বাংলাদেশ

মতামত

খেলা

বিনোদন

জীবনযাপন

তারুণ্য

কিড জোন

অন্যান্য

রেস-জেন্ডার

ফ্যাক্ট চেক

স্বাস্থ্য

আন্তর্জাতিক

শিক্ষা

অর্থ-বাণিজ্য

বিজ্ঞান-প্রযুক্তি

শিশুদের নীল বেদনা পৃথিবীর এক গাঢ় দুঃখ

  • খান মোহাম্মদ রবিউল আলম   
  • ২ সেপ্টেম্বর, ২০২১ ১৭:৪৯

শিশুদের সামনে অগ্নিমূর্তি দেখানোর কোনো নৈতিক অধিকার বাবা-মা রাখেন না। মালিকানার দিক থেকে বাবা-মা শিশুদের একান্ত নিজেদের সন্তান হিসেবে বিবেচনা করেন, যা পরিপূর্ণ সত্য নয়। প্রতিটি শিশু প্রকৃতির হাজারও রসায়নের সমষ্টি। শিশুদের মালিকানা বলে যদি কিছু থাকে তবে সেটা প্রকৃতি। বাবা-মা শিশুদের কেয়ারগিভার মাত্র।

বিভিন্ন গণমাধ্যমে প্রকাশিত খবর থেকে জানা যায়, জাপানি নাগরিক নাকানো এরিকো ও বাংলাদেশি নাগরিক শরীফ ইমরানের বিয়ে বিচ্ছেদোত্তর সন্তানদের অভিভাবকত্ব নিয়ে বিরোধ আদালত পর্যন্ত গড়িয়েছে। জাপানি নাগরিক নাকানো এরিকো সন্তানদের অভিভাবকত্ব দাবি করে এদেশের হাইকোর্টে রিট আবেদন করেছেন। সন্তান ফিরে পেতে মা জাপান থেকে বাংলাদেশে ছুটে এসেছেন।

হাইকোর্ট আগামী ৩১ আগস্ট ২০২১ পর্যন্ত তেজগাঁওয়ের ভিকটিম সাপোর্ট সেন্টারে উন্নত পরিবেশে তাদের সন্তানদের রাখার নির্দেশ দিয়েছেন। নাকানো এরিকো ও শরীফ ইমরানের সন্তান জেসমিন মালিকা (১১), লাইলা লিনা (১০) বর্তমানে তেজগাঁওয়ের ভিকটিম সাপোর্ট সেন্টারে রয়েছে এ নিবন্ধ লেখা পর‌্যন্ত।

জাপানে জন্ম নেয়া ও বেড়ে ওঠা শিশু দুটি আজ এক বিশেষ পরিস্থিতির শিকার। তারা বাবা-মার সঙ্গে সীমিত পরিসরে দেখা করার সুযোগ পাচ্ছে। গণমাধ্যম থেকে আরও জানা গেছে, এ ধরনের পরিস্থিতির সঙ্গে শিশুদের খাপ খাওয়াতে বেশ কষ্ট হচ্ছে। শিশুদের এ অবস্থা যেকোনো সংবেদনশীল মানুষের জন্য পীড়াদায়ক।

পৃথিবীর সব শিশুর রয়েছে স্বাভাবিকভাবে বেড়ে ওঠার অধিকার। এটি বাড়তি কোনো চাওয়া বা করুণার বিষয় নয়। একটি মৌলিক বিষয়। শিশুদের মর্যাদাপূর্ণ ও শঙ্কাহীনভাবে বেড়ে ওঠায় বাবা-মার রয়েছে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা। কোনো বিশেষ পরিস্থিতির শিকার হয়ে শিশুরা শাস্তি ভোগ করতে পারে না। শিশুদের বিস্ফোরোণ-উন্মুখ পরিস্থিতির মধ্যে ফেলে দেয়া কোনো সভ্য মানুষের কাজ হতে পারে না। শিশুর কুসুমরাঙা মুহূর্ত বেদনার নীল রঙে ঢেকে দেয়া যায় না। মনে রাখতে হবে, শিশুদের নীল বেদনা পৃথিবীর এক গাঢ় দুঃখ।

বাস্তবতা হলো পরিবারে শিশুদের অনেক সময় বৈরী পরিস্থিতির মুখোমুখি হতে হয়। নাকানো এরিকো ও শরীফ ইমরানের সন্তানদ্বয় জেসমিন মালিকা ও লাইলা লিনার অবস্থা বাংলাদেশে অনেক শিশুর অভিজ্ঞতার সঙ্গে সাজুয্যময়। এখানে ঘরভাঙা দুঃখবোধ নিয়ে অনেক শিশু বেড়ে ওঠে। সারা পৃথিবীর শিশুদের কষ্টগুলো প্রায়ই একরকম। পৃথিবীর কোনো প্রান্তে একটি শিশু সংকটগ্রস্ত মানে সব শিশুরই কষ্ট।

ঘরভাঙাকেন্দ্রিক দুঃখবোধ শিশুদের মনে গভীর ক্ষত তৈরি করে। তাদের এ অভিঘাত বয়ে বেড়াতে হয় জীবনজুড়ে। কোনো সংসারই হুট করে ভাঙে না। সংসার ভাঙার পূর্ব মুহূর্তগুলো হয়ে ওঠে সংঘাতময়। সংসার ভাঙার আগে তৈরি হয় মতবিরোধ, দ্বন্দ্ব-সংঘাত ও সহিংসতা, যা নীরবে শিশুদের সহ্য করতে হয়। মানসিক বিষণ্নতা তাদের পেয়ে বসে। আশ্রয় করে অজানা আশঙ্কা।

নিজগৃহে সংঘাত পৃথিবীর ভয়াবহতম কষ্ট। পারিবারিক এ সংঘাতের দর্শক কেবল শিশুরা। বিশেষত নগরজীবনে। নগরজীবনে পরিবারিক সংকটে শিশুরা যুদ্ধের মধ্যে পড়ে। কারণ, তাদের পালিয়ে বাঁচার কোনো জায়গা নেই। নেই পরিবেশ বদলের সুযোগ। কেবল শার্সি দিয়ে পাশের বাড়ির আরেকটি দেয়াল দেখা ছাড়া বাড়তি কোনো সুযোগ নেই।

নগরজীবনে পারিবারিক কলহে পাশে নেই কোনো খোলা জায়গা বা প্রিয়জন। কেউ এসে একটু ভারী গলায় বলে না তোমরা ‘থামো’। নগরজীবনে নেই কোনো সম্পর্কসঙ্গ। এখানে জীবন ও ব্যক্তি একা। ছোট-খাটো বিষয় নিয়ে বিস্ফোরণ উন্মুখ পরিস্থিতি তৈরি হয়। শিশুরা ক্ষণে ক্ষণে আগুনের তাপ অনুভব করে। অনেক সময় তারা এ তাপে পড়ে যেতে বাধ্য হয়।

গ্রামীণ পটভূমিতে বাবা-মার মধ্যে দ্বন্দ্ব-সংঘাত তৈরি হলে অনেক সময় চাচি-ফুফু-দাদীরা শিশুদের টেনে নিয়ে যায়। দুপুর বেলায় গোসল করিয়ে দুটো ভাত খাইয়ে ঘুমিয়ে দেয়। বিরোধ মিটাতে দূতিয়ালি করে। বিকেলে পরিস্থিতি স্বাভাবিক হলে শিশুদের বাড়িতে দিয়ে যায়।

সামান্য সংখ্যক শিশু জীবনীশক্তি ঘুরে দাঁড়ানোর চেষ্টা করে। বাবা-মার বিরোধে নিরপেক্ষ ভূমিকা পালন করার চেষ্টা করে। ভারসাম্য বজায় রাখতে চায়। বাবা-মা বুঝতে দেয় না কাকে সে বেশি ভালোবাসে। বিরোধ থামলে একবার বাবার কাছে আরেকবার মায়ের কাছে ছুটে যায়। বাবা-মার মধ্যে সম্পর্কের গুরুত্ব বা অনুভব জাগিয়ে তোলার চেষ্টা করে। জীবনের শুরুতে তাদের এ অনাকাঙ্ক্ষিত কূটনৈতিক তৎপরতা শিখতে হয়। তবে এ সংখ্যা বেশি নয়। তুলনামূলক বিচারে, আমাদের শিশুদের বেঁচে থাকা বা জীবনীশক্তি অনেক উন্নত।

বাবা-মার বিরোধে শিশুরা দিশেহারা হয়ে পড়ে। আর তা পড়াটাই স্বাভাবিক। এ রকম পরিস্থিতিতে শিশুরা দোটানা পরিস্থিতির ভেতর পড়ে। তারা ভেঙে যায়, বিভক্ত হতে থাকে। এটি তাদের কাঙ্ক্ষিত কোনো বিভক্তি নয়। শিশুরা মূলত বন্ধন চায় বিভক্তি নয়।

শিশু যখন কোনো কারণে আজ সহিংস হয়ে উঠছে তখন নিজেকে শান্ত করার কোনো স্মৃতি খুঁজে পাচ্ছে না। যেমন, আমার কোনো কারণে আব্বার ওপর অভিমান হলে ভাবতাম কয়েকদিন পরই তো আব্বা কাকনহাটের মেলায় নিয়ে যাবে। মুহূর্তেই মহিষের গাড়ি, মহিষের পায়ের ধুপধাপ শব্দ, টোপরের ভেতর খড়ের গন্ধ, সার্কাসের জাদুকর, মেলার বড় বড় মিষ্টি, টমটম আর বাঁশির শব্দ ভেসে উঠত। অভিমান মুহূর্তেই পানি হয়ে যেত। সহিংস পরিবারগুলো শিশুদের অভিমান প্রশমনে ভালো কোনো স্মৃতি গড়ে উঠছে না। এ কারণে তারা অল্পতেই সহিংস হয়ে ওঠে।

স্বামী-স্ত্রীর বিরোধ শুরু হলে প্রথমে যে বিষয়টি লোপ পায় তা হলো ‘রেসিও’ মানে অনুপাত জ্ঞান। ইংরেজি রেসিও শব্দের সঙ্গে ‘র‌্যাশানাল’ শব্দের সম্পর্ক রয়েছে যার অর্থ যৌক্তিক আচরণ। স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে তিক্ততা তৈরি হলে অনেক সময় যৌক্তিক আচরণ লোপ পায়। সহিংসতা হয়ে ওঠে প্রধান মুখ্য বিষয়। কার পাল্লা ভারী সেই হিসাব এখানে নয়। পরিবারগুলো হয়ে ওঠে পাগলাগারদের মতো। এক ধরনের বদ্ধতার মধ্যে পড়ে যায় শিশুরা।

এ বদ্ধতা অনেক সময় শিশুর স্বাভাবিক বিকাশ বাধাগ্রস্ত করে মনোবৈকল্য তৈরি করে। পশ্চিমা এক মনস্তত্ত্ববিদ শিক্ষার্থীদের ওপর বিদ্যালয়ে বাজানো ঘণ্টার প্রভাব নিয়ে গবেষণা করেছেন। তিনি দেখান ঘণ্টার ব্যাপক প্রভাব রয়েছে শিশুদের ধারাবাহিক মনোযোগের ওপর। ঘণ্টানির্ভর মনোযোগের যে স্থিতি শিশু মনোজগতে পোক্ত করে দেয়া হয় তার প্রভাব সারাজীবন বহন করে চলে। শিশুরা বাকি জীবন ঘণ্টানির্ভর মনোযোগ নিয়ে কাটায়।

মনোবিজ্ঞানী আলবার্ট বান্দুরা বলেছেন, শিশুদের মন হলো কাদামাটির মতো। তাদের যেভাবে আকার দেয়া যাবে সেই আকারে তারা গড়ে উঠবে। শিশুদের মনোজগত গঠনে পরিবার একটি মৌলিক প্রতিষ্ঠান। বাবা-মার ভূমিকা বিশেষভাবে গুরুত্বপূর্ণ। শিশুদের জন্য সহায়ক পরিবেশ তৈরির ব্যাপারে বাবা-মার কর্তৃত্ব অস্বীকার করা যায় না।

শিশুদের সামনে অগ্নিমূর্তি দেখানোর কোনো নৈতিক অধিকার বাবা-মা রাখেন না। মালিকানার দিক থেকে বাবা-মা শিশুদের একান্ত নিজেদের সন্তান হিসেবে বিবেচনা করেন, যা পরিপূর্ণ সত্য নয়। প্রতিটি শিশু প্রকৃতির হাজারও রসায়নের সমষ্টি। শিশুদের মালিকানা বলে যদি কিছু থাকে তবে সেটা প্রকৃতি। বাবা-মা শিশুদের কেয়ারগিভার মাত্র। জাপানি প্রখ্যাত লেখক মুরাকামি হারুকি বলেছেন- “মানুষ চূড়ান্ত বিবেচনায় কিছুই না কেবল বাহকমাত্র- নিজেকে পাস করে দেয় জিনের মাধ্যমে। ঘোড়দৌড়ের মতো প্রজন্ম থেকে প্রজন্মান্তরে ছড়িয়ে পড়ে।”

ভেঙে যাওয়া সংসারের শিশুদের জন্য তৈরি হয় স্নেহবঞ্চনার দীর্ঘ পঙ্কিলপথ। তাদের জীবনের পরের অংশের সব কিছুই হয়ে পড়ে অর্ধেক। এ ধরুন ঈদের আনন্দ, জন্মদিন, বাইরে ঘুরে বেড়ানো, নতুন বই পড়ার বা বাসার রান্নার নতুন সাধ, জ্যোৎস্না বা শীতের পিঠা। অথবা মা-বাবার স্নেহের পরশ। কখনও হয়ত মায়ের কাছ থেকে ভালোবাসা কখনওবা বাবার কাছ থেকে। কিন্তু কিছুতেই তা শতভাগ হয় না। এর মধ্যে শিশুদের উভয়ের সঙ্গে যোগাযোগ রক্ষা করে চলতে হয়। অপরিণত বয়সে তাকে জটিল পরিস্থিতি সামলাতে হয়। শিশুর এ বঞ্চনা পৃথিবীর কোনোকিছু দিয়ে পূরণযোগ্য নয়।

যারা কোনো অপরাধ না করেও নির্মম শাস্তি ভোগ করে, যাদের বেঁচে থাকতে হয়, এগিয়ে যাওয়ার স্বপ্ন দেখতে হয় এমন সব শিশুদের জন্য থাকছে হৃদয় নিংড়ানো ভালোবাসা। প্রতিটি শিশুর আবাস হোক স্বর্গতুল্য। জেসমিন মালিকা ও লাইলা লিনাও আগামী পৃথিবীর মা।

লেখক: যোগাযোগ বিশেষজ্ঞ।

এ বিভাগের আরো খবর