আপডেট : ২৫ ফেব্রুয়ারি, ২০২১ ২০:৪৫
‘ভিন্নমত’ দমনে বহিষ্কারের পথে ছাত্র ইউনিয়ন
শিপন আলীশিপন আলী, ঢাকা

‘ভিন্নমত’ দমনে বহিষ্কারের পথে ছাত্র ইউনিয়ন

ছাত্র ইউনিয়নের ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় সংসদের বহিষ্কৃত সভাপতি সাখাওয়াত ফাহাদ (বাঁয়ে) ও সাধারণ সম্পাদক রাগীব নাঈম। ছবি: নিউজবাংলা।

দেশের প্রাচীনতম বামপন্থি ছাত্র সংগঠন বাংলাদেশ ছাত্র ইউনিয়নে বিভাজন নিরসনে বেশ কিছু উদ্যোগ নেয়া হলেও তা ভেস্তে যেতে বসেছে। সংগঠনের কেন্দ্রীয় সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদকের বিরোধী অংশের বেশ কয়েকজন নেতাকে বৃহস্পতিবার বহিষ্কার করা হয়েছে সংগঠন থেকে।

বহিষ্কৃতরা হলেন ছাত্র ইউনিয়ন কেন্দ্রীয় সংসদের সহসভাপতি সম্পা দাস, আন্তর্জাতিক, বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিষয়ক সম্পাদক ঐশ্বর্য্য আহমেদ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় সংসদের সভাপতি সাখাওয়াত ফাহাদ, সাধারণ সম্পাদক রাগীব নাঈম, সহকারী সাধারণ সম্পাদক মেঘমল্লার বসু, ঢাকা মহানগর সংসদের সভাপতি তাসিন মল্লিক, সাধারণ সম্পাদক বিল্লাল হোসেন এবং সাংগঠনিক সম্পাদক সাদাত মাহমুদ।

সংগঠনের ‘শৃঙ্খলা ও নৈতিকতা পরিপন্থি’ কাজে জড়িত থাকার অভিযোগ তোলা হয়েছে এসব নেতার বিরুদ্ধে। তবে বহিষ্কৃতদের পাল্টা অভিযোগ, গত কেন্দ্রীয় সম্মেলনে অগণতান্ত্রিকভাবে একতরফা কমিটি করা হয়। এর বিরোধিতার কারণেই বহিষ্কারের মুখে পড়তে হয়েছে তাদের।

গত বছরের ১৯ নভেম্বর ৪০তম জাতীয় সম্মেলনে ফয়েজ উল্লাহকে সভাপতি ও দীপক শীলকে সাধারণ সম্পাদক নির্বাচনের মাধ্যমে ছাত্র ইউনিয়নের ৪১ সদস্যের নতুন কেন্দ্রীয় কমিটি গঠন হয়। তবে সংগঠনের এক অংশের দাবি, ওই সম্মেলনে একাধিক গঠনতান্ত্রিক ব্যত্যয় ঘটিয়ে গণতান্ত্রিক চর্চা বিনষ্ট করা হয়েছে।

এই কমিটির বিরোধিতা করে ছাত্র ইউনিয়নের একাংশের নেতারা নতুন সম্মেলনের (রিকুইজেশন সম্মেলন) দাবিতে সোচ্চার হন। ঢাকা মহানগর, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ও জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়সহ বেশ কয়েকটি জেলা সংসদের প্রতিনিধিরা নতুন কাউন্সিল আহ্বানের পক্ষে সই করেন। সংগঠনটির গঠনতন্ত্র অনুসারে কাউন্সিলরদের এক-তৃতীয়াংশ সই করলে ২১ দিনের মধ্যে নতুন করে কাউন্সিল আয়োজনের বাধ্যবাধকতা রয়েছে।

আরও পড়ুন: ছাত্র ইউনিয়ন কি বিভাজনের মুখে

ছাত্র ইউনিয়ন যে বামপন্থি দলের গণসংগঠন হিসেবে পরিচিত, সেই বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টির (সিপিবি) শীর্ষ নেতাদের হস্তক্ষেপে তখন এই বিরোধ কিছুটা চাপা পড়ে। তবে এ বিষয়ে সমঝোতা চেষ্টার মধ্যেই বৃহস্পতিবার ছয় মাসের জন্য বহিষ্কৃত হলেন নতুন সম্মেলনের দাবি তোলা সাত নেতা। আর ঐশ্বর্য্য আহমেদ বহিষ্কৃত হয়েছেন এক মাসের জন্য।

একই সঙ্গে ছাত্র ইউনিয়নের গঠনতন্ত্রের ৪৮(ক) ধারা লঙ্ঘনের দায়ে ৫৬(গ) ধারা অনুযায়ী ঢাকা মহানগর ও বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় সংসদ বিলুপ্ত করা হয়েছে। পাশাপাশি, ঢাকা মহানগরে ২১ সদস্যের এবং বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় সংসদে ১৫ সদস্যের আহ্বায়ক কমিটি ঘোষণা করা হয়েছে।

ছাত্র ইউনিয়নের কেন্দ্রীয় সংসদ থেকে পাঠানো এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে এ তথ্য জানানো হয়।

ছাত্র ইউনিয়নের গঠনতন্ত্রের ৪৮(ক) ধারায় বলা হয়েছে, ‘জেলা সম্মেলন অথবা জেলা সংসদ মূলনীতির ক্ষেত্রে জাতীয় সম্মেলন অথবা কেন্দ্রীয় সংসদের সিদ্ধান্ত মেনে চলবে। জেলা সংসদ বা জেলা সম্মেলনের কোনো প্রস্তাব কেন্দ্রীয় সংসদ বা জাতীয় সম্মেলনের প্রস্তাবের সঙ্গে অসামঞ্জ্যপূর্ণ হলে জেলা সংগঠনের প্রস্তাব বাতিল বলে গণ্য হবে।’

অন্যদিকে ৫৬(গ) ধারায় রয়েছে, ‘প্রয়োজনবোধে শুধু কেন্দ্রীয় সংসদ সংগঠনের যেকোনো স্তরের সদস্যের বিরুদ্ধে সরাসরি শাস্তিমূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করতে পারবে। প্রতিষ্ঠানের যে কোনো পর্যায়ের সংসদ গঠনতন্ত্র, ঘোষণপত্র, নীতিমালা, কর্মসূচি বা ঐতিহ্য-বিরোধী সিদ্ধান্ত গ্রহণ করলে বা কার্যাবলিতে অংশ নিলে বা যথাযথ বিবেচনা সাপেক্ষে নিম্নতম সংসদের বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করতে পারে। এক্ষেত্রে সর্বোচ্চ শাস্তি হবে ওই সংসদ বিলুপ্ত ঘোষণা।’

ছাত্র ইউনিয়নের সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় সংসদের সভাপতি সাখাওয়াত ফাহাদ, সাধারণ সম্পাদক রাগীব নাঈমকে বহিষ্কারের তথ্য জানিয়ে বলা হয়, ‘ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় সংসদের সহসভাপতি মাহির শাহরিয়ার রেজাকে ভারপ্রাপ্ত সভাপতি এবং সহকারী সাধারণ সম্পাদক শিমুল কুম্ভকারকে ভারপ্রাপ্ত সাধারণ সম্পাদকের দায়িত্ব দেয়া হয়েছে।’

এ বিষয়ে জানতে চাইলে ছাত্র ইউনিয়ন ঢাবি সংসদের বহিষ্কৃত সভাপতি সাখাওয়াত ফাহাদ অভিযোগ করেন বর্তমান কেন্দ্রীয় কমিটির নেতারা অগণতান্ত্রিক উপায়ে সংগঠন চালাতে চাইছেন।

সাখাওয়াত ফাহাদ নিউজবাংলাকে বলেন, ‘জাতীয় সম্মেলনের পর থেকে সংগঠনের মধ্যে একটা অভ্যন্তরীণ ঝামেলা চলছে। আমরা দাবি করেছিলাম, গত সম্মেলনে কিছু ব্যত্যয় ঘটেছে। স্বৈরাচারী উপায়ে ভোট গ্রহণ করে এই কমিটি বের করে নিয়ে আসা হয়েছে।

‘তাই আমরা গঠনতান্ত্রিকভাবে সভাপতির কাছে রিকুইজিশন সম্মেলনের আবেদন করেছিলাম। এখতিয়ার না থাকা সত্ত্বেও সভাপতি সে আবেদন খারিজ করে দেন।’

তিনি বলেন, ‘রিকুইজিশন সম্মেলনের দাবি করা ও দাবির পক্ষে কাউন্সিলরদের বোঝানোকে তারা সংগঠন পরিপন্থি কাজ হিসেবে চিহ্নিত করেছে। কারণ তারা রিকুইজিশন সম্মেলনকে সংগঠনের পরিপন্থি হিসেবে মনে করে। তবে এ ধরনের সম্মেলনের বিষয়ে গঠনতন্ত্রে সুস্পষ্ট নির্দেশনা রয়েছে।’

আরও পড়ুন: ভাঙছে ছাত্র ইউনিয়ন, সম্মেলনের ডাক একাংশের

কেন্দ্রীয় কমিটির এই সিদ্ধান্তকে ‘অগণতান্ত্রিক’ দাবি করেছেন ছাত্র ইউনিয়নের ঢাকা মহানগর সংসদের বহিষ্কৃত সভাপতি তাসিন মল্লিক।

তিনি নিউজবাংলাকে বলেন, ‘তারা (কেন্দ্রীয় কমিটির নেতারা) অগণতান্ত্রিক ও গঠনতান্ত্রিক কাজ করে যাচ্ছেন। আমরা ঐকমত্যের ডাক দিয়েছিলাম, তাতে তারা একমত হননি। কেন্দ্রীয় কমিটির সঙ্গে বসে আমরা সবাই সিদ্ধান্ত নিয়েছিলাম একত্রে একটা নতুন সম্মেলন দেব, কিন্তু তারা সেই সিদ্ধান্ত ভায়োলেট করেছে।’

তিনি বলেন, ‘আমরা দ্রুততম সময়ের মধ্যে কেন্দ্রীয় প্রতিনিধিদের নিয়ে বসব এবং নতুন সম্মেলনের তারিখ জানাব।’

ছাত্র ইউনিয়নের বিজ্ঞপ্তিতে ‘অসাংগঠনিক’ কাজে যুক্ত থাকার অভিযোগে কেন্দ্রীয় সংসদের সহসভাপতি নজির আমিন চৌধুরী জয়, সহসভাপতি জয় রায়, সহকারী সাধারণ সম্পাদক মিখা পিরেগু, সহকারী সাধারণ সম্পাদক তামজিদ হায়দার চঞ্চল, সদস্য সাদ্দাম হোসেন, সদস্য রথীন্দ্রনাথ বাপ্পীকে সতর্ক করার তথ্যও জানানো হয়। এতে হুঁশিয়ারি দেয়া হয়, ‘পরবর্তীতে তারা এমন কাজের সঙ্গে সম্পৃক্ত হলে যথাযথ সাংগঠনিক ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।’

‘সংগঠন পরিপন্থি কাজ’-এর বিষয়ে জানতে চাইলে ছাত্র ইউনিয়নের কেন্দ্রীয় সংসদের সভাপতি ফয়েজ উল্লাহ বলেন, ‘সাংগঠনিক বিশৃঙ্খলা এবং উপদলীয় তৎপরতার কারণে কয়েকজন নেতাকে ছয় মাসের জন্য বহিষ্কার এবং কয়েকজনকে সতর্ক করা হয়েছে।’

তিনি বলেন, ‘আগামী ১২ মার্চ সংগঠনের জাতীয় পরিষদের সভা আহ্বান করা হয়েছে। এই সভা আমাদের সর্বোচ্চ পরিষদ। সংগঠন পরিচালনার সব বিষয় জাতীয় পরিষদে উপস্থাপন করা হয়। এখানে প্রস্তাবগুলো পাশের পর সারা দেশে পৌঁছে দেয়া হয়।’