শিক্ষামন্ত্রী সস্প্রতি বলেছেন, শিগরিই দীর্ঘদিন যাবৎ বন্ধ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলো খুলে দেয়া হবে এবং এ ব্যাপারে সরকারের সব ধরনের প্রস্তুতি রয়ছে। তবে তিনি এ ব্যাপারে দুটি শর্তের কথা উল্লেখ করেছেন। এক. করোনার সংক্রমণ হার শতকরা ৫ ভাগে নেমে আসা এবং দুই. শতভাগ শিক্ষার্থীর টিকাদান সম্পন্ন হওয়া। এই লক্ষ্যেই টিকা গ্রহণকারীর বয়স কমিয়ে ১৮ বছরে নামানো হয়েছে।
সরকারের এমন সিদ্ধান্ত নিঃসন্দেহে উৎসাহব্যঞ্জক। দীর্ঘ দেড় বছর করোনা মহামারির কারণে দেশের সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ রয়েছে। বন্ধ না রেখেও যেমন উপায় ছিল না তেমনই আবার শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খোলা বা শিক্ষার্থীদের শিক্ষাজীবন অব্যাহত রাখার বিকল্প এবং কার্যকর পথ খুঁজে বের করতে সরকার নিঃসন্দেহে ব্যর্থ হয়েছে। ফলে শিক্ষার্থীরা সকল পর্যায়েই সীমাহীন ক্ষতির শিকার হয়েছেন। এ ক্ষতি পূরণ হবার নয়।
ভাবতেই খারাপ লাগে যে, দুটি বছর কোনো নতুন শিক্ষার্থী কোনো শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ভর্তি হতে পারেনি এবং তাদের জীবন থেকে কর্মজীবনে প্রবেশের যোগ্যতা অর্জনের সুযোগ থেকে পিছিয়ে পড়ছে। যার অভিঘাতে তাদের পরবর্তী জীবন ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে। আর যে লাখ লাখ শিক্ষার্থী এই দুবছর লেখাপড়া থেকে বঞ্জিত হয়ে বাইরে সময় পার করেছেন-তাদের অবস্থাও অনুরূপ। আবার যারা অনলাইনে পরীক্ষা দিয়ে পরবর্তী ধাপে উন্নীত হয়েছে, বাড়ি বসে তারা প্রায় সবাই বই খুলে পরীক্ষা দেয়ার ফলে তাদের প্রকৃত ফল জানা যায়নি। প্রায় সবাই ভালো নম্বর পেয়ে উত্তীর্ণ হয়েছে যা স্বাভাবিক সময়ে সম্ভব হতো না। যাহোক, আনন্দের খবর হলো ইতোমধ্যে করোনায় মৃত্যুর সংখ্যা ও হার এবং সংক্রমণের হার আনুপাতিক হিসেবে যথেষ্ট কমে এসেছে। এই প্রক্রিয়া অব্যাহত রাখাই বিশেষ প্রয়োজন।
কেন সংক্রমণ ও মৃত্যুর সংখ্যা ও হার কমে আসছে? না, এটা কোনো দৈব ঘটনা নয়। বিজ্ঞান এ কাজে শতভাগ সুযোগ করে দেয়াতেই তা সম্ভব হয়েছে। অর্থাৎ বৈজ্ঞানিকেরা করোনার ভ্যাকসিন আবিষ্কার করে তা বাজারজাতকরণ ও ব্যবহারের সুযোগ করে দেয়ায় এবং বাংলাদেশ ডবল ডোজ ভ্যাকসিন প্রদানের সংখ্যা বেড়ে যাওয়ায় মৃত্যু ও সংক্রমণ কমে এসেছে। তাই এই শুভ প্রক্রিয়া শুধু অব্যাহত রাখাই নয়-তা আরও বেশি জোরদার এবং গতিশীল সম্পন্ন হওয়া দরকার। সরকারি সূত্রে পাওয়া খবর অনুযায়ী সরকারের হাতে এখন যথেষ্ট টিকা মজুদ আছে এবং ভারত চীন ও অন্যান্য দেশ থেকে বিপুলসংখ্যক ভ্যাকসিন আসবে শিগগিরই। সুতরাং গণহারে টিকা প্রদান পুনরায় শুরু করার প্রস্তাব রাখছি। এক্ষেত্রে এমন করা যায় কি না যে, গ্রামাঞ্চলে যখন কোনো ইউনিয়নে টিকাদান কার্যক্রম শুরু করা হবে তখন প্রতিদিন নির্দিষ্ট কটি করে গ্রামের মানুষকে টিকা দেয়া হবে। একসঙ্গে ইউনিয়নের সব গ্রামের মানুষ জড়ো হলে শৃঙ্খলা রক্ষা করা কঠিন এবং তা কয়েক সপ্তাহ আগে যখন গণটিকা দেয়া হচ্ছিল তখন দেখা গেছে।
শহরেও ওয়ার্ড ভিত্তিতে একই ব্যবস্থা নেয়া যেতে পারে। নির্দিষ্ট দুটি করে ওয়ার্ডে টিকাদান করলে সেখানেও সুশৃঙ্খলভাবে টিকাদান সম্পন্ন হতে পারে। তবে দুটি শর্ত। এক. রেজিস্ট্রেশন অন দ্য স্পট ব্যবস্থা চালু করা দরকার; দুই. টিকাদানের বুথের সংখ্যা বাড়াতে হবে। শুধু জাতীয় পরিচয়পত্র দেখেই যেন ভ্যাকসিন দেয়া হয় এবং কমবয়সী যারা এখনও জাতীয় পরিচয়পত্র পাননি-তাদের জন্য ভিন্ন কোনো সহজ ও গ্রহণযোগ্য কার্যকর পদ্ধতি গ্রহণ করা হোক।
সরকার টিকা গ্রহণকারীদের বয়ঃসীমা ১৮ করেছে। এর ফলে এইচএসসি থেকে উপরের শিক্ষার্থীরা টিকা নিতে পারবে। সে ক্ষেত্রে প্রাথমিক ও উচ্চ বিদ্যালয়ে যে লাখ লাখ ছেলেমেয়ে শিক্ষা গ্রহণ করছে এবং যারা স্কুল খোলার পরে নানা শ্রেণিতে নানা পর্যায়ে ভর্তি হবে তাদের তো টিকা দানের আওয়তায় আনা যাবে না। তা হলে হাজার হাজার মাধ্যমিক ও প্রাথমিক বিদ্যালয় কি আরও অনির্দিষ্টকাল বন্ধ রাখা হবে? তাই যদি হয় তবে তা হবে আত্মঘাতী। শিক্ষার সুযোগের ক্ষেত্রে স্তরভেদে সামান্যতম বৈষম্য করা নেহায়তেই অনুচিত।
তাই শিশু-কিশোরদের দ্রুত শিক্ষাঙ্গনে ফিরিয়ে আনা এবং নতুনদের ভর্তির সুযোগ দ্রুত সৃষ্টি করা প্রয়োজন। আর তা করতে হলে টিকা গ্রহণকারীর বয়স নামিয়ে আনা প্রয়োজন। যদিও বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা ১৮ বছরের নিচে কারো ওপর টিকা প্রয়োগ করে এর অনুমোদন কোনো দেশেই দেয়নি। তবে দুয়েকটি দেশ এরই মধ্যে শিশুদের ওপর টিকা প্রয়োগ করেছে। সেটি কতটা সাফল্য বয়ে আনবে তা দেখার বিষয়। বাংলাদেশে আদৌ সম্ভব কি না সেটিও ভাবা দরকার। নইলে শিক্ষার্থী শিশু, কিশোর-কিশোরী, তরুণ-তরুণীদের পদচারণায় আবার মুখরিত করে তোলা দুষ্কর।
এ ব্যাপারে আমি শুধু টিকা গ্রহণের বয়স নামিয়ে আনার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করতেই বলছি না বরং আরও বলছি, পর্যায়ক্রমে বারো বছরের শিশু তারপরে ২০ বছরের তরুণ-তরুণীদেরকে এবং অতঃপর ২০ থেকে ৪০ বছর বয়স্ক নারী-পুরুষকে টিকাদান করা হোক। অব্যশই কম বয়সীদের এ ব্যাপারে অগ্রাধিকার পাওয়া উচিত।
বিষয়টি আরও অনেক বেশি গুরুত্বপূর্ণ যে, একদিকে যেমন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলো বন্ধ থাকায় শিক্ষাদান ও শিক্ষাগ্রহণ বন্ধ থাকছে তাই নয় এর ফলে বেশ কিছু সামাজিক সংকটও তৈরি হচ্ছে। যেমন লেখাপড়ার সুযোগ বন্ধ-তাই অনেক অভিভাবক কম বয়সী মেয়েদেরকে বিয়ে দিয়ে দিচ্ছেন ফলে বাল্যবিবাহ, অকাল মাতৃত্ব এমন সংকটের সৃষ্টি হচ্ছে। শিশু-কিশোর তরুণ-তরুণীদেরকে দিন রাত্রির বেশিরভাগ সময় বাড়িতে আবদ্ধ থাকার ফলে তাদের শারীরিক ও মানসিক বিকাশও বাধাগ্রস্ত হচ্ছে। এর পরিণতিতে আগামী ১০ বছরের মধ্যে একটা বড় ধরনের সমস্যায় পড়তে হতে পারে।
আবার অপ্রত্যক্ষ সংকটও সৃষ্টি হয়েছে। এটি অর্থনৈতিক। স্কুল-কলেজ তো শুধু আগের মতো শহরেই সীমাবদ্ধ থাকছে তা নয়, গ্রামাঞ্চলেও অসংখ্য শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। তাই শিক্ষার্থীদের নিজ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে যাতায়াতের যানবাহন যথা বাস, স্কুটার, রিকশা প্রভৃতিও যাত্রীর অভাবে দেড় বছর যাবৎ অর্থকষ্টে ভুগছিল তারও অনেকটা সুরাহা হবে। পথঘাট শিক্ষাঙ্গনে আবার প্রাণচঞ্চল হয়ে উঠবে।
শুধু টিকাদানই নয়। নিয়মিত শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোর প্রতিটি রুম এবং আঙিনা জীবাণুমুক্ত করার জন্য স্প্রে, মাস্ক ও শারীরিক দূরত্ব বজায় রেখে-অর্থাৎ স্বাস্থ্যবিধি পুরোপুরি মেনে ক্লাস পরিচালনার ব্যবস্থা করতে হবে।
লেখক: একুশে পদকপ্রাপ্ত সাংবাদিক।