বাংলাদেশ

মতামত

খেলা

বিনোদন

জীবনযাপন

তারুণ্য

কিড জোন

অন্যান্য

রেস-জেন্ডার

ফ্যাক্ট চেক

স্বাস্থ্য

আন্তর্জাতিক

শিক্ষা

অর্থ-বাণিজ্য

বিজ্ঞান-প্রযুক্তি

নারীর প্রতি সহিংসতা বন্ধ হোক

  • মেহেরাবুল ইসলাম সৌদিপ   
  • ১৬ সেপ্টেম্বর, ২০২১ ১৩:১৭

নারী যেমন ঘর-সন্তান সামলায়, রান্নাবান্না, সাজগোজ এবং স্বামীসেবা করে। এই নারীই আবার শ্রমজীবী হয়ে ইট ভাঙে, অফিসে ছোটে। তাদের প্রতি অন্যায়-অবিচার, অনধিকার, অস্বীকার, প্রতিটি কাজে দোষারোপ করার মতো কাজগুলো আমরা ছোট করেই দেখছি। এছাড়া স্ত্রী নির্যাতনের বিষয়টিকে আমাদের সমাজ স্বাভাবিক ঘটনা হিসেবেই ধরে নেয়।

নারী- মা, বোন, অর্ধাঙ্গিনী আরও অনেক পরিচয় বহনকারী এ মানুষগুলো আমাদের সমাজের নানা ক্ষেত্রে নিপীড়িত, অবহেলিত। পরিবার ও কর্মক্ষেত্রে নারীর এগিয়ে যাওয়া, গতিশীলতা, অর্থনৈতিক সম্পৃক্ততা ও দৃশ্যমান ভূমিকা থাকার পরও নারী নির্যাতন কমছে না বরং নির্যাতনের ধরন বদলাচ্ছে।

জীবনযাত্রার মানোন্নয়নের পাশাপাশি দিনে দিনে মানবসমাজে নতুন অপরাধের সংখ্যা বেড়ে চলেছে। যার অন্যতম উদাহরণ ‘নারীর প্রতি সহিংসতা’ বা নারী নির্যাতন। বর্তমানে ধর্ষণ ও পারিবারিক নির্যাতন ভয়ংকর অবস্থায় পৌঁছে গেছে। বিশেষ করে নারী নির্যাতনের মতো ঘটনা ইদানীং ব্যাপক আকারে বেড়েছে। এ নিয়ে সামাজিক সচেতনতা বৃদ্ধি ও কঠোর প্রতিরোধ গড়ে তুলতে না পারলে এর কোনো প্রতিকার হবে না।

সমাজে নারীদের প্রতিনিয়ত শারীরিক ও মানসিকভাবে অপদস্ত হতে হচ্ছে। প্রাচীন আমলের বিভিন্ন সামাজিকপ্রথা, কুসংস্কার এমনকি লোকলজ্জার ভয় কাটিয়ে নারী এখন পুরুষের পাশাপাশি পথ চলতে শুরু করেছে। কিন্তু এসময়ে এসেও পথেঘাটে, বাস-ট্রেনে এমনকি বাসা, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বা কর্মস্থলেও নারীরা ব্যাপকহারে নির্যাতিত হচ্ছে।

যৌতুক, বাল্যবিবাহ, বহুবিবাহ, ধর্ষণ, হত্যাকসহ এমন নারী সহিংসতার ঘটনা নিত্যদিনের। নারীরা রাজনৈতিক সহিংসতারও শিকার হচ্ছে। অধিকাংশ ক্ষেত্রে পারিবারেই তারা সহিংসতার মুখোমুখি হয়। নারীদের বিরুদ্ধে সহিংসতা যেন স্বাভাবিক ঘটনা।

নারীর ওপর পুরুষের অবিরাম ক্ষমতার অপব্যবহারের ফলে সম্প্রতি এই নির্যাতনের ঘটনা বেড়ে চলেছে বলে সংশ্লিষ্টরা মনে করেন। প্রতিদিন দেশের কোনো না কোনো স্থান থেকে ধর্ষণের খবর পাওয়া যায়। প্রতিদিন পত্রিকা খুললেই পাওয়া যায় একাধিক ধর্ষণ ও নারী নির্যাতনের খবর। পৃথিবীব্যাপী এসব সহিংসতার শিকার হয়ে প্রতি বছর অসংখ্য নারীর মৃত্যু হচ্ছে।

নারী যেমন ঘর-সন্তান সামলায়, রান্নাবান্না, সাজগোজ এবং স্বামীসেবা করে। এই নারীই আবার শ্রমজীবী হয়ে ইট ভাঙে, অফিসে ছোটে। তাদের প্রতি অন্যায়-অবিচার, অনধিকার, অস্বীকার, প্রতিটি কাজে দোষারোপ করার মতো কাজগুলো আমরা ছোট করেই দেখছি।

এছাড়া স্ত্রী নির্যাতনের বিষয়টিকে আমাদের সমাজ স্বাভাবিক ঘটনা হিসেবেই ধরে নেয়। এসব ঘটনার পাশাপাশি আবার যৌতুকপ্রথাকে প্রতিষ্ঠিত করছে একটি স্বার্থান্বেষী মহল। যা নির্যাতনের মাত্রা আরও একধাপ বাড়িয়ে দিয়েছে। তবে নারীর অবস্থার যে পরিবর্তন হচ্ছে না- এর দায় নারীরও কিছু রয়েছে। এখন ঘরে ঘরে অশান্তি, আত্মহত্যা, ডিভোর্স যেন লেগেই আছে। নারী সমাজকে এই হীন পরিস্থিতি থেকে রক্ষায় সোচ্চার নারীবাদীরা। প্রণিত হয়েছে নানা আইনও। তবু নারীর দুর্দশা থেকে মুক্তি মিলছে না।

করোনাকালে নারীর প্রতি সহিংসতা যেন বেড়েছে আগের থেকে বেশি। সমাজ-রাষ্ট্র তো নয়ই, পরিবারও নির্যাতনের শিকার নারীর পাশে দাঁড়ায় না। অনেক ক্ষেত্রে অভিযুক্ত ব্যক্তি প্রভাবশালী হলে তার বিরুদ্ধে যথাযথ আইন প্রয়োগ করা হয় না। এ সংস্কৃতি অপরাধপ্রবণতা বাড়িয়ে দিচ্ছে। আবার আইন প্রয়োগকারী সংস্থাসহ সংশ্লিষ্টরা করোনা মোকাবিলায় ব্যস্ত হওয়ায় নারী নির্যাতনের বিষয়ে মনোযোগ হারাচ্ছে।

করোনাকাকালে যৌন সহিংসতা, পারিবারিক কলহ, শারীরিক নির্যাতন, হত্যা, যৌতুকের জন্য অত্যাচার, বিকৃত যৌনতার মতো নির্যাতনগুলো ভিন্নরূপে আবির্ভূত হয়।

নারী নির্যাতনের সংখ্যা, ধরন যে দিন দিন বেড়ে চলছে পরিসংখ্যান ঘাটলে তা স্পষ্ট হয়ে যায়। বাংলাদেশ মহিলা পরিষদের দেয়া তথ্যমতে, শুধু ২০২০ সালে দেশে ১৩৪৬ কন্যাশিশু ও নারী ধর্ষণের ঘটনাসহ মোট ৩৪৪০টি নারী নির্যাতনের ঘটনা ঘটেছে। পরিষদটির লিগ্যাল এইড উপ-পরিষদে সংরক্ষিত ১৩টি দৈনিক পত্রিকায় প্রকাশিত সংবাদের ভিত্তিতে ২০২০ সালে নারী ও শিশু নির্যাতনের এই তালিকা তৈরি করা হয়। এর মধ্যে ১০৭৪টি ধর্ষণ, ২৩৬টি গণধর্ষণ ও ৩৩টি ধর্ষণের পর হত্যা ও ৩টি ধর্ষণের কারণে আত্মহত্যাসহ মোট ১৩৪৬ জন নারী ও কন্যাশিশু ধর্ষণের শিকার হয়। এছাড়া ২০০ জনকে ধর্ষণের চেষ্টা, শ্লীলতাহানির শিকার ৪৩ সহ ৭৪ জন যৌন নিপীড়নের শিকার হয়। অ্যাসিড দগ্ধের শিকার ২৫ জন। এর মধ্যে অ্যাসিডে দগ্ধের কারণে মৃত্যু ৪টি।

তাছাড়া অগ্নিদগ্ধের শিকার ২৯ জন, যার মধ্যে ১৩ জনের মৃত্যু ঘটে। অপরদিকে উত্ত্যক্তের শিকার হয় ৫৯ জন। অপহরণের ঘটনা ঘটেছে মোট ১২৫টি। পাচারের শিকার ১০১, এর মধ্যে পতিতালয়ে বিক্রি হয়েছে ৪ জন।

বিভিন্ন কারণে ৪৬৮ জন নারী ও শিশুকে হত্যা করা হয়। এছাড়াও ৩৫ জন শিকার হয় হত্যাচেষ্টার। যৌতুকের কারণে নির্যাতিত ১১৭ জন, যার মধ্যে ৫২ জন হত্যার শিকার। শারীরিক নির্যাতনের শিকার ১৫৯ জন। তাছাড়াও বিভিন্নভাবে নির্যাতনের শিকার ১৬৪ জন। ২৫২ জন নারী ও কন্যাশিশুর রহস্যজনক মৃত্যু হয়।

বাল্যবিবাহ-সংক্রান্ত ঘটনা ঘটেছে ১১৭টি। পাশাপাশি সাইবার ক্রাইম অপরাধের শিকার হয় ৪৩ জন নারী। এ পরিসংখ্যান থেকে বোঝা যায়, সমাজ ও রাষ্ট্রের প্রতিটি ক্ষেত্রে রয়েছে নারীদের প্রতি নৃশংসতার চিহ্ন।

এই অসহায়, নির্যাতিত নারী ও শিশুদেরকে সমাজে অসতী বা খারাপ গণ্য করে ধিক্কার দিচ্ছে সমাজপতিরা। অপরদিকে ধর্ষণ বা নির্যাতনকারীরা আইনের ফাঁক দিয়ে বেরিয়ে যাচ্ছে। প্রেম প্রত্যাখ্যান, কু-প্রস্তাবে রাজি না হওয়া, স্বামীকে পরবর্তী বিয়েতে অনুমতি না দেয়ায় নৃশংসভাবে হত্যা করাসহ অনেক নারী বিনা অপরাধে শারীরিক ও মানসিক শাস্তি ভোগ করে।

নেপোলিয়ন বলেছিলেন, ‘‘আমাকে একজন শিক্ষিত মা দাও, আমি তোমাদের একটি শিক্ষিত জাতি দেব।’’ বিদ্রোহী কবি নজরুল ইসলাম বলেছেন- ‘‘সাম্যের গান গাই, আমার চক্ষে পুরুষ রমণী কোন ভেদাভেদ নাই।’’ ‘‘বিশ্বে যা কিছু মহান সৃষ্টি চির কল্যাণকর, অর্ধেক তার করিয়াছে নারী, অর্ধেক তার নর। বিশ্বে যা কিছু এল পাপ-তাপ, বেদনা অশ্রুবারি, অর্ধেক তার আনিয়াছে নর, অর্ধেক তার নারী।’’

অনেকক্ষেত্রে নারীরা সমাজে পশ্চাৎপদ এবং পুরুষের তুলনায় নিম্নস্তরের এ বিষয়ে বিভ্রান্তিকর চিন্তাধারায় তাদের মন আচ্ছন্ন থাকে। তবে এ কথাও সত্য যে, বিভিন্নভাবে তাদেরকে পিছিয়ে রাখার আপ্রাণ চেষ্টা চলে। এজন্য শুধু পুরুষ নয়, পুরুষতান্ত্রিকতায় আক্রান্ত নারীরাও দায়ী। যুগ যুগ ধরে নারীদের মনে যে ধারণা সৃষ্টি হয়, তা হলো- সামাজিক ও রাজনৈতিক কাজ নারীদের জন্য নয়। এখনও এ ধারণা বদ্ধমূল রাখার চেষ্টা চলে যে, নারীরা ঘরের বাইরে গেলে তাদের পারিবারিক ও সামাজিক জীবন নষ্ট হয়।

মেয়েদের প্রতি এ ধারণাকে কিছু প্রচার মাধ্যম যেমন- নাটক, চলচ্চিত্র, গল্প, উপন্যাস আরও দৃঢ়মূল করে।

আমাদের সমাজে নারীদের একসময় বোঝা হিসেবে গণ্য করা হতো। এমনকি নারী বেচাকেনার মতো ঘটনাও ঘটে। আর সেই পন্থারই আধুনিকায়ন করে পতিতালয়ের সৃষ্টি।

নারীদের ওপর সহিংসতার আরেকটি কারণ হলো- সমাজের নেতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গি। বিদ্যমান সমাজ ব্যবস্থায় সহিংসতার শিকার অনেক নারী চাইলেও আইনের আশ্রয় নিতে পারে না বরং পরিবার ও সন্তানের কথা ভেবে সহ্য করতে বাধ্য হয়।

বছরের পর বছর নারীর প্রতি নির্যাতন প্রতিরোধ নিয়ে আন্দোলন করেও এর সমাধান মিলছে না। অতীতে মানুষের মধ্যে এত সচেতনতা ছিল না। তখন নারী নির্যাতন যে একটা অপরাধ সেটা হয়ত অনেকে জানত না। এখন সময় পাল্টাচ্ছে। শিক্ষা-দীক্ষায় এগিয়েছে মানুষ। সচেতনতা সৃষ্টি হচ্ছে সব ক্ষেত্রে। কিন্তু নারী নির্যাতনের মতো একটি মারাত্মক স্পর্শকাতর বিষয়ে তেমন সচেতনতা সৃষ্টি হয়নি।

নারী সহিংসতা রোধে আছে আইন, বিভিন্ন ধরনের আন্তর্জাতিক চুক্তি। কিন্তু এগুলোর তেমন কোনো বাস্তবায়ন নেই। এসব আইন সম্পর্কে সাধারণ মানুষও সচেতন নয়। নারী নির্যাতন প্রতিরোধে তাই প্রয়োজন দৃষ্টিভঙ্গির পরিবর্তন। সহিংসতা রোধে প্রচলিত আইনের প্রয়োগ নিশ্চিত করতে হবে। এক্ষেত্রে পরিবার ও সমাজকে এগিয়ে আসতে হবে। পাশাপাশি নারীদেরও সোচ্চার হতে হবে। কথা বলতে হবে নিজ অধিকার আদায়ে।

এ সমস্যা মোকাবিলায় নারীর ক্ষমতায়নের ওপর জোর দেয়া দরকার। উন্নত আইনব্যবস্থা, সামাজিক রীতিনীতি বদল ও স্বাস্থ্য সচেতনতা বৃদ্ধির দিক থেকে পুরুষেরও এগিয়ে আসা দরকার। নারী নির্যাতন প্রতিরোধের দায়িত্ব শুধু পত্রপত্রিকায় সংবাদ প্রকাশ ও সামাজিক সংগঠনগুলোর প্রতিবাদ সমাবেশই নয় বরং ব্যক্তি, সমাজ ও সরকারের মূল দায়িত্বটা পালন করা জরুরি।

লেখক: সাংবাদিক

এ বিভাগের আরো খবর