বাংলাদেশ

মতামত

খেলা

বিনোদন

জীবনযাপন

তারুণ্য

কিড জোন

অন্যান্য

রেস-জেন্ডার

ফ্যাক্ট চেক

স্বাস্থ্য

আন্তর্জাতিক

শিক্ষা

অর্থ-বাণিজ্য

বিজ্ঞান-প্রযুক্তি

শুভ জন্মদিন ‘ছোট আপা’

  • ড. কাজী এরতেজা হাসান   
  • ১৩ সেপ্টেম্বর, ২০২১ ১৭:১৫

প্রত্যেক রাজনৈতিক নেতৃত্বের নেপথ্যে আরও একজনকে পাওয়া যায়, যার প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ সহযোগিতা ছাড়া সাফল্য প্রায় অসম্ভব। শেখ রেহানা তেমনই একজন, যিনি সবসময় বড়বোনের পাশে থেকেছেন, তাকে সাহস জুগিয়েছেন। প্রবাসে আওয়ামী লীগ নেতৃত্ব সবসময় তাকেই পেয়েছে কাণ্ডারি হিসেবে। তাই তো শেখ রেহানা মানে আমাদের কাছে ভালোবাসার অনির্বাণ বাতিঘর হয়ে আছেন। একজন সাধারণের মতোই জীবনযাপন করেন বঙ্গবন্ধুর ছোট মেয়ে শেখ রেহানা। যেন একদম সাদাসিধে একজন নারী।

যাকে আমরা ‘ছোট আপা’ হিসেবেই জানি এবং চিনি। তাকে নতুন করে কোনো বিশেষণের প্রয়োজন নেই। তিনি বঙ্গবন্ধুকন্যা এবং বাঙালির দুঃসময়ে নির্বাণ লাভের পীঠস্থান। বঙ্গবন্ধুকন্যা ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ছায়াসঙ্গী হিসেবে নীরবেই দেশের উন্নয়ন ও অগ্রযাত্রায় কাজ করে যাচ্ছেন জাতির পিতার অসমাপ্ত কাজগুলো বাস্তবায়ন করার জন্য। প্রধানমন্ত্রী হিসেবে শেখ হাসিনাকে সর্বাত্মক সহায়তা দেয়ার পাশাপাশি আমাদের ছোট আপা সব সময়ই কাজ করে যাচ্ছেন বাংলাদেশের জন্য, শেখ হাসিনাকে ভালো রাখার জন্য। নিভৃতচারী এই মহিয়সী নারীর আজ জন্মদিন।

শুভ জন্মদিন আমাদের বাঙালির আশা আশ্রয়ের শেষ ঠিকানা শেখ হাসিনার ছায়াসঙ্গী এবং আদরের ছোট বোন শেখ রেহানা! জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ছোট মেয়ে শেখ রেহানার ৬৬তম জন্মদিন আজ সোমবার। ১৯৫৫ সালের ১৩ সেপ্টেম্বর জন্মগ্রহণ করেন তিনি।

১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্টের কালরাতে শেখ মুজিবুর রহমান ও মা শেখ ফজিলাতুন নেছা মুজিবসহ অন্য সদস্যদের ঘাতকরা নির্মমভাবে হত্যা করে। ওই সময় শেখ হাসিনার সঙ্গে জার্মানিতে থাকায় প্রাণে বেঁচে যান দুইবোন। জীবনের নানা চড়াই-উতরাই পেরিয়ে আজ তিনি শুধু বঙ্গবন্ধুর কন্যাই নন, তিন সন্তান- ছেলে রাদওয়ান সিদ্দিক ববি, মেয়ে টিউলিপ সিদ্দিক ও রূপন্তির গর্বিত জননী। টিউলিপ যুক্তরাজ্যের লেবার পার্টির রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত রয়েছেন। হ্যাম্পস্টিড অ্যান্ড কিলবার্ন থেকে নির্বাচিত লেবার পার্টির এমপি তিনি। রাজনীতি ও ক্ষমতার কেন্দ্রবিন্দুতে থাকলেও নির্মোহ শেখ রেহানা সবসময়ই অন্তরালেই থেকেছেন বড়বোন শেখ হাসিনার প্রাণশক্তি হিসেবে।

আমার প্রিয় অনুজ, ভোরের পাতার বিশেষ প্রতিনিধি উৎপল দাস কয়েক বছর আগেই একবার গণভবন সূত্রের বরাত দিয়ে বলেছিল, শেখ রেহানা আপা কখনও ঘটা করে জন্মদিন পালন করেন না। আওয়ামী লীগও দলীয়ভাবে কোনো কর্মসূচি হাতে নেয় না। অবশ্য গেল বছর জন্মদিনে আওয়ামী লীগের পক্ষ থেকে এক মিনিটের একটি ভিডিও ক্লিপে শেখ রেহানাকে শুভেচ্ছা জানানো হয়েছে। এতে খুব সংক্ষেপে শেখ রেহানার নির্মোহ জীবনযাপন সম্পর্কে কিছু কথা তুলে ধরা হয়।

১৯৭৭ সালের জুলাইয়ের শেষদিকে ড. শফিক আহমেদ সিদ্দিকের সঙ্গে শেখ রেহানার বিয়ে হয় লন্ডনের কিলবার্নে। শফিক আহমেদ সিদ্দিক ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অ্যাকাউন্টিং ও ইনফরমেশন সিস্টেমস বিভাগের অধ্যাপক ছিলেন। সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ বাঙালি, জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের কনিষ্ঠ মেয়ের নাম রেহানা। মায়ের ডাক নাম রেণুর প্রথম অক্ষর আর বড় বোন হাসিনার শেষের অক্ষর অক্ষুণ্ন রেখে নাম।

পারিবারিক পদবি যুক্ত হয়ে পরিপূর্ণ নাম শেখ রেহানা। অতি আদরের ছোট ভাই রাসেলের কাছে যিনি ছিলেন ‘দেনা’ আপা। রাসেলের দেনা আপা কিংবা বাবা-মায়ের আদরের রেহানা বা মুন্নার জন্ম ও বেড়ে ওঠা এমন এক সময়ে যখন বঙ্গবন্ধু ধীরে ধীরে হয়ে উঠছেন বাঙালি জাতির সব আশা-ভরসার মূর্ত প্রতীক। বাংলা ও বাঙালির মুক্তির পথিকৃৎ। জেল-জুলুম, নির্যাতন যার নিত্যসঙ্গী।

শেখ রেহানা যখন বুঝতে শিখেছেন, তখনই দেখেছেন বাবা শেখ মুজিব বাঙালি জাতির শোষণ মুক্তির জন্য আন্দোলন-সংগ্রাম করতে গিয়ে মাসের পর মাস, বছরের পর বছর কারাগারে। কারাগারই যেন তার মূল বাড়ি। আর নিজবাড়িতে তিনি যেন ক্ষণিকের অতিথি। ঈদ-পার্বণে প্রায়ই তিনি কারাগারে। যদিও কখনও তিনি বাড়িতে থাকার সুযোগ পেতেন তখন বঙ্গবন্ধু পরিবারে সে বছরের ঈদ হতো সবচেয়ে সেরা ঈদ। শেখ রেহানা এক স্মৃতিচারণা করে লিখেছেন-

“ছোটবেলায় দেখতাম, আব্বা প্রায়ই থাকতেন জেলখানায়। আমদের কাছে ঈদ ছিল তখন, যখন আব্বা জেলখানার বাইরে থাকতেন, মুক্ত থাকতেন। আব্বাও জেলের বাইরে, ঈদও এলো এমন হলে তো কথাই নেই। আমাদের হতো ডাবল ঈদ।”

বঙ্গবন্ধুর এমনই কপাল তিনি কোনো মেয়ের বিয়েতেই উপস্থিত থাকতে পারেননি! বড় মেয়ের বিয়ের সময় জেলে আর ছোট মেয়ের বিয়ের আগেই তো ঘাতকের হাতে জীবন দিতে হলো। আর বঙ্গমাতা শেখ ফজিলাতুন নেছা রেণু নিজহাতে বড় মেয়ে হাসুর বিয়ে দিতে পারলেও ছোট মেয়ের বিয়ে দিতে পারেননি। শেখ হাসিনার সন্তান জয়-পুতুল নানা-নানি-মামাদের আদর পেলেও, শেখ রেহানার সন্তান ববি, টিউলিপ, রূপন্তী তাদের আদর থেকে বঞ্চিত হয়েছে। পরিবারের বড় জামাতা ড. ওয়াজেদ মিয়া শ্বশুর-শাশুড়ির আদর-আপ্যায়ন পেলেও, ছোট জামাতা ড. শফিক সিদ্দিক তা থেকে বঞ্চিত হয়েছেন।

শেখ রেহানার বিয়ে সম্পন্ন হয় লন্ডনের কিলবার্নে বঙ্গবন্ধু পরিবারের সুখ-দুঃখের সাথি, বঙ্গবন্ধুর ফুফাতো ভাই মোমিনুল হক খোকার বাড়িতে ১৯৭৭ সালের জুলাই মাসের শেষ সপ্তাহে ড. শফিক সিদ্দিকের সঙ্গে। শফিক সিদ্দিক তখন বিলেতের সাউদাম্পটন ইউনিভার্সিটিতে উচ্চশিক্ষারত ছিলেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকতায় থাকাকালে তিনি সেখানে এসেছিলেন।

শেখ রেহানাও বঙ্গবন্ধু সপরিবারে শহিদ হওয়ার পর বড়বোন শেখ হাসিনার সঙ্গে জার্মানি থেকে দিল্লি চলে যান এবং সেখান থেকে পরে তাদের প্রিয় খোকা চাচার কাছে লন্ডনে বসবাস শুরু করেন। শফিক সিদ্দিকের পরিবার ও শেখ রেহানাদের পরিবার ছিলেন পূর্বপরিচিত এবং ১৯৭৪ সালেই পারিবারিকভাবে তাদের বিয়ের পাকা কথা হয়। সব ঠিকঠাক থাকলে শেখ রেহানা জার্মানি থেকে ফিরে আসার পর বিয়ের কাজটি সম্পন্ন হবার কথা ছিল। কিন্তু ১৫ আগস্টের হত্যাকাণ্ডের পর দেশে যাওয়া এবং বেঁচে থাকাই যেখানে অনিশ্চিত হয়ে যায়, সেখানে আবার বিয়ে? তারপরও জীবন থেমে যায় না।

একটি কথা বলতেই হয় বঙ্গবন্ধু পরিবারের সবচেয়ে দুঃখী সন্তানের নাম হলো ‘রেহানা’। ছোটভাই রাসেল ছাড়া সবার কাছে যিনি ছিলেন আদরের ‘মুন্না’। বড়বোনের বিয়েতে বাবা উপস্থিত না থাকতে পারলেও মা, ভাই, চাচা ও তিনিসহ আত্মীয়স্বজন উপস্থিত ছিলেন। ভাইদের বিয়েতে পিতা মুজিব উপস্থিত থেকে আশীর্বাদ করেছেন। কিন্তু শেখ রেহানার বিয়েতে একমাত্র জীবিত বোন টিকিটের টাকা জোগাড় করতে পারেননি বলে অনুপস্থিত ছিলেন।

এ প্রসঙ্গে শফিক সিদ্দিক লিখেছেন-

“৮৩ সালে তখন হাসিনা আপা আওয়ামী লীগের সভানেত্রী হিসেবে ঢাকায় অবস্থান করছেন। ওই সময়ে আমি আমার পিএইচডি থিসিসের কাজে ঢাকা গিয়েছিলাম। একদিন হাসিনা আপার বাসায় উপস্থিত হয়ে দেখতে পেলাম, উনি হাশেম ভূঁইয়া নামের একজন কর্মীর অসুস্থ মেয়েকে লন্ডন পাঠাবার ব্যবস্থা করছেন। তখন হাসিনা আপা বেশ দুঃখ করে আমাকে বললেন, ‘শফিক দেখ, আজকে আল্লাহর ইচ্ছায় আমি আমার একজন কর্মীর অসুস্থ মেয়েকে বিদেশ পাঠাতে সাহায্য করতে পারি। কিন্তু সেদিন আমার একমাত্র বোনের বিয়ের অনুষ্ঠানে উপস্থিত থাকতে দিল্লি থেকে লন্ডন যেতে পারিনি, কেবল টিকিটের টাকার অভাবে।”

এর চেয়ে বড় কষ্ট ও দুঃখের ঘটনা কারো জীবনে হতে পারে না। এরপরও দুঃখ কষ্ট তাকে, তাদের দুবোনের পরিবারকে তাড়া করে ফিরেছে। এখনও তো বাবা-মা ভাই হারানোর বেদনা তাদের তাড়া করে বেড়ায়। যদিও পারিবারিক, সামাজিক ও রাজনৈতিক জীবনে তারা অনেকটাই এখন সুখের পরশ পাচ্ছেন। তবে একটা বিষয়ে তাদের চরম শত্রুও স্বীকার করতে বাধ্য হবে, পারিবারিক শিক্ষা, বিশেষ করে মায়ের দেয়া শিক্ষা তাদের ধৈর্য, সাহস, বিচক্ষণতা, অধ্যবসায়, ত্যাগ, নির্লোভ চলার পথকে সুগম করেছে। বিজয়ী করেছে।

পুরোপুরি সুখী করতে না পারলেও স্বস্তি দিয়েছে। প্রেরণা জুগিয়েছে যুদ্ধজয়ের। বিয়ের পর শফিক সিদ্দিক ও শেখ রেহানাকে নানামুখী সংকট মোকাবিলা করে অগ্রসর হতে হয়েছে। সে সময় আর্থিক কষ্টটাই ছিল প্রবল। বিয়ের পর পরই স্বামীর সঙ্গে চলে আসেন সাউদাম্পটন ইউনিভার্সিটিতে।

মাথা গোঁজার ঠাঁই করে নেন আরেক বাঙালি পরিবারের সঙ্গে রুম ভাগাভাগি করে। আর্থিক অনটনের কারণে চাইলেই একক বাড়ি ভাড়া করে থাকার সামর্থ্য তাদের ছিল না। তাই শেখ রেহানাও বিভিন্ন জায়গায় চাকরির চেষ্টা করছিলেন। এমনকি বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্যান্টিনেও কর্মখালি দেখে চেষ্টা করেছেন কিন্তু শেষ পর্যন্ত হয়নি। নববিবাহিতা স্ত্রীর চাকরি করার বিষয়টি মন থেকে না চাইলেও শফিক সিদ্দিক রাজি হয়েছিলেন দুটি কারণে।

প্রথমত, শেখ রেহানা প্রায়ই একা বাসায় থাকতেন এবং সার্বক্ষণিক মা, বাবা, ভাইদের ছবি সামনে নিয়ে কান্নাকাটি করতেন। ফলে শফিক সিদ্দিকের সন্দেহ জেগেছিল, এভাবে একা থাকতে থাকতে শেখ রেহানার মানসিক সমস্যা যদি দেখা দেয়! সুতরাং কাজে থাকলে মানুষের সান্নিধ্যে ও ব্যস্ত থাকার কারণে ১৫ আগস্টের ভয়াবহ স্মৃতি কিছুটা হলেও ভুলে থাকতে পারবেন।

দ্বিতীয়ত, কিছুটা হলেও আর্থিক সমস্যার সমাধান হবে, এই বিবেচনায় তিনি স্ত্রীর চাকরির ব্যাপারে সম্মত হন। ‘কিন্তু তিনি বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্যান্টিনের কাজের ধরন ব্যাখ্যা করে স্ত্রীর অভিব্যক্তি জানতে চেয়েছিলেন এভাবে, তুমি কি জান চাকরিটাতে তোমাকে ছাত্রদের খাবার পরিবেশন করতে হবে এবং সাথে ধোয়ামোছার কাজও করতে হবে? এই চাকরি কি তুমি করবে?’

এরপরের জীবন সাউদাম্পটন থেকে লন্ডনে প্রত্যাবর্তন। যাপিত জীবনের আরেক পর্যায়। লন্ডনে এসে স্বামীসহ শেখ রেহানা আবার ওঠেন মোমিনুল হক খোকার বাড়িতে। ইতোমধ্যে তিনি ও শফিক সিদ্দিক অনেক চেষ্টা-তদবির করে চাকরি জোটাতে সক্ষম হন। খুঁজে নেন ভাড়ায় হলেও একটা ছোট্ট নীড়। কেননা বেঁচে থাকা ও জীবনযুদ্ধ চালিয়ে যেতে হলে প্রথমেই যে দুটি জিনিসের প্রয়োজন তা হলো বাসস্থান ও জীবিকা নির্বাহের জন্য অর্থের জোগান।

শুরু হয় ঘুরে দাঁড়ানোর পালা, ব্যক্তিগত, পারিবারিক ও রাজনৈতিক পরিসরে। ভাড়া বাড়ি থেকে নিজের বাড়িতে উঠে আসেন তারা। শফিক সিদ্দিক চাকরি করার পাশাপাশি উচ্চশিক্ষার কাজটিও চালিয়ে যেতে থাকেন। শেখ রেহানা চাকরি নেন একটি লাইব্রেরিতে। লন্ডনেই জন্ম হয় ছেলে রাদওয়ান মুজিব সিদ্দিক ও বড় মেয়ে টিউলিপ সিদ্দিকের। ছোট মেয়ের রূপন্তীর জন্ম ব্রুনাইতে।

উল্লেখ্য, ব্রুনাইতে কমর্রত অবস্থায়ই ভুল চিকিৎসার শিকার হয়ে শফিক সিদ্দিক পঙ্গুত্ববরণ করে কয়েক বছর কর্মজীবন থেকে দূরে ছিলেন। জীবনযুদ্ধে কিছুটা স্থিত হয়েই শেখ রেহানা শুরু করেন রাজনৈতিক যুদ্ধের প্রস্তুতি। বড়বোন শেখ হাসিনার প্রতিনিধি হয়ে যোগদান করেন সুইডেনের রাজধানী স্টকহোমে অনুষ্ঠিত সর্ব-ইউরোপীয় বাকশালের সম্মেলনে ১৯৭৯ সালের ১০ মে।

আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে অত্যন্ত দৃঢ়তার সঙ্গে উত্থাপন করেন ১৫ আগস্ট নারকীয় হত্যাকাণ্ডের বিচার দাবি। যা উপস্থিত সবার দৃষ্টি আকর্ষণ করে। স্টকহোম থেকে ফিরে স্বামী শফিক সিদ্দিককে সঙ্গে নিয়ে গড়ে তোলেন সর্ব-ইউরোপীয় বঙ্গবন্ধু পরিষদ। সভাপতি করা হয় আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলার বঙ্গবন্ধুর আইনজীবী স্যার টমাস উইলিয়াম কিউসি এমপিকে।

সাধারণ সম্পাদকের দায়িত্ব অর্পিত হয় জাতীয় চার নেতার অন্যতম ক্যাপ্টেন এম মনসুর আলীর বড় ছেলে ড. মোহাম্মদ সেলিমের ওপর। প্রধান পৃষ্ঠপোষক করা হয় জননেত্রী শেখ হাসিনাকে। যুক্তরাজ্য প্রবাসীদের মধ্যে যারা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখেন তাদের মধ্যে যুক্তরাজ্য আওয়ামী লীগের তৎকালীন সভাপতি গৌস খান ও বর্তমান সভাপতি সুলতান মাহমুদ শরীফ অন্যতম।

সর্ব-ইউরোপীয় বঙ্গবন্ধু পরিষদের উদ্যোগে ১৯৮০ সালের ১৬ আগস্ট পূর্ব লন্ডনের ইয়র্ক হলে অনুষ্ঠিত ১৫ আগস্ট বঙ্গবন্ধুসহ সব শহিদদের স্মরণে শোকসভার মাধ্যমে শেখ হাসিনার অভিষেক হয় পুনরায় সক্রিয় রাজনীতিতে। একই সময়ে গঠিত হয় বঙ্গবন্ধুহত্যা তদন্তে আন্তর্জাতিক কমিশন। কমিশনের চেয়ারম্যানের দায়িত্ব গ্রহণ করেন স্যার টমাস উইলিয়াম এমপি কিউসি। সদস্য সচিব হন সলিসিটর অব্রে রোজ।

এছাড়া কমিশনের অন্যান্য সদস্য ছিলেন শান্তিতে নোবেল বিজয়ী সন ম্যাকব্রাইট, লেবার পার্টির তৎকালীন আইনবিষয়ক মুখপাত্র জেফরি টমাস কিইউসি এমপি। সর্ব-ইউরোপীয় বঙ্গবন্ধু পরিষদ ও আন্তর্জাতিক তদন্ত কমিশন গঠনে শেখ রেহানা অন্যতম মুখ্য ভূমিকা পালন করলেও তিনি আড়ালেই থেকে যান এবং এখনও আড়ালে থেকেই শেখ হাসিনার পাশাপাশি সবক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখছেন। যেভাবে বঙ্গমাতা বেগম শেখ ফজিলাতুন নেছা সবসময় আড়ালে থেকেই বঙ্গবন্ধুর পাশাপাশি আমাদের মুক্তিসংগ্রামে ঐতিহাসিক ও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছেন।

বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ডের পর নির্বান্ধব পরবাসে নিজেদের মতো করে জীবন যাপনের অভিজ্ঞতাও তাকে ঋদ্ধ করেছে। অভ্যস্থ করেছে পরিমিত জীবনাচারে। কৈশোর-উত্তীর্ণ বয়সেই অনুভব করতে হয়েছে শূন্যতা। যে শূন্যস্থান পৃথিবীর কোনো সম্পদ দিয়ে পূরণ করা যায় না। কিন্তু রাজনৈতিক পরিবারের সন্তান হিসেবে কাউকে তা বুঝতে দেননি। বরং বাংলাদেশের মানুষের মধ্যে খুঁজে ফিরেছেন আত্মার-আত্মীয়দের। যে কথা তিনি এক সাক্ষাৎকারেও উল্লেখ করেছেন; বলেছেন-

“আমরা মধ্যবিত্ত পরিবারের সন্তান। জনগণের মধ্যে থেকে তৃণমূল থেকে রাজনীতি করে আমার বাবা হয়েছিলেন বঙ্গবন্ধু, বাংলাদেশ নামের রাষ্ট্রের জনক। আমরা সেই বঙ্গবন্ধুর সন্তান, জনগণের মধ্যে এখনও আমরা খুঁজে ফিরি আমাদের মা-বাবা ও পরিবার সদস্যদের, সেই জনগণের ভালোবাসা নিয়েই জীবনের বাকি সময়টুকুও পাড়ি দিতে চাই। আমাদের জীবনে সবচেয়ে বড় পাওয়া আমরা বঙ্গবন্ধুর কন্যা। এই লন্ডনেও যখন রাস্তায় বের হই, তখন দেখি বিভিন্ন বর্ণের অনেকেই বঙ্গবন্ধুর কন্যা হিসেবে সম্মান করছে। সঙ্গে নিয়ে একটি ছবি তুলতে চাইছে। এর চেয়ে বড় পাওয়া আর কী হতে পারে আমাদের।”

একজন সফল মা হিসেবে শেখ রেহানা নিজেকে গর্বিত করেছেন আপন আলোয়। রাদওয়ান মুজিব সিদ্দিক ববি ও দুই মেয়ে হলেন টিউলিপ সিদ্দিক ও আজমিনা সিদ্দিক রূপন্তীর জননী তিনি। রাদওয়ান সিদ্দিক ববি আওয়ামী লীগের গবেষণা সেল সেন্টার ফর রিসার্চ অ্যান্ড ইনফরমেশনের (সিআরআই) ট্রাস্টি। সিআরআই’র হেড অব স্ট্রাটেজি অ্যান্ড প্রোগ্রাম হিসেবে কাজ করছেন যুক্তরাজ্যে পড়াশোনা করা ববি।

টিউলিপ রেজওয়ানা সিদ্দিক লন্ডনের হ্যাম্পস্টেড অ্যান্ড কিলবার্ন আসন থেকে লেবার পার্টির নির্বাচিত সংসদ সদস্য। স্বামী ক্রিস পার্সির সঙ্গে টিউলিপ সিদ্দিক লন্ডনে বসবাস করেন। শেখ রেহানার ছোট মেয়ে আজমিনা সিদ্দিক রূপন্তী অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যয়নরত ও লন্ডনে কন্ট্রোল রিস্কস নামে একটি প্রতিষ্ঠানের গ্লোবাল রিস্ক অ্যানালাইসিস সম্পাদক।

আমি কয়েকবার পরম শ্রদ্ধেয় ছোট আপা শেখ রেহানার সঙ্গে কথা বলেছি। আমি বিশ্বাস করি, কৈশোরেই পিতা-মাতাসহ পরিবারের সবাইকে হারানোর বেদনায় সিক্ত তিনি। এমন একটা সময় তিনি সবাইকে হারিয়ে ছিলেন, তখন বড়বোন শেখ হাসিনা ছাড়া তার আপন বলতে কেউই ছিল না।

তারপর নানা ঘাত-প্রতিঘাত, প্রতিকূলতা পেরিয়ে আজ প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ছায়াসঙ্গী হিসেবে দেশের উন্নয়নে কাজ করে যাচ্ছেন নিভৃতেই। তিনি প্রচারের আলোয় আসেন না। শেখ হাসিনার সব অর্জনে শেখ রেহানার অবদান অনস্বীকার্য বলেও মনে করি। যদি একটু আলাদা করে বিশ্লেষণ করি, তাহলে দেখা যাবে, বাংলাদেশের রাজনীতিতে শেখ রেহানার অবদান উপেক্ষা করার মতো নয়।

প্রত্যেক রাজনৈতিক নেতৃত্বের নেপথ্যে আরও একজনকে পাওয়া যায়, যার প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ সহযোগিতা ছাড়া সাফল্য প্রায় অসম্ভব। শেখ রেহানা তেমনই একজন, যিনি সবসময় বড়বোনের পাশে থেকেছেন, তাকে সাহস জুগিয়েছেন। প্রবাসে আওয়ামী লীগ নেতৃত্ব সবসময় তাকেই পেয়েছে কাণ্ডারি হিসেবে। তাই তো শেখ রেহানা মানে আমাদের কাছে ভালোবাসার অনির্বাণ বাতিঘর হয়ে আছেন। একজন সাধারণের মতোই জীবনযাপন করেন বঙ্গবন্ধুর ছোট মেয়ে শেখ রেহানা। যেন একদম সাদাসিধে একজন নারী।

চরিত্রে কখনও আদিখ্যেতা কিংবা অহংকার মনোবৃত্তি পোষণ করেননি। দেশের জন্য কাজ করে যাচ্ছেন নীরবে-নিভৃতে। সংগ্রাম করে যাচ্ছেন জীবনের প্রতিটি পর্যায়ে। সুযোগ্য মায়ের যোগ্য উত্তরসূরি তিনি। মা শেখ ফজিলাতুন নেছা মুজিব পর্দার অন্তরালে থেকে বঙ্গবন্ধুকে দিয়েছিলেন সাহস ও অনুপ্রেরণা। যার অনুপ্রেরণায় শেখ মুজিব হতে পেরেছিলেন বঙ্গবন্ধু। আর এখন পর্দার অন্তরালে বড়বোন বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার পাশে থেকে অনুপ্রেরণা দিয়ে যাচ্ছেন। তিনি হলেন শেখ রেহানা, জাতির পিতার কনিষ্ঠ কন্যা। শুভ জন্মদিন আমাদের সকলের শ্রদ্ধেয় ছোট আপা। আপনার দীর্ঘায়ু ও সুস্বাস্থ্য কামনা করছি।

লেখক: সদস্য, কেন্দ্রীয় শিল্প-বাণিজ্য উপকমিটি, বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ। পরিচালক, এফবিসিসিআই

এ বিভাগের আরো খবর