আমাদের দেশে সাধারণত জুন থেকে সেপ্টেম্বর পর্যন্ত বড় বন্যা হয়ে থাকে। গত কয়েক বছর ধরে সেরকমই দেখা যাচ্ছে। কিন্তু এবার আগস্টের শেষদিকে এসেও বন্যার সেরকম বড় কোনো আভাস পাওয়া যায়নি। তবে বন্যা না হলেও পানি উন্নয়ন বোর্ড (পাউবো) আশঙ্কা উড়িয়ে দিতে চায় না। কারণ, সেপ্টেম্বর পার না হওয়া পর্যন্ত বন্যা হবে না এমনটি নিশ্চিত হওয়া যায় না।
২০১৩ সালের পর দেশে প্রতিবছরই বড় বন্যা হচ্ছে। ২০১৬ ও ১৭ সালে বন্যা পরিস্থিতি ভয়াবহ রূপ নিয়েছিল। উত্তরবঙ্গসহ দেশের একটি বড় এলাকা প্লাবিত হয়। ২০২০ সালেও তিন দফা বন্যা হয়েছে এবং তাতে দেশের প্রায় অর্ধেক জেলার নিম্নাঞ্চল প্লাবিত হয়। প্রতিবছর জুন থেকে সেপ্টেম্বর পর্যন্ত এমন আশঙ্কা থাকে।
এ সময়ে বাংলাদেশে বন্যার প্রধান কারণ অতিবৃষ্টি। এ বৃষ্টি বাংলাদেশের ভূখণ্ডের মধ্যেও হতে পারে আবার সীমান্তবর্তী ভারতীয় ভূখণ্ডের মধ্যেও হতে পারে। শুধু ভারত নয়, উজানে থাকা দেশ চীন, নেপাল ও ভুটান থেকে নেমে আসা পানি না-হয় পাহাড়ি ঢল অথবা বৃষ্টি মূলত বাংলাদেশের বন্যার জন্য দায়ী। বাংলাদেশ ভাটিতে অবস্থিত বলেই উজানের পানি বাংলাদেশে বন্যা সৃষ্টি করে। শুষ্ক মৌসুমে এদেশ যেমন পানি তথা নাব্যতা সংকটে ভোগে, বর্ষা মৌসুমে ঠিক তার বিপরীত চিত্র দেখা যায়। বাংলাদেশের ভৌগোলিক অবস্থানের জন্যই এমন হয়ে থাকে। এছাড়া আন্তর্জাতিক নদী ও পানি আইনের প্রয়োগ না থাকায় এক্ষেত্রে কোনো ন্যায্যতা লক্ষ করা যায় না।
দেশের নদ-নদীগুলো আজ সমতলের সঙ্গে একাকার। জলাধার বলতে দেশে আজ আর কিছু অবশিষ্ট নেই। ফলে স্বাভাবিকভাবেই বৃষ্টি থেকে বন্যা হতে সময় লাগে না। এরকম অবস্থায় বন্যা পরিস্থিতি আরও দীর্ঘ হয়। জলপ্রবাহের জায়গা না থাকায় শুষ্ক মৌসুম পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হয়। তবে এখন যেহেতু আগস্টের শেষ, তাই বৃষ্টি বা বন্যা হলেও তা স্বল্পমেয়াদি হওয়ার আশঙ্কা বেশি। কারণ সেপ্টেম্বর পার হলেই শুষ্ক মৌসুম শুরু হয়ে যাবে।
বাংলাদেশ তথা এ অঞ্চলের জলবায়ু বিবেচনায় সে রকমটিই হওয়াই স্বাভাবিক। কিন্তু ইতোমধ্যেই দেশে যে বৃষ্টিপাত ঘটেছে ও উজানের পানি এসে জমা হয়েছে তা দেশের কিছু অঞ্চলে বন্যা পরিস্থিতি সৃষ্টি করেছে। উজান থেকে আসা এ পানির গন্তব্য বঙ্গোপসাগর। বাংলাদেশি ভূখণ্ডের বিভিন্ন নদী অতিক্রম করে এই উজানের পানি বঙ্গোপসাগরে যায়। স্বাভাবিকভাবেই এই নদীর অববাহিকাগুলো তলিয়ে যায়। নাব্যতা না থাকার কারণে অল্প পানিতেই নদীগুলো প্লাবিত হয়ে যায়। দেশের উত্তর ও উত্তর-পশ্চিমাঞ্চলের নদ-নদীগুলোই আগে প্রভাবিত হয়।
গণমাধ্যমে প্রকাশ কুড়িগ্রাম, সিরাজগঞ্জ, পাবনা, কুষ্টিয়া, মানিকগঞ্জ, রাজবাড়ী, ফরিদপুর ও শরীয়তপুর জেলায় পানি বেড়েছে। যদি তাই হয়, তবে এখন শুধু উত্তরের নদী নয়, মধ্যভাগ এমনকি নিম্নাঞ্চলের নদীগুলোও প্লাবিত হয়ে যাবে। রাজবাড়ীর গোয়ালন্দে পদ্মার পানি ইতোমধ্যে বিপৎসীমার ৪৯ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। একই খবর পাওয়া যাচ্ছে ধরলা, যমুনা, আত্রাই, পদ্মা ও গড়াই নদীর ক্ষেত্রেও।
পাউবো বলছে- গত তিন সপ্তাহ ধরে গড়াই নদীর পানি প্রতিদিনই একটু করে বাড়ছে। এভাবে পানি বাড়লে গড়াইয়ের বাঁধ ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে। একই চিত্র দেখা যাবে যমুনায়। যদি বাঁধ ক্ষতিগ্রস্ত হয় তবে সিরাজগঞ্জ, পাবনা, কুষ্টিয়া, মানিকগঞ্জ, রাজবাড়ী, ফরিদপুর ও শরীয়তপুর জেলায় বন্যা দেখা দিতে পারে।
শ্রাবণের শেষ ও ভাদ্রের শুরুতে সাধারণত মরা কাটাল ও ভরা কাটালের প্রভাবে নদীর পানি বৃদ্ধি পায়। এছাড়া এসময়ে ফারাক্কা থেকে আসা পানিও এর সঙ্গে যোগ হয়। এখন ভাদ্রের শুরু। কাজেই এখন পানি বাড়ার একটি সম্ভাবনা রয়েছে। এর সঙ্গে যদি বৃষ্টিপাত যোগ হয়, তবে নদীর পানি বাড়বে। বৃষ্টিপাত না হলে নদীর জোয়ার-ভাটার স্বাভাবিক প্রবাহই বহাল থাকবে।
আমাদের নদ-নদীগুলোর স্বাভাবিক পানি প্রবাহ আজ অনেকাংশেই ক্ষতিগ্রস্ত। নদীকে আমরা আক্ষরিক অর্থেই শাসন করতে চেয়েছি। বুঝতে চাইনি নদীর মন, আবেগ ও তার ছুটে চলার প্রবণতা। বুঝতে চাইনি তার মিলন ও বিশ্রামের প্রয়োজনীয়তাকেও। নদী ও পানিবিজ্ঞান তথা নদীর ঐতিহাসিক গতিধারাকে পাত্তা না দিয়ে বাঁধ নির্মাণ করা হয়েছে অনেক ক্ষেত্রে।
আধুনিক বিজ্ঞান ও লোকজ জ্ঞানকেও পাত্তা দেয়া হয়নি নদী শাসনে। যেখানে সেখানে ব্রিজ-সেতু নির্মাণ ও সেতুরক্ষা বাঁধ দিয়ে নদীকে বলেছি ‘থাম’! নদী আমাদের কথা শুনে কোথাও চিরদিনের জন্য থেমে গেছে। তাই বর্ষায় সে খরস্রোতা আর শুষ্ক মৌসুমে সে মরা। মূলত সে প্রতিবাদী।
নদীশাসনের নামে আমরা শুধু নদীতে বাঁধ দেয়া ও ড্রেজিংয়ের ওপরই গুরুত্ব দেই। কিন্তু এভাবে নদীতে (বিশেষ করে পলিবাহী নদীতে) যান্ত্রিক খনন নদীর জলপ্রবাহের কোনো স্থায়ী বা প্রাকৃতিক সমাধান দিতে পারে না। ফলে আমরা প্রতিবছরই দেখি নদী খনন করতে। এতে শুধু নদীরই ক্ষতি হয় না, ক্ষতিগ্রস্ত হয় নদীর জীববৈচিত্র্য।
আর নদীর বাঁধও স্থায়ী কোনো সমাধান দিতে পারে না। ফি বছরই ক্ষতিগ্রস্ত হয় নদীর বাঁধের কোনো না কোনো অংশ। নদীর বাঁধের একদিকে সংস্কার হয় তো আরেক দিকে ফাটল দেখা দেয়। তাৎক্ষণিক বন্যা নিয়ন্ত্রণের জন্য নদীর তীরে বালুর বস্তা ফেলা হয়। এতে অস্থায়ীভাবে হয়তো কিছুটা রক্ষা হয়, কিন্তু শেষরক্ষা হয় না। বাঁধে ফাটল ধরলে পাউবো দোষ দেয় নির্দোষ নদীকে।
বন্যা বা নদীর পানি বাড়ার সঙ্গে নদীভাঙন যেন অবিচ্ছেদ্যভাবে জড়িয়ে আছে। প্রতিবছরই নিঃস্ব হয় অসংখ্য মানুষ। বসতবাড়ি হারিয়ে মানুষ পাড়ি দেয় অজানা গন্তব্যে।
পরিসংখ্যান বলছে, গত চল্লিশ বছরে অন্তত এক লাখ হেক্টর ভূমি নদীগর্ভে বিলীন হয়ে গেছে। মানুষ হারিয়েছে ভিটেমাটি, আবাদি জমি। এছাড়া রাস্তাঘাট, সরকারি-বেসরকারি অনেক অবকাঠামোও হারিয়ে গেছে নদীগর্ভে। এসবের আর্থিক ক্ষতির হিসাব কারো জানা নেই।
দেশের বন্যা পরিস্থিতি হয়তো এখনও প্রাথমিক অবস্থায় আছে। এ সময়ে আমাদের দেশে পানি বাড়া বা বন্যা হওয়া একটি স্বাভাবিক বিষয়। পাউবো, নদী কমিশন, বিআইডব্লিউটিএ’র এ বিষয়টি অবশ্যই জানা। কাজেই এ বিষয়ে তাদের সব সময়ের প্রস্তুতি থাকার কথা। স্বল্প ও দীর্ঘমেয়াদি প্রস্তুতি ও পরিকল্পনা থাকা জরুরি। হয়তো সেই পরিকল্পনা আছে। কিন্তু তারপরও বন্যা পরিস্থিতি দেখা দিলে সব কিছুতেই একটা সমন্বয়হীনতা চোখে পড়ে। এমনকি বন্যাকবলিত এলাকাগুলোয় ত্রাণ সরবরাহ ও পুনর্বাসনেও সমন্বয়হীনতা চোখে পড়ে।
নদীভাঙন, বন্যা ও নাব্যতা সংকট- নদীর সঙ্গে আমাদের এ ত্রিমুখী লড়াই চলছেই। এ লড়াই হয়তো কখনই শেষ হবার নয়। কিন্তু লড়াইয়ে টিকে থাকতে হলে স্বল্প ও দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা থাকতে হবে। বিজ্ঞান ও লোকজ জ্ঞানের সমন্বয়ে তৈরি হতে পারে এই ধরনের পরিকল্পনা। স্থানীয় জনগণের সম্পৃক্ততাকে গুরুত্ব দিতে হবে। নদীর ঐতিহাসিক গতি ও প্রবহমান ধারা ও মৌসুমভেদে এর আচরণের ভিন্নতা, অন্য নদীর সঙ্গে এর মিথস্ক্রিয়া- এ বিষয়গুলো বন্যা ও নদী ব্যবস্থাপনার সঙ্গে সম্পৃক্ত। শুধু বন্যা হলে ‘হায় হায়’ এ প্রবণতা নদীভাঙন, বন্যা ও নাব্যতা সংকটের কোনো সমাধান দিতে পারবে না। এক্ষেত্রে একটি সমন্বিত স্বল্প ও দীর্ঘ মেয়াদী পরিকল্পনা কাম্য।
লেখক: আইনজীবী, কলাম লেখক।