সম্প্রতি বিআইডিএস আয়োজিত এক সভায় পরিকল্পনামন্ত্রী এম এ মান্নান বলেছেন, ‘বাংলাদেশ উন্নয়নের যে মডেল অনুসরণ করছে তাতে অর্থনৈতিক বৈষম্য বাড়ছে।’ এ বৈষম্য খুব সহসা কমবে, এমন সম্ভাবনা কম বলেও তিনি মন্তব্য করেছেন।
পরিকল্পনামন্ত্রী নিঃসন্দেহে বাস্তবসম্মত কথা বলেছেন। কিন্তু তার এ বক্তব্যে হতাশাই বাড়াবে। কেননা, বৈষম্য কোনো ভালো জিনিস নয়। কিছু লোকের হাতে টাকাপয়সা জমা হচ্ছে। তারা ভোগবিলাসে জীবন কাটাচ্ছেন। আর কিছু লোক দরিদ্র থেকে অতিদরিদ্রে পরিণত হচ্ছেন। তারা বেঁচে থাকার জন্য ন্যূনতম সুযোগ-সুবিধাটুকুও পাচ্ছেন না। এটা কোনো সমাজের জন্যই কাঙ্ক্ষিত নয়।
পরিকল্পনামন্ত্রীর কাছ থেকে দেশবাসী এর নিদান দেখতে চান। কিন্তু তিনি বৈষম্যের ফাঁদ বের হওয়ার কোনো নিদান না দিয়ে বরং বৈষমকেই ‘অনিবার্য’ মনে করছেন। এটা মোটেও কাঙ্ক্ষিত নয়।
তার মানে আমাদের দেশে বৈষম্য বাড়তে থাকবে, চলতেই থাকবে? বৈষম্য কমানোর জন্য পরিকল্পনামন্ত্রী বা সরকারের কিছুই করার নেই?
একথা ঠিক যে, বৈষম্য কমবেশি সব দেশেই আছে। কিন্তু কল্যাণকামী রাষ্ট্রে বৈষম্য কমানোর জন্য রাষ্ট্রীয় বিভিন্ন উদ্যোগ-আয়োজন আছে। কিন্তু আমাদের দেশেই এ ব্যাপারে কেমন যেন একটা ‘হাল ছাড়া’ ভাব লক্ষ করা যায়। বৈষম্য বন্ধ করা তো দূরের কথা, বৈষম্য কমানোরও কোনো সংকল্প দেখা যায় না। এটি কমিয়ে আনতে দরকার করনীতি সামঞ্জস্যপূর্ণ ও কার্যকর করা। দ্বিতীয় হচ্ছে ধনীক শ্রেণির কাছ থেকে অধিক হারে কর আদায় করা। পাশাপাশি কালোটাকা কমিয়ে আনা। কিন্তু এগুলো কিছুই করা হচ্ছে না।
বাংলাদেশ এখন কালোটাকার উর্বর ক্ষেত্র হয়ে দাঁড়িয়েছে। এটি মূলত হচ্ছে দুর্নীতির কারণে। দুর্নীতি এখন সর্বগ্রাসী রূপ ধারণ করে প্রশাসনের সবখানে ছড়িয়ে পড়েছে। সুশাসনের অভাব তীব্র হওয়ায় বাড়ছে কালো টাকা। সুশাসন নিশ্চিত করার কোনো তাগিদ নেই। কালোটাকার উৎস বন্ধ করারও কোনো দৃঢ় পদক্ষেপ নেই।
ফলে আয় বৈষম্য দিন দিন বেড়েই চলেছে। করোনায় তা আরও মারাত্মক আকার ধারণ করেছে। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের হিসাবে গেছে, এক বছরে দেশে কোটিপতির সংখ্যা বেড়েছে সাড়ে ১১ হাজার। অপরদিকে বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠানের জরিপে উঠে এসেছে নতুন করে প্রায় আড়াই কোটি মানুষ দরিদ্র হওয়ার চিত্র।
আয় বৈষম্য মারাত্মক আকার ধারণ করার কারণ হচ্ছে দুর্নীতির মাধ্যমে কালোটাকা অর্জন, হন্ডির মাধ্যমে দেশ থেকে টাকা পাচার, প্রণোদনা প্যাকেজের টাকা ভিন্ন খাতে স্থানান্তর, করনীতিতে অসামঞ্জস্য, ধনীদের কাছ থেকে কম হারে কর আদায় ও বিনিয়োগ বন্ধ থাকা। এসব কারণে একশ্রেণির মানুষের বৈধ ও অবৈধ উপায়ে আয় বাড়ছে। পক্ষান্তরে আয় কমছে কোটি কোটি মানুষের। নানা কারণে পিছিয়ে পড়া মানুষ আরও পিছিয়ে পড়ছেন।
এমনকি গরিব ও পিছিয়ে পড়াদের জন্য বিশেষ উদ্যোগ বা সংরক্ষণও তেমন একটা জোরদার নয়। ‘অ্যাফার্মেটিভ অ্যাকশন’ বস্তুটার— সংরক্ষণ যার অতি জরুরি অংশ— দার্শনিক ভিত্তি মিলবে ডিস্ট্রিবিউটিভ জাস্টিস বা বণ্টনের ন্যায্যতার তত্ত্বে। সেই ধারায় অনেক তত্ত্ব, তার অনেক অভিমুখ। কিন্তু, মূল সুরটাকে যদি বের করে নিয়ে আসতে হয়, তবে তা এই রকম: ভাগ্যের কারণে যেন কাউকে বঞ্চিত না হতে হয়।
আমাদের দেশে বিভিন্ন আদিবাসী, দলিত, প্রতিবন্ধী, নারী প্রমুখ জনগোষ্ঠীকে দীর্ঘ কাল উন্নয়নের যাবতীয় সুযোগ-সুবিধার বাইরে রেখেছে। শিক্ষায়, স্বাস্থ্যে, পেশা বাছাইয়ের স্বাধীনতায়, বহু প্রজন্ম ধরে এসব কিছুর বঞ্চনা যে জনগোষ্ঠীকে উন্নয়নের দৌড়ের শেষ সারিতে রেখেছে। এর জন্য নিজেরা মোটেও দায়ী নয়।
এমন মানুষদের বঞ্চনার ঘেরাটোপ থেকে বের করে আনার জন্যই সংরক্ষণ। মদ খেয়ে, অথবা জুয়া খেলে সর্বস্বান্ত হলে, বা ব্যবসায় কারো ভরাডুবি হলে কিন্তু সরকার সংরক্ষণের ব্যবস্থা করে না। কথাটা এমনই স্বতঃসিদ্ধ যে হাস্যকর ঠেকতে পারে। হাসির কথা কিন্তু নয়। কোন দুর্ভাগ্য নিজের তৈরি করা, অর্থাৎ যাকে এড়ানো যায় বা যেত, আর কোন দুর্ভাগ্যের ওপর নিজের কোনো হাত থাকা সম্ভব নয়, অর্থাৎ যা এড়ানো অসম্ভব— ন্যায্যতার বিচারে সেটা মস্ত প্রশ্ন। যে দুর্ভাগ্য নিজের নিয়ন্ত্রণের বাইরে, একমাত্র তাতেই সংরক্ষণের দাবি করা যায়।
যে অর্থনৈতিক দুর্ভাগ্য নিজের ডেকে আনা, তার জন্য সংরক্ষণের দাবি করা যায় না, সেটা স্পষ্ট। কিন্তু, নিয়ন্ত্রণাতীত দুর্ভাগ্যের শিকার হওয়া সংরক্ষণের আওতায় আসার জন্য জরুরি, কিন্তু যথেষ্ট নয়। সেই ‘দুর্ভাগ্য’ তৈরি হচ্ছে কীভাবে, সেটা জানা প্রয়োজন— ব্যক্তির কারণে, না কি সমষ্টির কারণে? ‘সংরক্ষণ’ আসলে একটা রাষ্ট্রীয় প্রায়শ্চিত্ত। ক্ষতিপূরণ।
কিছু জনগোষ্ঠী একটি নির্দিষ্ট পরিচিতির কারণেই দীর্ঘকাল ক্ষমতাবান জনগোষ্ঠীর হাতে বৈষম্যের শিকার, এবং সেই কারণেই অর্থনীতির বিভিন্ন স্তরে তাদের প্রতিনিধিত্ব স্বাভাবিকের চেয়ে কম— এই ভুলটা শুধরে দেয়া ছাড়া সংরক্ষণের আর কোনো ভূমিকা থাকতে পারে না। ফলে, সংরক্ষণের আওতায় আসতে হলে শুধু দুর্ভাগ্যের শিকার হলেই চলবে না, সেই দুর্ভাগ্য হতে হবে সমষ্টিগত পরিচিতির কারণে।
সংরক্ষণ যে পাল্টা বৈষম্য তৈরি করে— অর্থাৎ, ঐতিহাসিকভাবে বঞ্চিতদের বাড়তি সুযোগ করে দেয় তথাকথিত সংখ্যাগরিষ্ঠ ও মূলধারার ব্যক্তিদের সুযোগ থেকে খানিকটা কেড়ে নিয়ে— ইতিহাসের কারণেই তাকে মেনে নেওয়া ছাড়া উপায়ান্তর নেই। সময়ের উলটো দিকে যেহেতু যাওয়া যায় না, অতএব যারা অন্যায় করেছিল, তাদের উত্তরসূরিদেরই প্রায়শ্চিত্তের দায় নিতে হবে। এই প্রায়শ্চিত্ত ছাড়া অ্যাফার্মেটিভ অ্যাকশন হয় না।
তা হলে কি ঐতিহাসিকভাবে বৈষম্যের শিকার না হলে উন্নয়নের সুযোগ পাওয়ার উপায় নেই? সেই দায় তা হলে কার? দায় রাষ্ট্রেরই। কোনো ঘটনার আকস্মিকতায় কারো যদি পা পিছলেও যায়, সে যাতে সামলে নিতে পারে, একেবারে তলানিতে গিয়ে ঠেকতে না হয় তাকে, তা নিশ্চিত করার দায় রাষ্ট্রের। স্বাধীন বাংলাদেশ সেই দায় নেয়ার জন্য তৈরি হয়েছিল। তখন বলা হয়েছিল, দেশের প্রতিটি শিশু যাতে উন্নতির সমান সুযোগ পায়, সবার যেন শিক্ষার সমান অধিকার থাকে, সমান পুষ্টি জোটে, তা নিশ্চিত করাই রাষ্ট্রের সবচেয়ে বড় দায়িত্ব। কথাটাকে ভেঙে দেখলে পিছিয়ে পড়া বঞ্চিতদের পাশাপাশি অন্যদের প্রতি রাষ্ট্রের দায়িত্বের জায়গাটা স্পষ্ট হতে পারে।
ধরা যাক, একটা পাঁচিলঘেরা জমির মধ্যে একটা বাড়ি, সেই বাড়িতে সমৃদ্ধি থাকে, উন্নয়ন থাকে। কিছু লোক আছে পাঁচিলের ভিতরে, কিছু লোক পাঁচিলেরও বাইরে। সংরক্ষণ হলো- পাঁচিলের গেটটুকু খোলা, যাতে বাইরের লোকেরাও ভিতরে আসতে পারে। এর পর বাড়ির দরজা-জানালা খোলার কাজ। রাষ্ট্র সবার জন্য সে দরজাগুলো খুলবে।
তার উপায় কী? কয়েকটা উদারণ দেয়া যেতে পারে। সবার জন্য শিক্ষা একটা উপায়। সবার জন্য স্বাস্থ্য আর একটা উপায়। এবং সবাই যাতে সেই ‘সর্বজনীন শিক্ষা’ আর ‘সর্বজনীন স্বাস্থ্য’-ই ব্যবহার করে, তা নিশ্চিত করা। আমাদের দেশে বাজার এসে সর্বজনীন ব্যবস্থাকে নিয়ে গেছে। সরকার এখনও স্কুল চালায়, হাসপাতাল চালায়। কিন্তু, চাকরির বাজারে যে শিক্ষার দাম, তা পেতে গেলে বেসরকারি স্কুলের দ্বারস্থ হওয়া ছাড়া উপায় নেই; আত্মসম্মান বজায় রেখে চিকিৎসা পরিষেবা পেতে পেলে কর্পোরেট হাসপাতালই গতি। গরিবের জন্য বৈষম্য সৃষ্টি করার এমন পথ আর হয় না। স্বাস্থ্যখাতে সরকার ব্যয়বরাদ্দ বাড়ায় প্রায় না বাড়ানোর মতোই। ভঙ্গুরতর হতে থাকে সরকারি স্বাস্থ্য অবকাঠামো, আর মানুষ বাধ্য হন বেসরকারি হাসপাতালের ওপর আরও বেশি নির্ভরশীল হতে।
সবার জন্য সরকারি শিক্ষা বাধ্যতামূলক হলে চিকিৎসার খরচে সর্বস্বান্ত হওয়া বা অন্য কোনো কারণে দরিদ্র হয়ে যাওয়া পরিবারের পক্ষে অন্তত একটা বৈষম্য এড়ানো সম্ভব হতো। সবার সন্তানই বাধ্যতামূলকভাবে সরকারি স্কুলে গেলে সেই স্কুলগুলোর মানেরও উন্নতি হতো কি না— সেই তর্ক আলাদা। কিন্তু, চাকরির ক্ষেত্রে স্কুলের পার্থক্যের ফলে বড়লোকের ছেলের সঙ্গে গরিবের ছেলের যোগ্যতাগত ফারাক হতো না। পারিবারিক অবস্থার তারতম্যের ফলে সন্তানের ‘সক্ষমতা’র মানে ফারাক তৈরি হতো না। সবার জন্য দরজা খোলার এটাই তো উপায়। যেমন উপায় গণবণ্টন ব্যবস্থাকে আরও মজবুত করে তোলা। স্কুলে মিড ডে মিল চালু করে পুষ্টিকর খাবারের ব্যবস্থা করা এবং ধনী-গরিব নির্বিশেষে সব বাচ্চাকে সেই খাবারের থালায় বসানো।
সবার জন্য সক্ষমতার সাম্য তৈরির পথ খুঁজে বের করা রাষ্ট্রের দায়িত্ব। রাষ্ট্রকে সে পথে হাঁটতে বাধ্য করা নাগরিকের দায়িত্ব। কিন্তু দুঃখজনক হলেও সত্যি যে, আমরা সে পথেও হাঁটছি না!
লেখক: কলাম লেখক, সাবেক ছাত্রনেতা।