বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনার সরকার ২০৪১ সালের মধ্যে উন্নত সমৃদ্ধ বাংলাদেশ বিনির্মাণের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করেছে। সরকারের এই পরিকল্পনা বাস্তবায়নের জন্য প্রথম দরকার একটি উন্নত যোগাযোগ ব্যবস্থা। সরকার সে বিষয়টিকে বিশেষ গুরুত্ব দিয়েই বিগত একযুগে যোগাযোগ ব্যবস্থার ক্ষেত্রে তৈরি করেছে নতুন এক মাইলফলক। যোগাযোগ ব্যবস্থার উন্নয়নে বদলে যাচ্ছে বাংলাদেশ।
মাটির তলদেশ থেকে আকাশ পর্যন্ত সর্বত্র চলছে উন্নয়নের কর্মযজ্ঞ। বিশ্বমানের যোগাযোগ ব্যবস্থা গড়ে তোলার জন্য নেয়া হয়েছে বেশ কিছু মেগা প্রকল্প। বাংলাদেশ, ভারত, নেপাল ও ভুটানকে নিয়ে সাউথ এশিয়া সাব-রিজিওনাল ইকোনমিক কো-অপারেশন (সাসেক) আঞ্চলিক সহযোগিতার আওতায় একটি সমন্বিত যোগাযোগ ব্যবস্থা গড়ে তোলার কাজ এগিয়ে চলছে। ‘প্রেক্ষিত পরিকল্পনা-২০৪১’ অনুযায়ী ২০৩০ সালের মধ্যে দেশের সব মহাসড়ক ছয় লেন এবং ২০৪১ সালের মধ্যে আট লেনে উন্নীত ও দেশের প্রতিটি জেলার সঙ্গে রেল পরিষেবা চালু করার পরিকল্পনা নিয়েছে সরকার। যোগাযোগের ক্ষেত্রে সড়ক, রেল, আকাশ ও নৌ-পথকে সমান গুরুত্ব দিয়ে একটি আন্তর্জাতিক মানের যোগাযোগ ব্যবস্থা গড়ে তোলার কাজ চলছে।
পদ্মা সেতু, মেট্রোরেল, এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে, উড়াল সড়ক, মেরিন ড্রাইভসহ উন্নত দেশগুলোর মতো সব ধরনের যোগাযোগ ব্যবস্থার নেটওয়ার্কে আসছে বাংলাদেশ।দেশের প্রথম এক্সপ্রেসওয়ে ঢাকা-মাওয়া-ভাঙ্গা মহাসড়ক, অর্থনীতির লাইফ-লাইন খ্যাত ঢাকা-চট্টগ্রাম ১৯০ কিলোমিটার মহাসড়ক চার লেন, যাত্রাবাড়ী- কাঁচপুর আট লেন, প্রায় ৩০ কিলোমিটার দীর্ঘ ইটনা-মিঠামইন-অষ্টগ্রাম সড়ক চার লেন, ঢাকা-গাজীপুর-ময়মনসিংহ, ঢাকা-চন্দ্রা-টাঙ্গাইল সড়ক চার লেনে উন্নীত করা হয়েছে এবং ঢাকা-সিলেট মহাসড়ক ছয় লেনে উন্নীত করার কাজ হাতে নেয়া হয়েছে। ঢাকা মহানগরী ও পার্শ্ববর্তী এলাকার যানজট নিরসনে ২০৩০ সালের মধ্যে ৬টি এমআরটির (অর্থাৎ উড়াল ও পাতাল সড়ক) মাধ্যমে ১২৯ কিমি দীর্ঘ একটি মেট্রো নেটওয়ার্ক গঠনের লক্ষ্যে কাজ করছে সরকার। কক্সবাজার থেকে টেকনাফ পর্যন্ত ৮০ কিমি মেরিন ড্রাইভ নির্মাণ করা হয়েছে।
বান্দরবানের দুর্গম পাহাড়ি অঞ্চল দিয়ে সরাসরি কক্সবাজার পর্যন্ত সড়ক নির্মাণ করা হয়েছে। পর্যটন শিল্পকে মাথায় রেখে তিন উন্নয়নবঞ্চিত পার্বত্য জেলায় যোগাযোগ খাতে ব্যাপক উন্নয়ন করেছে সরকার। পাহাড়ের প্রতিটি জনগণকে যোগাযোগ নেটওয়ার্কে আনা হয়েছে।
উন্নত দেশগুলোর মতো বাংলাদেশের মানুষও মেট্রোরেলে চড়বে। কিছুদিন আগেও এটি ছিল স্বপ্ন। কিন্তু হাসিনা সরকার সেই স্বপ্নকে বাস্তবে পরিণত করতে যাচ্ছে। উত্তরা দিয়াবাড়ী থেকে পল্লবী-রোকেয়া সরণি-ফার্মগেট-শাহবাগ-টিএসসি-দোয়েল চত্বর-তোপখানা রোড-মতিঝিল হয়ে কমলাপুর পর্যন্ত মেট্রোরেল রুট-৬ নির্মাণের কাজ শেষ পর্যায়ে রয়েছে। এ রুটে ১৬টি স্টেশন থাকবে। ইতোমধ্যে পরীক্ষামূলক চলাচল শুরু হয়েছে। ২০২২ সালের ডিসেম্বরে এ রুটে মেট্রোরেল যাত্রী পরিবহন শুরু করবে। মেট্রোরেল রুট-৬ এর পাশাপাশি আরও দুটি রুট নির্মাণের কাজ চলছে। এর মধ্যে মেট্রোরেল রুট-১ এয়ারপোর্ট থেকে বাড্ডা-রামপুরা হয়ে কমলাপুর এবং দ্বিতীয় অংশ খিলক্ষেত হতে পূর্বাচল পর্যন্ত।
এছাড়া ঢাকা মহানগরীর পূর্ব-পশ্চিমে সংযোগ বাড়াতে চূড়ান্ত করা হয়েছে মেট্রোরেল-৫ এর রুট। এ রুটের দুটি অংশ। নর্দার্ন অংশ গাবতলী হতে হেমায়েতপুর হয়ে ভাটারা পর্যন্ত এবং সাউদার্ন অংশ গাবতলী থেকে হাতিরঝিল হয়ে আফতাবনগর বালুরপার পর্যন্ত। এসব মেট্রোরেল নির্মাণকাজ শেষ হলে ঢাকা মহানগরীতে দূর হবে যানজট, যাত্রাপথ হবে নিরাপদ ও স্বাচ্ছন্দ্যময়।
ঢাকা মহানগরীর সঙ্গে পার্শ্ববর্তী জেলাসমূহের যাতায়াত সহজ করতে গাজীপুর চৌরাস্তা থেকে এয়ারপোর্ট পর্যন্ত দ্রুত গতির বাস চলাচলের জন্য রাপিড বা বিআরটি রুট নির্মাণের কাজ চলমান রয়েছে। ধীরগতির যানবাহনের জন্যও থাকছে আলাদা লেন। এছাড়া বিমানবন্দর থেকে ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কের কুতুবখালী পর্যন্ত ৪৬ কিমি পর্যন্ত এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ের কাজ শুরু হয়েছে।
চট্টগ্রামের কর্ণফুলী নদীতে নির্মাণ করা হচ্ছে প্রায় সাড়ে তিন কিমি বঙ্গবন্ধু ট্যানেল। নদীর তলদেশে এটাই দেশের প্রথম সুড়ঙ্গপথ। যা চীনের সাংহাইয়ের আদলে কর্ণফুলী ও আনোয়ারা উপজেলাকে চট্টগ্রাম নগরের সঙ্গে সংযুক্ত করবে। চার লেন-বিশিষ্ট ‘বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান’ টানেল নির্মাণের ফলে চট্টগ্রাম শহর ‘ওয়ান সিটি অ্যান্ড টু টাউন’ মডেলে গড়ে উঠবে, ঢাকা-চট্টগ্রাম ও কক্সবাজারের মধ্যে আধুনিক যোগাযোগ ব্যবস্থা গড়ার পাশাপাশি এশিয়ান হাইওয়ের সঙ্গে সংযোগ স্থাপিত হবে। চট্টগ্রাম বন্দর ও প্রস্তাবিত গভীর সমুদ্রবন্দরের সুষ্ঠু কার্যক্রম ও ব্যবস্থাপনা সহজতর হবে। কর্ণফুলী নদীর পূর্ব প্রান্তের প্রস্তাবিত শিল্প এলাকার উন্নয়ন ত্বরান্বিত হবে এবং পশ্চিম প্রান্তে অবস্থিত চট্টগ্রাম শহর, বন্দর ও বিমানবন্দরের সঙ্গে উন্নত ও সহজ যোগাযোগ ব্যবস্থা স্থাপিত হবে। যা ২০২২ সালের ডিসেম্বরে যানবাহন চলাচলের জন্য উন্মুক্ত করে দেয়া হবে।
যোগাযোগের অন্যতম সহজ ও নিরাপদ মাধ্যম হলো রেলপথ। বাংলাদেশে রেল সম্পর্কে একসময় একটা কথা চালু ছিল, ছয়টার ট্রেন নয়টায় ছাড়ে, নয়টার ট্রেন কয়টায় ছাড়বে? বিগত একযুগে সে অবস্থা আর নেই। সমগ্র বাংলাদেশকে রেলের আওতায় নিয়ে আসার জন্য রেলপথ সম্প্রসারণ ও আধুনিকায়নের দিকে বিশেষ নজর দিচ্ছে সরকার। দক্ষিণাঞ্চলের মানুষদেরকে রেলের আওতায় নিয়ে আসতে পদ্মা সেতুতে রেল ব্রিজ নির্মাণ করা হয়েছে। ঢাকা থেকে নড়াইল হয়ে যশোর পর্যন্ত নতুন প্রকল্পটি বাস্তবায়নে মোট ব্যয় ধরা হয়েছে প্রায় ৩৫ হাজার কোটি টাকা। যা রেলের ইতিহাসে বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় প্রকল্প। পদ্মা সেতু ব্যবহার করে ঢাকা থেকে পায়রা বন্দরেও যাবে রেল। এছাড়া যমুনা নদীতে বঙ্গবন্ধু সেতুর পাশাপাশি পৃথক রেল সেতু নির্মাণের পরিকল্পনা নেয়া হয়েছে।
ভারত থেকে আনা হয়েছে নতুন নতুন ইঞ্জিন, কোচ। নির্মাণ করা হচ্ছে নতুন নতুন রেলপথ। ২০১৬-২০৪৫ মেয়াদে পাঁচ লাখ ৫৩ হাজার ৬৬২ কোটি টাকা ব্যয়ে ৩০ বছর মেয়াদি মাস্টার প্ল্যান নেয়া হয়েছে রেলপথ উন্নয়নে। রেলপথ সম্প্রসারণ, নতুন রেলপথ নির্মাণ ও সংস্কার, রেলপথকে ডুয়াল গেজে রূপান্তরকরণ, নতুন ও বন্ধ রেলস্টেশন চালু করা, নতুন ট্রেন চালু ও ট্রেনের সার্ভিস বৃদ্ধি করা এবং ট্রেনের কোচ সংগ্রহ অব্যাহত রয়েছে।
দ্রুতগতিতে কাজ চলছে ৯০০ কিলোমিটার ডুয়াল গেজ ডাবল রেল ট্র্যাক নির্মাণ, এক হাজার ৫৮১ কিলোমিটার নতুন রেল ট্র্যাক নির্মাণ, এক হাজার ৫২৭ কিলোমিটার রেল ট্র্যাক পুনর্বাসন, ৩১টি লোকোমোটিভ সংগ্রহ, ১০০টি যাত্রীবাহী কোচ পুনর্বাসন এবং ২২২টি স্টেশনের সিগন্যালিং ব্যবস্থার মানোন্নয়নের পরিকল্পনা করা হয়েছে। কুমিল্লা বা লাকসাম হয়ে ঢাকা থেকে চট্টগ্রাম পর্যন্ত ডাবল ট্র্যাক দ্রুতগতির রেললাইন নির্মাণ, ভাঙ্গা জংশন (ফরিদপুর) থেকে বরিশাল হয়ে পায়রা বন্দর পর্যন্ত রেললাইন নির্মাণ, নাভারন থেকে সাতক্ষীরা পর্যন্ত এবং সাতক্ষীরা থেকে মুন্সীগঞ্জ পর্যন্ত ব্রডগেজ রেললাইন নির্মাণ এবং ঢাকা শহরের চারদিকে বৃত্তাকার রেললাইন নির্মাণ প্রকল্প বাস্তবায়নের উদ্যোগ গ্রহণ করা হয়েছে।
দেশের আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরগুলোর যাত্রী ও কার্গো হ্যান্ডলিং সক্ষমতার মান ও পরিধি বৃদ্ধির অংশ হিসেবে হজরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে তৃতীয় টার্মিনাল নির্মাণকাজ চলছে। কক্সবাজারের পর্যটন শিল্পকে বিশ্ববাসীর কাছে তুলে ধরতে সমুদ্রছোঁয়া বিশ্বমানের বিমানবন্দর নির্মাণের কাজ শুরু হয়েছে। প্রথমবারের মতো অত্যাধুনিক প্রযুক্তির সাহায্যে জলভাগের ওপর দিয়ে রানওয়ে নির্মিত হতে যাচ্ছে, পৃথিবী খুব কম সংখ্যক বিমানবন্দরে এ ধরনের রানওয়ে আছে।
সিঙ্গাপুর-ব্যাংককের আদলে সাজানো হবে কক্সবাজারকে। সমুদ্রের জলে রানওয়ে নির্মাণের গ্রাউন্ড-ব্রেকিংয়ের মধ্য দিয়ে উন্নয়নের আরেক ধাপ এগিয়ে গেল বাংলাদেশ। বিশ্বের উপকূলীয় শহরে অবস্থিত সেরা বিমানবন্দরের মধ্যে অন্যতম হবে কক্সবাজার বিমানবন্দর। এছাড়া সৈয়দপুর বিমানবন্দরকে আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে উন্নীতকরণের শুরু হয়েছে। নেপাল, ভুটানসহ ভারতের উত্তর-পূর্বাঞ্চলীয় রাজ্যগুলো এই বিমানবন্দর ব্যবহার করতে পারবে। যার ফলে পুরো উত্তরবঙ্গেই উন্নয়নের ছোঁয়া লাগবে। বাগেরহাট জেলায় খানজাহান আলী বিমানবন্দর নির্মাণসহ যশোর, সৈয়দপুর ও বরিশাল বিমানবন্দর এবং রাজশাহীর শাহ মখদুম বিমানবন্দরের সম্প্রসারণ ও আধুনিকায়নের পরিকল্পনা নিয়েছে সরকার।
কক্সবাজারের মাতারবাড়ী এবং পটুয়াখালীর পায়রাতে চলছে গভীর সমুদ্রবন্দর নির্মাণের কাজ। চট্টগ্রাম সমুদ্রবন্দরের পণ্য হ্যান্ডলিং সক্ষমতা বৃদ্ধি ও মান আন্তর্জাতিক পর্যায়ে উন্নীতকরণের লক্ষ্যে নতুন কনটেইনার টার্মিনাল, ওভারফ্লো কনটেইনার ইয়ার্ড, বে-টার্মিনাল, বাল্ক টার্মিনাল নির্মাণ করা হয়েছে। এছাড়া অভ্যন্তরীণ নৌ-পথের ৫৩টি রুটে ক্যাপিটাল ড্রেজিং ও নাব্যতা দূর করে নৌ-পথ উন্নয়নের কার্যক্রম চলছে।
২০৪১ সালের মধ্যে দেশকে উন্নত দেশের কাতারে নিয়ে যেতে আধুনিক, নিরাপদ এবং পরিবেশবান্ধব পরিবহন ও যোগাযোগ অবকাঠামোর ওপর জোর দিচ্ছে সরকার। আগামী এক থেকে দেড় বছরের মধ্যে এসব প্রকল্প চালু হলে যোগাযোগ ব্যবস্থায় নতুন এক মাইলফলকে পৌঁছে যাবে বাংলাদেশ। বাড়বে কর্মসংস্থান, বিকাশ ঘটবে পর্যটন শিল্পের। বদলে যাবে দেশের সামগ্রিক অর্থনীতি।
লেখক: সদস্য, সম্প্রীতি বাংলাদেশ ও সাবেক ছাত্রনেতা।