প্রতি ৫০০ জন পুরুষের মধ্যে একজন একটি অতিরিক্ত সেক্স ক্রোমোজোম বহন করতে পারে। হতে পারে এটি এক্স বা ওয়াই। তবে তাদের মধ্যে খুব কম সম্ভবতই বিষয়টি জানেন। জেনেটিক্স ইন মেডিসিনে গত ৯ জুন প্রকাশিত এক গবেষণা ফলাফলে উঠে আসে এই তথ্য।
একজন পুরুষের সাধারণত এক্স এবং ওয়াই দুই ধরনের সেক্স ক্রমোজোম থাকে। আর নারীদের দুটি এক্স। এক্স এবং ওয়াই-এর মিলনে ছেলে সন্তান; এক্স এবং এক্সের মিলনে হয় কন্যাসন্তান। তবে যেসব পুরুষের শরীরে বাড়তি সেক্স ক্রোমোজোম থাকে তারা কী সমস্যা বা সুবিধা পায়?
গবেষকরা বলছেন, বাড়তি এক্স ক্রোমোজম থাকাকে বলা হয় ক্লাইনফেল্টার সিনড্রোম (কেএস)। এটি থাকার ফলে কিছুটা স্বাস্থ্যঝুঁকি তৈরি হতে পারে। যেসব পুরুষের বাড়তি এক্স ক্রোমোজোম আছে, তাদের প্রজননজনিত সমস্যা আছে। এসব পুরুষের সন্তান না হওয়ার হার এক্সওয়াই ক্রোমোজমধারীর চেয়ে চার গুণ বেশি। তাদের বয়ঃসন্ধি দেরিতে শুরু হওয়ার সম্ভাবনাও তিন গুণ বেশি।
অন্যদিকে বাড়তি ওয়াই ক্রোমোজম থাকাকে বলা হয় ৪৭, এক্সওয়াইওয়াই সিনড্রোম। এটির প্রজননের ওপর কোনো প্রভাব নেই। তবে অতীতের গবেষণা বলছে, এ উপসর্গের সঙ্গে শেখায় প্রতিবন্ধকতা, কথা বলা ও মোটর স্কিল অর্জনে দেরির মতো বিষয়গুলোর যোগসূত্র রয়েছে।
বাড়তি ক্রোমোজোমধারীদের টাইপ টু ডায়াবেটিস, ভেনোস থ্রমবোসিসের (শিরায় রক্ত জমে যাওয়া), ক্রনিক অবস্ট্রাকটিভ পালমোনারি ডিজিজ-এর (ফুসফুসে বায়ুপ্রবাহকে বাধা দেয়) মতো জটিলতায় আক্রান্ত হওয়ার আশঙ্কাও বেশি।
'এটা আসলে নিশ্চিত না যে কেন কেএস এবং ৪৭, এক্সওয়াইওয়াই সিনড্রোমের ঝুঁকিগুলো ভিন্ন। এটি জানতে হলে আরও গবেষণার প্রয়োজন।'
গবেষণায় অংশ নেন যুক্তরাজ্যের দুই লাখ ৭ হাজার স্বেচ্ছাসেবক। তাদের বয়স ৪০ থেকে ৭০ বছরের মধ্যে। সবাই জিনগত ও স্বাস্থ্যবিষয়ক ডেটাবেইস ইউকে বায়োব্যাংকের সদস্য এবং সাধারণের চেয়ে বেশি সুস্বাস্থ্যের অধিকারী।
গবেষণায় দেখা গেছে, অংশগ্রহণকারীদের ২১৩ জনের একটি বাড়তি এক্স ক্রোমোজোম ও ১৪৩ জনের একটি বাড়তি ওয়াই ক্রোমোজম রয়েছে।
তাদের মধ্যে খুব কম সংখ্যকেরই ক্রোমোজমজনিত জটিলতা আছে। যাদের ক্রোমোজম এক্স এক্স ওয়াই, তাদের মধ্যে কেবল ২৩ শতাংশের এ ধরনের কোনো সমস্যা ছিল। আর এক্স ওয়াই ওয়াই ক্রোমোজমধারীদের মাত্র ০.৭ শতাংশ সংশ্লিষ্ট কোনো সমস্যায় ভুগছেন।
অর্থাৎ ০.১৭ শতাংশের বাড়তি সেক্স ক্রোমোজম পাওয়া গেছে। এ হার প্রতি ৫৮০ জনে একজন। গবেষকরা বলছে, সাধারণ জনসংখ্যার ক্ষেত্রে এ হার কিছুটা কম হতে পারে। যেমন ‘প্রতি ৫০০ জনে একজন’ হতে পারে।
কেমব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ের মেডিক্যাল রিসার্চ কাউন্সিল (এমআরসি) এপিডেমিওলজি ইউনিটের পেডিয়াট্রিক এন্ডোক্রিনোলজিস্ট এবং গবেষণার সহসিনিয়র লেখক কেন ওং বলেন, ‘এটি কতটা সাধারণ তা দেখে আমরা অবাক হয়েছি। এটি বেশ বিরল বলে মনে করা হয়েছিল।’
সিলেটের ওসমানীনগরে এক ছাত্রকে বলাৎকারের অভিযোগে মাদ্রাসার সুপারকে কান ধরে ওঠবস করানো হয়েছে।
ওসমানীনগরের নুরপুর হাফিজিয়া সুন্নিয়া মাদ্রাসায় সালিশ ডেকে গত রোববার আব্দুল কাদিরকে এ শাস্তি দেয় মাদ্রাসা কমিটি ও স্থানীয় লোকজন।
আব্দুল কাদিরের বাড়ি সিলেটের কানাইঘাট উপজেলার লন্তীর মাটি গ্রামে। কান ধরে ওঠবস করানোর পাশাপাশি তাকে ২২ হাজার টাকা জরিমানা করে মুচলেকা নেয়া হয় এবং বরখাস্ত করা হয় মাদ্রাসা সুপারের পদ থেকে।
সম্প্রতি তাকে কান ধরে ৩০ বার ওঠবস করানোর ভিডিওটি ফেসবুকে ভাইরাল হয়।
মাদ্রাসার শিক্ষকরা জানান, গত শনিবার আব্দুল কাদির হিফজ বিভাগের এক আবাসিক ছাত্রকে বলাৎকার করেন। ১১ বছরের ওই শিশু বিষয়টি পরিবারকে জানালে তারা মাদ্রাসা কমিটির কাছে অভিযোগ করেন। সেই সঙ্গে শিশুটিকে একটি হাসপাতালে ভর্তি করা হয়।
মাদ্রাসা কমিটি স্থানীয় কয়েকজনকে নিয়ে রোববার সালিশ ডাকে। সালিশে তাকে কান ধরে ওঠবস করানো হয় ও শিশুটির চিকিৎসার খরচের জন্য ২২ হাজার টাকা জরিমানা করা হয়।
মাদ্রাসা কমিটির সভাপতি আপ্তাব আলী নিউজবাংলাকে বলেন, ‘সালিশের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী মুচলেকা নিয়ে আব্দুল কাদিরকে বরখাস্ত করা হয়েছে। সালিশের পর তিনি মাদ্রাসা ছেড়ে চলে গেছেন।’
এ বিষয়ে কথা বলার জন্য আব্দুল কাদিরকে একাধিকবার কল দেয়া হলেও তিনি ধরেননি।
কয়েকজন শিক্ষকের অভিযোগ, পুলিশ বিষয়টি জেনেও কোনো ব্যবস্থা নেয়নি।
এ বিষয়ে ওসমানীনগর থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) এসএম মাঈন উদ্দিন বলেন, ‘রোববার রাতে বলাৎকারের খবর পেয়ে আমি সঙ্গে সঙ্গে মাদ্রাসায় পুলিশ পাঠাই। সেখানে ওই শিক্ষক বা ছাত্র কাউকে পাওয়া যায়নি। এ বিষয়ে কেউ থানায় লিখিত অভিযোগ দিলে আমরা আইনি ব্যবস্থা নেব।’
আরও পড়ুন:সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে যেসব পুরুষ শার্ট খোলা ছবি পোস্ট করেন তাদের জন্য দুঃসংবাদ। গবেষণা বলছে, এই ধরনের ছবিতে নারীরা মোটেই আকৃষ্ট হন না। উল্টো উদোমদেহী পুরুষ অযোগ্য এবং যৌনতায় ঝুঁকিপূর্ণ হিসেবে বিবেচিত হন।
সেক্স রোল: আ জার্নাল অফ রিসার্সে সম্প্রতি গবেষণাটি প্রকাশিত হয়েছে। মিডিয়ায় ‘যৌন উত্তেজক’ ছবি সম্পর্কে মানুষের ধারণা অনুসন্ধান গবেষণাটির মূল লক্ষ্য হলেও এতে নারীর দৃষ্টিভঙ্গির ওপর বেশি জোর দেয়া হয়েছে।
গবেষকেরা দেখার চেষ্টা করেছেন পুরুষের আবেদনময় ছবি সম্পর্কে দর্শকের মানসিকতা কেমন। এ ক্ষেত্রে দর্শক হিসেবে নারীর পাশাপাশি কিছু পুরুষের মতামতও নেয়া হয়েছে।
গবেষণাপত্রের লেখক কলোরাডো বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্লিনিক্যাল সাইকোলজির পোস্টডক্টরাল ফেলো জোআনা ডাইকার বলছিলেন, ‘মিডিয়ায় নারী ও পুরুষের যৌন আবেদনময় ছবি কীভাবে আমাদের মনোভাব ও আচরণকে প্রভাবিত করতে পারে সে বিষয়টি জানা জরুরি। এই গবেষণার ক্ষেত্রে আমরা পুরুষের সেক্সি ডেটিং প্রোফাইল বেছে নিয়েছি। এসব প্রোফাইলের ইতিবাচক বা নেতিবাচক বৈশিষ্ট্যগুলো বিচার করতে চেয়েছি।’
গবেষণার ফল বলছে, শার্ট খোলা ছবির পুরুষ মনোযোগ আকর্ষণে চরমভাবে ব্যর্থ। ডেটিং সাইট টিন্ডার-এ পোস্ট করা এ ধরনের ছবি বলতে গেলে কোনো মনোযোগই কাড়তে পারেনি। নারীর পাশাপাশি গবেষণায় অংশ নেয়া পুরুষরাও পাত্তা দেয়নি সেক্সি প্রোফাইলধারী পুরুষকে।
যুক্তরাষ্ট্রে স্নাতক পর্যায়ের ৫৬৭ শিক্ষার্থীর মতামত নেয়া হয়েছে গবেষণায়, যাদের বয়স ১৮ থেকে ২৫ বছরের মধ্যে। অংশগ্রহণকারীদের প্রায় ৫৭ শতাংশ ছিলেন নারী।
গবেষকেরা দৈবচয়নের ভিত্তিতে তাদের একই ব্যক্তির আটটি মক টিন্ডার প্রোফাইলের মধ্যে একটি দেখতে দেন। মক প্রোফাইলগুলো তৈরি করা হয়েছিল এক প্রাপ্তবয়স্ক পুরুষের কোমর থেকে ওপরের ছবি দিয়ে। তবে যৌন আবেদনের তিনটি বৈশিষ্ট্যের ভিত্তিতে প্রোফাইলগুলোকে সাজানো হয়েছিল।
এই বৈশিষ্ট্যগুলো হচ্ছে, পেশিবহুলতা (পেশিবহুল বনাম অ-পেশিবহুল), যৌন আবেদনময় চেহারা (শার্টহীন বনাম শার্ট পরা) এবং সম্পর্কের অঙ্গীকার (নিয়মিত যৌনতায় আগ্রহ বনাম প্রতিশ্রুতিবদ্ধ সম্পর্ক)।
এসব টিন্ডার প্রোফাইল দেখার পরে অংশগ্রহণকারীরা পুরুষটির শারীরিক আকর্ষণ ক্ষমতা, সামাজিক আবেদন এবং সক্ষমতাসহ বিভিন্ন বিষয়ে তৈরি হওয়া ধারণা জানান।
গবেষণায় অংশগ্রহণকারী বেশির ভাগ নারী শার্টবিহীন পুরুষকে ঝুঁকিপূর্ণ যৌন আচরণকারী, কম আবেদনময় এবং সক্ষমতার দিক থেকে পেছানো বলে বিবেচনা করেছেন। পুরুষরাও বলেছেন, শার্টবিহীন ব্যক্তি ঝুঁকিপূর্ণ এবং তার সামাজিক আবেদন কম। তবে সক্ষমতার দিক থেকে এ ধরনের পুরুষকে খুব একটা পিছিয়ে রাখেননি গবেষণায় অংশ নেয়া বেশির ভাগ পুরুষ।
পুরুষ এবং নারী দুই পক্ষই পেশিবহুল পুরুষকে বেশি আকর্ষণীয় বলে মনে করেছেন। তবে পেশিবহুল পুরুষকে যৌনতায় ঝুঁকিপূর্ণ হিসেবে মনে করছেন গবেষণায় অংশ নেয়া পুরুষেরা। নারীরা অবশ্য এমনটা মনে করছেন না।
গবেষণার এমন ফল শার্ট খোলা পুরুষের জন্য সতর্কবার্তা বলে মনে করছেন জোআনা ডাইকার। তিনি বলেন, ‘একজন পুরুষ সেক্সি উপস্থাপনার জন্য অনলাইন ডেটিং প্রোফাইলে শার্টবিহীন ছবিসহ যেসব তথ্য দেন সেটি তার ঝুঁকি উল্টো বাড়িয়ে দেয়। এর মাধ্যমে তিনি কম উপযুক্ত, কম পছন্দযোগ্য এবং যৌনতায় ঝুঁকিপূর্ণ হিসেবে অন্যদের কাছে বিবেচিত হতে পারেন।
‘বাস্তবে সেক্সি ডেটিং প্রোফাইল থাকা পুরুষের প্রতি নারীরা নেতিবাচক প্রতিক্রিয়া জানান, কারণ এটি তাদের পছন্দের বিপরীত। আমাদের গবেষণায় দেখা গেছে, সেক্সি চেহারার পুরুষের প্রতি নারীর পাশাপাশি অন্য পুরুষও নেতিবাচক প্রতিক্রিয়া দেখান।’
আরও পড়ুন:জার্মানিতে যৌন নিপীড়নের দায়ে দোষী প্রমাণিত হয়েছেন এক নারী। উদ্দেশ্যমূলক সঙ্গীর কনডম ছিদ্র করে দেয়ার কারণে তাকে ছয় মাসের বিনাশ্রম কারাদণ্ড দিয়েছে পশ্চিম জার্মানির একটি আদালত।
রায়ে বিচারক জানান, এ মামলাটি জার্মানির আইনি ইতিহাসে স্থান পাবে। এটি চুরির শামিল। তবে এবার কাজটি করেছেন এক নারী।
মামলায় কী হয়েছিল
পশ্চিম জার্মানির বিলেফেল্ড শহরের একটি আঞ্চলিক আদালতে এ রায় দেয়া হয়। স্থানীয় সংবাদপত্রে বুধবার খবরটি ছাপা হয়।
মামলায় দোষী প্রমাণ হওয়া নারীর বয়স ৩৯। তিনি ৪২ বছরের এক পুরুষ সঙ্গীর ‘ফ্রেন্ডস উইথ বেনিফিটস’ সম্পর্কে ছিলেন। ২০২১ সালের শুরুতে তারা অনলাইনে পরিচিত হন। সেই থেকে প্রায়ই তারা শারীরিক সম্পর্কে জড়াতেন।
প্রতিবেদন বলছে, নারীটি তার সঙ্গীর প্রতি দুর্বল হয়ে পড়েছিলেন। যদিও তিনি জানতেন তার সঙ্গী কোনো ধরনের ‘প্রতিশ্রুতিবদ্ধ সম্পর্কে’ জড়াতে চান না।
সঙ্গীকে চিরদিনের জন্য নিজের করে নিতে এক রাতে সঙ্গমের আগে কনডমে ছিদ্র করে রাখেন ওই নারী। তিনি ভেবেছিলেন, গর্ভবতী হয়ে পড়লে হয়তো সঙ্গী তার অবস্থান বদলাবে। কিন্তু তার এই চেষ্টা ব্যর্থ হয়।
এর পরও চেষ্টা চালিয়ে গিয়েছিলেন ওই নারী। হোয়াটসঅ্যাপ মেসেজে ওই নারী তার সঙ্গীকে জানিয়েছিলেন, এখনও তিনি বিশ্বাস করেন ওই সময়ে অন্তঃসত্ত্বা হয়েছিলেন। স্বীকার করেছিলেন, ইচ্ছা করেই তিনি কনডমে ছিদ্র করেছিলেন।
পুরুষ সঙ্গী বিষয়টিকে ভালোভাবে নেননি। তিনি আইনের আশ্রয় নেন। ফৌজদারি মামলা ঠুকে দেন ওই নারীর বিরুদ্ধে। পরে অবশ্য দোষ স্বীকার করে নেন সেই নারী।
মামলাটি ‘ঐতিহাসিক’ কেন?
এ ঘটনায় অপরাধ সংঘটিত হয়েছে, আদালত এবং আইনজীবীরা এ বিষয়ে একমত। তবে তারা দ্বিধায় ছিলেন মামলার ধারা নিয়ে।
বিচারক অ্যাস্ট্রিড সালেউস্কি বলেন, ‘আমরা আজ এখানে আইনি ইতিহাস লিখেছি।’
অপরাধটি ধর্ষণ কি না তা তদন্ত করা হয় প্রথম। তবে ধর্ষণের আলামত মেলেনি। পরে বিচারক যৌন হয়রানি ও চুরির অভিযোগ আনেন ওই নারীর বিরুদ্ধে।
বিচারক সালেউস্কি বলেন, ‘সাধারণত ‘চুরি’ ঘটে যখন একজন পুরুষ মিলনের সময় গোপনে তার কনডম খুলে ফেলে, যা তার সঙ্গী জানেনই না। এ বিধানটি বিপরীত ক্ষেত্রেও প্রযোজ্য। পুরুষের অজান্তে বা তার সম্মতি ছাড়া কনডম খুলে ফেলাও অপরাধ।’
কোভিড ১৯ মহামারির কারণে প্রায় দুই বছর বন্ধ ছিল দেশের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান। যুক্তরাষ্ট্রের সংবাদমাধ্যম টাইমের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, এই সময়ের পর বাংলাদেশে স্কুলে ফেরেনি হাজার হাজার ছেলেশিশু। তাদের বেশির ভাগই শিশুশ্রমে যুক্ত হতে বাধ্য হয়েছে। আর্থিক অনটনের কারণে অনেক পরিবার তাদের সন্তানকে আর স্কুলমুখী করতে পারেনি। টাইমের প্রতিবেদনটি ভাষান্তর করেছেন সঞ্জয় দে।
রাজধানী ঢাকায় সূর্য তখন অস্তগামী। দুই সন্তানের জননী ৩৪ বছরের রেখা মন অচঞ্চল রাখার লড়াই করছেন। হাতের প্লাস্টিকের চুড়িগুলো মুচড়ে চলছেন রেখা। ১২ বছর বয়সী ছেলে ফোন করেছিল কি না নিশ্চিত হতে বারবার হাতের মোবাইলটি দেখছেন। আরও আধা ঘণ্টা আগেই ছেলের বাসায় ফেরার কথা।
রেখা সামনের দরজা দিয়ে বাইরে নজর বোলান, তার মুখজুড়ে উদ্বেগের ছাপ। ভ্রূ কুঁচকে বলেন, “কাজটি খুবই বিপজ্জনক। প্রতিদিন সকালে ওকে বিদায় জানাই আর প্রার্থনা করি, ‘আল্লাহ রাতে ঠিকঠাক বাসায় ফিরিয়ে এনো।'”
রেখার দুশ্চিন্তায় ভোগার কারণ আছে। তার বড় ছেলে রাফি স্থানীয় কাচের কারখানায় ১৮ মাস হলো কাজ শুরু করেছে। এরই মধ্যে একাধিকবার ক্ষতবিক্ষত ও রক্তাক্ত হয়ে বাসায় ফিরেছে সে। একদিন বিকেলে ধারালো ব্লেড দিয়ে জানালার কাচ কাটার সময় ও নিজের হাতের তালুও বাজেভাবে কেটে ফেলে। শিশুটির টি-শার্ট রক্তে ভিজে যাওয়ায় নিয়োগকারীরা জরুরি কক্ষে নিয়ে যান, কিন্তু রেখাকে কেউ খবর দেননি।
অনুতাপ ভরা গলায় রেখা বলেন, ‘আমি নিজের ভেতরে অনেক খারাপ বোধ করি, আমি একজন খারাপ মা। আমি জানি রাফি কাজ করতে চায় না। ও স্কুলে থাকতে চায়।’
২০২০ সালের মার্চে কর্তৃপক্ষ যখন প্রথম বাংলাদেশের স্কুল বন্ধ করে দেয়, তখন কেউ অনুমান করতে পারেনি, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলো পরবর্তী ১৮ মাস বন্ধ থাকবে। বিধিনিষেধের আওতায় এটি বিশ্বে সবচেয়ে দীর্ঘ সময় ধরে স্কুল বন্ধের অন্যতম ঘটনায় পরিণত হবে সেটাও ভাবা যায়নি।
২০২১ সালের সেপ্টেম্বরে ক্লাসগুলো পর্যায়ক্রমিক খোলা রাখার সূচিতে ফিরলেও ওমিক্রন ভ্যারিয়েন্টের কারণে কোভিড সংক্রমণ বাড়ায় জানুয়ারি ও ফেব্রুয়ারিতে চার সপ্তাহের জন্য স্কুল ফের বন্ধ হয়ে যায়। এখন প্রথম লকডাউনের দুই বছর পর শিশু-অধিকার কর্মীরা বলছেন, সারা দেশে হাজারও শিক্ষার্থী আর স্কুলে ফিরে আসেনি। তারা বলছেন, এদের বেশির ভাগই ১২ বছর বা তার বেশি বয়সী ছেলেশিশু। স্কুল বন্ধের ওই অন্তর্বর্তী সময়কাল তাদের ঠেলে দিয়েছে পূর্ণাঙ্গ শ্রমজীবনে।
২০২০ সালের মার্চে সরকার দেশব্যাপী লকডাউন জারির আগে রাফি ঢাকার শান্তিপুর উচ্চ বিদ্যালয়ে পড়াশোনা করছিল। ওই স্কুলে ৫ বছর থেকে ১৭ বছর বয়সী শিক্ষার্থী ছিল ১১০০-এর বেশি। ঢাকার ব্যস্ত রাস্তার পাশের স্কুলটির বন্ধ দরজা ২০২১ সালের সেপ্টেম্বরে আবার খুলে দেয়া হয়। শিক্ষকরা তাদের শিক্ষার্থীদের জন্য অপেক্ষা করতে থাকেন, তবে ক্লাসের ব্ল্যাকবোর্ডগুলোতে এখনও স্যাঁতসেঁতে ভাব।
স্কুল খোলার পর মাত্র ৭০০ শিক্ষার্থী ক্লাসে উপস্থিত হয়। পরের মাসগুলোতে এই সংখ্যা আর বাড়েনি। ডিসেম্বরের মধ্যে অনেক কাঠের বেঞ্চ এবং ডেস্ক খাঁখাঁ করতে দেখা যায়। একপর্যায়ে সেগুলো ভাঙারি হিসেবে বিক্রি করে দেয় স্কুল কর্তৃপক্ষ।
ক্লাসে অনুপস্থিত শিক্ষার্থীদের দুই-তৃতীয়াংশই ছেলেশিশু। প্রধান শিক্ষক বিপ্লব কুমার সাহা বলেন, ‘তারা এখন নিজেদের পরিবারের একমাত্র উপার্জনকারী।’
মহামারি শুরুর পর থেকে বাংলাদেশে ঠিক কত শিশু শ্রমের সঙ্গে যুক্ত হয়েছে তা জানা অসম্ভব। টাইম ম্যাগাজিন সারা দেশের ২০টি স্কুলের উপস্থিতির পরিসংখ্যান বিশ্লেষণ করে দেখেছে, ২০২০ সালের মার্চ থেকে ২০২১ সালের নভেম্বর পর্যন্ত ড্রপআউট শিক্ষার্থীদের মধ্যে ছেলেশিশুর সংখ্যা অন্তত ৫৯ শতাংশ। বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থা ব্র্যাকের তথ্যও এই পরিসংখ্যানকে সমর্থন করছে।
ক্রমবর্ধমান এই সংকট মার্চে শিশুশ্রমসংক্রান্ত আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থার (আইএলও) ‘কনভেনশন ১৩৮’ অনুমোদনের জন্য বাংলাদেশি কর্তৃপক্ষকে প্ররোচিত করেছিল। তারা ঘোষণা করে, ১৪ বছরের কম বয়সী কোনো শিশুকে কোনো শিল্পে নিয়োগ করা উচিত নয়। আগামী তিন বছরের মধ্যে শিশুশ্রম সম্পূর্ণ বিলোপের প্রতিশ্রুতিও দেয়া হয়। তবে মহামারির প্রথম ১৮ মাসে সারা দেশে খানা আয় গড়ে ২৩ শতাংশ কমেছে। অনেক বাবা-মা বলেছেন, তাদের সামনে কোনো বিকল্প নেই। তাদের ছেলে কাজ করতে না গেলে অন্য সন্তানসন্ততি খেতে পারবে না।
দুই বছর আগেও পরিস্থিতি এমন ছিল না। যখন প্রথম স্কুল বন্ধ হয়ে যায়, রাফির বাবা-মা তাদের ছেলেদের শিক্ষা নিয়ে উদ্বিগ্ন ছিলেন। রাফির ছোট ভাই বয়স মাত্র আট বছর। লকডাউনের শুরুতে তাদের পরিবার আশপাশের কয়েকটি পরিবারের সঙ্গে যোগ দিয়েছিল, যাতে করে স্থানীয় এক ডজন শিশুকে প্রতিদিন এক ঘণ্টা করে একজন গৃহশিক্ষকের মাধ্যমে পড়ানো যায়। তবে সপ্তাহের পর সপ্তাহ বাংলাদেশে লকডাউন থাকায় পরিবারগুলোর আর্থিক অবস্থার দ্রুত অবনতি হয়।
রেখার স্বামী তাজুল ছিলেন একজন সফল উদ্যোক্তা। তবে ২০২০ সালের গ্রীষ্মের মধ্যে তার পোশাক ব্যবসায় ধস নামে। এরপর তিনি দিনের বেলা রাস্তার পাশে একটি ছোট স্টল চালানো এবং রাতে বাজারে নিরাপত্তা প্রহরীর কাজ শুরু করেন। তার কর্মঘণ্টার কোনো সীমা ছিল না। তবে এরপরেও ঋণের অর্থ ও বাড়ি ভাড়া পরিশোধের মতো পর্যাপ্ত আয় হতো না। ঋণদাতারা বাসার দরজায় হাজির হতে শুরু করেন। ডায়াবেটিসসহ বিভিন্ন রোগে ভোগা রেখাকে তারা হুমকি দেন। একপর্যায়ে হতাশা নিয়ে তাজুল তার সন্তান রাফিকে কাজে পাঠানোর সিদ্ধান্ত নেন।
সে সময়ের কথা স্মরণ করে রেখা বলেন, ‘এটি কোনো পরিকল্পনা ছিল না; কিন্তু অবস্থা সত্যিই খুব খারাপ হয়ে গিয়েছিল।’
রেখা কখনও কল্পনাও করেননি নিজের ছেলেকে তিনি কাচের কারখানায় দিনে ১২ ঘণ্টার কাজের দিকে ঠেলে দেবেন। নিজেদের শূন্য ইটের ঘরের দিকে ইশারা করে তিনি বলেন, ‘কিন্তু এখন আমরা একটি বিপর্যস্ত জীবনের মধ্যে দিয়ে যাচ্ছি।’
মহামারি আঘাতের শুরুতে প্রাথমিক উদ্বেগের বিষয় ছিল মেয়েদের জোর করে বিয়ে দেয়ার ঘটনা। পরিস্থিতির সঙ্গে যুদ্ধ করা অনেক পরিবার খরচ কমানোর উপায় হিসেবে অল্পবয়সী মেয়েদের তাদের চেয়ে দ্বিগুণের বেশি বয়সী পুরুষের সঙ্গে বিয়ে দিচ্ছিল।
বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থা মানুষের জন্য ফাউন্ডেশন পরিচালিত একটি সমীক্ষায় লকডাউনের প্রথম ছয় মাসে দেশের এক-তৃতীয়াংশ এলাকায় প্রায় ১৪ হাজার বাল্যবিয়ের ঘটনা রেকর্ড করা হয়েছে। এসব মেয়ের অর্ধেকের বয়স ১৩ থেকে ১৫ বছর।
রাফি যেখানে পড়ত সেই শান্তিপুর উচ্চ বিদ্যালয়ের শিক্ষকরা তাদের ছাত্রীদের বিষয়ে খোঁজখবর রাখতেন। তারা জানেন, স্কুল থেকে বাদ পড়া মেয়েদের বেশির ভাগ গ্রামে চলে গেছে এবং শহরের বাইরে স্কুলে ভর্তি হয়েছে। অন্তত ১৫ জন মেয়েকে বাল্যবিয়েতে বাধ্য করা হয়েছে। প্রধান শিক্ষক বিপ্লব কুমার সাহা বলছেন, ‘১৫ সংখ্যাটি অনেক, তবে এটি আমাদের আশঙ্কার চেয়ে কম।’
তিনি যা প্রত্যাশা করেননি তা হলো মহামারি ছেলে শিক্ষার্থীদের ওপরেও প্রভাব ফেলবে। বিপ্লব কুমার বলেন, ‘এটি আমাদের প্রত্যাশা এবং কল্পনার বাইরে ছিল।’
বাংলাদেশে মাধ্যমিক শিক্ষা বিনা মূল্যে নয় এবং টিউশন ফি বছরে গড়ে প্রায় তিন হাজার টাকা। এই দেশে মহামারির আগে যেখানে প্রতি পাঁচজনের মধ্যে একজন ১৬৫ টাকার (১.৯০ ডলার) চেয়ে কম খরচে দিনযাপন করতেন, সেখানে মহামারির সময়ে স্টেশনারি, পাঠ্যবই এবং ইউনিফর্মের খরচও দ্রুত বৃদ্ধি পেয়েছে।
বাল্যবিয়ের ঝুঁকি মোকাবিলা এবং স্কুলে যাওয়ায় উৎসাহ দিতে সরকার প্রতি বছর ১১ থেকে ১৬ বছর বয়সী মেয়েদের উপবৃত্তি এবং টিউশন ভর্তুকি হিসেবে ৩৫০০ টাকা পর্যন্ত সহায়তা দেয়। ব্র্যাকের শিক্ষা পরিচালক সাফি খান বলেন, তবে ছেলে-মেয়েদের পরিবারের জন্য শিক্ষা আরও বিভিন্নভাবে উল্লেখযোগ্য খরচ তৈরি করে। এটি একটি অসম্ভব পরিস্থিতি এবং স্কুলে পাঠানো বজায় রাখার ক্ষেত্রে খুব কম সহায়তা আছে।
আইএলওর বাংলাদেশ ডিরেক্টর তুওমো পাউটিয়াইনেন বলছেন, অর্থনৈতিক সংকটের প্রথম লক্ষণগুলোর একটি হলো বয়ঃসন্ধিকালের ছেলেদের স্কুল থেকে ঝরে পড়া। স্কুল বন্ধের সময় বেশির ভাগ পরিবার মনে করেছিল, তাদের মেয়েদের কাজে পাঠানো অনেক বেশি ঝুঁকিপূর্ণ, তবে ছেলেরা তাদের জন্য আয়ের একটি জরুরি সংস্থান করতে পারে।
মেয়েদের শিক্ষার জন্য লাখ লাখ ডলারের বৈদেশিক সাহায্য এলেও বাংলাদেশে শিশু-অধিকার কর্মীরা বলেছেন, তারা কোভিডের প্রাদুর্ভাবের পর স্কুল ছেড়ে দেয়া লাখো ছেলেশিশু-কিশোরের সমান সহায়তার আহ্বান জানিয়ে লড়াই করছেন।
ওয়ার্ল্ড ভিশন বাংলাদেশের পরিচালক টনি মাইকেল গোমস বলছেন, “দাতারা যেন শিশুশ্রমের বিষয়ে ‘ইচ্ছাকৃতভাবে অন্ধ’। আমি একটি বিশাল বিচ্ছিন্নতা দেখতে পাচ্ছি … আপনি যদি সত্যিই জিজ্ঞাসা করেন তারা ঠিক কী অর্থায়ন করছে এবং তাদের সহায়তা শিশুদের জীবনকে প্রভাবিত করে কি না, তবে উত্তরটি ‘না’ হতে পারে।”
এই বক্তব্যের সঙ্গে বাংলাদেশে ইউনিসেফের প্রতিনিধি শেলডন ইয়েটও একমত। তিনি বলেন, ‘মেয়েদের ঝুঁকির বিষয়টিতে আমি কম জোর দিতে চাই না, তবে ছেলেদের নির্দিষ্ট চাহিদার প্রতিও আমাদের দৃষ্টি হারানো উচিত নয়।’
অনেক বাবা-মায়ের ক্ষেত্রে ক্রমবর্ধমান ঋণগ্রস্ততার সঙ্গে তাদের সন্তানদের শিক্ষার খরচ বাড়তি বোঝা তৈরি করেছে। এ কারণে তাদের ছেলেদের পড়াশোনার ইতি ঘটানো ছাড়া আর কোনো উপায় সামনে নেই।
আমেনা যখন তার ১১ বছরের ছেলে আলমগীরকে আর স্কুলে না পাঠানোর সিদ্ধান্ত জানান, ছেলেটি তখন তার সব বই ভাগাড়ে ফেলে দেয়। আমেনা বলেন, ‘আমার সেই সময়ের অনুভূতি ছিল অনেক কষ্টের।’
কিছুদিন পর আলমগীরের বন্ধুরা যখন গ্রাম ছেড়ে আবার স্কুলে ফিরে যায়, আমেনা দেখতে পান তার ছেলে কুঁড়েঘরের আড়ালে দাঁড়িয়ে কাঁদছে। আমেনা বলেন, ‘ওকে কাঁদতে দেখে আমিও কেঁদেছি।’
ছেলের কষ্ট আমেনা বুঝতে পারেন। ছোটবেলায় আমেনা তার ক্লাসের শীর্ষে ছিলেন, ১২ বছর বয়সে তার ভাই তাকে স্কুল ছাড়তে বাধ্য করেন। এরপর তাকে একজন বয়স্ক লোকের সঙ্গে বিয়ে দেয়া হয়।
আমেনা এর আগেও তার আরেক ছেলেকে শিক্ষা থেকে বঞ্চিত করতে বাধ্য হয়েছেন। পাঁচ বছর আগে স্বামী অসুস্থ হয়ে পড়লে আলমগীরের ভাইকে ইটের ভাটায় কাজ করতে পাঠানো হয়। ছেলেটির বয়স তখন ১১ বছর, ইটভাটায় দিনে তার উপার্জন ৩০০ টাকা। আমেনা বলেন, ‘আমরা ভেবেছিলাম আমাদের বাকি ছেলেরা শিক্ষিত হবে।’
তবে ২০২০ সালের মার্চে দেশব্যাপী লকডাউন শুরুর পর ইটভাটাটি চার মাসের জন্য বন্ধ ছিল। পরিবারের চাল ও চিকিৎসার জন্য ৪০ হাজার টাকা ঋণ করতে হয়। দুই বছর পর এখনও ৩০ হাজার টাকা ঋণ রয়েছে। আমেনার ভয়, এই ঋণ পরিশোধের জন্য আলমগীরেরও কাজ করে যেতে হবে।
বাংলাদেশে শিশুশ্রম বিষয়ক তথ্য খুবই অপ্রতুল। আইএলওর মতে, মহামারির আগে শিশুশ্রমের হার কমেছে বলে মনে হয়। তবে ২০১৩ সাল থেকে শিশুশ্রম নিয়ে দেশব্যাপী সরকারের নেতৃত্বে কোনো সমীক্ষা হয়নি।
২০১৯ সালে ইউনিসেফ একটি সমীক্ষা চালায়। এতে দেখা যায়, ১২ থেকে ১৪ বছর বয়সী প্রতি ১০ জন ছেলেশিশুর মধ্যে একজন পূর্ণকালীন শ্রমে জড়িত। গবেষণায় দেখা গেছে, আয়ের পরিমাণে হেরফের থাকলেও ১৪ বছরের কম বয়সী বেশির ভাগ ছেলে প্রতি মাসে ৪০ ডলারের (৩৪৭৫ টাকা) কম আয় করে।
ইউনিসেফের প্রতিনিধি শেলডন ইয়েট বলেন, ‘মহামারি শুরু হওয়ার পর থেকে আমাদের কাছে আপডেট পরিসংখ্যান নেই। তাই আমরা জানি না শিশুশ্রমের ওপর এর প্রভাব কী হতে চলেছে। তবে ধারণা করছি, প্রভাবটি অনেক খারাপ।’
বাংলাদেশ আইএলও কনভেনশনটি অনুমোদন করার আগেই দেশটির সংবিধানে ‘বিপজ্জনক’ শিশুশ্রম, যেমন ইট ভাঙা বা চামড়া ট্যানিংয়ের মতো কাজ বেআইনি ছিল। তবে বর্তমান আইনে ১৪ বছরের কম বয়সী শিশুদের অনানুষ্ঠানিক খাত- যেমন ঘরোয়া কাজ বা কৃষিতে তাদের পরিবারের প্রয়োজনে কাজ করা নিষিদ্ধ নয়।
শিশু অধিকার কর্মীরা বলছেন, যারা শিশুদের কোনো শিল্পে নিয়োগ করেন তাদের শাস্তি পাওয়ার ঘটনা বিরল। উদাহরণ হিসেবে তারা একটি জুস কারখানায় আগুনে কমপক্ষে ৫২ শ্রমিক নিহত হওয়ার তথ্য দিয়েছেন, যাদের মধ্যে ১১ বছরের মতো বয়সী শিশুর সংখ্যা কমপক্ষে ১৬। কারখানার মালিকদের অল্প সময়ের জন্য গ্রেপ্তার করা হয়েছিল এবং তারা জামিনে মুক্তি পান। তবে আদালতের মামলা এখনও বিচারাধীন।
অনেক কারখানামালিক বলেছেন, গত দুই বছরে প্রচুর বাবা-মা তাদের ছোট ছেলেদের কাজে নেয়ার অনুরোধ জানিয়ে দ্বারে দ্বারে ঘুরছেন। নারায়ণগঞ্জের একজন ব্যবসায়ী বলেছেন, মহামারি শুরু হওয়ার পর থেকে তিনি তার পোশাক কারখানায় প্রায় ১০ শিশুকে নিয়োগ দিয়েছেন। সবচেয়ে ছোটটির বয়স ছিল আট বছর।
এই ব্যবসায়ীর যুক্তি, সরকার ব্যর্থ হওয়ায় তিনি অসহায় পরিবারগুলোকে সাহায্য করছেন। তিনি বলেন, ‘আমাদের এই দেশে অনেক মানুষ এবং সম্পদ সীমিত। শিক্ষা (শিশুদের) ভবিষ্যতের কোনো নিশ্চয়তা দেয় না।’
তিনি যখন কথা বলছিলেন অদূরেই তুলার মেঘের মধ্যে নকঅফ অ্যাডিডাস (অ্যাডিডাসের নকল) ট্র্যাকসুট ভাঁজ করতে ব্যস্ত ১২ ও ১৩ বছর বয়সী দুটি ছেলে কাশির দমকে অস্থির ছিল।
বাংলাদেশে ইউনিসেফের প্রতিনিধি শেলডন ইয়েট মনে করছেন, মূল্যস্ফীতি বেড়ে যাওয়া এবং আরও বেশি পরিবার দারিদ্র্যের মধ্যে পতিত হওয়ায় বাংলাদেশি শিশুদের কর্মক্ষেত্র থেকে বের করে স্কুলে ফিরিয়ে আনার কাজটি দীর্ঘায়িত হবে।
তিনি বলেন, ‘এখানে কোনো একক ম্যাজিক বুলেট নেই। কনভেনশনের (আইএলও কনভেনশন) অনুসমর্থন গুরুত্বপূর্ণ, কিন্তু যথেষ্ট নয়। এ ক্ষেত্রে অনেকগুলো বিষয় আছে, যেমন বাধ্যতামূলক শিক্ষার সীমা কেবল ১০ বছর বয়স পর্যন্ত। আবার আর্থিকভাবে অসহায় পরিবারগুলোর জন্য তেমন কোনো সামাজিক সহায়তা নেই।’
এর পরেও সেপ্টেম্বরে স্কুলগুলো আংশিকভাবে ফের খোলার পর অনেক শিক্ষক ছাত্রদের বাড়িতে যেতে শুরু করেছেন। তাদের বামা-মাকে সন্তানদের ক্লাসে ফিরিয়ে দেয়ার অনুরোধ করেছেন।
শান্তিপুর উচ্চ বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক বিপ্লব কুমার সাহা বলেন, ‘আমরা তাদের (ঝরে পড়া ছেলে শিক্ষার্থী) পছন্দ করতাম। একসময়ের উপচে পড়া শ্রেণিকক্ষগুলোর খালি ডেস্ক দেখতে পেয়ে কিছু শিক্ষক ভারাক্রান্ত হয়ে পড়েছিলেন।’
আলমগীর শেষবার স্কুলে গিয়েছে দুই বছর আগে। শিশুটি চুপচাপ তাদের পাঁচটি ছাগলের দেখভাল করছিল, সকালে কাটা ঘাসের স্তূপের দিকে ছাগলগুলো নিয়ে যাওয়ার সময় সে একটির কান চুলকে দেয়।
তার বাবা-মা চান না আলমগীর তার বাবা ও ভাইয়ের সঙ্গে ইটের ভাটায় কাজ করুক। পরিবারের খামারে প্রচুর কাজ রয়েছে। আমেনারও আশা, ভবিষ্যতে ছেলেকে স্কুলে পাঠানোর টাকা জোগাড় করা যাবেই। তিনি বলেন, ‘আমাকে বিশ্বাস করতে হবে, আমি এটা ঘটাতে পারবই।’
তবে অন্য পরিবারগুলো কম আশাবাদী। রাফি যেখানে তার নিয়োগকর্তার সজাগ দৃষ্টির মাঝে কাচের কারখানার মেঝে পরিষ্কার করে, সেখান থেকে মাত্র ১০ মিনিটের দূরত্বের স্কুলে তার সাবেক সহপাঠীরা ইংরেজি ও ইতিহাস অধ্যয়ন করছে। মহামারির আগে রাফি ছিল উচ্ছ্বসিত, সারাক্ষণ বকবক করা এক শিশু। বাবা-মার ভাষায়, শক্তিতে পরিপূর্ণ একটি বলের মতো, যা সারাক্ষণ অশান্ত এবং খুব কমই স্থির।
আজকাল সে ক্লান্ত হয়ে বাড়ি ফেরে, ফেটে পড়ে আবেগ। মাকে বলে, ‘তোমার কারণে আমার জীবনের সব শেষ।’
রেখা জানেন না ছেলেকে কী করে সান্ত্বনা দেবেন, এই অনুতাপ তাকে তাড়িয়ে বেড়ায়। চোখের জলে ভেসে রেখা বলেন, ‘আমরাই ওর ভবিষ্যৎ নষ্ট করে দিয়েছি।’
আরও পড়ুন:ফেনীতে কিশোরকে ভয় দেখিয়ে তিন মাস ধরে বলাৎকারের অভিযোগে এক পুলিশ কনস্টেবলকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে।
ফেনী মডেল থানায় কর্মস্থল থেকে বৃহস্পতিবার দুপুরে অভিযুক্তকে গ্রেপ্তার করে বিকেলেই আদালতের মাধ্যমে কারাগারে পাঠায় পুলিশ।
এর আগে বুধবার নির্যাতনের শিকার ওই কিশোরের মা কনস্টেবল ইউনুস আলীর নামে থানায় মামলা করেন।
নিউজবাংলাকে এ তথ্য নিশ্চিত করে থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) নিজাম উদ্দিন বলেন, ‘ওই কিশোরের ডাক্তারি পরীক্ষা সম্পন্ন করা হবে।’
এজাহারে বলা হয়, গত বছরের ২৩ ডিসেম্বর তল্লাশির নামে মহিপাল থেকে তাকে আটক করেন ইউনুস আলী। এরপর তাকে পাশের একটি হোটেলে নিয়ে যান। সেখানে মামলার ভয় দেখিয়ে প্রথম দফায় বলাৎকার করেন। সে চিত্র মোবাইলে ধারণ করা করেন ইউনুস।
এ ভিডিও দেখিয়ে নিয়মিত তাকে বলাৎকার করতে থাকেন। এরই মধ্যে ওই কিশোরকে নিয়ে ইউনুস তার গ্রামের বাড়ি যান। সেখানে তার অন্য সহযোগীরাও কিশোরকে বলাৎকারের চেষ্টা করেন। পরে ইউনুসের মোবাইল ফোন নিয়ে পালিয়ে আসে কিশোর। বাড়ি ফিরে মোবাইলের সব ভিডিও ডিলিট করে সেটি বিক্রি করে দেয়।
এরই মধ্যে কনস্টেবল ইউনুস তার মোবাইলের আইএমইআই নম্বর ধরে ক্রেতার কাছে পৌঁছান ও খোঁজ নেন। পরে মহিপালের ওই মোবাইল ক্রেতা ওই কিশোরের বাড়িতে গিয়ে বিষয়টি জানালে পুরো ঘটনা জানাজানি হয়। কিশোর বাধ্য হয়ে তার পরিবারের কাছে ঘটনা খুলে বলে। এরপরই ওই কিশোরের মা বুধবার কনস্টেবল ইউনুসের নামে মামলা করেন।
ওই কিশোর আরও জানায়, থানায় রাখা পরিত্যক্ত একটি গাড়ির ভেতর নির্যাতনের আঁতুড়ঘর বানিয়েছেন ইউনুস আলী। সেখানে গভীর রাতে চালানো হতো নির্যাতন।
কিশোরের মায়ের দাবি, ইউনুস আলীর দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি হোক। একই সঙ্গে তার সহযোগীদেরও আইনের আওতায় আনা হোক।
ওসি নিজাম উদ্দিন বলেন, ‘মামলার এক দিন পরই ওই কনস্টেবলকে গ্রেপ্তার করে কারাগারে পাঠানো হয়েছে। ওই কিশোরকে পুলিশের জিম্মায় নেয়া হয়েছে। আদালতে ২২ ধারায় তার জবানবন্দি নেয়া হবে।’
আরও পড়ুন:‘নারী ধর্ষণ’ অপরাধের পাশাপাশি বলাৎকারকে ‘পুরুষ ধর্ষণ’ অপরাধ হিসেবে যুক্ত করতে দণ্ডবিধির ৩৭৫ ধারা সংশোধনের কেন নির্দেশ দেয়া হবে না তা জানতে চেয়ে রুল জারি করেছে হাইকোর্ট।
এ-সংক্রান্ত করা এক রিট আবেদনের পর রোববার বিচারপতি মো. মজিবুর রহমান মিয়া ও বিচারপতি খিজির হায়াতের হাইকোর্ট বেঞ্চ এ আদেশ দেয়।
রিটে আইন সচিব, স্বরাষ্ট্র সচিব ও পুলিশপ্রধানকে রুলের জবাব দিতে বলা হয়েছে।
আদালতে রিটের পক্ষে শুনানি করেন আইনজীবী তাপস কান্তি বল। রাষ্ট্রপক্ষে ছিলেন ডেপুটি অ্যাটর্নি জেনারেল বিপুল বাগমার।
দণ্ডবিধির ৩৭৫ ধারায় সংশোধন এনে ‘নারী ধর্ষণ’-এর অপরাধের পাশাপাশি অপরাধ হিসেবে ‘পুরুষ ধর্ষণ’ বিষয়টিকে যুক্ত করার নির্দেশনা চেয়ে গত বছরের ১৪ জানুয়ারি রিট করেন সমাজকর্মী ড. সৌমেন ভৌমিক, সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী ও মানবাধিকারকর্মী তাসমিয়া নূহাইয়া আহমেদ, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের আইনের শিক্ষক ড. মাসুম বিল্লাহ।
আইনজীবী তাপস কান্তি বল নিউজবাংলাকে বলেন, ‘দেশে হঠাৎ করেই বলাৎকার তথা পুরুষ ধর্ষণের অপরাধ বেড়ে চলেছে। এ ধরনের নির্যাতনকে ধর্ষণের অপরাধ হিসেবে বিচার করা যাচ্ছে না। এ কারণে দণ্ডবিধির ৩৭৫ ধারায় সংশোধন চেয়ে আদালতে রিট করি। ওই রিটের শুনানি নিয়ে আদালত রুল জারি করেছেন।’
মানবাধিকার সংগঠন আইন ও সালিশ কেন্দ্র (আসক) বিভিন্ন গণমাধ্যমের বরাতে এক পরিসংখ্যান প্রকাশ করেছে। সংগঠনচি বলছে, গত বছর দেশে শুধু মাদ্রাসায় ধর্ষণের শিকার হয়েছে অন্তত ৫২ শিশু। যার মধ্যে তিনজনের মৃত্যু হয়েছে। আর চলতি বছরের প্রথম তিন মাসে ‘ধর্ষণের শিকার’ হয়েছে আরও ১০ শিশু।
এ ছাড়া প্রায় সময়ই গণমাধ্যমে খবর আসে ছেলে শিশুদের ‘ধর্ষণের’। তবে শাস্তির বিধানে অনেক অপরাধী ছাড় পেয়ে যায়।
১৮৬০ সালের দণ্ডবিধির ৩৭৫ ধারায় বলা হয়েছে, ‘নারী ধর্ষণ: যদি কোন ব্যক্তি অতঃপর বর্ণিত ক্ষেত্র ব্যতীত নিম্নোক্ত পাঁচ প্রকার বর্ণনাধীন যে কোন অবস্থায় কোন নারীর সঙ্গে যৌন-সহবাস করে, সে ব্যক্তি নারী ধর্ষণ করেছে মর্মে পরিগণিত হবে।’
‘প্রথমত তার ইচ্ছার বিরুদ্ধে। দ্বিতীয়ত তার বিনা সম্মতিতে। তৃতীয়ত তার সম্মতি অনুযায়ী, যখন পুরুষটি জানে যে সে তাহার স্বামী নয় এবং সে (নারীটি) এ বিশ্বাস সম্মতি দান করে যে, সে (পুরুষটি) এমন কোন লোক, যার সঙ্গে সে আইনত বিবাহিত কিংবা সে নিজেকে তার সঙ্গে আইনত বিবাহিত বলে বিশ্বাস করে। পঞ্চমত: তার সম্মতিসহ বা সম্মতি ব্যতীত, যখন তার বয়স চৌদ্দ বৎসরের কম হয়।’
নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইনে ছেলেশিশুদের ধর্ষণের বিষয়টি আলাদাভাবে উল্লেখ করা হয়নি।
শিশু আইন অনুযায়ী, ১৮ বছরের নিচে সবাই শিশু। তাই ধর্ষণের শিকার শিশু ছেলে হোক বা মেয়ে- উভয়ের ক্ষেত্রে ওই আইনে বিচার করা যাবে। ১৮ বছরের বেশি বয়সী ছেলেদের ক্ষেত্রে দণ্ডবিধির ৩৭৭ ধারা প্রযোজ্য হবে। সেখানে এই অপরাধকে ‘অস্বাভাবিক যৌনাচার’ হিসেবে আখ্যা দিয়ে যাবজ্জীবন সাজার বিধান রয়েছে।
আরও পড়ুন:
মন্তব্য