বেশ কবছর আগের কথা। কানাডাপ্রবাসী আমার এক বন্ধু আক্ষেপ করে বলেছিলেন- অদ্ভুত আমাদের দেশ! গিয়েছিলাম জাদুঘরে। কটি গুরুত্বপূর্ণ প্রদর্শনীর ছবি তুলে নিয়ে যাব। কানাডায় আমার স্কুলের শিক্ষার্থীদের দেখাব। কিন্তু জাদুঘর গ্যালারির দায়িত্বে যারা ছিল, জানিয়ে দিল ছবি তোলা মানা। আমি জানতে চাইলাম কেন? কোনো উত্তর নেই। শুধু বিধিবদ্ধ নিয়মের কথা বললেন।
আমি হাসতে হাসতে ক্ষুব্ধ বন্ধুকে বললাম, দেশকে অদ্ভুত বলে লাভ নেই। দেশ ঠিকই আছে। কিন্তু এদেশে রয়েছে কিছু সংখ্যক অদ্ভুত মানুষ ও নীতিনির্ধারক। সঠিক কারণ ব্যাখ্যা না করতে পারলেও গৎবাঁধা নিয়মের দোহাই দিয়ে বিধি আরোপ করে। আমিও জাদুঘরে গিয়ে এই প্রশ্নের উত্তর পাইনি। এই অলিখিত নিয়ম চালু আছে দেশের অনেক প্রত্নস্থলেও।
জাদুঘরগুলোতে গেলে প্রত্নবস্তুর ছবি তুলতে বাধা দেয়া হয় কেন! এখন স্যাটেলাইটের যুগ। মহাকাশ ফটোগ্রাফি হচ্ছে। ঘরে বসে পৃথিবীর তাবৎ ছবি চলে আসছে। নেট থেকে নামানো যাচ্ছে হাজারও ছবি। আর জাদুঘরে গেলে বলছে ছবি তোলা নিষেধ।
প্রায় দুযুগ আগে ছাত্রছাত্রীদের নিয়ে গিয়েছিলাম ময়নামতিতে। তখনও স্মার্ট ফোন আসেনি। সাধারণ মোবাইল ফোন। ময়নামতি সেনানিবাসের ভেতর কটি প্রত্নক্ষেত্র আছে। কর্তৃপক্ষের কাছ থেকে আগেই অনুমতি নিয়েছিলাম। সেনানিবাসে ঢোকার গেইটে বলা হলো সবার মোবাইল, ক্যামেরা ইত্যাদি জমা দিতে হবে। ছবি তোলা নিষেধ। আমরা একটু হতাশ হলাম। কারণ বিশ্ববিদ্যালয়ে গিয়ে ওদের রিপোর্ট লিখতে হবে। এই সফর ছিল ওদের মাঠকর্মের অংশ। ছবি বেশ জরুরি।
আমরা বোঝাতে ব্যর্থ হলাম। আমাদের সঙ্গে দুজন সৈন্য দেয়া হলো পাহারায়। ত্রিরত্নমুড়া ও ভোজবিহারের কাছে এসে বুঝলাম না ছবি তোলায় নিষেধাজ্ঞা কেন! বিচ্ছিন্ন এলাকায় প্রত্নক্ষেত্র। এমন নয় যে, সেনাবাহিনীর স্পর্শকাতর কোনো কিছুর ছবি তুলে ফেলা হতে পারে। তাছাড়া সঙ্গে তো পাহারাদার আছেই। যাহোক, শুধু চর্মচক্ষে দেখেই ফিরতে হলো।
বিশ্ববিদ্যালয়ে ফেরার পর একদিন কজন ছাত্র এলো। হাতে ভোজবিহার ও ত্রিরত্নমুড়ার ছবি। একজন ঠিকই সবার চোখ এড়িয়ে ছবি তুলেছে। আমি যদিও নিয়ম ভাঙার জন্য বকাঝকা করলাম। পরে ভাবলাম ওদের কীইবা করার ছিল! এই ছবি তো ওদের রিপোর্টের জরুরি অনুষঙ্গ। এমন ভাবনাও এলো যে, এতসব নিয়মের মধ্যে থেকেও দেখছি ইচ্ছা করলে দিব্বি ছবি তোলা সম্ভব। তাহলে এত রাখঢাক কেন?
আমি ইউরোপের বিভিন্ন জাদুঘরে গিয়ে অবাক! জাদুঘরের ভেতর ছবি তোলায় কোথাও কোনো বিধিনিষেধ দেখলাম না। প্যারিসের বিশ্বখ্যাত ল্যুভ মিউজিয়ামে শত শত ছবি তুলেছি। কেউ বাধা দেয়নি। ইতালির দুয়েকটি মিউজিয়ামে কোনো কোনো গ্যালারিতে শুধু ফ্লাশ ব্যবহার করতে নিষেধ করেছে। কারণ ফ্লাশের আলোতে স্পর্শকাতর প্রত্নবস্তুর ক্ষতি হতে পারে।
১৯৯১-৯২ সালে গবেষণার প্রয়োজনে কলকাতাস্থ জাতীয় লাইব্রেরি ব্যবহার করেছিলাম। সেখানে দরকারি অনেক দুষ্প্রাপ্য বই আছে। আমার প্রয়োজন গোটা বই। লাইব্রেরিতে রিকুইজিশন দিয়ে ফটোকপি করা যায়। কিন্তু গোটা বই নয়। হয়ত কপিরাইট আইনে বাধা আছে। কিন্তু সময়ের বিবর্তনে তেমন অনেক বই নেটে পাওয়া যাচ্ছে এখন। ডাউনলোড করে প্রিন্ট করা যাচ্ছে ঘরে বসেই। জানি না এখনও ভারতীয় ন্যাশনাল লাইব্রেরিতে আগের বিধিনিষেধ রয়ে গেছে কি না। তবে আমাদের জাদুঘরে প্রত্নবস্তুর ছবি তোলায় রয়েই গেছে।
পর্তুগালের লিসবনের এভোরা বিশ্ববিদ্যালয়ে সংরক্ষিত আছে দুটো মূল্যবান পাণ্ডুলিপি। আঠারো শতকে (১৭৪৩ সালে) বাংলাদেশে আসা পর্তুগিজ পাদ্রি ফ্রান্সিসকো দ্য সিলভা পর্তুগিজ ভাষায় বাংলা ব্যাকরণ লিখেছিলেন। আর লেখা হয়েছিল বাংলা ভাষার কিছু শব্দার্থের বই। আমরা সাধারণভাবে জানি ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের আগে উনিশ শতকের শুরুতে স্যার উইলিয়াম কেরি প্রথম বাংলা ব্যাকরণ লিখেছিলেন। আমি অস্পষ্টভাবে এই পর্তুগিজ পাদ্রির ব্যাকরণ পাণ্ডুলিপির কথা জেনেছিলাম।
২০১৬ সালের মেতে দেখলাম, লিসবনে বাংলাদেশ দূতাবাসের এম্বেসেডর নির্ধারিত ফি দিয়ে এই পাণ্ডুলিপির সফট কপি সংগ্রহ করেছেন। কটি কপি প্রিন্ট করেছেন। আমাকে জানিয়েছেন দেশে ফিরে বাংলা একাডেমিকে এক কপি দেবেন। যদি অনুবাদ করে প্রকাশ করা যায়। অর্থাৎ এই মূল্যবান পাণ্ডুলিপির সফট কপি সংগ্রহ করা ওসব দেশে কঠিন কিছু নয়। যত নিয়মের গ্যাঁড়াকল আমাদের দেশে। এসব কারণে সাধারণ জ্ঞান অন্বেষী কৌতূহলী মানুষের ঐতিহ্য অনুসন্ধান করা অনেক ক্ষেত্রেই সংকটের কারণ হয়ে গেছে।
একটি বিষয় খুব হতাশার সঙ্গে দেখে আসছি। আমাদের অনেক শিক্ষিতজনের মধ্যে ইতিহাস ও ঐতিহ্যচর্চায় বেশ সীমাবদ্ধতা রয়েছে। অনেক সময় ইতিহাসকে গভীরভাবে ব্যাখ্যা করতেও ব্যর্থ হই। তাই ইতিহাস নামীয় বই হলেই একে ইতিহাস গ্রন্থ বলি। মূল্য বিচার করি না। ইতিহাসের সময় ও শাখা সম্পর্কে সতর্ক থাকি না। ফলে যথাযোগ্য বিশেষজ্ঞ যথাযথ জায়গায় দায়িত্ব পালন করতে পারেন না। অপাত্রে গুরুদায়িত্ব থাকায় ঐতিহ্যচর্চা ও গবেষণা বাধাগ্রস্ত হয়।
দুর্বল ইতিহাসচর্চার দেশে কেউ ইতিহাস নামীয় গ্রন্থ লিখে সুপরিচিত হওয়ার কারণে এসবের মান বিচার না করে ইতিহাস সংকলক ‘ইতিহাসবিদ’ হয়ে যান। আধুনিক যুগের ইতিহাস গবেষক প্রাচীন ও মধ্যযুগের ইতিহাস রক্ষকের দায়িত্বপ্রাপ্ত হন। রাজনৈতিক ইতিহাসের গবেষক শিল্প ইতিহাসের গুরুদায়িত্ব পালন করেন। এসব কারণে ঐতিহ্য সংরক্ষণে নানা ধরনের সংকট দেখা দেয়।
গত শতকের নব্বইয়ের দশকে আমি শরিয়তপুর জেলা সদরের পাশে একটি গুরুত্বপূর্ণ প্রত্নক্ষেত্রের সন্ধান পাই। একটি বাড়িতে অর্ধভঙ্গ অবস্থায় চারটি মন্দির রয়েছে। এর মধ্যে মনসামন্দির ও দুর্গামন্দির মধ্যযুগের নির্মাণশৈলীর বিশেষ ধারায় দোচালা আকৃতির ছাদবিশিষ্ট। লাল ইট বেরিয়ে আছে। ছাদের নিচের অংশে চমৎকার কারুকাজ। কোথাও মোজাইকের কাজ রয়েছে। এই মন্দিরগুলোর একটু পেছনে দ্বিতল কালীমন্দির। উপরের তলার অনেকটাই ধসে গেছে। এগুলো পরিত্যক্ত মন্দির ছিল।
বাড়িটি মনসাবাড়ি নামে পরিচিত। এই বাড়ি-সংলগ্ন আরেকটি অংশে ধ্বংসপ্রায় বিশাল ইমারত রয়েছে। দোতলাটি ভেঙে গেছে। একতলার অনেকটা অংশ এখনও টিকে আছে। এই অংশটি ময়ুরভট্টের বাড়ি নামে পরিচিত। এটি সে যুগে একটি বড় সংস্কৃত টোল ছিল বলে এক ধরনের সিদ্ধান্তে আসা গেছে।
আমি দেড় বছর গবেষণা করে এই বাড়ি দুটোর ইতিহাস তৈরি করেছিলাম। স্পষ্ট হয়- এই ইট কাঠের আড়ালে ষোলো বা সতেরো শতকের একটি গুরুত্বপূর্ণ সাংস্কৃতিক ইতিহাস দাঁড়িয়ে আছে। পরে তা গবেষণা জার্নাল ও গ্রন্থে প্রকাশ করেছি। আমি সেসময় সরকারের প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তরের দৃষ্টিতে এনেছিলাম। কিন্তু সংরক্ষণের ব্যবস্থা করা যায়নি।
অথচ দেখলাম পর্তুগালের পর্যটন নগরী এভোরাকে কত যত্নে সংরক্ষণ করা হয়েছে। মধ্যযুগে রোমান ও মুসলিম আধিপত্য এখানে প্রতিষ্ঠিত ছিল। রোমানরা দেয়ালঘেরা যে নগরী গড়ে তুলেছিল তা একেবারে অবিকল রেখে দিয়েছে পর্তুগিজরা। আর আমি কয়েক বছর আগে শরিয়তপুরে গিয়ে দারুণ হোঁচট খেলাম।
মনসাবাড়ির হিন্দু সেবায়েতদের আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে জেলা প্রশাসন কিছু অর্থ বরাদ্দ দিয়েছিল। আর তা দিয়ে প্রত্ন-আইন না মেনে পুরো প্লাস্টার করে মন্দিরটির ঐতিহ্যিক রূপ নষ্ট করে ফেলা হয়েছে। এক্ষেত্রে ঐতিহ্য সচেতন ও প্রত্ন-আইন সম্পর্কে সামান্য ধারণা থাকলে জেলা প্রশাসক সংস্কারের আগে প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তরের সঙ্গে যোগাযোগ করতে পারতেন। এর কবছর আগে বিলাস খান মসজিদ নামে শরিয়তপুরের একটি ছোট মোগল মসজিদকে গুড়িয়ে দিয়ে জেলা পরিষদের অর্থায়নে আধুনিক মসজিদ বানানো হয়।
স্থানীয়পর্যায়ে প্রশাসন ক্ষমতাবান। দেশের নানা অঞ্চলে ছড়িয়ে থাকা নানা ঐতিহ্যিক উপাদান সবার আগে প্রশাসনিক কর্মকর্তাদের দৃষ্টিগোচর হবে। এতে করে প্রাথমিকভাবে রক্ষা হবে তাদের হাতেই। তারাই দৃষ্টি আকর্ষণ করবেন সংশ্লিষ্ট দপ্তর ও গবেষকদের। কিন্তু নিজেরাই যদি সচেতন না থাকেন তবে ঐতিহ্য রক্ষা করা কঠিন। এ কারণে আমি বহু আগে থেকে বলে আসছি পিএটিসিতে তরুণ কর্মকর্তাদের বুনিয়াদি প্রশিক্ষণের সময় বাংলাদেশের সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য সম্পর্কে একটি কোর্স অন্তর্ভুক্ত করা হোক।
বছর দুয়েক আগে বাংলাদেশ পরিবেশ বাঁচাও আন্দোলনের (পবা) পক্ষ থেকে পিএটিসির রেক্টর মহোদয়কে চিঠি দিয়ে অনুরোধ করা হয়। প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তরের কোনো কোনো কমিটিতে বিশেষজ্ঞ সদস্য হিসেবে দায়িত্ব পালনের সুযোগ আমার রয়েছে। আমার মনে পড়ে এক দেড় বছর আগে এক সভার সিদ্ধান্ত অনুযায়ী একই অনুরোধ পিএটিসি প্রশাসনকে করার প্রস্তাব গৃহীত হয়। আমার জানা মতে, পিএটিসি কর্তৃপক্ষ গত দুবছর হয় সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য বিষয়ে ক্লাসের ব্যবস্থা রেখেছে।
ইউরোপে নানা দেশে দেখেছি ছোটখাট ঐতিহ্যিক নিদর্শনও কত যত্নে কত মমতায় সংরক্ষণ করে। ২০১৬ সালের ২৯ এপ্রিল পর্তুগালের এভোরা বিশ্ববিদ্যালয় একটি গোলটেবিল বৈঠকের আয়োজন করেছিল। সিদ্ধান্ত ছিল নানা বিষয়ে আমার সঙ্গে কথপোকথন হবে। সেখানে আয়োজকরা আমার কাছে বাংলাদেশের সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য ও ইউরোপীয়দের আগমন প্রসঙ্গে জানতে চান। সংগত কারণেই তাদের বিশেষ লক্ষ্য ছিল এককালে বাংলাদেশে পর্তুগিজ অবস্থান সম্পর্কে জানা। বাংলাদেশে পর্তুগিজ ঐতিহ্য সংরক্ষণের দুর্বলতার বিষয়ে তাদের হতাশা ছিল।
আমি চট্টগ্রাম ও সন্দ্বীপে একসময় পর্তুগিজ অবস্থান ও ঢাকার আশপাশে দুয়েকটি পর্তুগিজ গির্জার সন্ধান মাত্র দিতে পেরেছি। পর্তুগিজ অধ্যাপকরা ঠিকই বলেছেন, ভারতের গোয়ায় সেদেশের সরকার যেভাবে পর্তুগিজ ঐতিহ্য সংরক্ষণ করেছে এর সামান্যও যদি আমরা করতে পারতাম তাহলে ইতিহাস অনেকটা সমৃদ্ধ হতো।
বর্তমান যন্ত্রযুগে এমন হতাশা থেকে বেরিয়ে আসা যে খুব কঠিন আমার মনে হয় না। প্রয়োজন শুধু সরকারিপর্যায়ে প্রয়োজনীয় ও লাগসই নীতি নির্ধারণ এবং যথাযোগ্য গবেষকদের মেধা ব্যবহার করা।
লেখক: অধ্যাপক, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়