× হোম জাতীয় রাজধানী সারা দেশ অনুসন্ধান বিশেষ রাজনীতি আইন-অপরাধ ফলোআপ কৃষি বিজ্ঞান চাকরি-ক্যারিয়ার প্রযুক্তি উদ্যোগ আয়োজন ফোরাম অন্যান্য ঐতিহ্য বিনোদন সাহিত্য ইভেন্ট শিল্প উৎসব ধর্ম ট্রেন্ড রূপচর্চা টিপস ফুড অ্যান্ড ট্রাভেল সোশ্যাল মিডিয়া বিচিত্র সিটিজেন জার্নালিজম ব্যাংক পুঁজিবাজার বিমা বাজার অন্যান্য ট্রান্সজেন্ডার নারী পুরুষ নির্বাচন রেস অন্যান্য স্বপ্ন বাজেট আরব বিশ্ব পরিবেশ কী-কেন ১৫ আগস্ট আফগানিস্তান বিশ্লেষণ ইন্টারভিউ মুজিব শতবর্ষ ভিডিও ক্রিকেট প্রবাসী দক্ষিণ এশিয়া আমেরিকা ইউরোপ সিনেমা নাটক মিউজিক শোবিজ অন্যান্য ক্যাম্পাস পরীক্ষা শিক্ষক গবেষণা অন্যান্য কোভিড ১৯ শারীরিক স্বাস্থ্য মানসিক স্বাস্থ্য যৌনতা-প্রজনন অন্যান্য উদ্ভাবন আফ্রিকা ফুটবল ভাষান্তর অন্যান্য ব্লকচেইন অন্যান্য পডকাস্ট বাংলা কনভার্টার নামাজের সময়সূচি আমাদের সম্পর্কে যোগাযোগ প্রাইভেসি পলিসি

বিশ্লেষণ
বাংলাদেশ ভারত কূটনৈতিক সম্পর্কেরও সুবর্ণজয়ন্তী
google_news print-icon

বাংলাদেশ-ভারত কূটনৈতিক সম্পর্কেরও সুবর্ণজয়ন্তী

বাংলাদেশ-ভারত-কূটনৈতিক-সম্পর্কেরও-সুবর্ণজয়ন্তী
এই মার্চ মাসেই ভারত বঙ্গবন্ধুকে ‘গান্ধী শান্তি পুরস্কার’ দিয়েছে। কারণ বঙ্গবন্ধু দুই দেশের সম্পর্ক ও জোরালো অংশীদারের ভিত্তি গড়েছিলেন। ২০২০ সালের জন্য পুরস্কার ঘোষণা করতে গিয়ে ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি বলেছেন, মানবাধিকার ও স্বাধীনতার কাণ্ডারি ছিলেন বঙ্গবন্ধু। ভারতীয়দের কাছেও তিনি নায়ক। বঙ্গবন্ধুর উত্তরাধিকার ও অনুপ্রেরণা দুই দেশের ঐতিহ্যকেও ঋদ্ধ করেছে। তার দেখানো পথেই দুই দেশের বন্ধুত্ব, উন্নয়ন ও সমৃদ্ধির ভিত্তি আরও শক্তিশালী হয়েছে।’

নয়াদিল্লিতে গত ২৪ মার্চ এক সংবাদ সম্মেলনে ভারতের পররাষ্ট্রসচিব হর্ষবর্ধন শ্রিংলা বলেছেন, ‘সম্ভাব্য চুক্তি ও সমঝোতাগুলোও গুরুত্বপূর্ণ; কিন্তু সফরের মূল বিষয় হলো বাংলাদেশের স্বাধীনতা ও কূটনৈতিক সম্পর্কের ৫০ বছর এবং মুজিববর্ষ। তিনি বলেছেন, ১৯৭১ সালে ভারতীয়রাও বাংলাদেশের স্বাধীনতার জন্য রক্ত দিয়েছে। একটি দেশ স্বাধীন করতে প্রতিবেশী দুই দেশের একসঙ্গে হয়ে রক্তদান ও আত্মত্যাগ বিরল।’

মোদির সফরের গুরুত্ব তুলে ধরে শ্রিংলা আরও বলেছেন, ‘বঙ্গবন্ধু ২৬ মার্চ আলাদা রাষ্ট্র ঘোষণা করেছিলেন। এই দিনটি উদযাপন অনুষ্ঠানে আমাদের আমন্ত্রণ জানানো হয়েছে। গত ডিসেম্বর মাসেও শেখ হাসিনা-নরেন্দ্র মোদি ভার্চুয়াল শীর্ষ সম্মেলন করেছিলেন। সেখানেও সমঝোতা হয়েছিল। এবারও হবে। কিন্তু এবারের সফরের যে বিশেষ তাৎপর্য, তা থেকে বিচ্যুত হওয়া যাবে না।’

প্রকৃতপক্ষে বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্ব এবং ১৯৭১-এর মুক্তিযুদ্ধ ভারত-বাংলাদেশ কূটনৈতিক সম্পর্ককে দৃঢ় ভিত্তির ওপর দাঁড় করিয়ে দিয়েছে। স্বাধীন বাংলাদেশে বঙ্গবন্ধু বার বার বলে গেছেন ভারতের কথা। কৃতজ্ঞতা জ্ঞাপন করেছিলেন তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীর প্রতি। যেমন- ‘‘আমি ভারতের প্রধানমন্ত্রী শ্রীমতি ইন্দিরা গান্ধী এবং ভারত, সোভিয়েট ইউনিয়ন, ব্রিটেন, ফ্রান্স ও আমেরিকার জনসাধারণের প্রতি আমাদের এই মুক্তি সংগ্রামে সমর্থনদানের জন্য আন্তরিক কৃতজ্ঞতা জানাই। বর্বর পাকিস্তানি সৈন্যদের অত্যাচারে অতিষ্ঠ হয়ে আমার দেশের প্রায় এক কোটি মানুষ ঘর বাড়ি ছেড়ে মাতৃভূমির মায়া ত্যাগ করে ভারতে আশ্রয় নিয়েছিল। ভারত সরকার ও তার জনসাধারণ নিজেদের অনেক অসুবিধা থাকা সত্ত্বেও এই ছিন্নমূল মানুষদের দীর্ঘ নয় মাস ধরে আশ্রয় দিয়েছে, খাদ্য দিয়েছে। এজন্য আমি ভারত সরকার ও ভারতের জনসাধারণকে আমার দেশের সাড়ে সাত কোটি মানুষের পক্ষ থেকে আমার অন্তরের অন্তস্থল হতে ধন্যবাদ জানাই।’’ (১০/১/১৯৭২)

এরপর ১৯৭২ সালের ৭ ফেব্রুয়ারি কলকাতার ব্রিগেড প্যারেড গ্রাউন্ডে প্রদত্ত ভাষণে বঙ্গবন্ধু একইভাবে বলেন-

‘‘আমি দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করি যে ভারত-বাংলাদেশ মৈত্রী চিরদিন অটুট থাকবে। বিশ্বের কোনো শক্তিই পারবে না এই মৈত্রীতে ফাটল ধরাতে। ভারত-বাংলাদেশ ভূখণ্ডে আর সাম্রাজ্যবাদের কোনো খেলা চলতে দেওয়া হবে না।’’

এই মার্চ মাসেই ভারত বঙ্গবন্ধুকে ‘গান্ধী শান্তি পুরস্কার’ দিয়েছে। কারণ বঙ্গবন্ধু দুই দেশের সম্পর্ক ও জোরালো অংশীদারের ভিত্তি গড়েছিলেন। ২০২০ সালের জন্য পুরস্কার ঘোষণা করতে গিয়ে ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি বলেছেন, মানবাধিকার ও স্বাধীনতার কাণ্ডারি ছিলেন বঙ্গবন্ধু। ভারতীয়দের কাছেও তিনি নায়ক। বঙ্গবন্ধুর উত্তরাধিকার ও অনুপ্রেরণা দুই দেশের ঐতিহ্যকেও ঋদ্ধ করেছে। তার দেখানো পথেই দুই দেশের বন্ধুত্ব, উন্নয়ন ও সমৃদ্ধির ভিত্তি আরও শক্তিশালী হয়েছে।’

প্রকৃতপক্ষে বঙ্গবন্ধু অনুসৃত কূটনৈতিক সম্পর্কের পথেই প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা হাঁটছেন। তার আমন্ত্রণেই মোদি ঢাকা সফরে পৌঁছাবেন ২৬ মার্চ। বাংলাদেশ-ভারত সম্পর্ক এগিয়ে নিতে দুই দেশেরই জোরালো আগ্রহ দেখা যাচ্ছে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির সময়ে এ সম্পর্ক সত্যিকার অর্থেই ‘সোনালি অধ্যায়ে’ পরিণত হয়েছে।

১৭ মার্চ (২০২১) জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ১০১তম জন্মবার্ষিকীতে তার প্রতি শ্রদ্ধা জানিয়ে ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি বাংলায় টুইট করে লিখেছেন-

“মানবাধিকার ও স্বাধীনতার রক্ষক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জন্মবার্ষিকীতে তার প্রতি আমার আন্তরিক শ্রদ্ধা। সকল ভারতীয় নাগরিকের কাছেও তিনি একজন বীর হিসেবে গণ্য হন।”

অপরদিকে ২৬ মার্চ বাংলাদেশের স্বাধীনতার ৫০ বছর পূর্তিতে দশ দিনের অনুষ্ঠানমালার পাঁচ দিনের আয়োজনে যোগ দিয়েছেন প্রতিবেশী পাঁচ দেশের রাষ্ট্র ও সরকার প্রধান; যার মধ্যে নরেন্দ্র মোদিও আছেন। এই সফর নিয়ে উচ্ছ্বাস প্রকাশ করে মোদি টুইটে লিখেছেন-

“এই মাসের শেষের দিকে ঐতিহাসিক মুজিববর্ষ উদযাপন উপলক্ষে বাংলাদেশ সফর করতে পারা আমার জন্য সম্মানের বিষয়।”

নরেন্দ্র মোদি দুই দিনের সফরে ঢাকায় আসছেন আগামীকাল ২৬ মার্চ । তার ঢাকা সফরের মধ্যে দিয়ে প্রতিবেশী দুই দেশের কূটনৈতিক সম্পর্ক আরও জোরদার হবে বলে আশা করছেন বিশিষ্টজনরা। সফরের অংশ হিসেবে ২৭ মার্চ ঢাকায় অনুষ্ঠিত হবে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও তার মধ্যে দ্বিপক্ষীয় বৈঠক। বৈঠকে তিস্তা নদীর পানিবণ্টন নিয়ে আলোচনা করবেন দুই সরকারপ্রধান। আলোচনা হবে দুই দেশের মধ্যকার দ্বিপক্ষীয় সব ইস্যু নিয়ে। বৈঠকে বাংলাদেশ-ভারতের মধ্যে স্বাক্ষর হবে ৩টি সমঝোতা স্মারক। এসময় যৌথভাবে কয়েকটি প্রকল্পের উদ্বোধনের ঘোষণাও দিতে পারেন দুই দেশের সরকারপ্রধান। বাংলাদেশের স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তী উপলক্ষে আয়োজিত অনুষ্ঠানে ভারতীয় প্রধানমন্ত্রী বক্তব্য প্রদান করবেন। সন্ধ্যায় বঙ্গবন্ধু আন্তর্জাতিক সম্মেলন কেন্দ্রে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গে যৌথভাবে বঙ্গবন্ধু-বাপু ডিজিটাল প্রদর্শনীর উদ্বোধন করা হবে।

২৭ মার্চ সকালে তিনি টুঙ্গিপাড়ায় বঙ্গবন্ধুর সমাধিসৌধ পরিদর্শন করে শ্রদ্ধা নিবেদন করবেন। তাছাড়া তিনি সাতক্ষীরা ও গোপালগঞ্জে দুটি মন্দির পরিদর্শন করে স্থানীয় জনগণের সঙ্গে কথা বলবেন। বিকেলে দুই প্রধানমন্ত্রীর মধ্যে একান্ত বৈঠক ছাড়াও ভারতের প্রধানমন্ত্রী একইসঙ্গে বাংলাদেশ-ভারত বন্ধুত্বের ৫০ বছর উপলক্ষে পৃথক দুটি স্মারক ডাকটিকেট উন্মোচন করবেন।এই সফরকে সামনে রেখে গত ৯ মার্চ (২০২১) সীমান্তবর্তী ফেনী নদীর ওপর একটি সেতুর উদ্বোধন করা হয়েছে। সেতুটি সরাসরি যুক্ত করেছে বাংলাদেশ ও ভারতের উত্তর পূর্বের রাজ্যগুলোকে। এখন ভারতের এই রাজ্যগুলো সেতু দিয়ে সহজে চট্টগ্রাম বন্দর ব্যবহার করে পণ্য আনা নেয়া করতে পারবে। পাঁচ বছর আগেই ভারতের জন্য চট্টগ্রাম বন্দর ব্যবহার বা ট্রানজিট-ট্রান্সশিপমেন্টের সুবিধা কার্যকর হয়েছে। মূলত স্থল সীমান্ত-বাণিজ্যে সমস্যা কমানো গেছে, কানেক্টিভিটি অনেক বৃদ্ধি পেয়েছে এবং নতুন জিনিস যোগ হয়েছে। এসব উদ্যোগ প্রমাণ করে যে, দু’দেশের সম্পর্ক আরও দৃঢ় হয়েছে।

অপরদিকে ২০২০ ও ২০২১ সাল মহামারির জন্য অত্যন্ত চ্যালেঞ্জিং, তবে এর মাঝেই ভারত ও বাংলাদেশের মধ্যে ভালো সহযোগিতামূলক লেনদেন গড়ে উঠেছে। ভ্যাকসিনের ক্ষেত্রেও দুই দেশের সহযোগিতা আছে। নানা ক্ষেত্রে দুই দেশের অংশীদারত্ব এগিয়ে যাচ্ছে। ২০২০ সালের ২৫ মার্চ করোনা মোকাবিলায় চীনের আগে এদেশে এসেছে ভারতের জরুরি চিকিৎসা সহায়তা সরঞ্জাম। ৩০ হাজার সার্জিক্যাল মাস্ক এবং ১৫ হাজার হেড কভার ছিল আমাদের জন্য মূল্যবান। এই উপহার ছিল করোনাভাইরাস বিস্তাররোধে ঐক্যবদ্ধভাবে লড়াই করার প্রতিশ্রুতি বাস্তবায়নের অংশ। ভারতের ‘প্রতিবেশী প্রথম’ নীতির অংশ হিসেবে এবং কোভিড ১৯-এর বিস্তাররোধ করার জন্য একটি সমন্বিত আঞ্চলিক উদ্যোগ নিতে ১৫ মার্চ ২০২০ ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি এবং অন্যান্য সার্ক নেতৃবৃন্দ একটি ভিডিও সম্মেলন করেন। এই অঞ্চলের প্রতি ভারতের প্রতিশ্রুতি বাস্তবায়নের একটি উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত এটি। এই উপহারের মতো ভ্যাকসিনও উপহার পেয়েছি আমরা। অক্সফোর্ড-অ্যাস্ট্রাজেনেকার আবিষ্কৃত কোভিশিল্ড নামের টিকা তৈরি করেছে ভারতের সিরাম ইনস্টিটিউট। সেই কোভিশিল্ড নামের ভ্যাকসিন ২১ জানুয়ারি (২০২১) ভারতের উপহার হিসেবে ঢাকায় এসে পৌঁছায়।

আগেই ভারত জানিয়েছিল, কুড়ি লাখ ডোজ টিকা বিনামূল্যে বাংলাদেশকে উপহার দেবে তারা। এই উপহার দু’দেশের একসঙ্গে সংকট মোকাবিলার অনন্য নজির। উপরন্তু ২৬ মার্চ মোদির এদেশ সফরে বাংলাদেশকে ১০৯টি অ্যাম্বুলেন্স উপহার দেবে ভারত। ২৪ মার্চ অ্যাম্বুলেন্স পৌঁছে গেছে এদেশে। হর্ষবর্ধন শ্রিংলা বলেছেন, এ যাবত ভারতের তৈরি করোনার টিকা সবচেয়ে বেশি পেয়েছে বাংলাদেশ। প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি বলেছেন, বাংলাদেশের করোনা টিকার চাহিদা মেটাতে ভারত যথাসাধ্য চেষ্টা করবে।

দিল্লিতে শেখ হাসিনা ও নরেন্দ্র মোদির সরাসরি সাক্ষাৎ হয় ২০১৯ সালের অক্টোবর মাসে। তারপর করোনা মহামারিতে ভার্চুয়ালি একাধিক বৈঠক হয়েছে। আসলে ভারতের সঙ্গে এদেশের সংযোগ সবসময় অটুট রয়েছে। আর এজন্য তিস্তা চুক্তির বিষয়ে ভারত সরকার আন্তরিক এবং এ বিষয়ে কাজ অনেকটা এগিয়ে আছে বলে জানিয়েছেন পররাষ্ট্রমন্ত্রী। তার মতে, ‘শুধু তিস্তা চুক্তি নয়, বাকি যে আমাদের ৬টি অভিন্ন নদীর পানি নিয়েও আমরা আলোচনা করি।’

আমাদের পররাষ্ট্রনীতির পাঁচ লক্ষ্যের অন্যতম হলো- ‘ভারত ও নিকট প্রতিবেশী দেশসহ বিশ্বের সকল দেশের সঙ্গে গুরুত্বপূর্ণ দ্বিপক্ষীয় সম্পর্ক বজায় রাখা।’ এই লক্ষ্য অর্জনে কাজ করে চলেছে শেখ হাসিনা সরকার।

২০১১ সালে বাংলাদেশ ও ভারত স্থলসীমানা চুক্তি ১৯৭৪-এর প্রটোকল স্বাক্ষর এবং ২০১৫ সালে স্থলসীমানা চুক্তির অনুসমর্থন শেখ হাসিনার সুদীর্ঘ প্রচেষ্টারই সুফল। ইন্সট্রুমেন্ট অব রেটিফিকেশন এবং লেটার অব মোডলিটিস স্বাক্ষরের মাধ্যম তৎকালীন ১১১টি ভারতের ছিটমহল বাংলাদেশের এবং আমাদের ৫১টি ছিটমহল ভারতের অংশ হয়ে যায়। ছিটমহল বিনিময়ের মাধ্যমে এর আগে নাগরিকত্বহীন ৫০ হাজারের বেশি মানুষ তাদের দীর্ঘ প্রতীক্ষিত নাগরিকত্ব লাভ করে। এই মাইলস্টোন ঘটনাটি ঘটে ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির আমলে। তিনি ২০১৫ সালের ৬-৭ জুন বাংলাদেশ সফর করেন। এ সফরে সর্বমোট ২২টি দ্বিপক্ষীয় চুক্তি স্বাক্ষর হয়। শেখ হাসিনা সরকারের সফল কূটনৈতিক তৎপরতায় ভারতের সঙ্গে দীর্ঘদিনের অমীমাংসিত স্থলসীমানা ও সমুদ্রসীমা শান্তিপূর্ণভাবে নির্ধারিত হয়েছে। তবে মনে রাখা দরকার, ২০১১ সলের ৬-৭ সেপ্টেম্বর ভারতের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী ড. মনমোহন সিং বাংলাদেশ সফর করেন। ওই সফরের ঐতিহাসিক সাফল্য হচ্ছে, এর সুবাদেই ১৯৭৪ সালের ঐতিহাসিক স্থলসীমান্ত চুক্তি বাস্তবায়ন ঘটে যার ফলে ভারতে কংগ্রেসের উভয়পক্ষ অর্থাৎ লোকসভা ও রাজ্যসভায় চুক্তির রেটিফিকেশন সর্বসম্মতিক্রমে গৃহীত হয়। এ সাফল্যের কারণেই দীর্ঘদিনের অমীমাংসিত স্থলসীমানা নির্ধারণ ও ছিটমহল-বিনিময় শান্তিপূর্ণভাবে সম্পন্ন হয়। অবশ্য নরেন্দ্র মোদির আমলে ভারতের বাজারে বাংলাদেশি পণ্যের শুল্ক ও কোটামুক্ত প্রবেশের সুযোগের কারণে (সাফটা নেগেটিভ লিস্ট-এর ২৫ ধরনের আইটেম ব্যতীত) ভারতে বাংলাদেশের পণ্য রপ্তানিতে গতিশীলতা এসেছে। দু’দেশের মধ্যে বিদ্যমান বিশাল বাণিজ্যঘাটতি নিরসনের বিষয়ে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সুনির্দিষ্ট পদক্ষেপ গ্রহণের ব্যাপারে দৃঢ় অবস্থানে রয়েছেন। সেসময় ভারতের প্রধানমন্ত্রীও এ বিষয়টির উল্লেখ করে বাণিজ্যঘাটতি নিরসনে যাবতীয় ব্যবস্থা গ্রহণের নির্দেশনা দেন।

বাংলাদেশের অনুরোধের পরিপ্রেক্ষিতে ২০১৬ সালের ১৮ ফেব্রুয়ারি ফুলবাড়িতে (বাংলাবান্ধার বিপরীতে) ইমিগ্রেশন সুবিধা চালু করা হয়। স্থল শুল্ক স্টেশন বা স্থল বন্দর এবং অন্যান্য ব্যবসা-বাণিজ্যিক অবকাঠামো উন্নয়নে দু’দেশ ধারাবাহিকভাবে কাজ করে যাচ্ছে। আঞ্চলিক ও দ্বিপক্ষীয় বাণিজ্য সম্পর্ক উন্নয়নে এসব পদক্ষেপ নিঃসন্দেহে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখে চলেছে।

উল্লেখ্য, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সুযোগ্য নেতৃত্বে গত কয়েক বছরে স্বাক্ষরিত দ্বিপক্ষীয় বাণিজ্যচুক্তি, অভ্যন্তরীণ নৌ চলাচল রুট সম্পর্কিত প্রটোকল, ঢাকা-গৌহাটি-শিলং এবং কলকাতা-ঢাকা-আগরতলা বাস সার্ভিস, চট্টগ্রাম ও মংলা বন্দর ব্যবহার সম্পর্কিত সমঝোতা স্মারকসহ বিভিন্ন চুক্তি দেশ দু’টির আন্তঃযোগাযোগ সম্প্রসারণে যুগান্তকারী ভূমিকা রেখেছে। মৈত্রী এক্সপ্রেসের ঢাকা ও কলকাতায় প্রান্তীয় কাস্টমস ও ইমিগ্রেশন ব্যবস্থা চালু হয়েছে। খুলনা-কলকাতা ট্রেন সার্ভিস চলছে। অন্যদিকে বাংলাদেশ ও ভারত দু’দেশের মানুষেরই ভিসাপ্রাপ্তি সহজীকরণে বিভিন্ন পদক্ষেপ নেয়া হয়েছে।

এখন রেল, বিমান ও বাসযাত্রার তারিখ উল্লিখিত টিকিট দিয়ে কোনো ধরনের অ্যাপয়েন্টমেন্ট ছাড়াই ভিসার জন্য আবেদন করা যায়। উপরন্তু হাইকমিশনের অ্যাপয়েন্টমেন্ট ছাড়াই ভারতের হাসপাতাল ও ডাক্তারের অ্যাপয়েন্টমেন্ট দিয়ে সরাসরি মেডিক্যাল ভিসার জন্য আবেদন করা যাচ্ছে। ৬৫ বছরের ঊর্ধ্বে বাংলাদেশি নাগরিকদের জন্য ৫ বছরের মাল্টিপল ভিসা ইস্যুর ব্যবস্থা নেয়া হয়েছে। জনযোগাযোগ তথা কূটনৈতিক কর্মকাণ্ড সম্প্রসারণের লক্ষ্যে ভারত বাংলাদেশের খুলনা ও সিলেট এবং বাংলাদেশ ভারতের মুম্বাই ও গৌহাটিতে উপ-হাইকমিশন চালু করেছে।

নরেন্দ্র মোদির আমন্ত্রণে ভারতের গোয়াতে ২০১৬ সালের অক্টোবর মাসে অনুষ্ঠিত ব্রিকস-বিমসটেক আউটরিচ সামিটে অংশ নেন শেখ হাসিনা। ওই সম্মেলনে বিমসটেকভুক্ত দেশগুলোতে মানসম্মত ও টেকসই অবকাঠামো উন্নয়নের জন্য বিনিয়োগের প্রয়োজনের ওপর গুরুত্বারোপ করেন তিনি। পুনরায় ২০১৮ সালের ২৫-২৬ মে শেখ হাসিনা মোদির আমন্ত্রণে ভারতের পশ্চিমবঙ্গ সফর করেন। এটি ছিল প্রধানমন্ত্রীর দ্বিতীয় মেয়াদের দ্বিতীয় ভারত সফর। সফরকালে প্রধানমন্ত্রী পশ্চিমবঙ্গের শান্তিনিকেতনে বিশ্বভারতী বিশ্ববিদ্যালয়ে বাংলাদেশের অর্থায়নে নবনির্মিত ‘বাংলাদেশ ভবন’ উদ্বোধন করেন। পাশাপাশি তিনি বিশ্বভারতী বিশ্ববিদ্যালয়ের নিয়মিত সমাবর্তনে ‘গেস্ট অব অনার’ হিসেবে যোগদান করেন। সফরকালে আসানসোলে অবস্থিত কাজী নজরুল বিশ্ববিদ্যালয় এক বিশেষ সমাবর্তন অনুষ্ঠানে শেখ হাসিনাকে সম্মানসূচক ডক্টর অব লিটারেচার (ডি. লিট) উপাধিতে ভূষিত করে।

ভারত সফরকালে তিনি ভারতের প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে পারস্পরিক স্বার্থসংশ্লিষ্ট বিষয়ে দ্বিপক্ষীয় বৈঠকে মিলিত হন। শেখ হাসিনার দিকনির্দেশনা ও গুরুত্বারোপের ফলে বিদ্যুৎ ও জ্বালানি খাতে ভারতের সঙ্গে আজ আমরা সহযোগিতার এক অনন্য অবস্থানে উপনীত হয়েছি। ভারত থেকে ভেড়ামারা-বহরমপুর গ্রিডের মাধ্যমে এবং ত্রিপুরার পালাটানা বিদ্যুৎকেন্দ্র থেকে বর্তমানে ৬৬০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ আমদানি করা হচ্ছে।

২০১৬ সালের ১৯ মার্চ প্রথমবারের মতো বাংলাদেশ রেলপথে ভারত থেকে ২২৬৮ মেট্রিক টন হাই-স্পিড ডিজেল আমদানি করে। ইতোমধ্যে দু’দেশের মধ্যে তেল ও গ্যাসক্ষেত্রে সহযোগিতা সম্প্রসারণে দুটি সমঝোতা স্মারক স্বাক্ষর হয়। পাশাপাশি, জ্বালানি খাতে সহযোগিতা সম্প্রসারণে বিশেষত নবায়নযোগ্য জ্বালানি, সৌর শক্তি ও পারমাণবিক শক্তি ব্যবহারে দু’দেশের প্রচেষ্টা অব্যাহত রয়েছে। ভারত ও ফ্রান্সের যৌথ উদ্যোগে গঠিত আন্তর্জাতিক সোলার অ্যালায়েন্সে বাংলাদেশও যুক্ত হয়েছে। নিঃসন্দেহে বাংলাদেশের জ্বালানি নিরাপত্তা সংরক্ষণে এসব উদ্যোগ দীর্ঘমেয়াদি ভূমিকা পালন করবে।

শেখ হাসিনা সরকারের আমলে ভারতের নয়াদিল্লিতে অনুষ্ঠিত একাধিক সম্মেলনে যোগ দেন মন্ত্রী মহোদয়রাও। যেমন, ২০১৬ সালের ৩-৫ নভেম্বর নয়াদিল্লিতে অনুষ্ঠিত দ্বি-বার্ষিক এশিয়ান মিনিস্ট্রিয়াল কনফারেন্স অন ডিজাস্টার রিস্ক রিডাকশান (এএমসিডিআরআর) অংশ নেন দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণমন্ত্রী। ২০১৬ সালের ৬-৭ অক্টোবর নয়াদিল্লিতে অনুষ্ঠিত ইন্ডিয়ান ইকোনমিক সামিটে প্রধানমন্ত্রীর প্রতিনিধি হিসেবে যোগ দেন পরিকল্পনামন্ত্রী।

বিশ্ব অর্থনৈতিক ফোরাম (ডব্লিউইএফ) এবং কনফেডারেশন অব ইন্ডিয়ান ইন্ডাস্ট্রিজ (সিআইআই)-এর যৌথ আয়োজনে অনুষ্ঠিত এ সভায় তিনি বাংলাদেশের আর্থ-সামাজিক অগ্রগতি ও সাম্প্রতিক নানামুখী সাফল্য তুলে ধরেন।

ভারতের সঙ্গে ‘তিস্তাচুক্তি’ সম্পন্ন না হলেও পানি সম্পদের সুষ্ঠু ব্যবস্থাপনা এবং সবার জন্য সুপেয় ও নিরাপদ পানি এবং পয়ঃনিষ্কাশন সুবিধা নিশ্চিতকরণ বর্তমান সরকারের অন্যতম অঙ্গীকার। জলবায়ু পরিবর্তন ও টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা অর্জনে পানির সুষ্ঠু ব্যবস্থাপনার ভূমিকা গুরুত্বপূর্ণ। এ বিবেচনায় বৈশ্বিক পরিমণ্ডলেও পানিসম্পদ-বিষয়ক আলোচনা বিশেষ গুরুত্ব পাচ্ছে। এ-সংক্রান্ত বিভিন্ন আন্তর্জাতিক ফোরামের আলোচনায় পানিকে অন্যতম ‘মানবাধিকার’ হিসেবে উল্লেখ করেছেন প্রধানমন্ত্রী। এর মাধ্যমে মানবজাতির অস্তিত্ব সুরক্ষায় পানির অপরিহার্যতার বিষয়টি পুনর্ব্যক্ত হয়েছে। জাতিসংঘের পানি-বিষয়ক ‘হাই লেভেল প্যানেল অন ওয়াটার’-এ কথা বলেছেন শেখ হাসিনা।

২০২০ সালের ১৭ ডিসেম্বর বিশ্বজুড়ে মহামারির মধ্যে ভারতের প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে ভার্চুয়াল বৈঠক হয় আমাদের প্রধানমন্ত্রীর। মহামারির মধ্যেও দুই দেশের সহযোগিতা অব্যাহত থাকার কথা তুলে ধরে শেখ হাসিনা তখন বলেছিলেন, বছরজুড়ে রেলরুট দিয়ে বাণিজ্য, উচ্চপর্যায়ের পরিদর্শন ও সভা, সক্ষমতা বৃদ্ধির উদ্যোগ, কলকাতা থেকে উত্তর-পূর্ব ভারতে ভারতীয় পণ্যসামগ্রীর প্রথম পরীক্ষামূলক চালান প্রেরণ এবং অবশ্যই কোভিড-১৯ বিষয়ে সহযোগিতার মতো বিভিন্ন উদ্যোগ আমরা গ্রহণ করেছি। তিনি বলেন, করোনা মহামারির দ্বিতীয় ঢেউ মোকাবিলা করতে ব্যাপক ব্যবস্থা নেয়া হয়েছে, ফলে আন্তর্জাতিক সরবরাহ চেইন ব্যাপক বিঘ্ন ঘটা এবং ভোক্তাদের চাহিদা হ্রাস পাওয়া সত্ত্বেও আমাদের অর্থনীতি ঊর্ধ্বমুখী প্রবৃদ্ধির ধারা বজায় রাখতে সক্ষম হয়েছে। বাংলাদেশ ও ভারতের অর্থনীতির ক্রমবর্ধমান পারস্পরিক নির্ভরতা রয়েছে। বেশ কিছুসংখ্যক ভারতীয় নাগরিক বাংলাদেশের উৎপাদন ও সেবা খাতে নিযুক্ত রয়েছেন এবং তারা নিজদেশ ভারতে রেমিটেন্স পাঠিয়ে থাকেন। অপরদিকে, বাংলাদেশ থেকে সর্বোচ্চ সংখ্যক পর্যটক এবং চিকিৎসা সেবা গ্রহণকারীকে ভারত গ্রহণ করে।

এভাবে ৫০ বছরে গড়ে উঠেছে দু’দেশের কূটনৈতিক সেতুবন্ধন। নরেন্দ্র মোদির সফরে সেই সেতুবন্ধন আরও দৃঢ় হবে বলে সকলের প্রত্যাশা। তাছাড়া ২০১৯ সালের মে মাসে শুরু হওয়া নরেন্দ্র মোদির দ্বিতীয় দফার মেয়াদ ২০২৪ সালে শেষ হবে। মনে করা হচ্ছে, তখন ভারত চীনকে টপকে বিশ্বের সবচেয়ে বেশি জনসংখ্যার দেশে পরিণত হবে, আবার এই দেশটি হবে বিশ্বের পঞ্চম বৃহত্তম অর্থনীতির দেশ। আর এ কারণে বাংলাদেশের সঙ্গে দেশটির সম্পর্ক গুরুত্ব বহন করে। অথচ মোদির বাংলাদেশ সফর নিয়ে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি করতে একটি গোষ্ঠীকে উসকানি দিচ্ছে বিএনপি। এমন অভিযোগ করেছেন আওয়ামী লীগ সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের। তিনি বলেন, মোদির বিরোধিতার আড়ালে মুজিববর্ষের বিরোধিতা করছে দলটি। অপরদিকে, পররাষ্ট্রমন্ত্রী বলেছেন, বিরোধিতা হলেও নরেন্দ্র মোদিকে সর্বোচ্চ সম্মান ও নিরাপত্তা দেবে সরকার। নরেন্দ্র মোদিকে দল-মতের ঊর্ধ্বে রেখে আঞ্চলিক সহযোগিতার অন্যতম অনুপ্রেরণাদায়ী নেতা হিসেবে অভিনন্দন জানানো এদেশের জনগণের কর্তব্য।

লেখক : ইউজিসি পোস্ট ডক ফেলো, কবি, লেখক, সাধারণ সম্পাদক, বাংলাদেশ প্রগতিশীল কলামিস্ট ফোরাম, নির্বাহী কমিটির সদস্য, সম্প্রীতি বাংলাদেশ এবং অধ্যাপক, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়।

আরও পড়ুন:
স্মৃতি ২৫ মার্চ ’৭১ বিশ্বাসঘাতকতার একরাত
পাকিস্তানি গণহত্যা ও বৈশ্বিক প্রেক্ষাপট
একাত্তরে পাকিস্তানের গণহত্যা মহাকলঙ্কজনক অধ্যায়
ইতিহাসের কৃষ্ণ অধ্যায়
প্রকাশিত হোক পাকিস্তানি গণহত্যার বিবরণ

মন্তব্য

আরও পড়ুন

বিশ্লেষণ
The Dogs of Khalishapur and Rakibs thesis is a fresh idea

‘খলিশাপুরের কুকুরগুলো ও রকিবের থিসিস’ একটি নতুন ভাবনা

‘খলিশাপুরের কুকুরগুলো ও রকিবের থিসিস’ একটি নতুন ভাবনা
লেখক চমৎকার বইটিতে নানা অণুগল্পের মধ্য দিয়ে ওই সব ভয়ঙ্কর কুকুর-মানবদের চরিত্র পাঠকদের সামনে উপস্থাপন করেছেন।

সাংবাদিক মুস্তফা মনওয়ার সুজনের ‘খলিশাপুরের কুকুরগুলো ও রকিবের থিসিস’ উপন্যাস নিয়ে কিছু কথা পাঠকদের সামনে তুলে ধরার খুব ইচ্ছা থেকেই লিখতে বসা। লেখকের সঙ্গে যোগাযোগে সুবাদে বইটি লেখার শুরুর আগেই আলোচনা এবং পরে পান্ডুলিপি থেকেই পড়ার সুযোগ হয়েছে। এতে আমাদের প্রত্যেকের জীবনের চিরন্তন সত্য কিছু ঘটনা উপস্থাপন করেছেন লেখক।

বইটি না পড়লে বা না ধরলে আসলে চমৎকার কিছু বিষয় জানা থেকে পাঠকরা বঞ্চিত হবেন। আমি মনে করি, বইটি সবারই পড়া উচিত।

আমরা যদি বইমেলা থেকে সবসময় শুধু বিখ্যাত লেখকদের বই কিনি আর পড়ি, তাহলে এতসব অসাধারণ লেখাগুলো অজানাই থেকে যাবে। নতুন লেখক বা আরেকজন হুমায়ুন আজাদ কিংবা হুমায়ূন আহমেদ অথবা তার চেয়ে বেশি কেউ সৃষ্টি হবে না।

তবে নিশ্চয়ই বলছি না, বিখ্যাত লেখকদের বই কেউ পড়বেন না। অবশ্যই কিনবেন এবং পড়বেন। পাশাপাশি নতুন লেখকদের ভালো ভালো বইগুলোও স্পর্শ করতে হবে, দেখতে হবে ভেতরে কী আছে। তবেই তারা লিখতে উৎসাহ পাবেন, নাহলে তো আর লেখক সৃষ্টি হবে না।

সাংবাদিক মুস্তফা মনওয়ার সুজনের খলিশাপুরের কুকুরগুলো ও রকিবের থিসিস বইটি পড়ে মনে হয়েছে, এটি পড়ে পাঠক মজা পাবেন এবং ভাববেন।

বইটিতে লেখক যা বলতে চেয়েছেন তা অনেকটা এরকম- আমরা প্রতিনিয়ত অসংখ্য মানুষ দ্বারা পরিবেষ্টিত। এরমধ্যে কিছু মানুষ থাকে মুখোশ পরা, মুখোশটা মুখের সেঙ্গ খুব কৌশলে নিখুঁতভাবে মেশানো, সহজে দেখা যায় না। চারপাশটা ঘিরে তাদের বিচরণ। আমরা খুব বেশি খেয়াল না করলে বুঝতে পারি না, এদের ভেতর হিংস্র এক কুকুরের বাস। তারা প্রতি মুহূর্তে বন্ধুবেশে মানুষের চরম ক্ষতি করার জন্য উন্মুখ হয়ে থাকে; অনেকটা অজগর সাপের মতো।

এ প্রসঙ্গে আমার বন্ধু শারমিন মিলির একটি গল্প বলি। গল্পটি এরকম- এক লোক একটি অজগর সাপ পোষেন। তো এক পর্যায়ে দেখা গেল, অজগরটি খাওয়া-দাওয়া বন্ধ করে দিয়েছে। এতে সাপের মালিক বেশ চিন্তিত হয়ে পড়লেন এবং চিকিৎসকের শরণাপন্ন হলেন। তিনি চিকিৎসককে জানালেন, সাপটি এরকম ছিল না, তাকে খুবই ভালোবাসত, সবসময় তাকে জড়িয়ে ধরে থাকত, কিন্তু এখন যেন কেমন হয়ে গেছে! তখন চিকিৎসক হেসে বলেন, সাপটি আসলে তাকে কখনোই ভালোবাসেনি। সারাক্ষণ যে জড়িয়ে থাকত, সেটি আসলে প্রতি মুহূর্তে সে দেখত- তিনি সাপটির খাওয়ার উপযোগী হয়েছেন কি না। বইটি অজগরের গল্প বার বার মনে করিয়ে দিয়েছে।

লেখক চমৎকার বইটিতে নানা অণুগল্পের মধ্য দিয়ে ওই সব ভয়ঙ্কর কুকুর-মানবদের চরিত্র পাঠকদের সামনে উপস্থাপন করেছেন। উপন্যাসটিতে রকিব, অংকন, কেয়া, ফাহমিদাসহ বেশ কিছু চরিত্র দাঁড়িয়েছে, সেসব বাংলা উপন্যাসে নতুন মাত্র। উপন্যাসটি পড়ে বারবার মনে হয়েছে- চরিত্র সৃষ্টির নয়া কারিগরের আবির্ভাব হলো।

আমি হলফ করে বলতে পারি, ‘খলিশাপুরের কুকুরগুলো ও রকিবের থিসিস’ পড়লে পাঠকের অবশ্যই অনেক ভালো লাগবে। বইটির শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত এক রকম আকর্ষণ বা মাদকতা আছে। অসাধারণ এক কাহিনী। আমি পাঠক হিসেবে, আহ্বান জানাই- পাঠকরা যেনো বইমেলায় গিয়ে মনোবৈজ্ঞানিক উপন্যাসটি সংগ্রহ করেন এবং সময় নিয়ে বইটি পড়েন।

‘খলিশাপুরের কুকুরগুলো ও রকিবের থিসিস’-এর প্রকাশক বেহুলা বাংলা। অমর একুশে বইমেলায় সোহরাওয়ার্দী উদ্যানের ২২৪ নম্বর স্টলে গেলেই মিলবে, এছাড়া রকমারি তো আছেই।

লেখক: সাংবাদিক

আরও পড়ুন:
ফটোগ্রাফি নিয়ে ভিন্নধর্মী বই ‘বিখ্যাত ছবির পেছনের গল্প’
বইমেলায় মীরাক্কেল খ্যাত রাশেদের ‘ফিলিং চিলিং’

মন্তব্য

বিশ্লেষণ
One of the ethos of Ekush is to protest injustice and end domination over the weak

একুশের অন্যতম চেতনা অন্যায়ের প্রতিবাদ ও দুর্বলের ওপর আধিপত্যের অবসান

একুশের অন্যতম চেতনা অন্যায়ের প্রতিবাদ ও দুর্বলের ওপর আধিপত্যের অবসান মো. শহীদ উল্লা খন্দকার
২১ শে ফেব্রুয়ারি রক্ত স্নাত ভাষা আন্দোলনের স্মৃতিবহ মহান শহীদ দিবস। একই সঙ্গে দিনটি আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস হিসেবেও পালিত হবে বিশ্বজুড়ে। আমাদের জাতীয় জীবনের অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ একটি দিন এটি।

প্রায় দুই হাজার কিলোমিটার দূরত্বে অবস্থিত দুটি ভূখণ্ডের দুটি ভিন্ন ভাষার জাতিসত্তাকে মিলিয়ে পাকিস্তান রাষ্ট্রের জন্ম থেকেই মাতৃভাষাকে কেন্দ্র করে সূচনা হয়েছিল আন্দোলনের। আর এই ভাষা আন্দোলনকেই বাংলাদেশ রাষ্ট্র সৃষ্টির পথে প্রথম পদক্ষেপ হিসেবে বিবেচনাযোগ্য । ১৯৪৭ সালে যখন দ্বিজাতি তত্ত্বের ভিত্তিতে ভারত ভাগ হয়েছিল তার আগ থেকেই আসলে শুরু হয়েছিল ভাষা নিয়ে বিতর্ক।পাকিস্তান রাষ্ট্র গঠন নিশ্চিত হওয়ার পর উর্দু-বাংলা বিতর্ক আবার মাথাচাড়া দিয়ে ওঠে।

২১ শে ফেব্রুয়ারি রক্ত স্নাত ভাষা আন্দোলনের স্মৃতিবহ মহান শহীদ দিবস। একই সঙ্গে দিনটি আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস হিসেবেও পালিত হবে বিশ্বজুড়ে। আমাদের জাতীয় জীবনের অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ একটি দিন এটি।

মহান আন্তজার্তিক মাতৃ ভাষা ২১ ফেব্রুয়ারীতে যারা বুকের তাজা রক্ত দিয়ে বাংলাকে মায়ের ভাষা ও রাষ্ট্রভাষা হিসেবে প্রতিষ্ঠা করে গেছেন তাদের প্রতি বিনম্র শ্রদ্ধা ও সশ্রদ্ধ সালাম জানাই।

১৯৪৭ সালে দেশবিভাগের পর থেকেই পাকিস্তানের পশ্চিমাঞ্চলের শাসকগোষ্ঠী পূর্বাঞ্চলের সংখ্যাগরিষ্ঠ বাঙালিকে তাদের অধীন করে রাখার পরিকল্পনা করেছিল। আজ আমরা গর্বিত স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশের বাসিন্দা।

১৯৫২ সালের এই দিনে মাতৃভাষা বাংলার মর্যাদা রাখতে গিয়ে বুকের রক্ত ঢেলে দিয়েছিল রফিক, সালাম, বরকত, সফিউর, জব্বাররা। তাদের রক্তে শৃঙ্খলমুক্ত হয়েছিল দুঃখিনী বর্ণমালা, মায়ের ভাষা। বাঙালি জাতিসত্তা বিকাশের যে সংগ্রামের সূচনা সেদিন ঘটেছিল, জাতির পিতা শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বে মুক্তিযুদ্ধের গৌরবময় পথ বেয়ে স্বাধীন বাংলাদেশের অভ্যুদয়ের মধ্য দিয়ে তা চূড়ান্ত পরিণতি লাভ করে। একুশে ফেব্রুয়ারি তাই বাঙালির কাছে চির প্রেরণার প্রতীকে পরিণত হয়েছে। এই হত্যাকাণ্ড মাতৃভাষার অধিকারের দাবিতে গড়ে ওঠা আন্দোলনকে দমিয়ে দেয়নি।

বায়ান্নর একুশে ফেব্রুয়ারি বাঙালির স্বাধিকার আন্দোলনে যোগ করে নতুন মাত্রা। শহীদদের রক্ত তাদের প্রতিজ্ঞাবদ্ধ হতে প্রেরণা জোগায়। এর পরের ইতিহাস পর্যায়ক্রমিক আন্দোলনের।

স্বাধীনতাসংগ্রাম, সশস্ত্র মুক্তিযুদ্ধসহ ইতিহাসের প্রতিটি গুরুত্বপূর্ণ পর্যায়ে আমাদের পথ দেখিয়েছে একুশে ফেব্রুয়ারি। তেমনি একুশ আজও পৃথিবীর বিভিন্ন জাতির ভাষার অধিকার অর্জনেরও পথিকৃৎ হয়ে আছে।

স্বাধীন বাংলাদেশের সংবিধানে বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়া হয়। বাংলা ভাষায় সংবিধান প্রণীত করেন বঙ্গবন্ধু। এটিই একমাত্র দলিল যা বাংলা ভাষায় প্রণীত হয়েছে। স্বাধীন বাংলাদেশের রাষ্ট্রপতি হিসেবে ১৯৭৪ সালের ২৫ সেপ্টেম্বর জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান, জাতিসংঘের সাধারণ অধিবেশনে প্রথম বাংলায় বক্তব্য দিয়ে বিশ্বসভায় বাংলাকে তুলে ধরেন। ’৫৪-র নির্বাচনে যুক্তফ্রন্টের বিজয়, আইয়ুব খানের সামরিক শাসনবিরোধী আন্দোলন, ’৬২-র শিক্ষা আন্দোলন, ’৬৬-র স্বাধিকার প্রতিষ্ঠার লড়াই, ’৬৯-র গণঅভ্যুত্থান, ’৭০-এর জাতীয় নির্বাচনে আওয়ামী লীগের জয়লাভ এবং ’৭১-এর মুক্তিযুদ্ধের মধ্য দিয়ে শেষ পর্যন্ত প্রতিষ্ঠা লাভ করে বাঙালির স্বাধীন-সার্বভৌম রাষ্ট্র বাংলাদেশ।

আর বাঙালি মুক্ত হয় ঔপনিবেশিক শাসন-শোষণ থেকে। বাঙালির স্বাধীনতা সংগ্রামের ইতিহাসের প্রতিটি পর্যায়ে ’৫২-র ভাষা আন্দোলন অনুপ্রেরণা হিসেবে কাজ করেছে। তাই একুশ আমাদের জাতীয় জীবনে এক অন্তহীন প্রেরণার উৎস।

ভাষা আন্দোলনের মধ্য দিয়ে বাঙালি জাতীয়তাবাদ প্রতিষ্ঠিত হয়। একুশের অন্যতম চেতনা ছিল রাষ্ট্রীয় জীবনে অসাম্য বৈষম্য, দুর্বলের ওপর সবলের আধিপত্য ইত্যাদির অবসান। বাঙালির ঐতিহ্য, কৃষ্টি, আবহমানকালের সংস্কৃতি ইত্যাদি সমুন্নত রাখা।

অমর একুশের চেতনা এখন বিশ্বের বিভিন্ন ভাষার মানুষের নিজস্ব ভাষা ও সংস্কৃতি রক্ষায় অনুপ্রেরণার উৎস। তবে বাংলা ভাষা ও সংস্কৃতির সঠিক চর্চা ও সংরক্ষণে আমাদের আরও বেশি পরিশ্রমী হতে হবে। তথ্যপ্রযুক্তির আশীর্বাদে আমরা এখন একই বৈশ্বিক গ্রামের বাসিন্দা। তাই উন্নত বিশ্বের সঙ্গে অগ্রগতির ধারা বজায় রাখতে আমাদের বর্তমান প্রজন্মকে বিভিন্ন ভাষায় প্রয়োজনীয় দক্ষতা অর্জন করতে হবে, যা আন্তর্জাতিক যোগাযোগ মাধ্যম হিসেবে স্বীকৃত।

আমি বিশ্বাস করি যে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস পালন আমাদের নিজস্ব ভাষার উন্নয়ন ও সংরক্ষণের পাশাপাশি বহুভাষিক শিক্ষার মাধ্যমে একটি টেকসই ভবিষ্যৎ গড়তে ইতিবাচক ভূমিকা পালন করবে- এটাই আমাদের প্রত্যাশা।

অমর একুশের চেতনাকে ধারণ করে বিশ্বের বিভিন্ন ভাষা ও সংস্কৃতির মানুষের মধ্যে পারস্পরিক শ্রদ্ধাবোধ জাগ্রত হোক, বৈষম্যহীন বর্ণিল পৃথিবী গড়ে উঠুক- শহীদ দিবস ও আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবসে এটাও আমাদের প্রত্যাশা।

জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের পদাঙ্ক অনুসরণ করে তার কন্যা শেখ হাসিনা সরকার প্রধান হিসেবে প্রতিবারই জাতিসংঘে বাংলায় ভাষণ দিয়ে যাচ্ছেন। তার সরকার বাংলাভাষাকে জাতিসংঘের দাপ্তরিক ভাষা হিসেবে স্বীকৃতি আদায়ের প্রচেষ্টা অব্যাহত রেখেছেন। বাংলাদেশে ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীরও ভাষার চর্চার ব্যাবস্থা করেছেন। আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা ইনস্টিটিউট গড়ে তুলেছেন, যেখানে হারিয়ে যাওয়া মাতৃভাষা নিয়ে গবেষণা হচ্ছে।

অমর একুশে গ্রন্থমেলাসহ প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা, ‘আমাদের শিল্প, কলা, সাহিত্য, সংস্কৃতিকে আরো উন্নতমানের করে শুধু আমাদের দেশে না, বিশ্বদরবারে পৌঁছে দিতে চান। ‘আমাদের সাহিত্য আরো অনুবাদ হোক। বিশ্বের বিভিন্ন ভাষাভাষী মানুষ আমাদের সাহিত্যকে জানুক, আমাদের সংস্কৃতিকে জানুক, সেটাই আমরা চাই।

বাঙালি জাতীয়তাবাদ ও জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবের আদর্শ অনুসরণ করে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী বাংলাদেশকে বিশ্বের কাছে উন্নয়নের রোল মডেলে পরিণত করেছেন। প্রধানমন্ত্রী জননেত্রী শেখ হাসিনা’র অসাধারণ নেতৃত্বে বাংলাদেশ উন্নত সমৃদ্ধশালী দেশের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে। বাংলাদেশের জন্য ধারাবাহিক অগ্রগতি আর সম্মানের পথটি দিন দিন প্রশস্ত করে চলেছেন বঙ্গবন্ধু কন্যা শেখ হাসিনা। তিনি দায়িত্ব পাওয়ার পর থেকে তিনি নিষ্ঠার সঙ্গে দেশ ও মানুষের উন্নয়নের কাজে নিজেকে পুরোপুরি সঁপে দিয়েছেন। বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার রাজনৈতিক কর্মজীবন প্রায় চার দশকের। তারই নেতৃত্বে বাংলাদেশে চলমান উন্নয়নের ধারাকে অব্যাহত রাখতে হবে। তাহলে প্রকৃত অর্থে বঙ্গবন্ধু’র স্বপ্নের সোনার বাংলা প্রতিষ্ঠা হবে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সুযোগ্য নেতৃত্বে বাংলাদেশ চতুর্থ শিল্প বিপ্লবে নেতৃত্ব দিবে। ২০৪১ সালের মধ্যে উন্নত সমৃদ্ধ দেশ তথা জাতির জনকের স্বপ্নের সোনার বাংলা স্মার্ট বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠিত হবেই।

সব মাতৃ ও আঞ্চলিক ভাষাকেই সমান মর্যাদা দিয়ে সংরক্ষণের দায়িত্ব রয়েছে বিশ্ববাসীর। একুশের শহীদদের প্রতি জানাই গভীর শ্রদ্ধা। শহীদ স্মৃতি অমর হোক।

লেখক: সাবেক সচিব ও প্রধানমন্ত্রীর নির্বাচনি এলাকার মনোনীত প্রতিনিধি।

মন্তব্য

বিশ্লেষণ
Awami Leagues manifesto has a special commitment to protect the interests of minorities

আওয়ামী লীগের ইশতেহারে সংখ্যালঘুর স্বার্থ রক্ষায় বিশেষ অঙ্গীকার

আওয়ামী লীগের ইশতেহারে সংখ্যালঘুর স্বার্থ রক্ষায় বিশেষ অঙ্গীকার
আওয়ামী লীগের নির্বাচনি ইশতেহারে নিম্ন আয়ের প্রান্তিক-সুবিধাবঞ্চিত মানুষের কথাই ঘুরে-ফিরে এসেছে। প্রবীণ, সমাজের পিছিয়ে পড়া মানুষ এমনকি সংখ্যালঘু জাতিসত্তার ক্ষমতায়নের প্রসঙ্গও এসেছে। বিশেষত সংখ্যালঘু জাতিসত্তার মানুষের জন্য আলাদা কমিশন গঠন করার বিষয়টি গুরুত্বপূর্ণ। দেশের পিছিয়ে পড়া জনগোষ্ঠীর ক্ষমতায়নে এই প্রতিশ্রুতি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে।

দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন সামনে রেখে আওয়ামী লীগের ইশতেহারে সংখ্যালঘুদের স্বার্থ সুরক্ষায় বিশেষ অঙ্গীকারের কথা ঘোষণা করা হয়েছে। এবারের ইশতেহারের স্লোগান- ‘স্মার্ট বাংলাদেশ: উন্নয়ন দৃশ্যমান বাড়বে এবার কর্মসংস্থান’।

ইশতেহারে স্মার্ট বাংলাদেশ গড়ার অঙ্গীকার করে ১১টি বিষয়কে অগ্রাধিকার দিয়েছে আওয়ামী লীগ। কর্মসংস্থান সৃষ্টি, দ্রব্যমূল্য ক্রয়ক্ষমতার মধ্যে রাখা, আয়ের মধ্যে সঙ্গতি প্রতিষ্ঠা, দেশের রূপান্তর ও উন্নয়নে তরুণ এবং যুব সমাজকে সম্পৃক্ত রাখা, পুঁজি পাচারকারীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণ, ঘুষ-দুর্নীতি উচ্ছেদ, ঋণ-কর-বিলখেলাপি ও দুর্নীতিবাজদের বিচারের আওতায় এনে তাদের অবৈধ সম্পদ বাজেয়াপ্ত করার প্রতিশ্রতি দিয়েছে দলটি। এছাড়া গুরুত্ব পেয়েছে কৃষি, সেবা, অর্থনৈতিক ও শিল্প উৎপাদন খাত এবং তৃতীয় লিঙ্গের মানুষদের মৌলিক অধিকার নিশ্চিত করা।

আওয়ামী লীগের ২০০৮ সালের নির্বাচনি ইশতেহারের শিরোনাম ছিলো ‘দিন বদলের সনদ’, ২০১৪ সালের ‘এগিয়ে যাচ্ছে বাংলাদেশ’, ২০১৮ সালের ‘সমৃদ্ধি ও অগ্রযাত্রায় বাংলাদেশ’। এটিতে ২১টি বিশেষ অঙ্গীকার ছিলো।

আওয়ামী লীগ সভাপতি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ২৭ ডিসেম্বর ইশতেহার ঘোষণা করেন। নির্বাচনি ইশতেহারের সারাংশ তুলে ধরেন তিনি।

ইশতেহারে ডিজিটাল থেকে স্মার্ট বাংলাদেশে উত্তরণ প্রসঙ্গে তিনি বলেন, চতুর্থ শিল্প বিপ্লবের যুগে বিশ্ব প্রতিযোগিতায় টিকে থাকার জন্য প্রযুক্তি সক্ষমতা একান্ত প্রয়োজন। এজন্য ‘স্মার্ট নাগরিক’, ‘স্মার্ট সরকার’, ‘স্মার্ট অর্থনীতি’ ও ‘স্মার্ট সমাজ’- এই চারটি স্তম্ভের সমন্বয়ে ‘স্মার্ট বাংলাদেশ’ গড়ার ঘোষণা দেয়া হয়। স্মার্ট বাংলাদেশ বাস্তবায়নে প্রতিটি ক্ষেত্রে কাজের কথা উল্লেখ করা হয়।

জনগণের ভোটে নির্বাচিত হলে ২০৪১ সালের মধ্যে বাংলাদেশকে ক্ষুধা-দারিদ্র্যমুক্ত স্মার্ট সোনার বাংলা হিসেবে গড়ে তোলার অঙ্গীকার করা হয়েছে।

ইশতেহারে আওয়ামী লীগ যে ১১টি বিষয়কে বিশেষ অগ্রাধিকার দিয়েছে তা হলো- দ্রব্যমূল্য সবার ক্রয়ক্ষমতার মধ্যে রাখার জন্য সর্বাত্মক প্রচেষ্টা চালিয়ে যাওয়া; কর্মোপযোগী শিক্ষা ও যুবকদের কর্মসংস্থান নিশ্চিত করা; আধুনিক প্রযুক্তিনির্ভর স্মার্ট বাংলাদেশ গড়ে তোলা; লাভজনক কৃষির লক্ষ্যে সমন্বিত কৃষিব্যবস্থা, যান্ত্রিকীকরণ ও প্রক্রিয়াজাতকরণে বিনিয়োগ বৃদ্ধি; দৃশ্যমান অবকাঠামোর সুবিধা নিয়ে এবং বিনিয়োগ বৃদ্ধি করে শিল্পের প্রসার ঘটানো; ব্যাংকসহ আর্থিক খাতে দক্ষতা ও সক্ষমতা বৃদ্ধি করা; নিম্ন আয়ের মানুষদের স্বাস্থ্যসেবা সুলভ করা; সর্বজনীন পেনশন ব্যবস্থায় সবাইকে যুক্ত করা; আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর কার্যকারিতা ও জবাবদিহি নিশ্চিত করা; সাম্প্রদায়িকতা এবং সব ধরনের সন্ত্রাস ও জঙ্গিবাদ রোধ করা, সর্বস্তরে গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা সুরক্ষা ও চর্চার প্রসার ঘটানো।

‘স্মার্ট বাংলাদেশ’ গড়ার প্রত্যয় নিয়ে টানা তিনবার ক্ষমতায় থাকা দল আওয়ামী লীগ তার নির্বাচনী ইশতেহারে ক্ষুদ্র জাতিসত্তা, নৃ-গোষ্ঠী ও ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের নিয়ে কী পরিবল্পনা আছে তা তুলে ধরেছে ইশতেহারে। নতুন করে সরকার গঠন করতে পারলে আওয়ামী লীগ কী কী পদক্ষেপ গ্রহণ করবে তা স্পষ্ট করে জানিয়েছে ইশতেহারে।

বর্তমানে বাংলাদেশে পাহাড় ও সমতল মিলে প্রায় ৪৫টি ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীর ৩০ লাখের বেশি মানুষ বসবাস করছে। বাংলাদেশের সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িত রয়েছে তাদের জীবন, ঐতিহ্য, সংস্কৃতি, ইতিহাস ও আশা-আকাঙ্ক্ষা।

জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বাংলাদেশের সংবিধানে ক্ষুদ্র জাতিসত্তা, নৃ-গোষ্ঠী, ধর্মীয় সংখ্যালঘুসহ সব সম্প্রদায়ের মানুষের সম-অধিকার ও মর্যাদার স্বীকৃতি দিয়েছিলেন। সেই আলোকে আওয়ামী লীগ ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠী ও ধর্মীয় সংখ্যালঘু জনগোষ্ঠীর প্রতি বৈষম্যমূলক আচরণের অবসান ঘটানো; তাদের জীবন, সম্পদ, উপাসনালয় ও স্বাতন্ত্র্য রক্ষায় এবং জীবনমানের উন্নয়নে অগ্রাধিকার ভিত্তিতে বিভিন্ন কার্যক্রম অব্যাহত রেখেছে। সাম্প্রদায়িকতা যেন মাথাচাড়া দিয়ে উঠতে না পারে। ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্র বাংলাদেশ। প্রত্যেকে নিজ নিজ ধর্ম পালন করবে স্বাধীনভাবে। তাতে কেউ বাধা প্রদান করতে পারবে না।

বাংলাদেশ সারা বিশ্বের কাছে সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির এক উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত। এই বাংলাদেশে ঈদুল ফিতর, ঈদুল আজহা, ঈদে মিলাদুন্নবী, জন্মাষ্টমী, শারদীয় দুর্গোৎসব, বুদ্ধপূর্ণিমা, বড়দিন ইত্যাদি ধর্মীয় অনুষ্ঠান কোনো বিশেষ ধর্মের গণ্ডিতে সীমাবদ্ধ থাকে না। জাতি-ধর্ম-বর্ণ-গোষ্ঠী নির্বিশেষে সর্বস্তরের মানুষের অংশগ্রহণ ও উপস্থিতিতে সম্প্রীতি ও সৌহার্দ্যপূর্ণ পরিবেশে এসব উদযাপিত হয়।

জাতীয় চেতনায় ও শান্তির প্রেরণায় উদ্বুদ্ধ হয়ে সৌহার্দ্যপূর্ণ সম্পর্ক বজায় রেখে প্রধানমন্ত্রীর আহ্বানে ‘ধর্ম যার যার উৎসব সবার’ স্লোগান সামনে রেখে সব ধর্ম-বর্ণ-গোষ্ঠীর মানুষ সাড়ম্বরে পালন করে প্রতিটি ধর্মীয় উৎসব। এ বছর ৩২ হাজার পূজামণ্ডপে অত্যন্ত শান্তিপূর্ণ পরিবেশে পূজা উদযাপিত হয়েছে। প্রধানমন্ত্রী বলেছেন আমাদের দেশের সব ধর্মের মানুষ একসঙ্গে মুক্তিযুদ্ধ করে দেশ স্বাধীন করেছেন, তাই সকলে সমান অধিকার নিয়ে এদেশে বাস করবেন।

ধর্মীয় ও জাতিগত সংখ্যালঘুদের জমি, বসতভিটা, উপাসনালয়, বনাঞ্চল, জলাভূমি ও অন্যান্য সম্পদের সুরক্ষার ব্যবস্থা করা হয়েছে। ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীর জমি ও বন এলাকায় অধিকার সংরক্ষণের জন্য ভূমি কমিশনের কার্যক্রম অব্যাহত আছে এবং তা থাকবে। ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীর জনগণকে সমাজের ও উন্নয়নের মূলস্রোতে আনার জন্য সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচিসহ বিভিন্ন কার্যক্রম বাস্তবায়ন হচ্ছে। অনগ্রসর ও অনুন্নত ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠী ও চা-বাগান শ্রমিকদের সন্তানদের শিক্ষা ও চাকরি ক্ষেত্রে বিশেষ কোটা এবং সুযোগ-সুবিধা অব্যাহত আছে।

ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীর মানুষের জন্য শিক্ষা ও স্বাস্থ্য পরিষেবাগুলো প্রত্যন্ত অঞ্চলে সম্প্রসারণ করা হয়েছে। রাস্তাঘাট, বিদ্যুৎসহ অন্যান্য অবকাঠামোগত সুযোগ-সুবিধা বৃদ্ধি করা হয়েছে। ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠী সম্প্রদায়গুলোর বৈচিত্র্যময় রীতিনীতি ও ঐতিহ্যগুলোকে সংরক্ষণ এবং প্রদর্শন করার জন্য সরকারের তরফ থেকে উৎসাহিত করা হচ্ছে।

বৃহত্তর রাজনৈতিক প্রতিনিধিত্ব ও সামাজিক অন্তর্ভুক্তি নিশ্চিত করতে সরকার সিদ্ধান্ত গ্রহণ প্রক্রিয়ায় জাতিগত সংখ্যালঘুদের অংশগ্রহণ বাড়ানোর জন্য ইতিবাচক পদক্ষেপ নিয়েছে। পার্বত্য চট্টগ্রাম শান্তিচুক্তির বিভিন্ন ধারা অনুযায়ী বিভিন্ন বিষয় আঞ্চলিক পরিষদ এবং জেলা পরিষদের কাছে ন্যস্ত করা হয়েছে। ফলে স্থানীয়, ভৌগোলিক, আর্থ-সামাজিক পরিবেশ বিবেচনায় নিয়ে উন্নয়ন কর্মকাণ্ড প্রণয়ন ও বাস্তবায়ন করা হচ্ছে।

তিন পার্বত্য জেলায় পর্যটনশিল্প, খাদ্য প্রক্রিয়াজাতকরণসহ ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্প, ঐতিহ্যবাহী কুটির শিল্পের বিকাশে বিশেষ ব্যবস্থা গ্রহণ করার পরিকল্পনা নেয়া হয়েছে। উচ্চ মূল্যের মসলা চাষ, কফি-কাজু বাদাম চাষ, তুলা চাষ, সৌরবিদ্যুৎ ইত্যাদি জনমুখী পদক্ষেপ বাস্তবায়ন করা হচ্ছে। মন্দির, শ্মশান, প্যাগোডা, গির্জা, সিমেট্রির উন্নয়নে অনুদান প্রদান ও উন্নয়ন কার্যক্রম অব্যাহত আছে। হিন্দু, বৌদ্ধ ও খ্রীষ্টান ধর্মীয় কল্যাণ ট্রাস্টসমূহের মাধ্যমে সংশ্লিষ্ট ধর্মাবলম্বীদের সার্বিক কল্যাণ সাধনে নিয়মিত কার্যক্রম অব্যাহত আছে।

সংবিধানের অনুচ্ছেদ ২৩(ক) তে বলা আছে, রাষ্ট্র বিভিন্ন উপজাতি, ক্ষুদ্র জাতিসত্তা, নৃ-গোষ্ঠী ও সম্প্রদায়ের অনন্য বৈশিষ্ট্যপূর্ণ আঞ্চলিক সংস্কৃতি এবং ঐতিহ্য সংরক্ষণ, উন্নয়ন ও বিকাশের ব্যবস্থা গ্রহণ করবে। সংবিধানের এই ধারা সুরক্ষায় উদ্যোগ অব্যাহত থাকবে।

আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে জাতীয় সংসদে অর্পিত সম্পত্তি আইন সংশোধন করা হয়েছে এবং অর্পিত সম্পত্তি সংশ্লিষ্ট সমস্যা নিষ্পত্তির ব্যবস্থা নেয়া হয়েছে। আইন প্রয়োগে বাধা দূর করা হবে।

সংখ্যালঘুদের স্বার্থ সুরক্ষার জন্য জাতীয় সংখ্যালঘু কমিশন গঠন এবং সংখ্যালঘু বিশেষ সুরক্ষা আইন প্রণয়ন করা হবে। আওয়ামী লীগ ধর্মীয় সংখ্যালঘু, ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠী ও অনগ্রসর সম্প্রদায়ের জীবন ও জীবিকার নিরাপত্তা নিশ্চিত করার লক্ষ্যে আবশ্যক পদক্ষেপ নেয়া অব্যাহত রাখবে।

বিএনপি-জামায়াত জোট সরকারের ‘এথনিক ক্লিনজিং’ অপনীতির কবলে পড়ে দেশের ধর্মীয় সংখ্যালঘু সম্প্রদায় এবং ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠী হিংস্র আক্রমণ ও বৈষম্যের শিকার হয়। ধর্মীয় সংখ্যালঘু ও ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীর অসংখ্য নর-নারী নিহত হয়েছে; অসংখ্য নারী হয়েছে ধর্ষণের শিকার; তাদের ঘরবাড়ি, জমি, ব্যবসা প্রতিষ্ঠান দখল ও লুণ্ঠিত হয়েছে। আওয়ামী লীগ এ অমানবিক ঘটনাগুলোর বিচারকার্য সম্পন্ন করবে এবং তার পুনরাবৃত্তি হতে দেবে না।

বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ ধর্মীয় সংখ্যালঘু, ক্ষুদ্র জাতিসত্তা ও চা-বাগানে কর্মরত শ্রমজীবী জনগোষ্ঠীর ওপর সন্ত্রাস, বৈষম্যমূলক আচরণ এবং মানবাধিকার লঙ্ঘনের চির অবসান, তাদের জীবন, সম্পদ, সম্ভ্রম, মান-মর্যাদার সুরক্ষা এবং রাষ্ট্র ও সমাজ জীবনের সর্বক্ষেত্রে সমান অধিকার নিশ্চিত করার নীতি অব্যাহত রাখবে। বস্তি, চর, হাওর, বাওড়, উপকূলসহ দেশের সব অনগ্রসর অঞ্চলের সুষম উন্নয়ন এবং ওইসব অঞ্চলের জনগণের জীবনের মানোন্নয়ন অগ্রাধিকার পাবে।

বাংলাদেশের সুবিধাবঞ্চিত মোট জনসংখ্যার একটি অংশ দলিত, হরিজন ও বেদে সম্প্রদায়। সমাজে চরমভাবে অবহেলিত, বিচ্ছিন্ন, উপেক্ষিত এ জনগোষ্ঠী। তাদের জীবনমান উন্নয়ন এবং তাদের মূল স্রোতে নিয়ে আসার কর্মসূচি বাস্তবায়নে আওয়ামী লীগ অঙ্গীকারবদ্ধ।

দলিত, হরিজন সম্প্রদায়ের জন্য ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোররেশনে ফ্ল্যাট নির্মাণ করে দেয়া হয়েছে। মুন্ডা, ট্রান্সজেন্ডার, কুষ্ট রোগীদের অর্থ সহায়তা দেয়া হচ্ছে। ২ কাঠা জমিতে তাদেরকে ঘর করে দেয়া হয়েছে।

২০১২-২০১৩ অর্থবছরে পাইলট কর্মসূচির মাধ্যমে ৭টি জেলায় বেদে ও অনগ্রসর জনগোষ্ঠীর জীবনমান উন্নয়ন কার্যক্রম শুরু হয়। ২০১৫-১৬ অর্থবছরে এই কর্মসূচি সম্প্রসারণ করে মোট ৬৪ জেলায় এই কার্যক্রম চালু রাখা হয়েছে। ২০১৯-২০ অর্থবছরে বেদে জনগোষ্ঠীর জীবনমান উন্নয়ন কর্মসূচি ও অনগ্রসর জনগোষ্ঠীর জীবনমান উন্নয়ন কর্মসূচি স্বতন্ত্র দুটি কর্মসূচিতে বিভক্ত করা হয়। দুটো কর্মসূচিই সম্প্রসারিত করা হয়েছে।

অনগ্রসর জনগোষ্ঠীর জীবনমান উন্নয়ন কার্যক্রমে উপকারভোগীর সংখ্যা ৮২ হাজার ৫০৩ জনে উন্নীত হয়েছে। বিশেষ ভাতাভোগীর সংখ্যা ৫৪ হাজার ৩০০ জনে উন্নীত হয়েছে। শিক্ষার্থীদের জন্য উপবৃত্তি দেয়া হয়েছে। বেদে ও সমাজের পিছিয়ে পড়া জনগোষ্ঠীর জীবনমান উন্নয়নে সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচি অব্যাহত রাখা হবে। বৃত্তিমূলক প্রশিক্ষণের মাধ্যমে বেদে ও সমাজের পিছিয়ে পড়া জনগোষ্ঠীর দক্ষতা বৃদ্ধি করা হবে, যাতে তারা আয়বর্ধনমূলক কর্মকাণ্ডে সম্পৃক্ত হয়ে সমাজের মূল স্রোতোধারায় আসতে পারে। সমাজের পিছিয়ে পড়া জনগোষ্ঠীর জন্য নগদ অর্থ সাহায্য ও বাসস্থান প্রদান কর্মসূচি সারা দেশে সম্প্রসারিত করা হবে।

ট্রান্সজেন্ডার সম্প্রদায় বাংলাদেশের মোট জনসংখ্যার একটি ক্ষুদ্র অংশ। আবহমানকাল থেকেই এ জনগোষ্ঠী সমাজ ও রাষ্ট্রজীবন থেকে বিচ্ছিন্ন ও উপেক্ষিত, মানবেতর জীবনযাপন করছে। আওয়ামী লীগ সরকার এই সম্প্রদায়ের মৌলিক অধিকার সংরক্ষণ ও সামাজিক ন্যায়বিচার নিশ্চিত করে তাদেরকে সমাজের মূল স্রোতধারায় সম্পৃক্ত করার লক্ষ্যে নানা কল্যাণমুখী কর্মসূচি গ্রহণ করেছে।

সামাজিক নিরাপত্তা কার্যক্রমের আওতায় ২০১২-১৩ অর্থবছরে ট্রান্সজেন্ডার জনগোষ্ঠীর জীবনমান উন্নয়ন কর্মসূচি বাস্তবায়ন শুরু হয়। ট্রান্সজেন্ডার জনগোষ্ঠীর ভাতাভোগীর সংখ্যা ২০০৬ সালে ১ হাজার ১২ জন ছিল, যা ২০২২-২৩ সালে ৬ গুণ বৃদ্ধি পেয়ে ৬ হাজার ৮৮৪ জন হয়েছে। বিশেষ ভাতা পান ৫ হাজার ৬২০ জন। ২০১৪ সালে ট্রান্সজেন্ডার জনগোষ্ঠীকে ‘তৃতীয় লিঙ্গ’ হিসেবে স্বীকৃতি দেয়া হয়েছে। ২০১৯ সালে এই সম্প্রদায়ের লোকজন স্বতন্ত্র লৈঙ্গিক পরিচয়ে ভোটাধিকার লাভ করে।

আওয়ামী লীগ নির্বাচনি ইশতেহারে সমান অধিকার ও মর্যাদার বিষয়গুলোকে তুলে ধরেছে। সবার বিশ্বাস নতুন সরকার গঠনের পর সংখ্যালঘুদের স্বার্থরক্ষায় যেসব অঙ্গীকার করা হয়েছে সেগুলো বাস্তবায়ন করা হলে তা সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের সামগ্রিক স্বার্থ রক্ষায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করবে।

নিম্নবিত্ত ও নিম্ন আয়ের মানুষদের জন্য নিত্যপণ্যের দাম বৃদ্ধি গুরুতর সমস্যা। তাদের সামাজিক নিরাপত্তা নিশ্চিতকল্পে নানা সময়োপযোগী পদক্ষেপ নেয়ার বিষয়েও আভাস দেয়া হয়েছে আওয়ামী লীগের ইশতেহারে।

মধ্যবিত্ত, নিম্নবিত্ত ও স্বল্প আয়ের মানুষদের সামাজিক সুরক্ষা নিশ্চিত করার বিষয়ে অনেক কথা বলা হয়েছে। নিত্যপণ্যের দাম ক্রমেই বাড়ছে। অভ্যন্তরীণ বাজারে স্থিতিশীলতা ফিরিয়ে আনতে শুধু দ্রব্যমূল্য নিয়ন্ত্রণই যথেষ্ট নয়।

আওয়ামী লীগের নির্বাচনি ইশতেহারে নিম্ন আয়ের প্রান্তিক, সুবিধাবঞ্চিত মানুষের কথাই বার বার ঘুরেফিরে এসেছে। সুবিধাবঞ্চিত মানুষের অধিকার, সুযোগ-সুবিধার কথা উঠে এসেছে। প্রবীণ, সমাজের পিছিয়ে পড়া মানুষ এমনকি সংখ্যালঘু জাতিসত্তার ক্ষমতায়নের প্রসঙ্গও এসেছে। বিশেষত সংখ্যালঘু জাতিসত্তার মানুষের জন্য আলাদা কমিশন গঠন করার বিষয়টি গুরুত্বপূর্ণ। দেশের পিছিয়ে পড়া জনগোষ্ঠীর ক্ষমতায়নে এই প্রতিশ্রুতি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে।

লেখক: প্রাবন্ধিক ও গবেষক

মন্তব্য

বিশ্লেষণ
How many lives were sacrificed?
বঙ্গবন্ধুর ‘বড়ভাই’ শহীদ ডা. জিকরুল হক স্মরণে

কত প্রাণ হলো বলিদান

কত প্রাণ হলো বলিদান সত্তরের নির্বাচনের আগে সৈয়দপুরে এক জনসভায় বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের পাশে শহীদ ডা. জিকরুল হক। তার পেছনে দাঁড়ানো তাজউদ্দীন আহমদ। ছবি: সংগৃহীত
অনেক ত্যাগ-তিতিক্ষা ও এক সাগর রক্তের বিনিময়ে অর্জিত হয় বাঙালি জাতির মহান স্বাধীনতা। জাতি আজ গভীর শ্রদ্ধাভরে স্মরণ করছে মুক্তিযুদ্ধে আত্মোৎসর্গকারী সেই সব বীর শহীদের। স্বাধীনতার ওই লাল সূর্য ছিনিয়ে আনার পেছনে রয়েছে সন্তান হারানো লাখো মায়ের আর্তনাদ, পিতা হারানো সন্তানের চিৎকার, সম্ভ্রম হারানো নারীর আহাজারি, অগণিত মানুষের স্বজন হারানোর বেদনা। যাদের ঋণ স্বাধীন বাংলাদেশ কোনো দিন শোধ করতে পারবে না।

‘পৃথিবীর এক প্রান্ত থেকে অন্য প্রান্তে জলন্ত/ঘোষণার ধ্বনি-প্রতিধ্বনি তুলে/ নতুন নিশান উড়িয়ে, দামামা বাজিয়ে দিগ্বিদিক/ এই বাংলায়/ তোমাকেই আসতে হবে, হে স্বাধীনতা’।

বাংলাদেশের যুদ্ধকালীন সময়ে লেখা কবি শামসুর রাহমানের কবিতাটি একাত্তর সালের এই দিনে সত্যি হয়ে দেখা দিয়েছিল বাঙালি জাতির জীবনে। আজ থেকে ৫২ বছর আগে ৩০ লাখ শহীদের রক্তের বিনিময়ে ১৯৭১ এর ১৬ ডিসেম্বরে এসেছিল কাঙ্ক্ষিত স্বাধীনতা। যে রেসকোর্স ময়দানে (বর্তমান সোহরাওয়ার্দী উদ্যান) জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান একাত্তরের ৭ মার্চ ‘এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম’ বলে পরোক্ষভাবে স্বাধীনতার ঘোষণা দিয়েছিলেন, সেই রেসকোর্স ময়দানেই পরাজয় মেনে মাথা নত করে ৯৩ হাজার পাকিস্তানি সৈন্য আত্মসমর্পণ করেছিল। পৃথিবীর মানচিত্রে অভ্যুদয় ঘটল স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশের।

অনেক ত্যাগ-তিতিক্ষা ও এক সাগর রক্তের বিনিময়ে অর্জিত হয় বাঙালি জাতির মহান স্বাধীনতা। জাতি আজ গভীর শ্রদ্ধাভরে স্মরণ করছে মুক্তিযুদ্ধে আত্মোৎসর্গকারী সেই সব বীর শহীদের। স্বাধীনতার ওই লাল সূর্য ছিনিয়ে আনার পেছনে রয়েছে সন্তান হারানো লাখো মায়ের আর্তনাদ, পিতা হারানো সন্তানের চিৎকার, সম্ভ্রম হারানো নারীর আহাজারি, অগণিত মানুষের স্বজন হারানোর বেদনা। যাদের ঋণ স্বাধীন বাংলাদেশ কোনো দিন শোধ করতে পারবে না।

বিজয়ের ৫২ বছর পেরিয়ে এসেছে জাতি। কিন্তু স্বাধীনতার দীর্ঘ সময় পেরিয়েও আজও অনেকের ত্যাগ ও বীরত্বগাথা অজানাই রয়ে গেছে। মুক্তিযুদ্ধে এমনই একজন ত্যাগী বীর ছিলেন শহীদ ডা. জিকরুল হক।

জিকরুল হক ১৯৭০ সালের সাধারণ নির্বাচনে পূর্ব পাকিস্তান প্রাদেশিক পরিষদে আওয়ামী লীগের প্রার্থী হিসেবে এমপিএ (মেম্বার অব প্রভিনশিয়াল অ্যাসেম্বলি) নির্বাচিত হয়েছিলেন। তার নির্বাচনী এলাকা ছিল অবাঙালি-অধ্যুষিত। তা সত্ত্বেও তিনি বিপুল ভোটে জয়ী হয়েছিলেন। মূলত জনসেবা, শিক্ষা বিস্তার ইত্যাদি কাজে জড়িত থাকার কারণে। তিনি একজন চিকিৎসক, শিক্ষানুরাগী, সমাজসেবী ও রাজনীতিবিদ হিসেবে নীলফামারী জেলার সৈয়দপুরে খ্যাতিমান ছিলেন।

জিকরুল হকের ছেলে বীর মুক্তিযোদ্ধা ও সৈয়দপুর উপজেলা আওয়ামী লীগের সহসভাপতি মো. মোনায়মুল হক দৈনিক বাংলাকে জানান, “বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বাবাকে ‘বড়ভাই’ বলে সম্বোধন করতেন। একাত্তরের ২৩ মার্চ বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের সঙ্গে বিকেল ৩/৪টার দিকে ফোনে কথা হয় তার বাবার। বঙ্গবন্ধু সৈয়দপুর শহরের রাজনৈতিক পরিস্থিতি তার কাছ থেকে জানার পর আত্মগোপনে যেতে বলেছিলেন। বাবা তা করেননি।”

২৫ মার্চ রাতেই সৈয়দপুর সেনানিবাসে অবস্থানরত পাকিস্তানি সেনাদের একটি দল জিকরুল হককে তার নতুন বাবুপাড়ার বাড়ি থেকে ধরে সেনানিবাসে নিয়ে যায়। এরপর ১২ এপ্রিল রংপুর ক্যান্টনমেন্টের নিসবেতগঞ্জে এক বধ্যভূমিতে জিকরুল হকসহ মোট ১৫০ বাঙালিকে হত্যা করা হয়। এদের মধ্যে বেশ কয়েকজন রাজনৈতিক সহচরও ছিলেন।

মোনায়মুল হক আরও জানান, মুক্তিযুদ্ধের সময় জিকরুল হকের আপন দুই ভাই জহুরুল হক ও আমিনুল হক এবং ভাইপো কুদরত-ই-এলাহীসহ আট আত্মীয় শহীদ হন। তার দুই ভাইয়ের একজনকে জুন মাসের মাঝামাঝি এবং আরেকজনকে ১৪ ডিসেম্বর অবাঙালিরা হত্যা করে। ১৯৯৬ সালে শহীদ বুদ্ধিজীবী দিবসে ডাক বিভাগে তার নামে স্মারক ডাক টিকিট প্রকাশ করা হয়। ২০০১ সালে বাংলাদেশ সরকার তাকে মরণোত্তর স্বাধীনতা পুরস্কারে ভূষিত করেন।

পাকিস্তানি শাসনামলে এক অবাঙালি ম্যাজিস্ট্রেটের সহায়তায় স্থানীয় অবাঙালিরা সৈয়দপুর উচ্চবিদ্যালয়ের সামনে খেলার মাঠে উর্দু স্কুল নির্মাণের উদ্যোগ নিয়েছিলেন। অবাঙালি অধ্যুষিত একই এলাকায় পাশাপাশি দুটি স্কুল নির্মাণ হলে সহিংসতার শঙ্কা ছিল। জিকরুল হক স্থানীয় নেতা ও বাঙালিদের সহযোগিতায় উর্দু স্কুল নির্মাণ বন্ধ করে দিয়েছিলেন।

জিকরুল হকের জন্ম ১৯১৪ সালের ১ সেপ্টেম্বর, সৈয়দপুরে। তার আদি পৈতৃক নিবাস দিনাজপুর জেলার চিরিরবন্দর উপজেলার পলাশবাড়ীতে। বাবা শেখ জিয়ারতউল্লাহ আহমদ, মা খমিউননেছা চৌধুরানী। চার ভাই ও দুই বোনের মধ্যে তিনি ছিলেন দ্বিতীয়। জিকরুল হক নয় ছেলে ও দুই মেয়ের জনক।

১৯৩৩ সালে সৈয়দপুর বাংলা উচ্চবিদ্যালয় থেকে দ্বিতীয় বিভাগে ম্যাট্রিক পাস করেন। ১৯৩৯ সালে কলকাতার ক্যাম্বেল মেডিকেল স্কুল থেকে এলএমএফ পাস করেন। মেডিকেল স্কুলে পড়ার সময় সক্রিয় রাজনীতিতে জড়িয়ে পড়েন।

কলকাতা ক্যাম্বেল মেডিকেল স্কুলে অধ্যয়নকালে তিনি এ কে ফজলুল হক এবং হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দীর সাহচর্যে আসেন এবং ভারত ভাগের পর তাদের অনুপ্রেরণায় রাজনীতিতে অংশ নেন। তিনি ১৯৩০ থেকে ১৯৪০ সাল পর্যন্ত মুসলিম ছাত্র ফেডারেশনের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। এরপর তিনি মুসলিম লীগে যোগ দেন। জিকরুল হক থানা মুসলিম লীগের সেক্রেটারি ও পরে সভাপতি এবং পরবর্তীতে জেলা আওয়ামী লীগের আমরণ সভাপতি ছিলেন। ১৯৫৪ সালে যুক্তফ্রন্টের মনোনয়ন না পেয়ে স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে নির্বাচন করে বিপুল ভোটে জয়ী হয়েছিলেন।

মন্তব্য

বিশ্লেষণ
Awami League is not responsible for dialogue

সংলাপের দায় আওয়ামী লীগের নয়

সংলাপের দায় আওয়ামী লীগের নয় খায়ের মাহমুদ। ছবি: সংগৃহীত
বিগত দুটো নির্বাচনের মতো এই নির্বাচনের আগেও যে সহিংস পরিস্থিতি বিএনপি-জামায়াত তৈরি করেছে তাতে তাদের সঙ্গে সংলাপের দায় কোনোভাবেই বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের নয়। বরং তাদের উচিত সহিংসতা পরিহার করে সরকারের সঙ্গে সংলাপের জন্য সরাসরি প্রস্তাব দেয়া, কোনো বিদেশি প্রভুর মাধ্যমে নয়।

যুক্তরাষ্ট্রের দক্ষিণ এশিয়াবিষয়ক সহকারী পররাষ্ট্রমন্ত্রী ডোনাল্ড লু দ্বাদশ সংসদ নির্বাচনের তফসিল ঘোষণার ঠিক আগে আগে দুটি দলকে চিঠি দিয়ে যে শর্তহীন সংলাপের আমন্ত্রণ জানিয়েছেন তা কোনো ভাবেই কাকতালীয় বা সাধারণ কোনো ঘটনা নয়, বরং গভীর কোনো ষড়যন্ত্রের আভাস বলেই মনে হচ্ছে ।

নির্বাচন কমিশন ওয়েবসাইট অনুযায়ী দেশে মোট নিবন্ধিত রাজনৈতিক দলের সংখ্যা ৪১, তার মধ্যে ফরমায়েশি চিঠি পেলো মাত্র দুটো দল, আওয়ামী লীগ এখনও আনুষ্ঠানিকভাবে চিঠি প্রাপ্তির কথা জানায়নি। আওয়ামী লীগ, বিএনপি এবং জাতীয় পার্টির মধ্যে যে নিঃস্বার্থ সংলাপ মোড়লরা চাচ্ছেন, তাহলে বাকি ৩৮টি নিবন্ধিত দল কী দোষ করল?

তারা দেশে প্রচলিত আইন মেনে নিবন্ধিত হয়েছে, গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় যেকোনো দল নির্বাচিত হয়ে সরকার গঠন করতে পারে, তাহলে কি যুক্তরাষ্ট্র ধরে নিচ্ছে এই ৩ দলের বাইরে দেশে আর কোনো দল নেই বা তাদের হিসেবে তারা দল নয়? শর্তহীন সংলাপ চাইলেন ভালো কথা একটিবার চিঠিতে সহিংসতা বন্ধের কথা বললেন না কোনো? নাকি সহিংসতা, আগুন সন্ত্রাস, রাষ্ট্রীয় সম্পদের ধ্বংস আপনাদের আইনের শাসনের বাইরে?

ফায়ার সার্ভিসের তথ্য অনুযায়ী, গত ২৮ অক্টোবর থেকে গত ১৭ দিনে বিএনপির হরতাল-অবরোধে সারা দেশে অগ্নিসংযোগের ১৫৪টি ঘটনা ঘটেছে। এর মধ্যে ১৩৫টি ঘটনায় পোড়ানো হয়েছে যানবাহন। আগুনে ৯৪টি বাস, ৩টি মাইক্রোবাস, ২টি প্রাইভেটকার, ৮টি মোটরসাইকেল, ১৩টি ট্রাক, ৮টি কাভার্ড ভ্যান, ১টি অ্যাম্বুলেন্স, ২টি পিকআপ, ২টি সিএনজি, ১টি নছিমন, ১টি লেগুনা, ফায়ার সার্ভিসের ১টি পানিবাহী গাড়ি, ১টি পুলিশের গাড়ি, বিএনপির ৫টি অফিস, আওয়ামী লীগের ১টি অফিস, ১টি পুলিশ বক্স, ১টি কাউন্সিলর অফিস, ২টি বিদ্যুৎ অফিস, ১টি বাস কাউন্টার এবং ২টি শোরুম পুড়ে যায়।

গত ১৭ দিনে গড়ে প্রতিদিন ৫টি করে বাস পোড়ানো হয়েছে। বিএনপি কার্যত মাঠে নেই, আন্দোলনের নামে তারা চোরাগোপ্তা হামলা চালিয়ে, গাড়িতে আগুন লাগিয়ে পালিয়ে যাচ্ছে। এই চোরাগোপ্তা হামলা এবং আগুন সন্ত্রাসের মধ্যে কী করে সংলাপ হতে পারে? আপনি যদি রাজনৈতিক সচেতন হন, একটু খেয়াল করলেই দেখবেন গত এক কয়েক মাসে বিএনপির আল্টিমেটাম আর দফার শেষ নেই। একবার ২৭ দফা, একবার ৩১ দফা, সর্বশেষ ১ দফাসহ নানা কথা বলছে দলটি।

একবার বলছে সংসদ ভেঙ্গে দিতে হবে। একবার বলছে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের কথা। একবার বলছে শেখ হাসিনার অধীনে নির্বাচন হবে না। এখন পিটার হাসের সংলাপের ওপর ভর করেছে তারা। বিএনপি আসলে কী চায়? বিএনপির সর্বশেষ ঘোষিত কমিটিতে চেয়ারপার্সনের ৭৩ জন উপদেষ্টা আছেন, আমার কৌতূহল হয় তারা আসলে কি উপদেশটা দেন ! যে দলটি একসময় রাষ্ট্র ক্ষমতায় ছিল তাদের দুর্নীতিগ্রস্ত অপরিপক্ব নেতৃত্ব দেখে একজন সচেতন নাগরিক হিসেবে আমার সত্যি কষ্ট হয়।

বিএনপির সঙ্গে সংলাপের ইতিহাস সুখের নয়, তাদের সঙ্গে যখনই সংলাপের কথা এসেছে, তখনই হয় সংলাপ বর্জন করেছে অথবা শর্ত জুড়ে দিয়ে তা বানচাল করে দিয়েছে। এরা ২০১৪-তে সংলাপে অংশ নেয়নি অন্যদিকে ২০০৭ ও ২০১৮ তে সংলাপে বসলেও শর্ত জুড়ে দিয়ে মিথ্যাচার করে সংলাপগুলোকে প্রশ্নবিদ্ধ করেছে।আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের কিন্তু ১৫ অক্টোবরেই শর্তহীন সংলাপের কথা বলেছিলেন। কিন্তু বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল তা নাকচ করে দিয়ে বলেছিলেন, শর্তহীন সংলাপে রাজি নয় বিএনপি।

স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীও বলেছেন, সংবিধানের কাঠামোর মধ্যে ‘শর্তহীন সংলাপ’ হতে পারে। তিনি বলেছেন, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সব সময় আলাপ-আলোচনা করার জন্য নির্দেশ দেন, বিএনপি তার প্রতিক্রিয়া জানায়নি। ইলেকশন কমিশন দ্বাদশ জাতীয় নির্বাচনের প্রস্তুতি শুরু করার পর ধারাবাহিক ভাবে সকল রাজনৈতিক দলের সঙ্গে আলোচনার জন্যে বসেছে, বিএনপি নির্বাচন কমিশনের ডাকে একবারও সভায় যোগদান করেনি।

তারা সেখান গেলে নির্বাচন কমিশনকে পরামর্শ দিলে, কমিশন যদি না শুনতো বা না বাস্তবায়ন করতো তারা তখন সেটা নিয়ে প্রতিবাদ বা আন্দোলন করতে পারতো কিন্তু কোনো গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ায় অংশগ্রহণ না করে শুধু দোষারোপের রাজনীতি করলে তো আপনি জনগণের সমর্থন পাবেন না । মানুষকে বোকা বানানো এখন আর সহজ না, গ্রামের চায়ের দোকানে বসে তারা মেগাবাইট গিগাবাইটের হিসেবে করে, নির্বাচনে কারচুপির জন্যে ক্যাপিটল হিলের ভাঙচুরের বিষয়ে তারা তর্ক করে।

সুতরাং আপনার আন্দোলনের বিষয়বস্তুর খবর ডিজিটাল বাংলাদেশের কল্যাণে তারা একমুহূর্তেই পাচ্ছে , আপনি জনগণের মনে স্থান করে নিতে পারছেন না, কারণ জনগণের আস্থা অর্জন করার মতো কিছু আপনি করেনি, এখনও করতে পারছেন না। আপনাদের ২০১০ সালের ডিসেম্বর মাসের আরব বসন্তের কথা মনে আছে নিশ্চই, তখন বিবিসিতে একটা প্রোগ্রাম দেখাতো ‘হাউ ফেসবুক চেঞ্জ দা ওয়ার্ল্ড’ অর্থাৎ ফেসবুক তথা সোশ্যাল মিডিয়া কীভাবে পৃথিবীকে পরিবর্তন করে দিচ্ছে, আরব বসন্তের সময়ই প্রথম ফেসবুকে গ্রুপ খুলে মানুষকে একত্রিত করার মতো বিষয় ঘটেছিল।

আর তার একযুগ পর এখন পৃথিবীতে সোশ্যাল মিডিয়াতে যোগাযোগের অসংখ্য মাধ্যম বর্তমান আর তাতে বিএনপি জামাতের কর্মীরা খুব সক্রিয়, মানুষ যদি তাদের বিশ্বাস করতো বা আন্দোলনে সমর্থন দিতো তাহলে কোনো বাধাই আর বাধা হতো না তাদের জন্যে। মানুষ আরব বসন্তের মতো রাস্তায় নেমে আসতো। আসলে মিথ্যা বা ষড়যন্ত্রের উপরে হওয়া আন্দোলন খুব বেশিদূর যেতে পারে না। নেতৃত্বহীন-ভেঙে পড়া বিএনপির এখন একমাত্র ভরসা বিদেশি প্রভুরা, জনগণ নয়। ডোনাল্ড লু আপনি সংলাপ চাইলেন একবার বিএনপির দণ্ডিত নেতৃত্বের পরিবর্তন চাইলেন না কেন? সংলাপ কার সঙ্গে করা সম্ভব?

যে দলের চেয়ারপার্সন দুর্নীতির মামলায় ১৭ বছরের কারাদণ্ডপ্রাপ্ত অপরাধী, ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান ৭৮ বছরের কারাদণ্ডপ্রাপ্ত অপরাধী সে দলের সঙ্গে? ২১ আগস্ট গ্রেনেড হামলা ও হত্যা মামলায় যাবজ্জীবন এবং দুর্নীতি ও অপরাধের অন্য চারটি মামলায় ২৮ বছরের কারাদণ্ড সহ মোট ৫৮ বছরের কারাদণ্ডপ্রাপ্ত পলাতক আসামি বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান। ২১ আগস্টে ২৭ জন মানুষ হত্যা তো আছেই, তা ছাড়া বার বার জননেত্রী শেখ হাসিনাকে হত্যার চেষ্টা করেছে বিএনপি। এমন একটি দলের সঙ্গে কী করে সংলাপ হতে পারে?

নির্বাচনের ট্রেন এখন প্লাটফর্মে, বিএনপি দল হিসেবে উঠতে না পারলে, তরুণ-প্রবীণ নেতৃত্বের অনেকেই সেই ট্রেনে উঠার জন্যে প্রস্তুত। বিএনপিকে কোনো গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ায় আসতে হলে অবশ্যই দণ্ডিত অপরাধীদের দল থেকে বের করে তারপর অন্য আরেকটি গণতান্ত্রিক দলের সঙ্গে সংলাপের কথা বলতে হবে।

বিগত দুটো নির্বাচনের মতো এই নির্বাচনের আগেও যে সহিংস পরিস্থিতি বিএনপি-জামায়াত তৈরি করেছে তাতে তাদের সঙ্গে সংলাপের দায় কোনোভাবেই বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের নয়। বরং তাদের উচিত সহিংসতা পরিহার করে সরকারের সঙ্গে সংলাপের জন্য সরাসরি প্রস্তাব দেয়া, কোনো বিদেশি প্রভুর মাধ্যমে নয়।

লেখক: সহযোগী অধ্যাপক, আইন বিভাগ, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়

আরও পড়ুন:
মেয়র, চেয়ারম্যান, মেম্বার পদে থেকে সংসদ নির্বাচন করা যাবে না
সরকারি বদলি নিয়োগে লাগবে ইসির অনুমতি
নারায়ণগঞ্জে বাম গণতান্ত্রিক জোটের মিছিলে পুলিশের লাঠিচার্জ
নির্বাচনে আন্তর্জাতিক মহলের ‘হস্তক্ষেপে’ উদ্বেগ জাবির ৫ শতাধিক শিক্ষকের
জাতির উদ্দেশে ভাষণে যা বললেন সিইসি

মন্তব্য

বিশ্লেষণ
Sheikh Hasina is a leader and a warrior

শেখ হাসিনা- একজন নেতা, একজন যোদ্ধা

শেখ হাসিনা- একজন নেতা, একজন যোদ্ধা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। ফাইল ছবি
বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বাংলাদেশকে বিশ্বের বুকে শুধু একটি বিরল মাত্রাই দেননি, দেশে বৈশ্বিক উন্নয়ন কর্মকাণ্ডকেও জোরদার করেছেন তিনি। বাংলাদেশের সাধারণ মানুষ প্রায়ই তাকে শুধু জাতীয় দৃষ্টিকোণ থেকে দেখে এবং সেই দৃষ্টিকোণ থেকে মূল্যায়ন করতে অভ্যস্ত, যা নিঃসন্দেহে প্রয়োজনীয়, কিন্তু যথেষ্ট নয়। বৈশ্বিক নেতৃত্ব তার অভ্যন্তরীণ নেতৃত্বের মতোই অতুলনীয় এবং তার অতুলনীয় নেতৃত্বের সম্পূর্ণ বিস্তৃতি তার প্রশংসা ছাড়া বোঝা যায় না।

বঙ্গবন্ধু কন্যা শেখ হাসিনা বাংলাদেশের জনগণের সার্বিক কল্যাণ, উন্নয়ন ও মুক্তির অগ্রদূত হিসেবে কাজ শুরু করেছিলেন। তিনি প্রমাণ করেছেন যে, বাংলাদেশে গণতন্ত্রের উন্নয়নে তার কোনো বিকল্প নেই। শেখ হাসিনার সততা, নিষ্ঠা, যৌক্তিক মানসিকতা, দৃঢ় মনোবল, প্রজ্ঞা ও অসাধারণ নেতৃত্ব বাংলাদেশকে বিশ্ব দরবারে এক ভিন্ন উচ্চতায় প্রতিষ্ঠিত করেছে এবং তিনি এখন বিশ্বখ্যাত নেতা হিসেবে পরিচিত।

আওয়ামী লীগ সব ধরনের শোষণ, বঞ্চনা, অবিচার ও নিপীড়নের বিরুদ্ধে রাজনৈতিকভাবে সোচ্চার, প্রতিরক্ষামূলক ভূমিকা পালন করেছে এবং অব্যাহত রেখেছে। প্রতিষ্ঠালগ্ন থেকেই এটি জনগণের অর্থনৈতিক, সামাজিক, রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক মুক্তির জন্য কাজ করে আসছে। এই দল যখন ক্ষমতায় থাকে, তখন মানুষের ভাগ্যের উন্নতি হয়। এই দলের প্রতিষ্ঠার পর থেকে ৭৪ বছরের ইতিহাস এই সত্যের সাক্ষ্য দেয়।

জাতির পিতা বঙ্গবন্ধুর সাহসী কন্যা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার গতিশীল নেতৃত্বে আওয়ামী লীগ ১৫ বছর ধরে ক্ষমতায় রয়েছে এবং তিনি জনগণের কল্যাণে নিবেদিতভাবে কাজ করে যাচ্ছেন। শেখ হাসিনার অদম্য শক্তি, সাহস, মনোবল ও বলিষ্ঠ নেতৃত্বে বিশ্ব বিস্মিত। বাংলাদেশ ২০৩০ সালের মধ্যে বিশ্বের ২৯তম এবং ২০৪০ সালের মধ্যে ২০তম বৃহত্তম অর্থনীতিতে পরিণত হবে বলে আশা করা যাচ্ছে। এদিকে বাংলাদেশকে ২০২৬ সাল থেকে ‘মধ্যম আয়ের দেশ’ হিসেবে এবং ২০৪১ সালে ‘উন্নত দেশ’ হিসেবে আত্মপ্রকাশ করবে বলে ঘোষণা করা হয়েছে।

বাংলাদেশ যে এগিয়ে যাচ্ছে তার বড় প্রমাণ হলো গত কয়েক বছরে দেশের মানুষের মাথাপিছু আয় বেড়েছে। বর্তমানে মাথাপিছু আয় ২ হাজার ৭৬৫ ডলার। অর্থনৈতিক অগ্রগতির দিক থেকে বাংলাদেশ আজ বিশ্বের অন্যতম শীর্ষ স্থানীয় দেশ।

শেখ হাসিনা ৪টি মাইলফলক দিয়েছেন। প্রথমটি হচ্ছে ডিজিটাল বাংলাদেশ, যা ইতোমধ্যে একটা ধাপ পর্যন্ত বাস্তবায়িত হয়েছে। দ্বিতীয়টি হচ্ছে ২০৩০ সালের মধ্যে টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা (এসডিজি), তৃতীয়টি ২০৪১ সালের মধ্যে উন্নত বাংলাদেশ গড়ে তোলা এবং চতুর্থটি হচ্ছে ২১০০ সালের মধ্যে ডেল্টা প্ল্যান বাস্তবায়ন করা।

গত ১৫ বছরে দেশ পেয়েছে পদ্মা সেতু ও রেল সেতু। ঢাকা মেট্রোরেল, আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের আধুনিক তৃতীয় টার্মিনাল, পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র, কর্ণফুলী টানেল এবং এলিভেটেড এক্সপ্রেস ওয়ের প্রতিশ্রুতি তিনি অসম্পূর্ণ রাখেননি।

এরমধ্যে রাস্তাঘাটের ব্যাপক উন্নতি হয়েছে। কোভিড-১৯ মহামারির কারণে সমগ্র বিশ্বের অর্থনীতি মন্থর হয়ে পড়লেও তিনি এর প্রভাব বাংলাদেশে পড়তে দেননি। নতুন সেতু ও সড়কের মাধ্যমে অবকাঠামোর ব্যাপক উন্নতি হয়েছে। বাংলাদেশ আজ খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণ। কোভিড-১৯ মহামারিতে দলের অগণিত নেতা-কর্মী সবার পাশে দাঁড়িয়েছেন। নৌকা দ্রুত গতিতে দেশকে এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছে। বাংলাদেশ অন্ধকার থেকে এখন আলোর পথে।

শেখ হাসিনা এমন একজন নেতা যিনি বিশ্বের কাছে আলোর আলোকবর্তিকা। বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বাংলাদেশকে শুধু একটি বিরল মাত্রাই দেননি, দেশে বৈশ্বিক উন্নয়ন কর্মকাণ্ডকেও জোরদার করেছেন। বাংলাদেশের সাধারণ মানুষ প্রায়ই তাকে শুধু জাতীয় দৃষ্টিকোণ থেকে দেখে এবং সেই দৃষ্টিকোণ থেকে মূল্যায়ন করতে অভ্যস্ত, যা নিঃসন্দেহে প্রয়োজনীয়, কিন্তু যথেষ্ট নয়। বৈশ্বিক নেতৃত্ব তার অভ্যন্তরীণ নেতৃত্বের মতোই অতুলনীয় এবং তার অতুলনীয় নেতৃত্বের সম্পূর্ণ বিস্তৃতি তার প্রশংসা ছাড়া বোঝা যায় না।

অনেকের হয়তো মনে নেই যে, ২০২০ সালে শেখ হাসিনাসহ ১৮৯ জন রাষ্ট্র ও সরকার প্রধান মিলেনিয়াম ঘোষণাপত্রে বাংলাদেশের পক্ষে স্বাক্ষর করেন। তিনি কেবল সেই ঐতিহাসিক দলিলের স্বাক্ষরকারী হিসাবে ইতিহাসে নিজের জন্য একটি স্থান তৈরি করেননি। এই পদক্ষেপের মাধ্যমে তিনি বাংলাদেশকে একটি বৈশ্বিক অঙ্গীকারের অংশীদার করে তুলেছেন। সেই অঙ্গীকারের ওপর ভিত্তি করে তিনি বাংলাদেশের দৃষ্টিকোণ থেকে ৮টি সহস্রাব্দ লক্ষ্যমাত্রা অর্জনের অঙ্গীকার গ্রহণ করেন। তার নেতৃত্বে বাংলাদেশ দারিদ্র্যের হার ১৯৯০ সালের ৫৮ শতাংশ থেকে ২০১৯ সালের মধ্যে ২০ শতাংশে নামিয়ে আনতে সক্ষম হয়েছে। এই সময়ের মধ্যে বাংলাদেশের মানুষের গড় আয়ু ৫৮ বছর থেকে বেড়ে ৭৩ বছর হয়েছে। প্রাপ্তবয়স্কদের সাক্ষরতার হার ৩৫ শতাংশ থেকে বেড়ে ৭৫ শতাংশে দাঁড়িয়েছে। শিশু মৃত্যুর হার প্রতি হাজারে ১০০ থেকে কমে প্রতি হাজারে ২১ হয়েছে।

১৯৯০ সাল থেকে ২০১৯ সাল পর্যন্ত বাংলাদেশের ৩৫ বিলিয়ন ডলারের অর্থনীতি ৩৩০ বিলিয়ন ডলারে উন্নীত হয়েছে। মানুষের মাথাপিছু আয় প্রায় ৭ গুণ বৃদ্ধি পেয়েছে।

প্রধানমন্ত্রীর দক্ষ ব্যবস্থাপনায় বাংলাদেশের বিভিন্ন আর্থ-সামাজিক উন্নয়ন অর্জন প্রতিবেশী দেশগুলোকে ছাড়িয়ে গেছে। উদাহরণস্বরূপ, বাংলাদেশে গড় আয়ু ৭৩ বছর, ভারতে ৬৯ বছর এবং পাকিস্তানে ৬৭ বছর। বাংলাদেশে পাঁচ বছরের কম বয়সী দের মৃত্যুর হার প্রতি হাজারে ৩১ জন, ভারতে ৩৮ জন, পাকিস্তানে ৬৭ জন।

২০১৫ সালে প্রধানমন্ত্রীর নেতৃত্বে বাংলাদেশ ২০৩০ সালের মধ্যে টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা অর্জনের অঙ্গীকার ব্যক্ত করে এবং এই লক্ষ্যগুলি তার অষ্টম পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনার সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ। বাংলাদেশের উন্নয়ন কর্মকান্ড এই লক্ষ্য অর্জনের দিকে পরিচালিত হয়। পাশাপাশি পরিবেশ ও জলবায়ু পরিবর্তন, নারী অধিকার, শিশু সুরক্ষা, মানবাধিকার প্রভৃতি বিষয়ে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্ব ও অঙ্গীকার আন্তর্জাতিক অঙ্গনে স্বীকৃত ও অভিনন্দন। আমরা সবসময় তাকে উন্নয়নশীল বিশ্বের স্বার্থে কথা বলতে দেখেছি। বাংলাদেশের উন্নয়ন কর্মকান্ড এই লক্ষ্য অর্জনের দিকে পরিচালিত হয়। পাশাপাশি পরিবেশ ও জলবায়ু পরিবর্তন, নারী অধিকার, শিশু সুরক্ষা, মানবাধিকার প্রভৃতি বিষয়ে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্ব ও অঙ্গীকার আন্তর্জাতিক অঙ্গনে স্বীকৃত ও অভিনন্দন। আমরা সবসময় তাকে উন্নয়নশীল বিশ্বের স্বার্থে কথা বলতে দেখেছি।

প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার শাসনামলে বাংলাদেশ নিম্ন আয়ের দেশ থেকে মধ্যম আয়ের দেশে উন্নীত হয়েছে এবং স্বল্পোন্নত দেশ থেকে বেরিয়ে আসার প্রক্রিয়ায় রয়েছে। আজ আমরা ২০৪১ সালের দিকে তাকিয়ে আছি, যখন আমরা বিশ্ব দরবারে উন্নত বিশ্বের অংশ হতে চাই। ভবিষ্যতের দুনিয়া দ্রুত বদলে যাচ্ছে। আজ আমরা যে বিশ্বে বাস করছি, সেখানে বৈষম্য, অস্থিতিশীলতা এবং অপর্যাপ্ততা বাড়ছে। সুযোগ যেমন আছে, তেমনি দুর্বলতাও তৈরি হচ্ছে। এই পরিস্থিতিতে আমাদের এমন একজন নেতা দরকার, যিনি শুধু তার দেশের জন্য নয়, সমগ্র বিশ্বের জন্য অপরিহার্য। বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এমন একজন নেতা- বিশ্বের আলো।

শেখ হাসিনার সরকার শিক্ষার্থীদের বিনামূল্যে বই দিচ্ছেন। দরিদ্র ও মেধাবী শিক্ষার্থীরা বৃত্তি পাচ্ছে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা আন্তরিকভাবে চান শিক্ষার্থীরা শুধু মনোযোগ দিয়ে পড়াশোনা করুক, বাকিটা সরকারের দায়িত্ব। সুতরাং, শিক্ষার্থীদের পড়াশোনার সময় অর্থ নিয়ে চিন্তা করতে হবে না। প্রধানমন্ত্রী চান বাংলাদেশের শিশুরা শিক্ষা, জ্ঞান ও বিজ্ঞানের দিক দিয়ে বিশ্বের সঙ্গে তাল মিলিয়ে চলতে সক্ষম হোক। উপযুক্ত শিক্ষা অবকাঠামো গড়ে তোলার মাধ্যমে তিনি সবাইকে সত্যিকারের শিক্ষিত শিশু হিসেবে গড়ে তোলার সুযোগ করে দিচ্ছেন। শেখ হাসিনার মূলমন্ত্র হলো, মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় বাংলাদেশ এগিয়ে যাবে। তিনি অসাম্প্রদায়িক চেতনায় বিশ্বাসী। বঙ্গবন্ধুর আদর্শকে ধারণ করে তিনি সংখ্যালঘুদের কল্যাণে কাজ করে যাচ্ছেন। প্রতিবেশীদের সঙ্গে বন্ধুত্ব বজায় রেখে উন্নয়নের বিভিন্ন সূচকে ভারতকে টপকে যাচ্ছে বাংলাদেশ।

শেখ হাসিনা দেশবাসীর সেই স্বপ্ন সঠিক পথে বাস্তবায়নে বদ্ধপরিকর। আওয়ামী লীগের নৌকাকে দৃঢ় করে দেশের মানুষ আজ সুখ-সমৃদ্ধির নতুন দিগন্তে প্রবেশ করেছে। আওয়ামী লীগ সরকার জনগণের কল্যাণে কাজ করে যাচ্ছে। তাই বাংলাদেশে বয়স্ক ভাতা, বিধবা ভাতা, মাতৃত্বকালীন ভাতা, কর্মজীবী নারীদের বুকের দুধ সরবরাহকারী ভাতা ইত্যাদি চালু করা হয়েছে।

সবার কল্যাণই শেখ হাসিনা সরকারের ঘোষিত নীতি। ১৪ হাজার ৫০০ কমিউনিটি ক্লিনিক স্থাপন করা হয়েছে। সেখান থেকে ৩০ ধরনের ওষুধ বিনামূল্যে দেওয়া হচ্ছে। নৌকার কারণে স্বাস্থ্য অবকাঠামোর ব্যাপক উন্নতি হয়েছে। চলতি বছরের মে মাসে জাতিসংঘে প্রথমবারের মতো কমিউনিটি ভিত্তিক স্বাস্থ্যসেবা সংক্রান্ত একটি রেজুলেশন সর্বসম্মতিক্রমে গৃহীত হয়। ওই রেজুলেশনের মাধ্যমে বাংলাদেশে কমিউনিটি ক্লিনিকভিত্তিক প্রাথমিক স্বাস্থ্যসেবার মডেল প্রতিষ্ঠায় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার অসামান্য উদ্ভাবনী নেতৃত্ব আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত হয়েছে বলে বাংলাদেশে জাতিসংঘের স্থায়ী মিশন জানিয়েছে। জনগণের দোরগোড়ায় স্বাস্থ্যসেবা পৌঁছে দিতে কমিউনিটি ক্লিনিক মডেল তৈরি করায় জাতিসংঘের স্বীকৃতির পর প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে বিশেষ সম্মাননায় ভূষিত করেছে ব্রাউন ইউনিভার্সিটি।

শুধু স্বাস্থ্যখাত নয়, ভূমিহীনদেরও বিনামূল্যে ঘর দিচ্ছে সরকার। সরকার শুধু ঘর নির্মাণ ের মাধ্যমে তার দায়িত্ব পালন করছে না, সরকারি প্রকল্পগুলো তাদের জীবন ও জীবিকাও প্রদান করছে। এ পর্যন্ত ২১টি জেলাকে গৃহহীনমুক্ত ঘোষণা করা হয়েছে। ২০২১ সালের ২৩ জানুয়ারি মুজিববর্ষে প্রথম ধাপে ৬৩ হাজার ৯টি, দ্বিতীয় ধাপে ২০ জুন ৫৩ হাজার ৩৩০টি এবং তৃতীয় ধাপে ২ দফায় মোট ৫৯ হাজার ১৩৩টি ঘর বিতরণ করা হয়। আরও ২২ হাজার ১০১টি ঘর বিতরণের মাধ্যমে আশ্রয়ণ প্রকল্পের আওতায় মোট সংখ্যা দাঁড়াল ৫ লাখ ৫৫ হাজার ৬১৭টি।

প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার হাত ধরে করোনাভাইরাস মহামারির সময় বাংলাদেশের জনগণ বিনামূল্যে কোভিড-১৯ টিকা পেয়েছে। বাংলাদেশ সরকার বিভিন্ন দেশের সঙ্গে দৃঢ় সম্পর্ক তৈরি করে দেশের মানুষের জন্য সঠিক সময়ে টিকা আনতে পারে। এই সাফল্যের মূল কারিগর প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। কোভিড-১৯ মোকাবেলার পাশাপাশি তিনি সে সময় অর্থনীতির চাকা সচল রাখতে সক্ষম হয়েছিলেন। শেখ হাসিনার নেতৃত্বে বাংলাদেশের সাফল্যে বিস্ময় প্রকাশ করেছে বিশ্ব। সে সময় বেশ কয়েকটি আন্তর্জাতিক সংস্থায়ও বাংলাদেশের প্রশংসা করা হয়েছিল।ওয়ার্ল্ড ইকোনমিক ফোরামসহ বিশ্বের বিভিন্ন সংগঠন। করোনা মহামারি ও ইউক্রেন-রাশিয়া যুদ্ধের পর বিশ্বের অধিকাংশ দেশই অর্থনৈতিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। এমন পরিস্থিতিতেও বাংলাদেশ এগিয়ে যাচ্ছে। করোনার কারণে বাংলাদেশ একটি ব্যর্থ রাষ্ট্রে পরিণত হবে বলে মন্তব্য করা সমালোচকদের মুখে বাংলাদেশের উন্নয়ন ছিল একটি থাপ্পড়। শেখ হাসিনার হাত ধরেই ডিজিটাল বাংলাদেশ আজ বাস্তবে পরিণত হয়েছে। এখন আমরা স্মার্ট বাংলাদেশের দিকে এগিয়ে যাচ্ছি। যেখানে সকল নাগরিক সেবা হাতের নাগালে পাওয়া যাবে। এই ডিজিটাল ও স্মার্ট বাংলাদেশে কেউ ক্ষুধার্ত থাকতে পারবে না। আওয়ামী লীগ সরকার সবার জন্য খাদ্য, বস্ত্র, বাসস্থানের পাশাপাশি সুশিক্ষার ব্যবস্থা করেছে। শেখ হাসিনার নেতৃত্বে বিগত ১৫ বছরের সাফল্যই নৌকার বিজয়ের আসল হাতিয়ার।

যখন বাংলাদেশের সংকট তীব্র হয়, সবকিছু যখন অনিশ্চয়তাকে ঘিরে ঘোরে, বাংলার আকাশে কালো মেঘ জমে থাকে, তখন শেখ হাসিনা আমাদের শেষ ভরসা হয়ে দাঁড়ান। একজন মানুষ অদম্য সংকল্প ও নিষ্ঠার সাথে ভয়ের কালো মেঘ মুছে দেয় এবং দেশের মানুষ আশার আলো দেখতে পায়। যখনই মনে হয় যে সবকিছু শেষ হয়ে যাচ্ছে, আমরা একটি খারাপ সময়ের মুখোমুখি হই, একমাত্র ত্রাণকর্তা যিনি দক্ষতার সাথে খারাপ দুঃস্বপ্নদূর করেন তিনি হলেন আমাদের মাননীয় প্রধানমন্ত্রী। তার পরিচয় একজন প্রধানমন্ত্রী বা রাজনৈতিক নেতার চেয়েও বেশি, তিনি একজন অদম্য সাহসী মানুষ। তিনি একজন যোদ্ধা এবং একজন অভিভাবক। তিনি সাহসের সাথে কোভিড-১৯ মহামারী মোকাবেলা করেছেন, তবুও, এখন তিনি বিশ্বের সেরা উদাহরণ এবং বিশ্ব নেতারা বৈশ্বিক সংকট পরিচালনায় তার উদ্যোগের প্রশংসা করেছেন।

লেখক একজন কলামিস্ট ও গবেষক

আরও পড়ুন:
জেদ্দা থেকে ঢাকায় প্রধানমন্ত্রী
গাজায় অবিলম্বে যুদ্ধবিরতির আহ্বান প্রধানমন্ত্রীর
দ্বিতীয় জয়ের খোঁজে ২৮০ রানের লক্ষ্য পেল বাংলাদেশ
ওমরাহ করলেন প্রধানমন্ত্রী
সৌদি আরবে পৌঁছেছেন প্রধানমন্ত্রী

মন্তব্য

বিশ্লেষণ
The four national leaders were not traitors

জাতীয় চার নেতা বিশ্বাসঘাতক ছিলেন না

জাতীয় চার নেতা বিশ্বাসঘাতক ছিলেন না অধ্যাপক ড. কামালউদ্দীন আহমদ। ছবি: সংগৃহীত
একটি বিষয় লক্ষণীয় যে ৭৫ সালের ১৫ আগস্টের পরে অনেকেই অনেকভাবে, যেটা ভয়ে হোক কিংবা আতঙ্কে হোক আত্মগোপনে ছিল। অনেকেই প্রতিরোধ গড়ে তোলার চেষ্টা করেছিল। বঙ্গবন্ধু হত্যা পরবর্তী সময়ে জাতীয় চার নেতাসহ অনেককেই নানাভাবে প্রলোভন দেখানো হয়েছিলো খুনী মোশতাকের স্বৈরশাসিত সরকারের কেবিনেটে যোগদানের জন্য। কিন্তু তাঁরা ঘৃণাভাবে সেটা প্রত্যাখ্যান করেছিলেন। তখন থেকেই তারা জিয়া এবং মোশতাকের কুনজরে পড়েন।

১৯৭৫ সালের ৩ নভেম্বর ‘জেল হত্যা দিবস’ জাতীয় জীবনে একটি বেদনাদায়ক দিন। সেদিন নির্মমভাবে হত্যা করা হয় জাতীয় চার নেতাকে-যার নজির পৃথিবীর কোনো সভ্য সমাজে আছে কিনা তা আমার জানা নেই। তবে আমার মনে হয় এ ধরনের দৃষ্টান্ত কোথাও নেই।

সেদিন জাতীয় চার নেতার মধ্যে ছিলেন প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদ যিনি বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধকে এগিয়ে নেয়ার ক্ষেত্রে যুদ্ধকালীন সময়ে দীর্ঘ নয় মাস গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব পালন করেন। তাঁকেও নির্মমভাবে হত্যা করা হয়। এছাড়াও ক্যাপ্টেন মুনসুর আলী যিনি বঙ্গবন্ধুর আজীবন সৈনিক ছিলেন, স্বাধীনতার পরে স্বরাষ্টমন্ত্রীর দায়িত্বপালন করেন, কামরুজ্জামান বঙ্গবন্ধুর খুবই কাছের নেতা ছিলেন এবং সৈয়দ নজরুল ইসলাম বাংলাদেশের স্বাধীনতার সময় ভাইস প্রেসিডেন্ট ছিলেন যিনি মেহেরপুরের আম্রকাননে গার্ড অব অনার পরিদর্শন করেন, তাদেরকেও হত্যা করা হয়।

যারা বঙ্গবন্ধুর হত্যাকারী তাদের দীর্ঘদিনের পরিকল্পনা ছিল বঙ্গবন্ধুর সঙ্গের কারোরই চিহ্ণ রাখা যাবে না। সেই লক্ষ্যকে সামনে রেখে স্বাধীনতা বিরোধী পাকিস্তানি গোষ্ঠী বঙ্গবন্ধুকে সপরিবারে ৭৫ এর ১৫ আগস্ট হত্যা করেছিল এবং আওয়ামী লীগ যাতে নেতৃত্বশূন্য হয়ে যায় সে কারণে জাতীয় চার নেতার হত্যাযজ্ঞ।

এখানে একটি বিষয় লক্ষণীয় যে ৭৫ সালের ১৫ আগস্টের পরে অনেকেই অনেকভাবে, যেটা ভয়ে হোক কিংবা আতঙ্কে হোক আত্মগোপনে ছিল। অনেকেই প্রতিরোধ গড়ে তোলার চেষ্টা করেছিল। বঙ্গবন্ধু হত্যা পরবর্তী সময়ে জাতীয় চার নেতাসহ অনেককেই নানাভাবে প্রলোভন দেখানো হয়েছিলো খুনী মোশতাকের স্বৈরশাসিত সরকারের কেবিনেটে যোগদানের জন্য। কিন্তু তাঁরা ঘৃণাভাবে সেটা প্রত্যাখ্যান করেছিলেন। তখন থেকেই তারা জিয়া এবং মোশতাকের কুনজরে পড়েন।

মোশতাক-জিয়া গংরা প্রতিশোধ নেয়ার জন্য তেসরা নভেম্বরে তাদের নির্মমভাবে হত্যাকাণ্ড ঘটায়। এখানে আরেকটা উল্লেখযোগ্য বিষয় হলো- বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে অনেকেই তার ঘনিষ্ঠজন ছিলেন। তাদের মধ্যে অন্যতম খন্দকার মোশতাক যে ছিল বেইমান, খুনী মোশতাক।

সে যে কাজটি করেছে সে কাজটি সায় দেয়ার জন্য কিংবা উদ্বুদ্ধ করার চেষ্টা চালিয়েছিল। উপরন্তু জেলখানায়ও জাতীয় চার নেতার কাছে নানান সময়ে বিভিন্ন প্রস্তাব পাঠানো হয়। যেন মোশতাকের কেবিনেটেই তারা যোগদান করেন। কিন্তু তাঁরা তা ঘৃণাভরে প্রত্যাখান করেন।

হত্যার ঘটনা জাতির জন্য চরম বিপর্যয়কর ছিল। যারা মুক্তিযুদ্ধকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার ক্ষেত্রে এবং বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বকে শক্তিশালী করার ক্ষেত্রে অগ্রণী ভূমিকা পালন করেছিলেন, তাদের ইতিহাস থেকে মুছে ফেলার জন্য হত্যাকারীরা তেসরা নভেম্বর ঘটায়। সে কাজে তারা কতটুকু সফল হয়েছে আজকের প্রজন্ম তা বিচার করবে।

আমাদের মনে আছে তাজউদ্দীন আহমদ স্বাধীনতা যুদ্ধের সময় স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রে কথা বলতেন। আমরা তখন তাঁর বক্তব্য শুনতাম। রণাঙ্গন থেকে তিনি বিভিন্ন সাক্ষাতকার দিতেন এবং এগুলো আমাদের কাছে অনুপ্রেরণামূলক ও যুদ্ধে যোগদানের জন্য উৎসাহের কারণ ছিল। আমাদের কাছে মনে হতো প্রবাসী সরকার যেন বাংলাদেশের মধ্য থেকেই দেশ পরিচালনা করছেন এবং মুক্তিযোদ্ধা ও গেরিলা সকলের জন্যও একটা সাহস সঞ্চারী আইকন।

তাজউদ্দীন আহমদ কোথায় যাননি? কলকাতা থেকে শুরু করে মেঘালয়, আসাম সব জায়গায় তিনি ঘুরে বেড়িয়েছিলেন। মুক্তিযুদ্ধ সংগঠিত করার জন্য, বেগবান করার জন্য তৎকালীন ভারতীয় প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীর সাথে যে যোগাযোগ সেটা তাজউদ্দীন আহমদের সংযোগেই হয়েছিল। তিনি অনেক সাহসী ও আত্মবিশ্বাসী ছিলেন। বাংলাদেশের যোদ্ধা ছিলেন। সম্মুখসারির সমর বিশেষজ্ঞ ছিলেন। আর আমরা মাঝে মধ্যেই তৎকালীন বেতারে তাজউদ্দীনের ইংরেজি বক্তব্য শুনতাম। তাঁর যে উচ্চারণ ছিল তার দ্বারা আমরা অনেকেই অনুপ্রাণিত হতাম।

একটি বিষয় সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ, সেটা হচ্ছে, বিপদ তো বলে কয়ে আসে না। যেমন আমাদের জাতির পিতা বঙ্গবন্ধুকে হত্যা করার জন্য স্বাধীনতা যুদ্ধের আগে থেকেই একটা ষড়যন্ত্র চলছিল এবং সেই গোষ্ঠীরা স্বাধীনতা যুদ্ধের পরে ৭৫ সালে বঙ্গবন্ধু ও তাঁর পরিবারের সদস্যদেরকে নির্মমভাবে হত্যা করে মোশতাকের নেতৃত্বে।

আমরা শুনেছিলাম এই মোশতাক গোপনীয়ভাবে চীনের সঙ্গে যোগাযোগ রক্ষা করে দেশবিরোধী ষড়যন্ত্র করতো। সে কারণে তার ক্ষমতা অনেকটা খর্ব করে দিয়েছিলেন তাজউদ্দীন। আর এসব কারণেই ঈর্ষাপরায়ণ হয়ে ৩ নভেম্বর হত্যাকাণ্ড ঘটে। খন্দকার মোশতাক স্বাধীনতার পরেও তার মুখোশ উম্মোচন করেনি, দলের মধ্যে থেকেই তার ষড়যন্ত্র চালিয়ে গিয়েছিল।

সেনাবাহিনীর তৎকালীন উপ-প্রধান যাকে বঙ্গবন্ধুই সেনাবাহিনীদের ডেপুটি চিফ অফ স্টাফ করেছিলেন, এই পদতো আর সেনাবাহিনীতে ছিল না, বঙ্গবন্ধু জিয়াকে খুশি করার জন্যই এমনটা করেছিলেন। অথচ তারাই ষড়যন্ত্র করে বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ড ঘটিয়েছে।

আমি বলতে চাই এরাই বিশ্বাসঘাতক; যেটা আমি মনে করি দল যারা করেন, বিশেষ করে বঙ্গবন্ধুর আদর্শের যারা, তারা সকলে এই বিশ্বাসঘাতককতার নমুনা ১৯৭৫ সালেই দেখেছেন। আমরা পরবর্তীতেও আরও দেখেছি এই ধরনের বিশ্বাসঘাতকতা। তারা আবার জিয়া ও জেনারেল এরশাদ-এর সাথে হাত মিলিয়েছিল, বেগম জিয়ার সঙ্গে কেউ কেউ দল করেছিল।

বর্তমানে সময়েও বিশ্বাসঘাতকতা রয়েছে এবং এ বিষয়ে আমাদের সচেতন থাকতে হবে। এখনতো আমাদের মাননীয় প্রধানমন্ত্রী বঙ্গবন্ধু কন্যা দীর্ঘ ত্যাগ-তিতিক্ষার বিনিমিয়ে ক্ষমতায়। আজকে তিনি যদি ক্ষমতায় না থাকতেন আপনারা দেখতেন যেকোনো ক্রাইসিসে কত উৎকন্ঠা জন্মাত।

আজকে উন্নয়ন বলেন আর জয়বাংলা বলেন সবকিছুই এই বঙ্গবন্ধুর আদর্শ অনুযায়ী এবং আদর্শকে বাস্তবে রূপায়ণ করার ক্ষেত্রে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার দীর্ঘদিন ক্ষমতায় থাকার ফলেই সম্ভব হয়েছে।

আসলে বিশ্বাসঘাতকতা কোনো ‍কিছুর ক্রাইসিস হলেই বেশি দেখা যায়। যেমন ২০১৪ সালের নির্বাচনে, ২০১৮ সালের নির্বাচনে এবং ২০০১ সালে যে নির্বাচনটিতে সংবিধানকে শ্রদ্ধা করে শেখ হাসিনা অংশগ্রহণ করেছিলেন এবং বিশ্বাসঘাতকরা বাংলাদেশ আওয়ামীলীগকে পরাজিত করে। তার ফলে কি ভয়ঙ্কর ঘটনা ঘটেছিল সকলে আমরা তা জানি। বাংলাদেশের উন্নয়ন স্তব্ধ হয়ে গিয়েছিল। ২০১৪ কিংবা ২০১৮ এর কথা অনুযায়ী যখন কোনো ক্রাইসিস আসে তখনই একটি গোষ্ঠী নড়াচড়া শুরু করে। নানান ধরনের ষড়যন্ত্র শুরু করে। যেমন আমরা উত্তরা ষড়যন্ত্র দেখেছি।

গত ২৮ অক্টোবর (২০২৩)-এর যে ঘটনা সেটাও দেখুন। একটি দেশের সেনাবাহিনীর যিনি নাইন ডিভিশনের জিওসি ছিলেন, সেনাবাহিনীর দায়িত্বশীল ব্যক্তি, মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার কল্যাণেই আস্থার সঙ্গে তাকে এই দায়িত্ব দিয়েছিলেন। কিন্তু দেখেন দেশের যখন ক্রাইসিস পিরিয়ড তখনই এই বিশ্বাসঘাতকতা। আর এই ধরনের বিশ্বাসঘাতকতা জাতীয় নেতারা করেননি। এ ধরনের বিশ্বাসঘাতকদের ‍বিরুদ্ধে আমাদের রুখে দাঁড়াতে হবে। সচেতন থাকতে হবে। সেটা আমাদের কর্মক্ষেত্র হোক আর অন্য যেখানেই হোক না কেন? এদের ‍বিরুদ্ধে সোচ্চার হতে হবে।

বাংলাদেশ যার হাত ধরে স্বাধীন হয়েছিল তাকে কোনভাবেই অপমান করা, অশ্রদ্ধা করা- এ ধরনের ঘটনা বাংলাদেশে হতে দেয়া যাবে না। এই বিষয়ে আমাদের সবসময় সকল ষড়যন্ত্রের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তুলতে হবে।

আর আমরা যারা শিক্ষকতা করি এটাতো কোনো রাজনীতির পর্যায়ে পড়ে না। রাজনৈতিক মত তো সকলেরই আছে। কিন্তু দেশের যে মূল আদর্শ স্বাধীনতা ও মুক্তিযুদ্ধ এগুলোর বিরোধীদের সঙ্গে আপোস হওয়া উচিত নয়। যতদিন বাংলাদেশ থাকবে, এই বিশ্বাসঘাতকদের বিরুদ্ধে আমাদের সোচ্চার হতে হবে। এরা যেন বাংলাদেশের উন্নয়নে বাঁধা হয়ে না দাঁড়ায় এবং সে ধরনের সুযোগ যাতে না পায়, সচেতন থাকতে হবে। বিশ্বাসঘাতকদের বিরুদ্ধে সোচ্চার হতে হবে- আজকের বেদনাদায়ক ৩ নভেম্বর ‘জেল হত্যা দিবসে’র অঙ্গীকার এটা হলে বাংলাদেশের মুক্তিযোদ্ধাদের ত্যাগ সফল হবে। জয় বাংলা।

লেখক: অধ্যাপক, কলামিস্ট এবং ট্রেজারার-জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়

মন্তব্য

p
উপরে