মহামারি করোনা পৃথিবীকে বদলে দিয়েছে। বাংলাদেশে করোনা আঘাত হেনেছে ১৮ মাসের বেশি। করোনা আঘাত হানার প্রথমদিকে দেশের সব অফিস-আদালত, কল-কারখানার সঙ্গে কিছু ব্যতিক্রম ছাড়া বন্ধ হয়ে যায় দেশের হাসপাতালগুলোও। এমনকি প্রাইভেট হাসপাতালের জরুরি বিভাগগুলোও বন্ধ ছিল কিছুদিন।
রোগীর স্বজনরা রোগীকে নিয়ে এক হাসপাতাল থেকে আরেক হাসপাতালে ছোটাছুটি করেছেন। কখনও ইমারজেন্সি খালি নেই, কখনও আইসিইউ খালি নেই- এসব অজুহাতে হাসপাতালগুলো রোগী ফিরিয়ে দিয়েছে। মানুষের জন্য সে সময়টা ছিল দুঃস্বপ্নের মতো। তবে করোনাকালে অনেক ঝুঁকি নিয়ে হলেও চিকিৎসকরাই এগিয়ে এসেছেন মানুষের পাশে। হাসপাতালগুলোও খুলেছে চিকিৎসার দ্বার।
আমাদের দুঃস্বপ্ন কি কেটে গেছে? অবস্থার কি ইতিবাচক পরিবর্তন হয়েছে? আসলে, করোনাকালে দেশের চিকিৎসাসেবার আসল চিত্রই ফুটে উঠেছে। গত দেড় বছরে আমাকে বহুবার একাধিক সরকারি-বেসরকারি হাসপাতালে আসা-যাওয়া করতে হয়েছে। একবছর আগে আমার শ্বশুর হঠাৎ অসুস্থ হয়ে গেলে তাকে নিকটস্থ এভার কেয়ার হাসপাতালে নিয়ে যাই। ইমারজেন্সির বাইরে থেকেই অক্সিমিটার দিয়ে তার অক্সিজেন পরীক্ষা করে বলা হলো- আইসিইউ খালি নেই। পরে অন্য হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয়েছে।
মাস খানেক আগে গিয়েছি ঢাকা মেডিক্যালে। ইমারজেন্সি বিভাগ থেকে শুরু করে হাসপাতালের ভেতরের করিডোরেও রোগীদের রাখা হয়েছে। সিট খালি নেই। সব সরকারি হাসপাতালেই মোটামুটি একই চিত্র।
মানুষের এই দুরবস্থার সুযোগ নিয়ে অনেক হাসপাতাল রমরমা ব্যবসা করছে। হাসপাতালে নেয়ার আগে আমাদেরকে ভাবতে হয় গলাকাটা বিলের কথা। জরুরি বিভাগে নেয়ার আগেও সাত-পাঁচ ভেবে পা ফেলতে হয়। এভাবে চিকিৎসার পেছনে গুনতে হচ্ছে মোটা অঙ্কের টাকা।
আমাদের ক্রমবর্ধমান চিকিৎসাব্যয় ও ক্রমহ্রাসমান প্রান্তিক মানুষের চিকিৎসাসেবা নিয়ে কারো কোনো মাথাব্যথা নেই। সরকারি হাসপাতালের সরকারি ফি না বাড়লেও ওষুধপথ্য ও অন্যান্য চিকিৎসা সরঞ্জামের দাম দিনকে দিন বেড়েই চলেছে। এছাড়া ভেজাল ওষুধে দেশ সয়লাব। করোনা ও ক্যানসারসহ নানা জটিল রোগের ভেজাল ওষুধও পাওয়া যায় মহল্লার দোকানে। নামিদামি ব্র্যান্ডের মোড়ক লাগিয়ে ওষুধ এখন তৈরি হচ্ছে দেশেই। ঢাকার মিটফোর্ড বা অন্যান্য এলাকা থেকে অনলাইনে দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলে হোম ডেলিভারি দেয়া হচ্ছে এসব ওষুধ। দেশে আসল ওষুধ শিল্পের বিকাশ হয়েছে সন্দেহ নেই। কিন্তু নকল ওষুধ তৈরি, সরবরাহ ও বিপণনেও অসাধু ব্যবসায়ীরা পিছিয়ে নেই।
দেশে নানা ক্ষেত্রে উন্নয়ন হচ্ছে এতে সন্দেহ নেই। অন্যান্য সেক্টরের মতো চিকিৎসা ক্ষেত্রেও অবকাঠামোগত উন্নয়ন চোখে পড়ার মতো। সম্ভাব্য ক্ষেত্রে সরকারি হাসপাতালগুলোর শয্যাসংখ্যাও বাড়ানো হচ্ছে। পাশাপাশি নতুন স্থাপনাও নির্মাণ হচ্ছে। ঢাকা মেডিক্যালের নতুন ভবন ও বার্ন ইউনিট সবার নজর কাড়ে। অন্যান্য হাসপাতালেও হয়তো শয্যাসংখ্যা বাড়ানো হতে পারে। কিন্তু প্রয়োজনের তুলনায় তা অপ্রতুল। কাজেই, বিদ্যমান হাসপাতালগুর শয্যাসংখ্যা বাড়ানোর পাশাপাশি নতুন হাসপাতাল প্রতিষ্ঠা করা জরুরি।
সংবিধান বলছে, রাষ্ট্র নাগরিকদের জন্য চিকিৎসার ব্যবস্থা করবে [১৫(ক)], জনস্বাস্থ্যের উন্নতিসাধনকে রাষ্ট্র তার প্রাথমিক কর্তব্য বলে গণ্য করবে [১৮(১)] । কিন্তু হাসপাতাল যদি রোগী ফিরিয়ে দেয়, ভেজাল ওষুধ খেয়ে যদি রোগীর ক্ষতি হয় তবে রাষ্ট্র কীভাবে তার কর্তব্য পালন করবে? জানি, রাষ্ট্রের পক্ষে এতকিছু করা সম্ভব নয়।
রাষ্ট্র হাসপাতাল তৈরি করে দিতে পারে, সেই হাসপাতাল পরিচালনা ও ব্যবস্থাপনার জন্য একটি কর্তৃপক্ষ নিয়োগ করে দিতে পারে, ওষুধ তৈরি ও বিপণনের নীতিমালা প্রণয়ন করে দিতে পারে। কিন্তু সেই হাসপাতালের ব্যবস্থাপনা কর্তৃপক্ষ যদি তাদের দায়িত্বে ও হিসাবের খাতায় নয়-ছয় করে তবে রাষ্ট্র বা সরকার তা কীভাবে তদারকি করবে? আমাদের হয়েছে, ‘সর্ব অঙ্গে ব্যথা, ওষুধ দেব কোথা’ অবস্থা। সে ওষুধেওতো ভেজাল। কুইনাইন জ্বর সারাবে, কুইনাইন সারাবে কে? সরকারকে হাসপাতালও তৈরি করতে হয়, জ্বর সারাতে হয় আবার কুইনাইনও সারাতে হয়। কাজেই সরকার বা রাষ্ট্রের এখন দাঁড়িপাল্লায় ব্যাং মাপার মতো অবস্থা দাঁড়িয়েছে। একটা ঠিক করে তো আর দুইটা বিগড়ে যায়।
দেশে অনেক হাসপাতাল ও মেডিক্যাল কলেজ হলেও সেগুলো এখনও স্বয়ংসম্পূর্ণ না বলেই মনে হয়। ঢাকার আশপাশের জেলাগুলোর সরকারি হাসপাতাল থেকেও রোগী পাঠিয়ে দেয়া হয় ঢাকা মেডিক্যালে। এমনকি বরিশাল, ফরিদপুর, রাজশাহী, রংপুর মেডিক্যাল থেকেও রোগীকে ঢাকা মেডিক্যালে রেফার করা হয়। পূর্ণাঙ্গ আইসিইউ-সেবা পর্যন্ত পাওয়া যায় না ওইসব হাসপাতালগুলোতে। কাজেই দেশের সব মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালগুলোকে আরও সমৃদ্ধ করা হোক, স্বয়ংসম্পূর্ণ করা হোক। শুধু প্রাথমিক চিকিৎসার জন্য মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতাল করা নয়।
এদিকে বেসরকারি হাসপাতালের চিকিৎসাব্যয় সাধারণ মানুষের নাগালের বাইরে। হাসপাতালে একবার ভর্তি হলে এর খরচ কোথায় গিয়ে ঠেকবে তা বলা মুশকিল। সাধ্যের মধ্যে না থাকায় চিকিৎসার মাঝপথেই অনেক রোগীকে স্বজনরা অন্য হাসপাতাল অথবা বাড়িতে নিয়ে যায়। প্রাইভেট হাসপাতালের চিকিৎসাব্যয় নিয়ে কথা বলার কেউ নেই।
দেশের স্বাস্থ্যসেবা নিয়ে বহুবার কোর্ট-কাচারি পর্যন্ত হয়েছে। কিন্তু অবস্থার কোনো উন্নতি হয়নি। সম্প্রতি হাসপাতাল থেকে রোগী ফিরিয়ে দেয়ার বিষয়টি নতুন করে হাইকোর্টের নজরে আনে বাংলাদেশে লিগ্যাল এইড অ্যান্ড সার্ভিসেস ট্রাস্ট (ব্লাস্ট)। হাইকোর্ট দেশের সব হাসপাতাল ও ক্লিনিকে জরুরি চিকিৎসাসেবা নিশ্চিত করার নির্দেশ দিয়েছেন। একজন রোগীকে জরুরিসেবা দেয়া যেকোনো হাসপাতালের মৌলিক ও নৈতিক দায়িত্ব। কিন্তু এটা যে সব সম্ভবের দেশ!
এই সম্ভবের (জরুরি চিকিৎসাসেবা না দেয়া) বিরুদ্ধে ব্লাস্ট রিট করলে হাইকোর্ট গত রোববার সব হাসপাতাল ও ক্লিনিকে জরুরি চিকিৎসাসেবা নিশ্চিত করার নির্দেশ দেন। আদেশে আরও বলা হয়- ‘কোনো অসুস্থ ব্যক্তিকে যখনই হাসপাতাল বা ক্লিনিক অথবা চিকিৎসকের কাছে আনা হয়, ওই অসুস্থ ব্যক্তির তাৎক্ষণিক জরুরি স্বাস্থ্যসেবা প্রদানে সংশ্লিষ্ট হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ অসম্মতি জ্ঞাপন করতে পারবে না।
ব্লাস্টের ওই রিটের রুলে আদালত আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ আদেশ দিয়েছেন। বেসরকারি হাসপাতাল বা ক্লিনিকের নতুন লাইসেন্স ইস্যু করার সময় ও লাইসেন্স নবায়ন করার সময় জরুরি স্বাস্থ্যসেবা বিভাগ থাকতে হবে শর্ত যুক্ত করে দিতে কেন নির্দেশনা দেয়া হবে না, তা জানতে চেয়েছে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষকের কাছে। সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের রুলের জবাবের ওপর ভিত্তি করে আদালত তার পরবর্তী আদেশ দেবেন। জরুরি স্বাস্থ্যসেবা বিভাগ থাকা হাসপাতাল বা ক্লিনিক প্রতিষ্ঠার জন্য বাধ্যতামূলক করাই যুক্তিসংগত।
এছাড়া আদালত দেশের স্বাস্থ্যসেবার সার্বিক চিত্রও প্রতিবেদন আকারে জানতে চেয়েছে। আমরা আদালতের চূড়ান্ত আদেশ ও এর বাস্তবায়নের অপেক্ষায় রইলাম। কিন্তু বাস্তবতা হচ্ছে, সরকারি প্রতিবেদন ও বাস্তবতা সব সময় এক হয় না। প্রতিবেদন তৈরি করা হয় ডাটাবেজের ওপর ভিত্তি করে আর চিকিৎসা দেয়া একটি মানবিক ও ম্যানুয়াল কাজ। সরকারি হাসপাতালগুলোতে অনেক সুযোগ-সুবিধাই আছে, কিন্তু সেগুলো অচল হয়ে পড়ে আছে। দক্ষ জনবলের অভাবে অনেক দামি মেশিনই অকেজো হয়ে পড়ে আছে অথবা ইচ্ছা করেই সেগুলো কাজে লাগানো হচ্ছে না। গণমাধ্যমে এ খবর আমরা দেখতে পাই।
ফলে রোগী বাধ্য হয়েই বিভিন্ন টেস্টের জন্য প্রাইভেট ল্যাবরেটরিতে যায়। এর সঙ্গে হাসপাতাল প্রশাসনের কোনো যোগসাজস আছে কি না নাকি বিষয়টি নিতান্তই অবহেলাজনিত তা খতিয়ে দেখা দরকার। উচ্চমূল্যে মেশিন প্রকিউর করে কেন তা আজীবন অন্ধকার প্রকোষ্ঠে ফেলে রাখা হয় তা-ও খতিয়ে দেখতে হবে।
স্বাস্থ্য নিয়ে গত দেড় বছরে সংসদ ও সংসদের বাইরে আলোচনা-সমালোচনা কম হয়নি। ১৫ সেপ্টেম্বরও সংসদে Medical Collegues (Governing Bodies) (Repeal) Bill 2021 বাছাই কমিটিতে পাঠানো ও বিলটির ওপর সংশোধনী প্রস্তাবের ওপর আলোচনাকালে দেশের স্বাস্থ্য ব্যবস্থা নিয়ে আলোচনা হয়।
আলোচনায় সংসদ সদস্য বলেন-‘আমরা এখন পর্যন্ত সরকারি হাসপাতাল এবং বেসরকারি হাসপাতালের মধ্যে কোনো পার্থক্য করতে পারিনি। যারা আজকে সরকারি হাসপাতালে কর্মরত তারাই আজকে বেসরকারি হাসপাতালের ব্যবসা করছে।’ কাজেই, সরকারি হাসপাতালের নাম, পদবি ব্যবহার করে বেসরকারি হাসপাতালেই বেশি সেবা দেয়া একটি ব্যাধি। ডাক্তারদের এই ব্যাধি দূর করতে হবে।
প্রাইভেট প্রাকটিস বন্ধ করার মতো অবস্থা বাংলাদেশের এখনও হয়নি। তাতে সাধারণ মানুষই ক্ষতিগ্রস্ত হবে। পাবলিক প্রাকটিস (সরকারি হাসপাতালের সেবা) ও প্রাইভেট প্রাকটিসের মধ্যে সমন্বয়ের কাজটি ডাক্তারদেরই করতে হবে।
সংবিধান সরকারি কর্মচারীদের রাষ্ট্রের সেবক হিসেবে আখ্যায়িত করেছে। রাষ্ট্রের সেবকের চেয়ে বড় কোনো পদবি আর কী হতে পারে! সরকারি ডাক্তাররাও তাই। অন্য সবাই এই পদ ও দায়িত্বের অবমূল্যায়ন করলেও ডাক্তারদের মতো মানবিক পেশায় নিয়োজিতদের কাছে মানবসেবাই বড় কথা। তারা সেটি করছেনও।
আসলে দেশের স্বাস্থ্যসেবা নিয়ে আমাদের একটি পূর্ণাঙ্গ পরিকল্পনা চাই। সমস্যা হলে তা নিয়ে বিচ্ছিন্ন ভাবনা সমস্যার স্থায়ী সমাধান দিত পারে না। আমাদের স্বাস্থ্যসেবার অব্যবস্থাপনা ও অনিয়ম দেখার কেউ নেই, কথা বলার কেউ নেই। পৃথিবীর অনেক দেশেই স্বাস্থ্যসেবা রেগুলেটরি কমিশন আছে। আমাদের দেশেও একটি স্বাস্থ্যসেবা রেগুলেটরি কমিশন হতে পারে। যদিও আমাদের দেশে অনেক কমিশনই আছে। কমিশনের কার্যকারিতাই মূল কথা।
গত বুধবার সংসদে স্বাস্থ্যসেবা নিয়ে আলোচনা-সমালোচনা হলে স্বাস্থ্যমন্ত্রী জাহিদ মালেক বলেন, সমালোচনা আমাকে শক্তিশালী করে। তা করুক। স্বাস্থ্যমন্ত্রী শক্তিশালী হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে দেশের স্বাস্থ্যসেবাও যদি শক্তিশালী হয় তবে সেটিই কাম্য।
লেখক: আইনজীবী ও কলাম লেখক