনেস প্রতিবেদনের পদ্ধতিগত পরিবর্তন নিয়ে প্রশ্ন তোলেন। চিলির কর্মকর্তারা বিশ্বব্যাংকের সমালোচনা করে বলেন, সংস্থাটি দক্ষিণ আমেরিকার দেশটির ক্ষেত্রে তাদের বার্ষিক ‘ডুয়িং বিজনেস’ প্রতিযোগিতামূলক র‍্যাঙ্কিংয়ে অন্যায় আচরণ করেছে।

২০১৪ সালে চিলির প্রেসিডেন্ট হন মিশেল বাশলে। এরপরে তার শাসনামলের পরবর্তী তিন বছরই ডুয়িং বিজনেস সূচকে চিলির অধঃপতন হয়। ২০১৫ সালে ৪১, ২০১৬ সালে ৪৮ ও ২০১৭ সালে ৫৫তম হয় চিলির অবস্থান।

চিলির প্রেসিডেন্টের অভিযোগের ভিত্তিতে বিষয়টি পর্যালোচনায় নেয়া হয়। পরে বিশ্বব্যাংকের সেসময়ের প্রধান অর্থনীতিবিদ পল রোমার অসংগতির কথা জানান। তার তথ্যানুযায়ী, বিশ্বব্যাংকের একজন সাবেক পরিচালক এমনভাবে জালিয়াতি করে ‘ইজ অফ ডুয়িং বিজনেস’ সূচক নির্ণয়ের পদ্ধতি তৈরি করেছিলেন, যাতে চিলির ক্ষমতাসীন সমাজতান্ত্রিক সরকারকে ক্ষমতাচ্যুত করা যায়।

পল রোমার প্রতিবেদনের পদ্ধতিতে পরিবর্তনের জন্য চিলির কাছে ক্ষমা চান। তিনি স্বীকার করেন বাশলের অধীন ব্যবসায়িক পরিবেশ সম্পর্কে ভুল ধারণা প্রকাশ করা হয়েছে। বিশ্বব্যাংকের এই র‌্যাঙ্কিং রাজনৈতিক প্রভাবযুক্ত। তথ্য সংগ্রহে পদ্ধতিগত পরিবর্তনের ফলে প্রতিবেদনে চিলির অবনমন হতে পারে।

সেসময় এ বিষয়ে ওয়াল স্ট্রিট জার্নালে বক্তব্য দেন পল রোমার। তিনি বলেন- ‘আমি চিলি এবং অন্য যেকোনো দেশে যেখানে আমরা ভুল ধারণা দিয়েছি, তাদের কাছে ব্যক্তিগতভাবে ক্ষমা চাই। আমার দায় রয়েছে। কারণ, আমরা বিষয়গুলো যথেষ্ট পরিষ্কার করিনি। বিশ্বব্যাংক অতীতের রিপোর্টগুলো সংশোধন করার পদ্ধতি শুরু করছে এবং পদ্ধতি পরিবর্তন না করে র‍্যাঙ্কিং কেমন হবে, তা পুনরায় প্রকাশ করবে।’

রোমার বলেন, সংশোধনগুলো চিলির জন্য বিশেষভাবে প্রাসঙ্গিক। কারণ, তাদের অবস্থান সাম্প্রতিক বছরগুলোতে অস্থিতিশীল ছিল। বিশ্বব্যাংকের কর্মীদের রাজনৈতিক প্রেরণার কারণে বিষয়টি কলঙ্কিত হয়েছে। কারণ, বিশ্বব্যাংকের এ প্রতিবেদন ব্যাপকভাবে আন্তর্জাতিক মিডিয়ায় কাভারেজ পায়। এমন মন্তব্য করায় পল রোমারকে পদত্যাগ করতে হয়।

প্রতিবেদনের পদ্ধতিগত পরিবর্তন করা সেই সাবেক পরিচালক ছিলেন অগাস্টো লোপেজ-ক্লারোস। চিলি বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক অধ্যাপক লোপেজ-ক্লারোস সে সময় বিশ্বব্যাংকের দায়িত্ব থেকে ছুটি নিয়ে জর্জটাউন বিশ্ববিদ্যালয়ে সিনিয়র ফেলো হিসেবে দায়িত্ব পালন করছিলেন। সে সময় তার ওই কাজের জন্য প্রেসিডেন্ট মিশেল বাশলে ব্যাপক সমালোচনার মুখে পড়েন।

২০১৮ সালে মার্চে দায়িত্ব থেকে সরে যান মিশেল বাশলে। সমাজতান্ত্রিক দল থেকে ক্ষমতা চলে যায় কনজারভেটিভ দলের কাছে। দায়িত্ব পান প্রেসিডেন্ট সেবাস্তিয়ান পিনেরা।

পল রোমারের ক্ষমা চাওয়ার পর ওই সময় এক টুইটে মিশেল বাশলে লেখেন, ‘বিশ্বব্যাংকের প্রতিযোগিতামূলক র‌্যাঙ্কিং তৈরিতে যা ঘটেছে, তা খুবই উদ্বেগজনক। আন্তর্জাতিক প্রতিষ্ঠানগুলো যে র‌্যাঙ্কিং পরিচালনা করে, তা নির্ভরযোগ্য হওয়া উচিত। কারণ, তারা বিনিয়োগ ও দেশগুলোর উন্নয়নে প্রভাব ফেলে।’ তিনি আরও বলেন, তার সরকার আনুষ্ঠানিকভাবে বিশ্বব্যাংকের কাছে সম্পূর্ণ তদন্তের অনুরোধ জানাবে।

গত বছরের আগস্টে বিশ্বব্যাংক জানায়, ২০১৭ ও ২০১৯ সালে প্রকাশিত প্রতিবেদনে তথ্য সংগ্রহে পদ্ধতিগত পরিবর্তনের ক্ষেত্রে অসংগতি থাকতে পারে, কিন্তু তা এখনও চিহ্নিত হয়নি। তাই প্রতিবেদন তৈরিতে তথ্য সংগ্রহে পদ্ধতিগত পরিবর্তন এবং অসংগতির কারণে যেসব দেশ অধিক প্রভাবিত হয়েছে, সেসব দেশের সঠিক তথ্য পর্যালোচনা করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে বিশ্বব্যাংক। আর এ কারণে গত বছরের অক্টোবরে ডুয়িং বিজনেস ইনডেক্স তৈরি স্থগিত করে তারা।

আর এরই ধারাবাহিকতায় বৃহস্পতিবার ঘোষণা দিয়ে এই রিপোর্ট আর না করার কথা জানিয়েছে সারাবিশ্বে ‘দাদাগিরি’ ফলিয়ে আসা বিশ্বব্যাংক। তাহলে, কী দাঁড়াল বিশ্বব্যাংকও ‘ধোয়া তুলসী পাতা’ নয়! তাদের বিরুদ্ধেও অনিয়মের অভিযোগ প্রমাণিত হয়। বিশ্বব্যাংকেও দুর্নীতি হয়!

লেখক: সিনিয়র সাংবাদিক, সাবেক ছাত্রনেতা।

এ বিভাগের আরো খবর