'শুক্রবারে কে এসে আমায় মা বলে ডাক দেবে? আমার কাছে ভাত খেতে চাইবে? আমার আগে তুই চলে গেলি কেন বাজান? '
ছেলের মৃত্যুর সংবাদ পেয়ে কান্নায় ভেঙে পড়ে কথাগুলো বলছিলেন আব্দুল্লাহ আল মামুন রাজার মা নুরুন নাহার।
পূবালী ব্যাংকের ঢাকার মোগলটুলী ব্রাঞ্চ শাখার প্রিন্সিপাল অফিসার হিসেবে কাজ করতেন ৪২ বছর বয়সী রাজা। ১০ বছরেরও বেশি সময় ধরে তিনি স্ত্রী ও সন্তানকে নিয়ে ঢাকাতে বসবাস করতেন।
পরিবারের ভাষ্য, সম্প্রতি রাজা খুলনায় বদলির জন্য আবেদন করেছিলেন। তাই তিন মাস আগে স্ত্রী ও সন্তানকে খুলনার রায়েরবাগ এলাকায় ভাড়া বাড়িতে রেখে গিয়েছিলেন। এরপর প্রতি বৃহস্পতিবার রাতে ঢাকার কর্মস্থল থেকে তিনি খুলনা চলে আসতেন, আবার রোববার সকালে কর্মস্থলে ফিরে যেতেন।
প্রতি সপ্তাহের মতো এবারও রোববার বাড়ি থেকে কর্মস্থলের দিকে রওনা হন রাজা। কিন্তু মাদারীপুরের শিবচরের এক্সপ্রেসওয়ের কুতুবপুর এলাকায় সড়ক দুর্ঘটনায় তিনি নিহত হন। এ দুর্ঘটনায় নিহতের সংখ্যা বেড়ে ১৯ জনে দাঁড়িয়েছে।
রাজার বাড়িতে গিয়ে দেখা যায়, স্থানীয়রা তাদের বাড়তে ভিড় করেছন। লাশ দাফনের জন্য বাড়িতে নিয়ে আসা হয়েছে খাটিয়া। তার মা শোকে বারবার কেঁদে উঠছেন।
নুরুন নাহার বলেন, 'সকাল ৫ টায় আমার বাজান ঢাকাতে রওনা দেন। তার ১০ টার ব্যাংকে পৌঁছানোর কথা। তবে ব্যাংক থেকে আমাদের জানানো হয়, রাজা ব্যাংকে যাননি। তখন আমরা ধারাবাহিকভাবে তাকে মোবাইল করতে থাকি। তবে কেউ রিসিভ করেনি। পরে এক অটোরিকশা চালক এসে জানান, যে বাসে আমার বাজান ঢাকা যাচ্ছিল, সেটা এক্সিডেন্ট করেছে।'
রাজার বাবা শেখ মোহাম্মদ আলী বাংলাদেশ কৃষি ব্যাংকের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা ছিলেন। ২০০৯ সালে তিনি অবসরে যান।
শেখ মোহাম্মদ আলী বলেন, 'আমার ৩ ছেলে ও এক মেয়ে রয়েছে। এর মধ্যে রাজা ছিল মেজো সন্তান। সন্তানদের মধ্যে রাজাই একমাত্র চাকরি করতেন।'
তিনি জানান, রাতেই রাজাকে সরকারি গোরস্থানে দাফনের সিদ্ধান্ত হয়েছে।
আরও পড়ুন:রিতা,
তুমি বোধহয় ভালই আছ। আর থাকবে নাই বা কেন। তুমি এখন এক স্বাধীন ও সার্বভৌম রাষ্ট্র বাংলাদেশের নাগরিক হয়েছ। আমাদের দুঃখ-দুর্দশা হয়ত তোমার অজানা নেই। আমাদের অবস্থা যে কতদূর চরম তা তুমি কল্পনাও করতে পারবে না।
একদিন আমাদের বাড়ীতে একদল লোক এসে আমাদের কিছু জিনিসপত্রসমেত আমাকে একটি জিপে তুলে নিয়ে যায়। কোথায় যাচ্ছি তাও জানি না। কেবল শুনতে পাচ্ছি আমাদের পেছনেও কয়েকটি গাড়ি আসছে। পথে গাড়ির মধ্যেই অমানসিক অত্যাচার শুরু হল। শিবিরে জীপ পৌঁছাল এবং আমায় শিবিরে ঠেলে নামিয়ে দেওয়া হল। সেখানে দেখলাম আমার মতই আরও কয়েকজন মেয়ে রয়েছে।
কিছুক্ষণ পর একদল ‘পশু’ শিবিরে এসে আমাদের উপর অত্যাচার শুরু করে দিল। দিনের পর দিন সন্ধ্যায় আমাদের নিয়ে যওয়া হয় এবং ভোর ৪টার সময় ছেড়ে দিয়ে যাওয়া হয়। কোনরকম বাধা দিলে যে অত্যাচার শুরু হতো তা অবর্ণনীয়। রবারের চাবুক দিয়ে তারা আমাদের নির্দয়ভাবে পেটায়। এই আতঙ্কে আমরা চরম অসম্মানজনক জীবনযাপন করতে বাধ্য হই।
...আমাদের চিঠি লেখার অধিকারও নেই। খাদ্য পাওয়াও কষ্টকর। রেডক্রস যদি কোন খাবার দেয় তাহলে ঐসব ‘পশুরা’ এসে ছিনিয়ে নিয়ে যায়। দিনে একবার মাত্র আমাদের খাবার দেওয়া হয়। খাবার হলো দেড় পিস রুটি আর এক গ্লাসস পানি। দিনে মাত্র তিন গ্লাস পানি দেওয়া হয়।
এই অত্যাচার সহ্য করতে না পেরে অনেক মেয়েই আত্মহত্যা করেছে। তাদের কবর অবধি দেওয়া হয় না। এসিড দিয়ে দেহ পুড়িয়ে দেওয়া হয়। যারা অন্তঃসত্ত্বা হয়ে পড়ে তারা সাধারণত সন্তান জন্মাবার আগেই মারা যায়। কয়েকজন আবার সন্তানের জন্ম দিয়েই মারা যায়। আমিও অন্তঃসত্ত্বা। কিন্তু আমরা কি করতে পারি? বাঙালী মেয়ে জন্মানই পাপ। এই অত্যাচার সহ্য করে আমি এখনও বেঁচে আছি। তবে আধমরা হয়ে আছি। মুজিব ভাই কি আমাদের রক্ষা করবে না? আমাদের এই চরম দুঃখ-দুর্দশার কথা বঙ্গবন্ধুর কানে তুলো।
-শীলা
পাকিস্তানি হানাদারের বন্দি শিবির থেকে লেখা এক নির্যাতিতা বাঙালির চিঠি এটি। বান্ধবী রিতার কাছে শীলা নামের এক বীরাঙ্গনার লেখা এই চিঠিতে উঠে এসেছে আমাদের স্বাধীনতার জন্য এ দেশের নারীদের অপরিসীম ত্যাগ আর হানাদার বাহিনীর নির্যাতনের চিত্র। দেশ তখন মুক্ত। তবু মুক্তি মেলেনি শীলাদের। নিজের মুক্তির জন্য এই নারীও তাই পথ চেয়ে আছেন সেই মহানায়কের, যার তর্জনীতে লুকিয়ে ছিলো বাঙালির স্বাধীনতা।
১৯৭২ সালের ২১ জুন সুনামগঞ্জ থেকে প্রকাশিত, গোলাম রব্বানী সম্পাদিত সাপ্তাহিক ‘বিন্দু বিন্দু রক্তে’ প্রকাশিত হয় এ চিঠি। কেবল নাম ব্যতীত চিঠিটির প্রেরক ও প্রাপকের আর কোনো পরিচয় উল্লেখ করা হয়নি।
প্রায় সমসাময়িক সময়ে সিলেট থেকে প্রকাশিত, আমীনুর রশীদ চৌধুরী সম্পাদিত সাপ্তাহিক ‘যুগভেরী’তে প্রকাশিত হয় স্বাধীনতা পরবর্তীকালেও পাকিস্তানি বন্দিশিবিরে আটক থাকা এক ব্যক্তির চিঠি। চিঠিটি লেখা হয়েছিল ১৯৭২ সালের ২৯ মার্চ। যুগভেরীতে এই পত্র লেখকের নাম ছাপানো হয়নি।
পিতার কাছে লেখা চিঠির শেষাংশে পত্র লেখক লিখেছেন, ‘... ধুপাদিঘীর পশ্চিমপাড়ে যাহা আছে এবং সেখানে যারা থাকে, যে হালে থাকে ঠিক সেভাবেই আছি। আর কাজ হচ্ছে- ওখানে তারা যে কাজ করে সেই কাজ। অনেকে আছি। এখানে যাদেরকে রাখা হয়েছে তাদের নামের পাশে লালকালি দিয়ে অনেক কিছু লেখা হচ্ছে। সবকিছু খুলিয়া লেখা সম্ভব নয়। কারণ তো বুঝতেই পারছেন। এখানে ১২০০-এর বেশী বিমান বাহিনীর লোক।’
উল্লেখ্য, পত্রে উল্লিখিত ধোপাদিঘির পশ্চিমপাড় বলতে কারাগার বুঝানো হয়েছে। এই স্থানে সিলেট কেন্দ্রীয় কারাগার-২ অবস্থিত।
এ তো গেলো বন্দিশিবির থেকে লেখা নির্যাতিতদের চিঠি। যুদ্ধের ময়দান থেকেও অনেক মুক্তিযোদ্ধা অস্ত্র পাশে সরিয়ে কখনো কখনো হাতে তুলে নিয়েছিলেন কলম। প্রিয়জন আর সহযোদ্ধাদের কাছে নিজের, যুদ্ধের আর দেশের অবস্থা জানিয়ে লিখেছিলেন চিঠি।
সেসব চিঠিতে মুক্তিযোদ্ধাদের অবর্ণনীয় দুর্ভোগ, সর্বগ্রাসী অভাব, দালালদের দৌরাত্ম্য সত্ত্বেও বীর যোদ্ধাদের সাফল্য গাঁথা ও চূড়ান্ত জয়ের দৃঢ় প্রত্যয় ব্যক্ত হয়েছে। এসব টুকরো টুকরো আশা, হতাশা, সান্ত্বনা, প্রতীজ্ঞাই হয়ে উঠেছে এখন মুক্তিযুদ্ধের দলিল।
মুক্তিযুদ্ধে সিলেট অঞ্চলের এক অনন্য যোদ্ধা সুলেমান হোসেন। ৪ নম্বর সেক্টরের হয়ে যুদ্ধ করেছেন তিনি। ১৯৭১ সালের ১০ ডিসেম্বর সিলেট শহরের ধুবড়ী হাওড়ের (অধুনা শাহজালাল উপশহর) কাছে প্যারাসুট দিয়ে হেলিকাপ্টার থেকে নামার পরই পাকিস্তানি সেনারা তাকে ঘিরে ফেলে। এরপর দীর্ঘক্ষণ ধরে চলা সম্মুখযুদ্ধ শেষে তিনি আহত অবস্থায় ধরা পড়েন। চূড়ান্ত বিজয়ের ঠিক আগ মূহূর্তে ১৪ ডিসেম্বর হানাদাররা তাকে প্রকাশ্যে গুলি করে হত্যা করে।
দেশ স্বাধীন হওয়ার পর সিলেটের জিন্নাহ হলের নাম পাল্টে ‘শহীদ সুলেমান হল’ করা হয়। যুদ্ধচলাকালীন পরিবার-পরিজনকে বেশকিছু চিঠি লিখেছিলেন সুলেমান। চিঠিগুলোর বেশিরভাগই তার প্রবাসী বড় ভাইয়ের কাছে অর্থ সাহায্য চেয়ে লেখা।
একাত্তরের ১৬ এপ্রিল আসাম থেকে বড় ভাইকে লেখা সুলেমানের চিঠিতে ফুটে উঠেছে আর্থিক দৈন্য আর দুর্ভোগের চিত্র। চিঠির একাংশে সুলেমান লিখেছেন, ‘... বর্তমানে আমাদের মৃত্যুর দুইটি পথ খোলা আছে। একটি হইল বুলেট, অন্যটি হইল পেট।’
২৮ নভেম্বর একই ব্যক্তিকে লেখা আরেকটি পত্রে সুলেমান লিখেছেন, ‘...আমার বর্তমান অর্থনৈতিক অবস্থা অত্যন্ত শোচনীয়। কারণ টাকাপয়সা আমার কাছে ঔষধের মতই হয়েছে। ...শীতের দাপটে রাতে ডিফেন্সে থাকা যায় না। কারণ শীতের একটি কাপড়ও আমার নেই।’
এসব প্রতিকূলতা সত্ত্বেও সুলেমান দেশকে স্বাধীনতা এনে দিতে ছিলেন দৃঢ়প্রতিজ্ঞ। ৭ জুলাই প্রবাসী বড় ভাইকে লেখা এক চিঠিতে ফুটে উঠেছে সেই দৃঢ় প্রতিজ্ঞারই চিত্র।
সুলেমান লিখেন, ‘... বাংলাদেশের স্বাধীনতা কোন শক্তিই দমিয়ে রাখতে পারবে না। আমাদের বাংলার সাড়ে সাত কোটি মানুষ পরাধীনতার নাগপাশকে পদদলিত করিতে বদ্ধপরিকর। এতে যদি আমার বাংলাদেশ শ্মশানে পরিণত হয় তবু আমরা কিছু ছাড়ব না। বাংলা স্বাধীন ও শত্রুমুক্ত হবে সত্য, তবে কবে এবং কি অবস্থায় স্বাধীন হব সেটা বলা যায় না।
... পাঞ্জাবী বেনিয়ারা এবার বুঝে নিয়েছে যে তাহারা আর এখানে থাকতে পারবে না। আমরা জীবনের শেষ রক্তবিন্দু দিয়া মা-বোন ও মাতৃভূমির পবিত্রতা রক্ষা করিব।
...আমার সকল পণ প্রতিজ্ঞাকে কেউ নস্যাৎ করতে পারবে না। দালালদের খতম করার জন্য আমাদের গেরিলা বাহিনী শহরে প্রবেশ করেছে। দুই তিন সপ্তাহের মধ্যে দালালদের বংশ থাকিবে না। এরাই আমারে বড় শত্রু। যাক, জয় আমাদের হবেই। আমাদের জন্য চিন্তা করিবেন না। বাঁচিয়া থাকিলে দেখা হইবে।...’
তারিখ ও ঠিকানা উল্লেখ না করে মায়ের কাছে লেখা একটি চিঠিতে সুলেমান লিখেছেন, ‘... মা, আজকে আপনার সবচেয়ে বড় গৌরব যে আপনার ছেলে সত্যিকারের দেশসেবার উপায় পেয়েছে। সত্যিকারের দেশসেবা করে যদি প্রাণ বিসর্জন দিতে হয় সেটা ভাল। যাক, আমার জন্য চিন্তা করিবেন না। অদূর ভবিষ্যতেই দেখা হবে। আমাদের চূড়ান্ত লক্ষ্য অর্জনের আর বেশি বাকী নয়।...’
মাকে অদূর ভবিষ্যতেই দেখা হওয়ার আশ্বাস দিলেও আর কখনোই মায়ের সাথে দেখা হয়নি শহীদ বীর মুক্তিযোদ্ধা সুলেমানের।
মুক্তিযুদ্ধে সাচনা বাজারে পাকিস্তানি বাংকার ধ্বংসের সময় শহীদ হন সিরাজুল ইসলাম। এর আগে সুনামগঞ্জে সুরমা নদীতে পাকিস্তানি সেনাদের পরিবহন বহরে গেরিলা আক্রমণ চালান তিনি। ১৯৭১ সালের ৩০ জুলাই সুনামগঞ্জের টেকেরঘাট থেকে নিজের পিতাকে লেখা একটি চিঠিতে উল্লেখ করেছেন নিজের ও দেশের অবস্থা আর অবস্থানের কথা।
সিরাজুল লিখেন, ‘... দেশের জন্য আমরা সকলেই জান কোরবান করিয়াছি। আমাদের জন্য ও দেশ স্বাধীন হইবার জন্য দোয়া করিবেন। আমি জীবনকে তুচ্ছ মনে করি। কারণ দেশ স্বাধীন না হইলে আমাদের জীবনের কএনা মূল্য থাকিবে না। তাই যুদ্ধকেই জীবনের পাথেয় হিসেবে নিলাম।
মৃত্যুর মুখে আছি। যেকোন সময় মৃত্যু হইতে পারে এবং মৃত্যুর জন্য সর্বদা প্রস্তুত। দোয়া করিবেন মৃত্যু হইলেও যেন দেশ স্বাধীন হয়। তখন দেখবেন লাখ লাখ ছেলে বাঙলার বুকে পুত্রহারাকে বাবা বলে ডাকবে। এই ডাকের অপেক্ষায় থাকুন।
দেশবাসী, স্বাধীন বাংলা কয়েমের জন্য দোয়া কর, মীর জাফরী করিও না। কারণ মুক্তি ফৌজ তোমাদের ক্ষমা করিবে না এবং বাঙলায় তোমাদের জায়গা দেবে না।
ছালাম, দেশবাসী সালাম।’
সিলেট অঞ্চলের কিংবদন্তি গেরিলা মুক্তিযোদ্ধা জগৎজ্যোতি দাসের শহীদ হওয়ার ঘটনা আরও বেশি বিক্ষুব্ধ করে তুলেছিলো এ অঞ্চলের বীর মুক্তিযোদ্ধাদের। জগৎজ্যোতির মৃত্যু সংবাদ জানিয়ে তার সহযোদ্ধা সানু মিয়া আরেক মুক্তিযোদ্ধা গৌরাঙ্গ দেশীকে একটি চিঠি লেখেন। সংক্ষিপ্ত এই চিঠিতে প্রতিভাত হয়েছে জ্যোতির প্রাণের বদলা নেয়ার দৃপ্ত শপথ।
‘দাদা,
এখানে এসে জ্যোতিকে পেয়েছিলাম। চারদিন হলো, সে আমাদের ছেড়ে চলে গেছে। তাঁর কাজ সে শেষ করেছে, এবার আমাদের পালা। জ্যোতিকে ম্লান হতে দেবো না, রক্তের প্রতিশোধ আমরা রক্তেই নেব।
ইতি
সানু মিয়া’
রক্তের বদলা নিয়েই বীর মুক্তিসেনারা সূর্যের লালটুকু ছিনিয়ে আনেন বাঙলার সবুজ জমিনে। বাংলাদেশের পতাকা হয়ে ওঠে টিয়ে পাখির মতো লাল আর সবুজ। যুদ্ধজয় ও বঙ্গবন্ধুর দেশে ফেরার পর সিলেটের মহিলা মুক্তিফৌজ গঠনের অন্যতম উদ্যেক্তা ও নারীনেত্রী প্রীতিরানী দাশ শ্রদ্ধা ও ভালোবাসার অর্ঘ্য হিসেবে জাতির পিতাকে তাঁতের তৈরি একটি বস্ত্র উপহার পাঠান। এই উপহার পেয়ে প্রীতিরানীকে চিঠি লেখেন শেখ মুজিব।
১৯৭২ সালের ২১ নভেম্বর চিঠিটি বঙ্গবন্ধুর নিজ হাতে লেখা।
‘শ্রদ্ধেয়া প্রীতিরানী দাস
আমার আদাব গ্রহণ করবেন। তাঁতশিল্পের নিদর্শনস্বরূপ আপনার দেয়া উপহারখানা জেনারেল ওসমানী সাহেবের মারফত পেয়ে খুবই খুশি হয়েছি। শিল্প জগতে তাঁতশিল্প এক বিশেষ স্থান অধিকার করে আছে। বিশেষ করে বাংলাদেশের উন্নতমানের তাঁতশিল্প একটি গৌরবের বিষয়। দেশের ভাঙ্গা অর্থনীতিকে পুনরুজ্জীবিত করার প্রশ্নে আপনাদের ভূমিকা কোন অংশে কম নয়। সেহেতু আমাদের তাঁতশিল্পের ক্রমবিকাশ এবং বিশ্বের হস্তশিল্পাঙ্গনে এর সুপ্রতিষ্ঠিত স্থান আমার একমাত্র কাম্য।
সরকার এ ব্যাপারে পূর্ণ সহযোগীতা করে যাবে। দেশের বেকার সমস্যা দূরীকরণ এবং অর্থনৈতিক উন্নয়নে আপনাদের প্রচেষ্টাকে আমি আন্তরিকভাবে ধন্যবাদ জানাচ্ছি।
ইতি
শেখ মুজিব”
[এই প্রতিবেদনে উল্লিখিত চিঠিগুলো সাপ্তাহিক ‘বিন্দু বিন্দু রক্ত’, সেই সময়ের সাপ্তাহিক ও বর্তমানে দৈনিক ‘যুগভেরী’ এবং গবেষক দীপংকর মোহান্ত সম্পাদিত ‘চিঠিপত্রে মুক্তিযুদ্ধ’ বই থেকে সংগৃহীত।]
আরও পড়ুন:দেশজুড়ে উৎকণ্ঠা-আতঙ্ক আর অজানা শঙ্কায় দিনাতিপাত করছে মানুষ। পাকিস্তানি হানাদারদের নিষ্ঠুর অত্যাচারে দিশেহারা সবাই। এমনই সময় পরিক্রমায় এলো ৭ মার্চ ১৯৭১। তৎকালীন রেসকোর্স ময়দানে (সোহরাওয়ার্দী উদ্যান) লাখো মানুষ অপেক্ষায়।
জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান এলেন এবং বজ্র কণ্ঠে ঘোষণা দিলেন- ‘এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম৷’
সেই অনানুষ্ঠানিক ঘোষণাই আনুষ্ঠানিকতা পায় একাত্তরের ২৬ মার্চ।
বাঙালির সেই গৌরবদীপ্ত দিন আজ। মহান স্বাধীনতা ও জাতীয় দিবস। হাজার বছরের পরাধীনতার শৃঙ্খল ভেঙে ১৯৭১ সালের এই দিনে বিশ্বের বুকে স্বাধীন জাতি রাষ্ট্র গঠনের লক্ষ্যে স্বাধীনতার ডাক দিয়েছিলেন বঙ্গবন্ধু।
২৬ মার্চ দিনটি বাঙালির কাছে একইসঙ্গে গৌরব ও শোকের। ২৫ মার্চ মধ্যরাতে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী শুরু করে গণহত্যা। ওই রাতেই বঙ্গবন্ধু ঘোষণা করেন, ‘আজ থেকে বাংলাদেশ স্বাধীন।’ এই ঘোষণার পর ৯ মাস মুক্তিযুদ্ধের সিঁড়ি বেয়ে ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর বিশ্বের বুকে অভ্যুদয় হয় স্বাধীন-সার্বভৌম বাংলাদেশের।
প্রতিবছর বিনম্র শ্রদ্ধা ও গভীর কৃতজ্ঞতায় দিনটি পালন করে জাতি। স্মরণ করে স্বাধীনতার জন্য আত্মদানকারী দেশের বীর সন্তানদের। শ্রদ্ধা জানায় মহান স্বাধীনতার রূপকার বাঙালির অবিসংবাদিত নেতা জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান, মুক্তিযুদ্ধের সংগঠক জাতীয় নেতা, নৃশংস গণহত্যার শিকার লাখো সাধারণ মানুষ এবং সম্ভ্রম হারানো মা-বোনের প্রতি।
দিনটি উযাপনে এবারও রাষ্ট্রীয়ভাবে কর্মসূচি পালনের পাশাপাশি দেশের রাজনৈতিক দল, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক সংগঠনগুলো কর্মসূচি ঘোষণা করেছে।
দিবসটি উপলক্ষে পৃথক বাণী দিয়েছেন রাষ্ট্রপতি মো. আবদুল হামিদ ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।
স্বাধীনতার প্রশ্নে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ধাপে ধাপে বাঙালি জাতিকে ঐক্যবদ্ধ করেন। ১৯৪৭ সালে ভারত ভাগের অব্যবহিত পরই ভাষার প্রশ্নে একাত্ম হয় বাঙালি। ১৯৪৮, বায়ান্ন পেরিয়ে চুয়ান্ন, বাষট্টি, ছেষট্টির পথ বেয়ে আসে ১৯৬৯।
ঊনসত্তরের গণঅভ্যুত্থানে কেঁপে উঠে তৎকালীন সামরিক শাসক জেনারেল আইয়ুবের মসনদ। ‘বীর বাঙালি অস্ত্র ধরো-বাংলাদেশ স্বাধীন করো’, ‘জাগো জাগো বাঙালি জাগো, ‘তোমার আমার ঠিকানা- পদ্মা মেঘনা যমুনা’, ‘জয় বাংলা, জয় বঙ্গবন্ধু’ স্লোগানে প্রকম্পিত হয়ে ওঠে শহর থেকে গ্রাম-গ্রামান্তর।
বাঙালির ন্যায্য দাবিকে উপেক্ষা করতে না পেরে ১৯৭০ সালে নির্বাচন দেয় সরকার। জাতীয় ও প্রাদেশিক নির্বাচনে সংখ্যাগরিষ্ঠ আসন পায় বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বাধীন আওয়ামী লীগ। কিন্তু বাঙালির হাতে শাসনভার দেয়ার বদলে শুরু হয় ষড়যন্ত্র।
বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের ভাষণের পর প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া ও পাকিস্তান পিপলস পার্টির জুলফিকার আলী ভুট্টো বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে আলোচনার নামে করতে থাকেন কালক্ষেপণ। পর্দার আড়ালে প্রস্তুত হয় হিংস্র কায়দায় বাঙালি হত্যাযজ্ঞের ‘নীলনকশা’।
১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ মধ্যরাতে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী ঘুমন্ত নিরস্ত্র বাঙালির ওপর আধুনিক যুদ্ধাস্ত্র নিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়ে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের জগন্নাথ হল, ইকবাল হল, রোকেয়া হল, শিক্ষকদের বাসা, পিলখানার ইপিআর সদর দপ্তর, রাজারবাগ পুলিশ লাইনে একযোগে হামলা চালিয়ে হত্যা করে অগণিত নিরস্ত্র দেশপ্রেমিক ও জাতির শ্রেষ্ঠ সন্তানদের৷
বঙ্গবন্ধু তার দূরদর্শী সিদ্ধান্তে ওয়্যারলেসের মাধ্যমে ঘোষণা করেন বাংলাদেশের স্বাধীনতা। স্বাধীনতার আনুষ্ঠানিক ঘোষণা হ্যান্ডবিল আকারে ইংরেজি ও বাংলায় ছাপিয়ে চট্টগ্রামে বিলি করা হয়৷
আওয়ামী লীগের তৎকালীন শ্রম সম্পাদক জহুর আহমেদ চৌধুরী বঙ্গবন্ধুর স্বাধীনতার ঘোষণা চট্টগ্রামের ইপিআর সদর দপ্তর থেকে দেশের বিভিন্ন স্থানে ওয়্যারলেস মারফত পাঠানোর ব্যবস্থা করেন৷
চট্টগ্রাম জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক এম এ হান্নান দুপুর ২টা ১০ মিনিটে এবং বেলা ২টা ৩০ মিনিটে চট্টগ্রাম বেতার থেকে বঙ্গবন্ধুর স্বাধীনতার ঘোষণাপত্র পাঠ করেন৷
এদিকে বঙ্গবন্ধুকে গ্রেপ্তার করে ঢাকা সেনানিবাসে নিয়ে যাওয়া হয়৷
বঙ্গবন্ধুর আহ্বানে সাড়া দিয়ে ১৯৭১ সালের ২৬ মার্চই শুরু হয়ে যায় মুক্তিযুদ্ধ৷ ওই রাতেই তৎকালীন পূর্ব বাংলার পুলিশ, ইপিআর ও সেনাবাহিনীর সদস্যরা শুরু করেন প্রতিরোধ যুদ্ধ। তাদের সঙ্গে যোগ দেয় সাধারণ মানুষ৷
৯ মাসের যুদ্ধে ৩০ লাখ শহিদের রক্তের বিনিময়ে ১৬ ডিসেম্বর অর্জিত হয় কাঙ্ক্ষিত স্বাধীনতা৷ বিশ্ব মানচিত্রে স্থান করে নেয় স্বাধীন-সার্বভৌম বাংলাদেশ৷
কর্মসূচি
স্বাধীনতা ও জাতীয় দিবস পালনে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ দু’দিনের কর্মসূচি ঘোষণা করেছে। দলটি আজ সূর্যোদয়-ক্ষণে বঙ্গবন্ধু ভবন, কেন্দ্রীয় কার্যালয় এবং সারাদেশে সংগঠনের সব কার্যালয়ে জাতীয় ও দলীয় পতাকা উত্তোলন করবে।
আরও রয়েছে- সকাল ৬টায় জাতীয় স্মৃতিসৌধে শ্রদ্ধা নিবেদন (রাষ্ট্রপতি ও প্রধানমন্ত্রীর শ্রদ্ধা নিবেদনের অব্যবহিত পর)। সকাল ৭টায় ধানমণ্ডি ৩২ নম্বরে ঐতিহাসিক বঙ্গবন্ধু ভবন প্রাঙ্গণে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের প্রতিকৃতিতে শ্রদ্ধার্ঘ্য অর্পণ।
দোয়া মাহফিল ও বিশেষ প্রার্থনা সভা:
মহান স্বাধীনতা দিবসে আজ মসজিদ, মন্দির, প্যাগোডা, গির্জাসহ সব ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানে দেশব্যাপী বিশেষ প্রার্থনা কর্মসূচির আয়োজন রয়েছে।
বাদ যোহর বায়তুল মুকাররম জাতীয় মসজিদসহ দেশের সব মসজিদে দোয়া ও মিলাদ মাহফিল অনুষ্ঠিত হবে।
এছাড়া ২৫ মার্চ রাত ১২টা ১ মিনিটে মিরপুর ব্যাপ্টিস্ট চার্চে (৩/৭-এ সেনপাড়া, পবর্তা, মিরপুর-১০) খ্রীষ্টান সম্প্রদায়, আজ সকাল ১০টায় রাজধানীর মেরুল বাড্ডায় আন্তর্জাতিক বৌদ্ধ বিহারে বৌদ্ধ সম্প্রদায় এবং সকাল ১১টায় ঢাকেশ্বরী জাতীয় মন্দিরে হিন্দু সম্প্রদায় প্রার্থনা সভার আয়োজন করেছে।
টুঙ্গীপাড়ার কর্মসূচি:
সকাল ১১টায় আওয়ামী লীগ কেন্দ্রীয় কার্যনির্বাহী সংসদের একটি প্রতিনিধি দল টুঙ্গিপাড়ায় চিরনিদ্রায় শায়িত জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের সমাধিতে শ্রদ্ধার্ঘ্য নিবেদন এবং দোয়া ও মিলাদ মাহফিল কর্মসূচিতে অংশ নেবে।
আরও পড়ুন:গণহত্যা দিবসে শনিবার সন্ধ্যায় আলোক প্রজ্বালন করেছে বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টি (সিপিবি)। রাজধানীর সোহরাওয়ার্দী উদ্যানের শিখা চিরন্তনে এই আয়োজনে ২৫ মার্চ গণহত্যা দিবসকে আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি ও সাম্প্রদায়িক রাজনীতি নিষিদ্ধের দাবি জানানো হয়েছে।
আলোক প্রজ্বালন-পূর্ব সংক্ষিপ্ত সমাবেশে বক্তব্য দেন সিপিবি কেন্দ্রীয় কমিটির সভাপতি বীর মুক্তিযোদ্ধা মোহাম্মদ শাহ আলম, সাধারণ সম্পাদক রুহিন হোসেন প্রিন্স ও সহকারী সাধারণ সম্পাদক মিহির ঘোষ।
বীর শহীদদের প্রতি শ্রদ্ধা জানিয়ে নেতৃবৃন্দ বলেন, ‘শহীদদের স্বপ্ন এখনও পূরণ হয়নি। দেশে এখন পাকিস্তানি ভাবাদর্শ ও অর্থনীতি পুনঃপ্রতিষ্ঠিত হয়েছে, ধনবৈষম্য ও শ্রেণি বৈষম্য প্রতীয়মান। দেশে ২২ পরিবারের জায়গায় ৯৪ হাজারের বেশি কোটিপতি সৃষ্টি হয়েছে। গণতন্ত্র, ধর্মনিরপেক্ষতা, জাতীয়তাবাদ ও সমাজতন্ত্রের অঙ্গীকার থেকে দূরে সরে গেছে শাসক গোষ্ঠী।
‘গণতন্ত্র হরণ করা হয়েছে, সমাজতন্ত্র নির্বাসিত। অন্যদিকে রাষ্ট্রধর্ম সংবিধানে জেঁকে বসেছে। রাষ্ট্রীয় পর্যায় থেকে সাম্প্রদায়িক গোষ্ঠীর সঙ্গে যোগসাজশে শিক্ষাব্যবস্থা ও পাঠ্যসূচি সাম্প্রদায়িকীকরণ করা হচ্ছে।’
বক্তারা দেশের বাম-প্রগতিশীল ও গণতান্ত্রিক শক্তিকে ঐক্যবদ্ধ হয়ে দুর্নীতি-লুটপাটের বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়ে একাত্তরের চেতনায় মুক্তিযুদ্ধের বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠার জন্য লড়াই করার আহ্বান জানান। সে সঙ্গে অবিলম্বে সাম্প্রদায়িক রাজনীতি নিষিদ্ধ ও গণহত্যা দিবসকে আন্তর্জাতিক গণহত্যা দিবস হিসেবে স্বীকৃতির দাবি জানান তারা।
সংস্কৃতি প্রতিমন্ত্রী কে এম খালিদ বলেছেন, দেশ স্বাধীন হওয়ার পর এখনো একাত্তরের গণহত্যার আর্ন্তজাতিক স্বীকৃতি অর্জন সম্ভব হয়নি। এ স্বীকৃতি অর্জনে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা কাজ করে যাচ্ছেন। তার উদ্যোগে ২০১৭ সাল থেকে জাতীয়ভাবে ২৫ মার্চ গণহত্যা দিবস হিসেবে পালন করা হচ্ছে। সম্প্রীতি বাংলাদেশ, বঙ্গবন্ধু পরিষদসহ বিভিন্ন সংগঠন এ বিষয়ে কাজ করে যাচ্ছে।
তিনি বলেন, সরকারি-বেসরকারি উদ্যোগসহ সবার সম্মিলিত ও সমন্বিত প্রয়াসে একাত্তরের গণহত্যার আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি অর্জন সম্ভব হবে।
জাতীয় গণহত্যা দিবস উপলক্ষে সম্প্রীতি বাংলাদেশ-এর উদ্যোগে শনিবার সকাল সাড়ে ১০টায় জাতীয় প্রেস ক্লাবে ‘গণত্যার আর্ন্তজাতিক স্বীকৃতি’ শীর্ষক এক গোলটেবিল আলোচনা সভায় প্রধান অতিথির বক্তব্যে সংস্কৃতি প্রতিমন্ত্রী কে এম খালিদ এসব কথা বলেন।
সরকারিভাবে অধ্যাপক মুনতাসীর মামুনের নেতৃত্বে সংস্কৃতি বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের প্রকল্প ‘গণহত্যা-নির্যাতন ও মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক গবেষণা কেন্দ্র’ দেশব্যাপী গণহত্যা বিষয়ক জরিপ কার্যক্রমের মাধ্যমে গণহত্যার প্রমাণক ও তথ্য-উপাত্ত সংগ্রহ করে যাচ্ছে। এরই মধ্যে ৩৪টি জেলায় সাড়ে চার হাজার বধ্যভূমিসহ ১৭ হাজার ২৮৬টি গণহত্যা, গণকবর চিহ্নিত হয়েছে।
এতে ধারণা করা যায় যে, একাত্তরের গণহত্যার প্রকৃত সংখ্যা ৩০ লাখ ছাড়িয়ে যাবে এবং এর মাধ্যমে গণহত্যার সংখ্যাতাত্ত্বিক বিতর্কের অবসান ঘটবে। সরকারি-বেসরকারি উদ্যোগসহ সবার সম্মিলিত ও সমন্বিত প্রয়াসে একাত্তরের গণহত্যার আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি অর্জন সম্ভব হবে।
‘সম্প্রীতি বাংলাদেশ’-এর আহ্বায়ক পীযূষ বন্দ্যোপাধ্যায়ের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠানে আলোচনা করেন মুজিবনগর সরকারের কর্মকর্তা সাবেক সচিব মুসা সাদিক, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক ও বঙ্গবন্ধু পরিষদ কেন্দ্রীয় কমিটির সাধারণ সম্পাদক অধ্যাপক আ ব ম ফারুক, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক ও বাংলাদেশ পূজা উদযাপন পরিষদের সাধারণ সম্পাদক অধ্যাপক চন্দ্রনাথ পোদ্দার, মিরপুর ব্যাপ্টিস্ট চার্চের রেভারেন্ড মার্টিন অধিকারী, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক অধ্যাপক রফিকুল ইসলাম এবং ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের ৫ নম্বর ওয়ার্ড কাউন্সিলর ও সবুজবাগ থানা আওয়ামী লীগের সভাপতি লায়ন চিত্ত রঞ্জন দাস। অনুষ্ঠান সঞ্চালনা করেন ‘সম্প্রীতি বাংলাদেশ’-এর সদস্য সচিব অধ্যাপক ডা. মামুন আল মাহতাব স্বপ্নীল।
আলোচকরা উল্লেখ করেন, ১৯৪৮ সালের ৯ ডিসেম্বর জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদে গৃহীত সিদ্ধান্তে যে বিষয়গুলোর উল্লেখ করা হয়েছে, তাতে একাত্তরের বর্বরতা অবশ্যই গণহত্যার স্বীকৃতির দাবি রাখে। বাংলাদেশের এমন কোনো অঞ্চল নেই, যেখানে গণহত্যার চিহ্ন নেই। পাকিস্তানি নেতাদের লেখাতেই প্রমাণিত যে তারা তিন মিলিয়ন বাঙালিকে হত্যা করবে। প্রবাসী বাঙালি, সংগঠন, মানবতাবাদী, বিশ্বসংগঠনগুলোর আরও জোরদার কর্মসূচি নিতে হবে।
বক্তারা বলেন, আমরা ৫৩ বছর ধরে স্বীকৃতির দাবি করে আসছি। প্রয়োজনে আরও ৫৩ বছর এ দাবি করেই যাবো। গণহত্যার স্বীকৃতির দাবি এখন বাংলাদেশের প্রতিটি মানুষের।
সংস্কৃতি বিষয়ক প্রতিমন্ত্রী বলেন, বসনিয়া, রুয়ান্ডা, মিয়ানমারসহ বেশ কয়েকটি দেশে গণহত্যার আর্ন্তজাতিক স্বীকৃতি মিলেছে। মহান মুক্তিযুদ্ধের সময় যুক্তরাষ্ট্র ও চীনসহ কয়েকটি পরাশক্তি পাকিস্তানের পক্ষে অবস্থান করার কারণে একাত্তরের (তখন) গণহত্যার আর্ন্তজাতিক স্বীকৃতি মিলেনি। তবে আমরা আশা করছি, দ্রুতই একাত্তরের গণহত্যার আর্ন্তজাতিক স্বীকৃতি মিলবে।
সংস্কৃতি প্রতিমন্ত্রী বলেন, একাত্তরের গণহত্যার আর্ন্তজাতিক স্বীকৃতির বিষয়ে যেসব বই ও প্রকাশনা বের হয়েছে সেগুলোকে বাংলা একাডেমির মাধ্যমে ইংরেজিসহ বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণভাষায় অনুবাদের ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
অনুষ্ঠানে বক্তারা বলেন, বসনিয়া, আর্মেনিয়া, রুয়ান্ডা, মিয়ানমারসহ বেশ কয়েকটি দেশে গণহত্যার আর্ন্তজাতিক স্বীকৃতি দেওয়া হয়েছে এবং আর্ন্তজাতিক আদালতে এসব গণহত্যার বিচার প্রক্রিয়া চলমান রয়েছে।
বক্তারা অনুরূপভাবে একাত্তরের গণহত্যার দ্রুত আর্ন্তজাতিক স্বীকৃতির দাবি জানান।
আওয়ামী লীগ সভাপতিমণ্ডলীর সাবেক সদস্য নূহ-উল-আলম লেনিনকে দলের উপদেষ্টামণ্ডলীর সদস্য করা হয়েছে৷
শনিবার দলের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের স্বাক্ষরিত এ সংক্রান্ত চিঠি লেলিনকে পৌঁছে দেয়া হয়েছে৷
নূহ-উল-আলম লেনিন নিউজবাংলাকে বলেন, ‘আওয়ামী লীগ সভাপতি ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সিদ্ধান্তে সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের আমাকে আজ (শনিবার) এ সংক্রান্ত চিঠি দিয়েছেন।’
প্রসঙ্গত, লেলিন দীর্ঘদিন ধরে আওয়ামী লীগের মুখপত্র উত্তরণ-এর সম্পাদক হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন। তিনি এর আগে দলের তথ্য ও গবেষণা সম্পাদক, প্রচার সম্পাদক এবং সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন।
হবিগঞ্জের বানিয়াচংয়ে ট্রাক্টরের ধাক্কায় একটি সিএনজিচালিত অটোরিকশায় থাকা দুই সহোদর নিহত হয়েছেন । এ ঘটনায় আহত হয়েছেন একই পরিবারের আরও তিনজন।
শনিবার সন্ধ্যা ৭টার দিকে হবিগঞ্জ-বানিয়াচং সড়কের ভাটিপাড়া এলাকায় এ দুর্ঘটনাটি ঘটে।
নিহতরা হলেন- বানিয়াচং উপজেলার ছিলাপাঞ্জা এলাকার কালাই উল্লাহর ছেলে ৬০ বছর বয়সী আব্দুল মঈন ও ৩৫ বছর বয়সী তাজ উদ্দিন।
পুলিশের ভাষ্য, মঈন তার ছোটভাই তাজসহ পরিবারের পাঁচজনকে নিয়ে শাশুড়ির জানাজায় অংশ নিতে দিতে বানিয়াচং উপজেলার উজিরপুরে যান। জানাজা শেষে ফেরার পথে তাদের বহনকারী অটোরিকশাটি ভাটিপড়া এলাকায় পৌঁছালে বিপরীত দিক থেকে আসা একটি ট্রাক্টর এতে ধাক্কা দেয়। এতে ঘটনাস্থলেই দুই ভাই মারা যান।
বানিয়াচং থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) অজয় চন্দ্র দেব বলেন, আহত তিনজনকে হবিগঞ্জ সদর হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছে।
দেশে সন্ত্রাসবাদ ও সহিংস চরমপন্থা মোকাবেলায় কমিউনিটি পুলিশ ও বিট পুলিশের সক্ষমতা জোরদার করতে যৌথভাবে উদ্যোগ নিয়েছে এন্টি টেররিজম ইউনিট (এটিইউ) ও ইউএনওডিসি।
এ উপলক্ষে শনিবার রাজধানীর হোটেল প্যান প্যাসিফিক সোনারগাঁওয়ে ‘প্রজেক্ট ইনসেপশন এবং ব্রিফিং মিটিং’-এর আয়োজন করা হয়।
অনুষ্ঠান শেষে এটিইউ ও ইউএনওডিসি’র যৌথ উদ্যোগের বিষয়ে জানতে চাইলে বাংলাদেশ পুলিশ প্রধান চৌধুরী আবদুল্লাহ আল মামুন বলেন, ‘আমাদের কমিউনিটি পুলিশ সফলভাবে কাজ করছে দীর্ঘদিন ধরে। এটাকে শক্তিশালী করার জন্য আমরা বিট পুলিশিং সামনে নিয়ে এসেছি। বিট পুলিশিং ও কমিউনিটি পুলিশিং একে অপরের পরিপূরক।
‘সন্ত্রাসবাদ দমনে ইউএনওডিসি রুট লেভেলে কাজ করার আগ্রহ প্রকাশ করেছে। এজন্য তারা আমাদের টুলসগুলো ব্যবহার করতে চায়। সে লক্ষ্যে আমরা একসঙ্গে কাজ করছি।’
অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথির বক্তব্যে আইজিপি বলেন, ‘সন্ত্রাসবাদ দমনে বাংলাদেশ পুলিশ, বাংলাদেশ সরকার ও আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীসহ সবাই মিলে আমরা সফলভাবে কাজ করছি। জঙ্গিবাদ-সন্ত্রাসবাদ আমাদের দেশে সম্পূর্ণরূপে নিয়ন্ত্রণে রয়েছে। আগামী দিনে এটা যেন সাসটেইনেবল হয় তা মাথায় রেখে আমরা কাজ করছি। আমরা সব সময় চাই সন্ত্রাসবাদ যেন দেশে মাথাচাড়া দিতে না পারে।’
এটিইউ ও ইউএনওডিসির যৌথ উদ্যোগ সারাদেশে সহিংস চরমপন্থার বিরুদ্ধে জনসচেতনতা সৃষ্টিতে নতুন মাত্রা যোগ করবে বলে আশাবাদ ব্যক্ত করেন পুলিশ প্রধান।
অনুষ্ঠানে বিশেষ অতিথির বক্তব্যে বাংলাদেশে নিযুক্ত কানাডিয়ান হাইকমিশনার লিলি নিকোলস জঙ্গিবাদ দমনে বাংলাদেশ সরকারের কার্যক্রমের প্রশংসা করেন। সহিংস চরমপন্থার বিরুদ্ধে বাংলাদেশ-কানাডা পারস্পরিক সহযোগিতা অব্যাহত থাকবে বলেও জানান তিনি।
অনুষ্ঠানে সভাপতিত্ব করেন এটিইউ-এর অতিরিক্ত আইজিপি এসএম রুহুল আমিন। তিনি তার বক্তব্যে অপরাধ দমন ও প্রতিরোধে কমিউনিটি ও বিট পুলিশের সাফল্য তুলে ধরেন। তিনি সহিংস চরমপন্থার বিরুদ্ধে সবাইকে ঐকান্তিক ও ঐক্যবদ্ধ হয়ে কাজ করার আহ্বান জানান।
অনুষ্ঠানে ইউএনওডিসি’র দক্ষিণ এশিয়া প্রতিনিধি মার্কো টেক্সেইরা, বাংলাদেশ পুলিশের বিভিন্ন ইউনিটের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা ও ইন্টেলিজেন্স সংস্থার প্রতিনিধিবৃন্দ উপস্থিত ছিলেন।
আরও পড়ুন:
মন্তব্য