× হোম জাতীয় রাজধানী সারা দেশ অনুসন্ধান বিশেষ রাজনীতি আইন-অপরাধ ফলোআপ কৃষি বিজ্ঞান চাকরি-ক্যারিয়ার প্রযুক্তি উদ্যোগ আয়োজন ফোরাম অন্যান্য ঐতিহ্য বিনোদন সাহিত্য ইভেন্ট শিল্প উৎসব ধর্ম ট্রেন্ড রূপচর্চা টিপস ফুড অ্যান্ড ট্রাভেল সোশ্যাল মিডিয়া বিচিত্র সিটিজেন জার্নালিজম ব্যাংক পুঁজিবাজার বিমা বাজার অন্যান্য ট্রান্সজেন্ডার নারী পুরুষ নির্বাচন রেস অন্যান্য স্বপ্ন বাজেট আরব বিশ্ব পরিবেশ কী-কেন ১৫ আগস্ট আফগানিস্তান বিশ্লেষণ ইন্টারভিউ মুজিব শতবর্ষ ভিডিও ক্রিকেট প্রবাসী দক্ষিণ এশিয়া আমেরিকা ইউরোপ সিনেমা নাটক মিউজিক শোবিজ অন্যান্য ক্যাম্পাস পরীক্ষা শিক্ষক গবেষণা অন্যান্য কোভিড ১৯ শারীরিক স্বাস্থ্য মানসিক স্বাস্থ্য যৌনতা-প্রজনন অন্যান্য উদ্ভাবন আফ্রিকা ফুটবল ভাষান্তর অন্যান্য ব্লকচেইন অন্যান্য পডকাস্ট বাংলা কনভার্টার নামাজের সময়সূচি আমাদের সম্পর্কে যোগাযোগ প্রাইভেসি পলিসি

বিশ্লেষণ
বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে রাষ্ট্রভাষা আন্দোলন ও বাংলার বিশ্বব্যাপ্তি
google_news print-icon

বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে রাষ্ট্রভাষা আন্দোলন ও বাংলার বিশ্বব্যাপ্তি

বঙ্গবন্ধুর-নেতৃত্বে-রাষ্ট্রভাষা-আন্দোলন-ও-বাংলার-বিশ্বব্যাপ্তি
বঙ্গবন্ধু রাষ্ট্রভাষা আন্দোলনের অন্যতম স্থপতি, আর শেখ হাসিনার রাজনীতিতে প্রবেশের সূচনাদ্বার হলো রাষ্ট্রভাষা আন্দোলন। মাত্র পাঁচ বছর বয়সে এই আন্দোলন শেখ হাসিনার মনে দাগ কেটেছিল। বঙ্গবন্ধু সে সময় গোপালগঞ্জের সাধারণ মানুষের সঙ্গে আলাপ করে জেনেছেন, গ্রামের মানুষেরাও ঢাকা শহরে গুলিবিদ্ধ হয়ে ছাত্র শহিদ হওয়ার কথা জানে এবং তারা পাকিস্তানি শাসকদের ওপর বিক্ষুব্ধ হয়ে আছে। জনগণের এই বিক্ষুব্ধতাকে তাদের শোষণমুক্তির আন্দোলনের সঙ্গে পরে যুক্ত করেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান।

অনেকে বলে থাকেন, রাষ্ট্রভাষা আন্দোলনের সময় বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান জেলবন্দি হয়ে ফরিদপুরে ছিলেন। ফলে, এই আন্দোলনে তার অংশগ্রহণ সম্ভব ছিল না। যারা এহেন কথা বলে থাকেন, তাদের বক্তব্যে তথ্য ও যুক্তি নেই। কারণ, রাষ্ট্রভাষা আন্দোলন শুধু কিছু মুহূর্তের ব্যাপার নয়। এর ছিল প্রস্তুতি ও প্রবহমানতা। এই প্রস্তুতি ও প্রবহমানতা বিচার করলে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে রাষ্ট্রভাষা আন্দোলনের প্রধান স্থপতি বলতে হয়।

বাঙালির আত্মশক্তির উত্থান দেখা গিয়েছিল ১৯৫২ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি। রাষ্ট্রভাষার জন্য প্রকাশ্যে আন্দোলন করে শহিদ হওয়ার পূর্বদৃষ্টান্ত আর নেই। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান তখন জেলে অন্তরীণ নিশ্চয়। একুশের ঘটনা স্মরণ করে জেলখানাতে বসে তিনি লিখেছেন:

“মাতৃভাষা আন্দোলনে পৃথিবীতে এই প্রথম বাঙালিরাই রক্ত দিল। দুনিয়ার কোথাও ভাষা আন্দোলন করার জন্য গুলি করে হত্যা করা হয় নাই। জনাব নূরুল আমিন বুঝতে পারলেন না, আমলাতন্ত্র তাঁকে কোথায় নিয়ে গেল। গুলি হলো মেডিকেল কলেজের হোস্টেলের এরিয়ার ভেতরে, রাস্তায়ও নয়। ১৪৪ ধারা ভঙ্গ করলেও গুলি না করে গ্রেপ্তার করলেই তো চলত। আমি ভাবলাম, দেখব কি না জানি না, তবে রক্ত যখন আমাদের ছেলেরা দিয়েছে তখন বাংলা ভাষাকে রাষ্ট্রভাষা না করে আর উপায় নাই।’ (রহমান, ২০১২ : ২০৪) ‘অসমাপ্ত আত্মজীবনী’তে এভাবেই একুশের রক্তদান এবং এই রক্তদানের পরিপ্রেক্ষিতে বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা করার দৃঢ় প্রত্যয় প্রকাশ করেছিলেন বঙ্গবন্ধু। জেলে বসে (১৯৬৬) সেই আন্দোলনের পরিণাম নিয়ে রাজনৈতিক গ্রন্থরচনা, কম সাহসের কথা নয়। এই সাহস বঙ্গবন্ধু নিজে লালন করতেন এবং তা বাঙালিদের মধ্যে সঞ্চারিত করতে তিনি পেরেছিলেন।

ভাষা ও সংস্কৃতি নিয়ে বঙ্গবন্ধুর ভাবনা এক দিনের নয়। ছাত্ররাজনীতিতে যখন তিনি ছিলেন, আওয়ামী লীগের মূল রাজনীতিতে যখন তিনি যুক্ত, স্বাধীন দেশে রাষ্ট্রক্ষমতায় যখন তিনি- সব সময়ই ভাষা ও সংস্কৃতি নিয়ে তিনি উন্নত ভাবনা ভেবেছেন এবং তা কার্যকরের ধারাবাহিক পদক্ষেপ গ্রহণ করেছিলেন। এই ভাবনার ধারাবাহিকতা আছে।

১৯৫২-এর আন্দোলনের পর ১৯৫৬ সালে পাকিস্তানে প্রথম সংবিধান প্রণীত হলে এর ২১৪ নং অনুচ্ছেদে উর্দুর পাশে বাংলাকেও রাষ্ট্রভাষা হিসেবে উল্লেখ করা হয়। বাঙালির জন্য বিলম্বে হলেও এটি একটি বিজয় নিশ্চয়। কিন্তু এতেই তুষ্ট ছিলেন না বঙ্গবন্ধু। ১৯৬৬ সালের ৮ জুন, বুধবার জেলবন্দি বঙ্গবন্ধু শহিদের আত্মত্যাগ স্মরণ করে স্রষ্টার কাছে নীরবে প্রার্থনা করেন এবং অন্তরের মণিকোঠায় নেন সুদৃঢ় সংগ্রামের শপথ। ‘কারাগারের রোজনামচায়’ বঙ্গবন্ধু লিখেছেন:

“বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা করার জন্য যেভাবে এ দেশের ছাত্র-জনসাধারণ জীবন দিয়েছিল তারই বিনিময়ে বাংলা আজ পাকিস্তানের অন্যতম রাষ্ট্রভাষা। রক্ত বৃথা যায় না। যারা হাসতে হাসতে জীবন দিল, আহত হলো, গ্রেপ্তার হলো, নির্যাতন সহ্য করল তাদের প্রতি এবং তাদের সন্তান-সন্ততিদের প্রতি নীরব প্রাণের সহানুভূতি ছাড়া জেলবন্দি আমি [বঙ্গবন্ধু] আর কি দিতে পারি! আল্লাহর কাছে এই কারাগারে বসে তাদের আত্মার শান্তির জন্য হাত তুলে মোনাজাত করলাম। আর মনে মনে প্রতিজ্ঞা করলাম, এদের মৃত্যু বৃথা যেতে দেব না, সংগ্রাম চালিয়ে যাবো। যা কপালে আছে তাই হবে। জনগণ ত্যাগের দাম দেয়। ত্যাগের মাধ্যমেই জনগণের দাবি আদায় করতে হবে।” (রহমান, ২০১৭ : ৭৩-৭৪) এই প্রতিজ্ঞা বঙ্গবন্ধু শেষপর্যন্ত রক্ষা করেছিলেন এবং সে কারণেই বাঙালি পেয়েছিল একটি স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশ।

১৯৪৭ সালের ৬ ও ৭ সেপ্টেম্বর ঢাকায় অনুষ্ঠিত হয় যুবলীগের কর্মী সম্মেলন অনুষ্ঠান এবং সেখানে ভাষা-বিষয়ক একটি প্রস্তাব গৃহীত হয়। এই প্রস্তাব আনুষ্ঠানিকভাবে উত্থাপন করেছিলেন তৎকালীন যুবনেতা শেখ মুজিবুর রহমান। বিশিষ্ট ভাষাসংগ্রামী গাজীউল হক লিখেছেন-

“সম্মেলনের কমিটিতে গৃহীত প্রস্তাবগুলো পাঠ করলেন সেদিনের ছাত্রনেতা শেখ মুজিবুর রহমান। (আজিজ, ১৯৯২ : ১৫) কী ছিল সেই প্রস্তাবে? গাজীউল হক বঙ্গবন্ধুর সে বচন উল্লেখ করে লিখেছেন:

“পূর্ব পাকিস্তান কর্মী সম্মেলন প্রস্তাব করিতেছে যে, বাংলা ভাষাকে পূর্ব পাকিস্তানের লিখার বাহন ও আইন আদালতের ভাষা করা হউক। সমগ্র পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা কী হইবে তৎসম্পর্কে আলাপ-আলোচনা ও সিদ্ধান্ত গ্রহণের ভার জনসাধারণের উপর ছাড়িয়া দেওয়া হউক এবং জনগণের সিদ্ধান্তই চূড়ান্ত বলিয়া গৃহীত হউক।” (আজিজ, ১৯৯২ : ১৫)

এই দাবি থেকেই রাষ্ট্রভাষা আন্দোলন দানা বাঁধতে থাকে। কিন্তু সরকারের সামনে আনুষ্ঠানিকভাবে উত্থাপন করেন ধীরেন্দ্রনাথ দত্ত। বঙ্গবন্ধু লিখেছেন-

“ফেব্রুয়ারি ৮ হবে, ১৯৪৮ সাল। করচিতে পাকিস্তান সংবিধান সভার (কন্সটিটিউয়েন্ট এ্যাসেম্বলি) বৈঠক হচ্ছিল। সেখানে রাষ্ট্রভাষা কি হবে সে বিষয়ও আলোচনা চলছিল। মুসলিম লীগ নেতারা উর্দুকেই রাষ্ট্রভাষা করার পক্ষপাতী। পূর্ব পাকিস্তানের অধিকাংশ লীগ সদস্যেরও সেই মত। কুমিল্লার কংগ্রেস সদস্য [তখন ‘জাতীয় কংগ্রেস’ নামে রাজনৈতিক দল ছিল; তিনি সেই দল থেকে নির্বাচিত সংসদ সদস্য ছিলেন।] বাবু ধীরেন্দ্রনাথ দত্ত দাবি করলেন বাংলা ভাষাকেও রাষ্ট্রভাষা করা হোক। কারণ, পাকিস্তানের সংখ্যাগুরুর ভাষা হল বাংলা। মুসলিম লীগ সদস্যরা কিছুতেই রাজি হচ্ছিলেন না। আমরা দেখলাম, বিরাট ষড়যন্ত্র চলছে বাংলাকে বাদ দিয়ে রাষ্ট্রভাষা উর্দু করার।” (রহমান, ২০১২ : ৯১)

আদতে, বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা করার আন্দোলন আনুষ্ঠানিকভাবে ১৯৪৮ সালের ৮ ফেব্রুয়ারি থেকেই আরম্ভ হয়ে যায়। এখানে উল্লেখ্য যে, পাকিস্তান সংসদে বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা করার দাবি উত্থাপন করার জন্য চরম মূল্য দিতে হয়েছিল ধীরেন্দ্রনাথকে। একাত্তরে মুক্তিযুদ্ধকালে তিনি ও তার পুত্রকে ধরে নিয়ে যায় পাকিস্তানি সেনারা। ধীরেন্দ্রনাথ দত্তের দৌহিত্রী আরমা দত্ত লিখেছেন-

“একদিন দাদু [ধীরেন্দ্রনাথ] আর দিলীপ কাকুকে ধরে নিয়ে যাওয়া হলো। আমাদের জীবনে সে এক অমাবস্যার কাল। [...] পরবর্তীকালে ময়নামতি সেনানিবাসের তৎকালীন বেসামরিক কর্মচারী রমণীমোহন শীলসহ অন্যদের স্মৃতিচারণা থেকে জেনেছি, কী নির্মম নির্যাতন চলেছে তখন দাদুর ওপর। দাদু ধীরেন্দ্রনাথ দত্ত ও কাকু দিলীপ দত্তের লাশ আমরা পাইনি।” (ইসলাম, ২০১৩ : ৬১৩) এভাবেই পাকিস্তানিরা তাদের শত্রুকে শেষ পর্যন্ত লক্ষ্যবস্তুতে পরিণত করে রেখেছিল। বঙ্গবন্ধুর জীবনও তার একটি।

মূলত ধীরেন্দ্রনাথ দত্তের দাবির পরিপ্রেক্ষিতে ছড়িয়ে পড়ে ভাষার মর্যাদা রক্ষার দাবি এবং সে-সূত্রেই রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদ পুনর্গঠিত হয় ১৯৪৮ সালের ২ মার্চ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ফজলুল হক মুসলিম হলে। তমদ্দুন মজলিস ও মুসলিম ছাত্রলীগের যৌথসভায় এই পরিষদ পুনর্গঠন করা হয়। ফজলুল হক মুসলিম হলের এই সভায় উপস্থিত ছিলেন ছাত্রনেতা শেখ মুজিবুর রহমান, শামসুল হক, অলি আহাদ, মোহম্মদ তোয়াহা, আবুল কাসেম, রণেশ দাশগুপ্ত, অজিতকুমার গুহ প্রমুখ। সভায় পূর্বাপর ঘটনাসমূহ আলোচনা করে গণপরিষদের সিদ্ধান্ত পর্যালোচনা ও মুসলিম লীগের বাংলা ভাষাবিরোধী কার্যকলাপ বিশ্লেষণ করে এর বিরুদ্ধে সক্রিয় আন্দোলন গড়ে তোলার সিদ্ধান্ত হয়। আন্দোলনের স্বার্থেই গঠিত হয় সর্বদলীয় রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদ। গণতান্ত্রিক যুবলীগ, গণআজাদী লীগ, পূর্ব পাকিস্তান মুসলিম ছাত্রলীগ, তমদ্দুন মজলিস, ছাত্রাবাস বা হোস্টেলগুলোর সংসদ ইত্যাদি ছাত্র ও যুব প্রতিষ্ঠান থেকে দুজন করে প্রতিনিধি নিয়ে পরিষদ গঠিত হয়। এই সংগ্রাম পরিষদ গঠনে শেখ মুজিবুর রহমান বিশেষভাবে সক্রিয় ছিলেন এবং তার ভূমিকা ছিল যেমন বলিষ্ঠ ও সুদূরপ্রসারী।

রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদের আহ্বায়ক মনোনীত হন শামসুল আলম। ১৯৪৮ খ্রিস্টাব্দের ১১ মার্চ ঢাকা শহরে ছাত্রসমাজ প্রতিবাদ সভা, সাধারণ ধর্মঘট বিক্ষোভ প্রদর্শন করে। বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা করার দাবিতে ওই দিন পূর্ববাংলায় সফল হরতাল পালিত হয় আর বাংলা ভাষার রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতির দাবিতে এভাবেই প্রত্যক্ষ সংগ্রামের সূচনা ঘটে। পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার পর এটাই ছিল প্রথম হরতল। হরতালে বিক্ষোভ দেখানোর সময় সচিবালয়ের প্রথম প্রবেশদ্বার বা গেইটে পিকেটিংয়ে অংশ নেন শেখ মুজিবুর রহমান, শামসুল হক, অলি আহাদ প্রমুখ, দ্বিতীয় প্রবেশদ্বারে অন্যরা। এই প্রত্যক্ষ সংগ্রাম সূচনা করতে গিয়ে পুলিশ ও শাসক দলের ভাড়াটে গুন্ডাদের হাতে বহু আন্দোলনকারী ছাত্রজনতা আহত এবং অনেক ছাত্রনেতা গ্রেপ্তার হন। গ্রেপ্তারকৃত ছাত্রনেতাদের মধ্যে শেখ মুজিবুর রহমান ছিলেন অন্যতম। এরই পরিপ্রেক্ষিতে আন্দোলন চরমে ওঠে। ফলে ১৫ মার্চও হরতাল পালিত হয়। অবস্থা নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যেতে পারে বিবেচনা করে ওই দিন পূর্ববাংলার মুখ্যমন্ত্রী খাজা নাজিমুদ্দিন ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের নেতৃবৃন্দের নির্বাচিত প্রতিনিধি কমরুদ্দিন আহমদের সঙ্গে এক গুরুত্বপূর্ণ চুক্তিতে স্বাক্ষর করতে বাধ্য হন। ছাত্র প্রতিনিধিদের সঙ্গে মুখ্যমন্ত্রীর চুক্তি! একটি অভাবিত ঘটনা। সেটিও সম্ভবপর হয়েছিল শেখ মুজিবুর রহমানসহ বন্দিদের মুক্তির লক্ষ্যে ছাত্রসমাজের বজ্রকঠোর মনোভাবের জন্য। এই চুক্তির আটটি শর্ত ছিল।

প্রধান কয়েকটি হলো: গ্রেপ্তারকৃতদের মুক্তিদান; হামলার তদন্ত ও প্রধানমন্ত্রীর বিবৃতিপ্রদান; বাংলাকে উর্দুর সমমর্যাদাদানের জন্য ব্যবস্থাপক সভায় প্রস্তাবের ব্যবস্থা; কলেজগুলোতে বাংলায় পঠনপাঠনের সুযোগ সৃষ্টি; আন্দোলনকারীদের ব্যাপারে আইনগত পদক্ষেপ না নেয়া; সংবাদপত্রসমূহের ওপর থেকে নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহার; ১৪৪ ধারা প্রত্যাহার; ‘আন্দোলনকারীরা বিদেশের অনুচর’ সরকারের এই বক্তব্য প্রত্যাহার। উল্লেখ্য, এই চুক্তিপত্র যখন তৈরি হয় তখন শেখ মুজিবুর রহমানসহ বিশিষ্ট ছাত্রনেতারা জেলে। সে কারণে চুক্তিপত্রের খসড়া জেলখানাতে নিয়ে গিয়ে শেখ মুজিবুর রহমানসহ কয়েকজনের অনুমোদন করিয়ে আনা হয়। বঙ্গবন্ধু ছাত্রজীবন থেকে এতোটাই প্রভাব সৃষ্টিকারী ব্যক্তিত্বে পরিণত হয়েছিলেন যে, জেলে থাকলেও তাকে না দেখিয়ে কোনো কাজ করার ক্ষেত্রে ছাত্রনেতৃবৃন্দ একমত হতেন না। এই চুক্তির পরিপ্রেক্ষিতে অবশেষে ১৫ মার্চ বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান জেল থেকে মুক্তিলাভ করেন।

‘অসমাপ্ত আত্মজীবনী’তে এ প্রসঙ্গে বঙ্গবন্ধু লিখেছেন যে, ১১ মার্চ তাদের জেলে নেওয়া হয়েছিল, আর ১৫ তারিখ সন্ধ্যায় মুক্তি দেওয়া হয়। জেলগেট থেকে শোভাযাত্রা করে তাদের সলিমুল্লাহ মুসলিম হলে নিয়ে যাওয়া হয়েছিল। বন্দি ছাত্রদের মুক্তি দেয়া হলেও রাষ্ট্রভাষা বাংলার দাবিতে বিক্ষোভ অব্যাহত থাকে এবং জেল থেকে মুক্তি পাবার পর দিনই বঙ্গবন্ধু এই বিক্ষোভে শামিল হন। শুধু শামিল নয়, বিক্ষুব্ধ ছাত্রদের সমাবেশে তাকে সভাপতিত্ব করতে হয়। এই সভাপতিত্বের ব্যাপারটি পূর্বনির্ধারিত ছিল না। এর আগে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ঐতিহাসিক বটতলায় কোনো সভাতে সভাপতিত্বও করেননি বঙ্গবন্ধু। কিন্তু বিক্ষুব্ধ ছাত্রসমাজ সে সময় বঙ্গবন্ধুর ওপরই নেতৃত্ব প্রদান করে। তাই ১৬ মার্চ অনুষ্ঠিত স্বতঃস্ফূর্ত বিক্ষোভ সমাবেশে সভাপতিত্ব করেন বঙ্গবন্ধু। সেখানে তিনি আন্দোলনের জন্য কিছু দিকনির্দেশনাও ঘোষণা দেন। বিক্ষোভ সমাবেশ থেকে শোভাযাত্রা নিয়ে পরিষদ ভবনের দিকে গমন এবং সেখানে দাবিনামা উত্থাপন করে আবার ফিরে আসা- এই ছিল বঙ্গবন্ধুর সিদ্ধান্ত। কিন্তু এই বিক্ষুব্ধ ছাত্রদের ওপর পুলিশ লাঠিচার্জ করে এবং বঙ্গবন্ধুও কাঁদানে গ্যাসের শিকার হন। রাষ্ট্রভাষা বাংলার জন্য আন্দোলন ঢাকা থেকে সারা দেশে তখনই ছড়িয়ে যায়। কিন্তু পাকিস্তানিরা এই আন্দোলনকে হিন্দু, কমিউনিস্ট ও ভারতের আন্দোলন বলে প্রপাগান্ডা চালায়। তারা বলে, ভারত থেকে হিন্দু ও কমিউনিস্টরা পাকিস্তানে এসে পাজামা-পাঞ্জাবি পরে এই আন্দোলন করছিল। বঙ্গবন্ধু লিখেছেন, এটি জনগণকে বিভ্রান্ত করতে পাকিস্তানিদের কূটচাল। বাংলা কেন পাকিস্তানের একমাত্র রাষ্ট্রভাষা হওয়া উচিত এ প্রসঙ্গে বঙ্গবন্ধু নিজস্ব ভাবনা ব্যক্ত করেছেন অত্যন্ত স্পষ্টভাবে। তার বক্তব্য:

‘‘বাংলা পাকিস্তানের শতকরা ছাপান্ন ভাগ লোকের মাতৃভাষা। তাই বাংলাই একমাত্র রাষ্ট্রভাষা হওয়া উচিত। তবুও আমরা বাংলা ও উর্দু দুইটা রাষ্ট্রভাষা করার দাবি করেছিলাম। পাঞ্জাবের লোকেরা পাঞ্জাবি ভাষা বলে, সিন্ধুর লোকেরা সিন্ধি ভাষায় কথা বলে, সীমান্ত প্রদেশের লোকেরা পাশতু ভাষায় কথা বলে, বেলুচরা বেলুচ ভাষায় কথা বলে। উর্দু পাকিস্তানের কোনো প্রদেশের ভাষা নয়, তবুও যদি পশ্চিম পাকিস্তানের ভায়েরা উর্দু ভাষার জন্য দাবি করে, আমরা আপত্তি করব কেন? যারা উর্দু ভাষা সমর্থন করে তাদের একমাত্র যুক্তি হলো উর্দু ‘ইসলামিক ভাষা’। উর্দু কি করে যে ইসলামিক ভাষা হলো আমরা বুঝতে পারলাম না।’’ (রহমান, ২০১২ : ৯৮)

তারপরও বঙ্গবন্ধু বাংলার একক মর্যাদা দাবি করেননি, করেছেন উর্দুর সঙ্গে সমমর্যাদা।

১৯৪৮ সালের ১৭ মার্চ পূর্বদিনের প্রতিক্রিয়ায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়সহ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ধর্মঘট পালিত হয়। বিকেলে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় বটতলায় পূর্বপাকিস্তান মুসলিম ছাত্রলীগের আহ্বানে নঈমুদ্দিন আহমদের সভাপতিত্বে এক সভা অনুষ্ঠিত হয়। সে সভাতেও ছাত্রনেতা শেখ মুজিবুর রহমান অংশগ্রহণ ও বক্তব্য প্রদান করেন। তবে এই অভূতপূর্ব ধর্মঘট পালনের জন্য নেতৃবৃন্দের কঠোর পরিশ্রম করতে হয়। ছাত্রনেতা শেখ মুজিবুর রহমানসহ তাজউদ্দীন আহমদ, শামসুল হক, মোহাম্মদ তোয়াহা, নঈমুদ্দিন আহমদ, শওকত আলী, আবদুল মতিন প্রমুখ নেতার কঠোর পরিশ্রম ও সাধনার ফলে রাষ্ট্রভাষা বাংলার আন্দোলন সমগ্র পূর্ববাংলা বাঙালির আত্মার আন্দোলন হিসেবে ছড়িয়ে পড়ে। জনসভা, মিছিল আর স্লোগানে সারা দেশ কেঁপে ওঠে; রাস্তা, দেয়াল, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান পোস্টারে ছেয়ে যায়। তাতে লেখা থাকে: ‘রাষ্ট্র ভাষা বাংলা চাই’। এই দাবি আদায়ের জন্য ভাষা সংগ্রাম কমিটি অক্লান্তভাবে কাজ করে যায় এবং এই ভাষা সংগ্রাম কমিটির সঙ্গে ওতপ্রোত সম্পর্কে যারা নিরলস কাজ করেছেন সেসব ছাত্রনেতার মধ্যে শেখ মুজিবুর রহমান ছিলেন সর্বাগ্রে। তার ভূমিকা ও সাহস ছিল স্মরণে রাখার মতো।

১৯ মার্চ মোহম্মদ আলি জিন্নাহ ঢাকায় এসে ২১ মার্চ ঢাকা ঘোড়দৌড় মাঠে (রেসকোর্স ময়দান) এক ভাষণে উর্দুকে পাকিস্তানের একমাত্র রাষ্ট্রভাষা করার প্রত্যয় ব্যক্ত করেন। বঙ্গবন্ধুসহ চার-পাঁচশ ছাত্র সেই সমাবেশে একত্রে বসেছিলেন। ছাত্ররা ধ্বনি ও হাত তুলে জিন্নাহর এই প্রত্যয়ের বিপক্ষে জানিয়ে দেয়: ‘মানি না’। এরই প্রতিধ্বনি পাওয়া যায় ২৪ মার্চ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাবর্তনের সময় জিন্নাহর বক্তব্যের সরাসরি বিরোধিতা। ২১ মার্চের প্রতিবাদ থেকেই ২৪ মার্চের প্রতিবাদের সাহস সঞ্চয়। ১৯৫২ খ্রিস্টাব্দের ভাষা আন্দোলনের ভিত তৈরিতে এভাবেই বঙ্গবন্ধু সক্রিয় ভূমিকা নিয়েছিলেন। মোহম্মদ আলি জিন্নাহ ঢাকা ত্যাগ করার পর ছাত্রসমাজের মধ্যে রাষ্ট্রভাষার প্রশ্নে খানিকটা দ্বিধার জন্ম যে হয়েছিল, তা স্বীকার না করে উপায় নেই। কেননা, পূর্ব ও পশ্চিম উভয় পাকিস্তানেই জিন্নাহর গ্রহণযোগ্য ভাবমূর্তি ছিল। জিন্নাহর মুখ দিয়ে একমাত্র রাষ্ট্রভাষা উর্দুর পক্ষে বক্তব্য এলে অনেক বাঙালি ছাত্রনেতা পর্যন্ত দ্বিধান্বিত হয়ে পড়েন। ছাত্রসমাজের এই দ্বিধাকালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ফজলুল হক মুসলিম হলে জিন্নাহর অবস্থানকে সমর্থন করার জন্য কেউ কেউ বক্তব্যও রাখেন। কিন্তু এখানেই আবার বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বের দূরদর্শিতা লক্ষ করা যায়। ছাত্রসমাজের এই দ্বিধাকালে দ্ব্যর্থহীনভাবে বঙ্গবন্ধু বলেন, নেতা অন্যায় করলেও ন্যায়ের স্বার্থে তার প্রতিবাদ করতে হবে। এ প্রসঙ্গে বঙ্গবন্ধু লেখেন: “আজও আমার একটা কথা মনে অছে। আমি বলেছিলাম, ‘কোন নেতা যদি অন্যায় কাজ করতে বলেন, তার প্রতিবাদ করা এবং তাকে বুঝিয়ে বলার অধিকার জনগণের আছে। যেমন, হজরত ওমরকে (রা.) সাধারণ নাগরিকরা প্রশ্ন করেছিলেন, তিনি বড় জামা পরেছিলেন বলে। বাংলা ভাষা শতকরা ছাপ্পান্ন জন লোকের মাতৃভাষা, পাকিস্তান গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র, সংখ্যগুরুদের দাবি মানতেই হবে। রাষ্ট্রভাষা বাংলা না হওয়া পর্যন্ত আমরা সংগ্রাম চালিয়ে যাব। তাতে যাই হোক না কেন, আমরা প্রস্তুত আছি।”

সাধারণ ছাত্ররা আমাকে সমর্থন করল। এরপর পূর্বপাকিস্তানের ছাত্র ও যুবকরা ভাষার দাবি নিয়ে সভা ও শোভাযাত্রা করে চলল। দিন দিন জনমত সৃষ্টি হতে লাগল। কয়েক মাসের মধ্যে দেখা গেল, নিখিল পূর্বপাকিস্তান মুসলিম ছাত্রলীগের কোনো সমর্থক রইল না। কিছু নেতা রইল, যাদের মন্ত্রীদের বাড়ি ঘোরাফেরা করা আর সরকারের সকল কিছুই সমর্থন করা ছাড়া কাজ ছিল না।” (রহমান, ২০১২ : ১০০)

ছাত্রসভায় রাষ্ট্রভাষা বাংলার প্রশ্নে বঙ্গবন্ধুর এই দ্ব্যর্থহীন অবস্থানের কারণে ছাত্রসমাজের দ্বিধাও কেটে যায় এবং সরকারের অবস্থান সমর্থনকারী ছাত্রসংগঠনের অবস্থাও দুর্বল হয়ে পড়ে। যথাসময়ে বঙ্গবন্ধু সঠিক পথনির্দেশ করতে পেরেছিলেন বলেই রাষ্ট্রভাষা বাংলার পক্ষে বিক্ষোভ ধীরে ধীরে আন্দোলনে রূপলাভ করে। আসলে বলা চলে, ১৯৪৮ খ্রিস্টাব্দের মার্চ মাসে রাষ্ট্রভাষা আন্দোলনের প্রথমপর্যায় শেষ হয়।

এ সময় বঙ্গবন্ধু বাঙালির রাজনৈতিক দল গঠনে তৎপর হন। আসলে ‘নিখিল পূর্ব পাকিস্তান মুসলিম ছাত্রলীগে’র ভূমিকা ছিল প্রতিক্রিয়াশীল। বঙ্গবন্ধু এই ব্যাপারটি ভালো করে ছাত্রসমাজে ব্যাখ্যা করতে পেরেছিলেন। তাই ছাত্রদের মধ্যে সমর্থন হারিয়ে ফেলে এই ছাত্রসংগঠনটি। দেশ ও ছাত্রদের স্বার্থে সঠিক পথে আন্দোলন পরিচালনার জন্য ‘পূর্ব পাকিস্তান মুসলিম ছাত্রলীগ’ নামে একটি সংগঠন প্রতিষ্ঠা করতে ১৯৪৮ সালে মার্চের প্রথম সপ্তাহে শেখ মুজিবুর রহমানসহ চৌদ্দজন ছাত্রনেতা একটি প্রচারপত্র বিলি করেন এবং সেই পরিপ্রেক্ষিতেই পূর্ব পাকিস্তানে গঠিত হয় সরকারবিরোধী প্রথম সংগঠন ‘পূর্ব পাকিস্তান মুসলিম ছাত্রলীগ’। রাষ্ট্রভাষা সংগঠনে এই ছাত্রসংগঠনের ভূমিকা গুরুত্বপূর্ণ।

১৯৪৯ সালের ডিসেম্বরে বঙ্গবন্ধুকে পাকিস্তান সরকার গ্রেপ্তার করে বিনাবিচারে আটকে রাখে। এদিকে ১৯৫১ সালের অক্টোবর মাসে পাকিস্তানের রাজনীতিতে হত্যা-পাল্টা হত্যার মাধ্যমে প্রধানমন্ত্রীর পদে আসীন হন পূর্ব বাংলার এককালীন মুখ্যমন্ত্রী খাজা নাজিমুদ্দিন। ১৯৫২ সালের ২৭ জানুয়ারি তিনি ঢাকার পল্টন ময়দানে একটি বক্তৃতায় উর্দুকে একমাত্র রাষ্ট্রভাষা করার ঘোষণা দেন। অথচ, তিনিই ১৯৪৮ সালে মুখ্যমন্ত্রী থাকাকালে ছাত্রদের সঙ্গে যে আট দফা চুক্তি করেছিলেন, তাতে বাংলাকে উর্দুর সমমর্যাদা প্রদান করা হবে বলে অঙ্গীকার ছিল। যারা লেখেন, এ সময় বঙ্গবন্ধু জেলে ছিলেন এবং ভাষা আন্দোলনে তার উপস্থিতি নেই। যারা এগুলো লেখেন, তারা প্রকৃত ইতিহাস হয় জানেন না অথবা জেনে গোপন করেন। বঙ্গবন্ধু রাষ্ট্রভাষা আন্দোলনেরও স্থপতি। এই আন্দোলন কীভাবে, কারা আরম্ভ করবে, জেলে বসে তার নিজের করণীয় কী হবে এসব তিনি আগেই ভেবেছেন এবং অনুসারীদের দিয়ে সে অনুসারে কাজ করিয়েছেন। ভাষাসৈনিক গাজিউল হক এ প্রসঙ্গে স্পষ্টতই লিখেছেন-

“১৯৪৯ সালের অক্টোবর মাসে গ্রেপ্তার হওয়ার পর জনাব শেখ মুজিবুর রহমান ১৯৫২ সালের ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত বিভিন্ন জেলে আটক ছিলেন। ফলে স্বাভাবিক কারণেই ’৫২ সালে ভাষা আন্দোলনে সক্রিয়ভাবে অংশগ্রহণ করা জনাব শেখ মুজিবুর রহমানের পক্ষে সম্ভব ছিল না। তবে জেলে থেকেই তিনি আন্দোলনের নেতৃবৃন্দের সঙ্গে যোগাযোগ রক্ষা করে চলতেন এবং বিভিন্ন বিষয়ে পরামর্শ দিতেন।’ (আজিজ, ১৯৯২ : ১৭)

আবদুল গাফফার চৌধুরীও ‘একুশকে নিয়ে কিছু স্মৃতি, কিছু কথা’ প্রবন্ধে লিখেছেন,

“শেখ মুজিব ১৯৫২ সালের ফেব্রুয়ারি মাসের ১৬ তারিখ ফরিদপুর জেলে যাওয়ার আগে ও পরে ছাত্রলীগের একাধিক নেতার কাছে চিরকুট পাঠিয়েছেন।” (আজিজ, ১৯৯২ : ২১)

এই চিরকুটে ছিল আন্দোলন সম্পর্কে দিকনির্দেশনা। এ ব্যাপারে ‘অসমাপ্ত আত্মজীবনী’তে বঙ্গবন্ধু নিজে সব প্রকাশ করে গেছেন। আসলে, ১৯৫২ সালের ২৭ জানুয়ারির পর রাষ্ট্রভাষা আন্দোলনের দ্বিতীয় পর্যায় আরম্ভ হয় এবং আরম্ভকারীদের মধ্যে অন্যতম প্রধান ছিলেন শেখ মুজিবুর রহমান। প্রধানমন্ত্রী খাজা নাজিমুদ্দিনের পল্টন-ঘোষণার পর জেল-হাসপাতালে বন্দি শেখ মুজিবুর রহমানের তাৎক্ষণিক প্রতিক্রিয়া ছিল এমন: যে ঢাকায় বসে খাজা নাজিমুদ্দিন ওয়াদা করেছিলেন সেই ঢাকায় বসেই উল্টো বললেন। জেল-হাসপাতালে সন্ধ্যায় মোহাম্মদ তোয়াহা ও অলি আহাদ বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে দেখা করতে এলে, তারাসহ বঙ্গবন্ধু ছাত্রলীগের আরও নেতা নিয়ে রাত একটায় জেল-হাসপাতালের গোপনীয় স্থানে সভা করেন। এই সভা করাটি ছিল খুবই ঝুঁকিপূর্ণ। কারণ, আই.বি’র লোকজন, পুলিশের সদস্য, গোয়েন্দা কর্মচারী আর সাধারণ ডাক্তার-নার্স- এতো সংস্থা ও লোকের চোখ এড়িয়ে মধ্যরাতের এই সভাটি আহ্বান করা একজন বন্দির জন্য স্বাভাবিককর্ম ছিল না। বঙ্গবন্ধু সেই ঝুঁকি নিয়েছিলেন এবং সে রাতের অনানুষ্ঠানিক সভায় যে পরিকল্পনা গৃহীত হয়েছিল সেই পরিকল্পনা অনুসারেই পরে রাষ্ট্রভাষা আন্দোলনের পথ সূচিত হয়েছে। এই সভা সম্পর্কে বঙ্গবন্ধু লিখেছেন-

“বারান্দায় বসে আলাপ হলো এবং আমি বললাম, সর্বদলীয় সংগ্রাম পরিষদ গঠন করতে। আওয়ামী লীগ নেতাদেরও খবর দিয়েছি। ছাত্রলীগই তখন ছাত্রদের মধ্যে একমাত্র জনপ্রিয় প্রতিষ্ঠান। ছাত্রলীগ নেতারা রাজি হল। অলি আহাদ ও তোয়াহা বলল, যুবলীগও রাজি হবে। আবার ষড়যন্ত্র চলছে বাংলা ভাষার দাবিকে নস্যাৎ করার। এখন প্রতিবাদ না করলে কেন্দ্রীয় আইনসভায় মুসলিম লীগ উর্দুর পক্ষে প্রস্তাব পাস করে নেবে। নাজিমুদ্দীন সাহেব উর্দুকে একমাত্র রাষ্ট্রভাষা করার কথাই বলেন নাই, অনেক নতুন নতুন যুক্তিতর্ক দেখিয়েছে। অলি আহাদ যদিও আওয়ামী লীগ ও ছাত্রলীগের সদস্য হয় নাই, তবুও আমাকে ব্যক্তিগতভাবে খুবই শ্রদ্ধা করত ও ভালবাসত। আরও বললাম, ‘খবর পেয়েছি, আমাকে শীঘ্রই আবার জেলে পাঠিয়ে দিবে, কারণ আমি নাকি হাসপাতালে বসে রাজনীতি করছি। তোমরা আগামীকাল রাতেও আবার এস।’ আরো দুএকজন ছাত্রলীগ নেতাকে আসতে বললাম। শওকত মিয়া ও কয়েকজন আওয়ামী লীগ কর্মীকেও দেখা করতে বললাম। পরের দিন রাতে এক এক করে অনেকেই আসল। সেখানেই ঠিক হল আগামী ২১শে ফেব্রুয়ারি রাষ্ট্রভাষা দিবস পালন করা হবে এবং সভা করে সংগ্রাম পরিষদ গঠন করতে হবে। ছাত্রলীগের পক্ষ থেকেই রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদের কনভেনর করতে হবে। ফেব্রুয়ারি থেকেই জনমত সৃষ্টি করা শুরু হবে। আমি [বঙ্গবন্ধু] আরও বললাম, ‘আমিও আমার মুক্তির দাবি করে ১৬ই ফেব্রুয়ারি থেকে অনশন ধর্মঘট শুরু করব।” (রহমান, ২০১২ : ১৯৬-৯৭)

বঙ্গবন্ধুর এই পরিকল্পনা অনুসারে তার সুপরিচিত কাজী গোলাম মাহবুবকে আহ্বায়ক মনোনীত করে ৩১ জানুয়ারি সর্বদলীয় রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদ গঠন করা হয়। এর মধ্য দিয়ে ১৯৪৮ সালে যে আন্দোলন শুধু ছাত্ররা করে আসছিল তাতে সর্বমহল যুক্ত হয়, এতে রাজনীতিবিদগণ আসার সুযোগ পান। সর্বদলীয় সংগ্রাম পরিষদের সভায় পূর্ববাংলা আইনসভার অধিবেশন আহ্বানের দিন অর্থাৎ ২১ ফেব্রুয়ারি হরতাল আহ্বান করা হয়। অল্প কয়েক দিনের মধ্যে এই আন্দোলনের ডাকের প্রতি জনসমর্থন বৃদ্ধি পায় অনেক গুণে। বঙ্গবন্ধু পরিকল্পনা অনুসারে জেল কর্তৃপক্ষকে চিঠি দেন যে, তাকে বিনাবিচারে আটক রাখা হয়েছে। হয় তাকে মুক্তি দেয়া হবে, তা না হলে ১৬ ফেব্রুয়ারি থেকে তিনি অনশনের মাধ্যমে দেহত্যাগ করে জেলমুক্ত হবেন। এই গোপন সভার সংবাদ নিশ্চয়ই কর্তৃপক্ষের গোচরে আসে এবং সে কারণেই সম্ভবত বঙ্গবন্ধুকে ফরিদপুর জেলে দ্রুত স্থানান্তর করা হয়। ঢাকা থেকে ফরিদপুরে আসার সময় ঢাকা-নারায়ণগঞ্জের পথে পুলিশের চোখ ফাঁকি দিয়ে একটি হোটেলে আবার গোপন রাজনৈতিক বৈঠক করেন বঙ্গবন্ধু নারায়ণগঞ্জের নেতাদের সঙ্গে। বঙ্গবন্ধু লিখেছেন-

‘‘আমরা আস্তে আস্তে খাওয়া-দাওয়া করলাম, আলাপ-আলোচনা করলাম। ভাসানী সাহেব, হক সাহেব ও অন্যান্য নেতাদের খবর দিতে বললাম। খবরের কাগজে যদি দিতে পারে চেষ্টা করব। বললাম, সাপ্তাহিক ‘ইত্তেফাক’ তো আছেই। আমরা যে আগামীকাল থেকে অনশন শুরু করব, সেকথাও তাদের বললাম, যদিও তারা পূর্বেই খবর পেয়েছিল। [...] তারা আমাকে বলল, ‘২১শে ফেব্রুয়ারি তারিখে নারায়ণগঞ্জে পূর্ণ হরতাল হবে। রাষ্ট্রভাষা বাংলার দাবি তো আছেই, আপনাদের মুক্তির দাবিও আমরা করব।” (রহমান, ২০১২ : ২০০)

এভাবেই রাষ্ট্রভাষা আন্দোলন সংগঠিত ও বিভিন্ন স্থানে বিস্তারে বঙ্গবন্ধু জেলবন্দি থাকার পরও নেতৃত্ব দিয়েছেন।

ফরিদপুর জেলে এসে বঙ্গবন্ধু ও মহিউদ্দিন আহমেদ পূর্বসিদ্ধান্ত অনুসারে অনশন আরম্ভ করেন এবং ২১ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত তারা শারীরিকভাবে অনেকটাই দুর্বল হয়ে যান। বঙ্গবন্ধু অনশনরত অবস্থায় জেলে বসেই কর্তব্যরত পুলিশদের কাছে সংবাদ পান ঢাকায় ১৪৪ ধারা ভঙ্গ করা হয়েছে, ২১ ফেব্রুয়ারিতে ঢাকায় গুলি হয়েছে, ছাত্ররা শহিদ হয়েছে, রাষ্ট্রভাষা বাংলা ও বঙ্গবন্ধুর মুক্তি চেয়ে ফরিদপুরে মিছিল হয়েছে ইত্যাদি। এই সংবাদ শারীরিক দুর্বলতা সত্ত্বেও বঙ্গবন্ধুর মনে প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি করে, বিশেষ করে ছাত্রহত্যার ব্যাপারটি। বঙ্গবন্ধু লিখেছেন-

“খুব খারাপ লাগছিল, মনে হচ্ছিল চিন্তাশক্তি হারিয়ে ফেলেছি। গুলি করার তো কোন দরকার ছিল না। হরতাল করবে, সভা ও শোভাযাত্রা করবে, কেউ তো বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি করতে চায় না। কোনো গোলমাল সৃষ্টি করার কথা তো কেউ চিন্তা করে নাই। ১৪৪ ধারা দিলেই গোলমাল হয়, না দিলে গোলমাল হওয়ার সম্ভাবনা কম থাকে। অনেক রাতে একজন সিপাহি এসে বলল, ছাত্র মারা গেছে অনেক। বহু লোক গ্রেপ্তার হয়েছে। রাতে আর কোন খবর নাই। ঘুম তো এমনিই হয় না, তারপর আবার এই খবর।” (রহমান, ২০১২ : ২০৩)

অর্থাৎ বঙ্গবন্ধু জেলবন্দি থাকলেও তার মন ছিল আন্দোলনে, তার চিন্তা ছিল আন্দোলনকারীদের ঘিরে। অনশন করার কারণে শারীরিকভাবে দুর্বল বঙ্গবন্ধু এরই মধ্যে প্রত্যয় গ্রহণ করেন যে, বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা না করে ঘরে ফেরার আর উপায় নেই। বঙ্গবন্ধুর প্রত্যয় ব্যক্ত হয়েছে এভাবে-

“গুলি হল মেডিকেল কলেজ হোস্টেলের এরিয়ার ভেতরে, রাস্তায়ও নয়। ১৪৪ ধারা ভঙ্গ করলেও গুলি না করে গ্রেপ্তার করলেই তো চলত। আমি [বঙ্গবন্ধু] ভাবলাম, দেখব কি না জানি না, তবে রক্ত যখন আমাদের ছেলেরা দিয়েছে তখন বাংলা ভাষাকে রাষ্ট্রভাষা না করে আর উপায় নাই।” (রহমান, ২০১২ : ২০৪)

অনশনে বঙ্গবন্ধুর শরীরের এমন অবনতি হয়েছিল যে, ডাক্তারেরা পর্যন্ত আতঙ্কিত হয়েছিলেন। অবশেষে ২৮ ফেব্রুয়ারি তিনি জেল থেকে মুক্ত হয়ে বের হন।

ভাষা আন্দোলনের প্রবল স্রোত পাঁচ বছরের শিশু শেখ হাসিনা পর্যন্ত পৌঁছেছিল। তাই জেল থেকে মুক্তি পেয়ে পাঁচ দিন পর বঙ্গবন্ধু যখন গোপালগঞ্জের বাড়িতে পৌঁছেন, শিশু শেখ হাসিনা বঙ্গবন্ধুর গলা আদরে জাপটে ধরে রাষ্ট্রভাষা বাংলা আর রাজবন্দিদের মুক্তি চেয়ে স্লোগান দেন। সেই স্মৃতি বঙ্গবন্ধু ভুলতে পারেননি। তিনি লিখেছেন-

‘‘পাঁচ দিন পর বাড়ি পৌঁছালাম। মাকে তো বোঝানো কষ্টকর। হাচু আমার গলা ধরে প্রথমেই বলল, ‘আব্বা, রাষ্ট্রভাষা বাংলা চাই, রাজবন্দিদের মুক্তি চাই। ২১শে ফেব্রুয়ারি ওরা ঢাকায় ছিল, যা শুনেছে তাই বলে চলেছে।” (রহমান, ২০১২ : ২০৭)

এ থেকে বোঝা যায়, ঢাকায় রাষ্ট্রভাষা আন্দোলন কতোটা তীব্র হয়েছিল এবং শেখ হাসিনার মধ্যে শৈশব থেকেই রাজনীতি কতটুকু আকর্ষণের বিষয় হয়ে উঠেছিল। পরে দেখা যাবে শেখ হাসিনা ছাত্ররাজনীতিতে যুক্ত হয়েছেন এবং আরও পরে জাতীয় রাজনীতিতে। তাই একথা বলাই চলে, বঙ্গবন্ধু রাষ্ট্রভাষা আন্দোলনের অন্যতম স্থপতি, আর শেখ হাসিনার রাজনীতিতে প্রবেশের সূচনাদ্বার হলো রাষ্ট্রভাষা আন্দোলন। মাত্র পাঁচ বছর বয়সে এই আন্দোলন শেখ হাসিনার মনে দাগ কেটেছিল। বঙ্গবন্ধু সে সময় গোপালগঞ্জের সাধারণ মানুষের সঙ্গে আলাপ করে জেনেছেন, গ্রামের মানুষেরাও ঢাকা শহরে গুলিবিদ্ধ হয়ে ছাত্র শহিদ হওয়ার কথা জানে এবং তারা পাকিস্তানি শাসকদের ওপর বিক্ষুব্ধ হয়ে আছে। জনগণের এই বিক্ষুব্ধতাকে তাদের শোষণমুক্তির আন্দোলনের সঙ্গে পরে যুক্ত করেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান।

রাষ্ট্রভাষা আন্দোলনের অব্যবহতি পরে বঙ্গবন্ধুর একটি গুরুত্বপূর্ণ কাজ হলো রাষ্ট্রভাষা বাংলার পক্ষে হোসেন শহিদ সোহরাওয়ার্দীর সমর্থন আদায় ও তা প্রকাশ-প্রচার করা। ইতিপূর্বে সোহরাওয়ার্দীর নামে মুসলিম লীগ সরকার পত্রিকান্তরে সংবাদ প্রকাশ করিয়েছে যে, সোহরাওয়ার্দী উর্দুকেই একমাত্র রাষ্ট্রভাষা করার কথা বলেছেন। এ সময় সোহরাওয়ার্দী দীর্ঘদিন করাচিতে অবস্থান করছিলেন। বঙ্গবন্ধু তাই করাচিতে যান এবং তার সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন। রাষ্ট্রভাষা আন্দোলনের অগ্রগতির ক্ষেত্রে বঙ্গবন্ধুর এই করাচি সফর খুবই তাৎপর্যপূর্ণ। কারণ, সোহরাওয়ার্দী উর্দুকে একমাত্র রাষ্ট্রভাষা করার পক্ষে- এই বার্তাটি যে বিপুলসংখ্যক বাঙালি সোহরাওয়ার্দীকে অন্ধভাবে সমর্থন করতো তাদের দ্বিধায় ফেলে দেয়। বঙ্গবন্ধুর করাচি সফরের কারণে সোহরাওয়ার্দীর মত সর্বাংশে বাংলা ও উর্দুর দিকে আসে এবং বাঙালির সংগ্রাম অনুকূল বাতাস পায়। এ প্রসঙ্গে বঙ্গবন্ধু রচিত গ্রন্থে আছে-

“আমি [বঙ্গবন্ধু] আর একটা অনুরোধ করলাম, তাঁকে [হোসেন শহিদ সোহরাওয়ার্দী] লিখে দিতে হবে যে, উর্দু ও বাংলা দুইটাকেই রাষ্ট্রভাষা হিসাবে তিনি সমর্থন করেন। কারণ অনেক ভুল বোঝাবুঝি হয়ে গেছে। মুসলিম লীগ এবং তথাকথিত প্রগতিবাদীরা প্রপাগান্ডা করছেন তাঁর [হোসেন শহিদ সোহরাওয়ার্দী] বিরুদ্ধে। তিনি [হোসেন শহিদ সোহরাওয়ার্দী] বললেন, ‘নিশ্চয়ই লিখে দেব, এটা তো আমার নীতি ও বিশ্বাস।’ তিনি লিখে দিলেন।” (রহমান, ২০১২ : ২১৬)

এই বক্তব্যটি পরে পূর্ববাংলার বিভিন্ন পত্রিকায় প্রকাশ পায়। পশ্চিম পাকিস্তানে শাসকগোষ্ঠী সেসময় মিথ্যে প্রচার করেছিল যে, বাঙালিরা শুধু বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা করতে আন্দোলন করছে। করাচিতেই সাংবাদিক সম্মেলনের মাধ্যমে ও বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের নেতৃবৃন্দ মারফত বঙ্গবন্ধু পশ্চিম পাকিস্তানিদের কাছে সত্য তুলে ধরেন। এটি যে শাসকদের মিথ্যে প্রচারণা সে কথাও বলেন বঙ্গবন্ধু। এই সংবাদ সম্মেলন সম্পর্কে বঙ্গবন্ধু লেখেন-

“খাজা সাহেব ও লাহোরের শহীদ সাহেবের ভক্তরা প্রেস কনফারেন্সের আয়োজন করলেন। প্রেস কনফারেন্সে সমস্ত দৈনিক কাগজের প্রতিনিধিরা উপস্থিত ছিলেন। এমনকি এপিপি’র প্রতিনিধিও উপস্থিত ছিলেন। আমার বক্তব্য পেশ করার পরে আমাকে প্রশ্ন করতে শুরু করলেন, আমি তাঁদের প্রশ্নের সন্তোষজনক উত্তর দিতে পেরেছিলাম। আমরা যে উর্দু ও বাংলা দু’টাই রাষ্ট্রভাষা চাই, এ ধারণা তাঁদের ছিল না। তাঁদের বলা হয়েছে, শুধু বাংলাকেই রাষ্ট্রভাষা করার দাবি করছি আমরা।” (রহমান, ২০১২ : ২১৭)

বঙ্গবন্ধুর এই করাচি সফরের মাধ্যমে রাষ্ট্রভাষা আন্দোলন সঠিক গতিপ্রাপ্ত হয় ও সাধারণ বাঙালি বিভ্রান্তি থেকে মুক্তি পায়।

১৯৫২ সালের অক্টোবরে চীন দেশে অনুষ্ঠিত শান্তি সম্মেলনে পাকিস্তানের ৩০ প্রতিনিধির একজন হিসেবে বঙ্গবন্ধু অংশগ্রহণ করেন। পূর্ববাংলা থেকে গিয়েছিলেন পাঁচ জন। কিন্তু একমাত্র বঙ্গবন্ধুই বাংলায় বক্তৃতা করার সাহস দেখান। এতে বাংলা ভাষার আন্তর্জাতিক পরিচিতি বাড়ে এবং এটি ছিল পাকিস্তানি শাসকদের বিরুদ্ধে প্রতিবাদও। কারণ, সরকারি ব্যবস্থাপনায় বিদেশে গিয়ে বাংলার অস্তিত্বকে ঊর্ধ্বে তুলে ধরা, কম কথা নয়! ‘অসমাপ্ত আত্মজীবনী’তে বঙ্গবন্ধু এ প্রসঙ্গে লিখেছেন-

“পূর্ব পাকিস্তান থেকে আতাউর রহমান খান ও আমি বক্তৃতা করলাম। আমি বাংলায় বক্তৃতা করলাম। আতাউর রহমান সাহেব ইংরেজি করে দিলেন। ইংরেজি থেকে চীনা, রুশ ও স্পেনিশ ভাষায় প্রতিনিধিরা শুনবেন। কেন বাংলায় বক্তৃতা করব না? ভারত থেকে মনোজ বসু বাংলায় বক্তৃতা করলেন। পূর্ব বাংলার ছাত্ররা জীবন দিয়েছে মাতৃভাষার জন্য। বাংলা পাকিস্তানের সংখ্যাগুরু লোকের ভাষা। কবিগুরু রবীন্দ্রনাথকে না জানে এমন শিক্ষিত লোক চীন কেন দুনিয়ায় অন্যান্য দেশেও আমি কম দেখেছি। আমি ইংরেজিতে বক্তৃতা করতে পারি। তবু আমার মাতৃভাষায় বলা কর্তব্য।”

কেন কর্তব্য? এর উত্তর আছে বঙ্গবন্ধুর অন্য বইয়ে। তিনি নিজেই বলেছেন, স্বদেশের ভাষা নিয়ে পৃথিবীর সব দেশের মানুষই গর্ববোধ করে; ইংরেজিতে ভাষণ দিয়ে গর্বের কিছু নেই বলে তিনি লিখেছেন। একই সঙ্গে তিনি এটাও লিখেছেন, বাঙালির রাষ্ট্রভাষা আন্দোলনের কথা যেহেতু বিশ্বের মানুষ জানে, সেহেতু বাংলাতেই বক্তৃতা দেওয়া উচিত। বাংলায় বক্তৃতা দেওয়াটা তার পূর্বপরিকল্পিত বলেই এ ব্যাপারে তিনি আতাউর রহমান খান, তফাজ্জাল হোসেন ও খোন্দকার মোহাম্মদ ইলিয়াসের সঙ্গে কী বলবেন তা আলাপ করে নিয়েছিলেন। ‘আমার দেখা নয়াচীন’ গ্রন্থে বঙ্গবন্ধু লিখেছেন-

“বাংলা আমার মাতৃভাষা। মাতৃভাষায় বক্তৃতা করাই উচিত। কারণ পূর্ব বাংলার ভাষা আন্দোলনের কথা দুনিয়ার সকল দেশের লোকই কিছু কিছু জানে। মানিক ভাই, আতাউর রহমান খান, ও ইলিয়াস বক্তৃতাটা ঠিক করে দিয়েছিল। দুনিয়ার সকল দেশের লোকই যার যার মাতৃভাষায় বক্তৃতা করে। শুধু আমরাই ইংরেজি ভাষায় বক্তৃতা করে নিজেদের গর্বিত মনে করি।’ (রহমান, ২০২০ : ৪৩)

এ প্রসঙ্গে বঙ্গবন্ধুর একটি পর্যবেক্ষণ বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। তিনি লক্ষ করেছেন চীন দেশের অনেকে ইংরেজি ভাষা জানার পরও ইংরেজি বলে না। এমনকি নানকিং বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য স্বভাষায় বঙ্গবন্ধু ও তাদের দলকে অভ্যর্থনা করেন। দোভাষী যখন ভুলভাবে এর উপস্থাপন করেন তখন উপাচার্য ইংরেজিতে দোভাষীর ভুল শুধরে দেন। উপাচার্যের এই স্বভাষা প্রীতির ব্যাপারটি বঙ্গবন্ধুকে বেশ নাড়া দিয়েছিল। আদতে চীনে অনুষ্ঠিত আন্তর্জাতিক শান্তি সম্মেলনে তিনি বাংলা ভাষায় বক্তব্য উপস্থাপন করে পাকিস্তানের শাসকদের সামনে চ্যালেঞ্জ ছুড়ে দেন। শান্তি সম্মেলনে বঙ্গবন্ধুর দেয়া বাংলায় এই ভাষণ রাষ্ট্রভাষা আন্দোলনের পরবর্তী প্রবাহকে তীব্র করেছে নিশ্চয়। এই ভাষাপ্রীতির জন্যই স্বাধীন বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী হিসেবে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ১৯৭৪ সালের ২৫ সেপ্টেম্বর জাতিসংঘে বাংলায় ভাষণ দিয়েছিলেন।

২১ ফেব্রুয়ারির প্রথম বার্ষিকী পালনের সময় বঙ্গবন্ধু ঢাকাতেই থাকেন, নেতৃত্ব দেন মিছিলে, করেন বক্তৃতা। ১৯৫৩ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রাঙ্গণ থেকে প্রভাতফেরি বের করা হয়; কালো পতাকা বহন করা হয়; ঢাকা শহর প্রদক্ষিণও করা হয়। এই মিছিলে নেতৃত্ব দেন শেখ মুজিবুর রহমান। আর্মানিটোলা মাঠে আতাউর রহমান খানের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত সভায় আওয়ামী লীগের পক্ষে বক্তব্য দেন তিনি। এভাবেই ২১-এর চেতনার ধারাবাহিকতায় আন্দোলনে থাকেন শেখ মুজিবুর রহমান। কিন্তু এই আন্দোলন করতে গিয়ে তাকে বার বার জেলে যেতে হয়েছে। ১৯৬৭ সালের ২১ ফেব্রুয়ারিতে তিনি জেল থেকেই স্মরণ করেছেন বায়ান্নের বীর শহিদদের এবং ‘কারাগারের রোজনামচায়’ লিখেছেন, ১৯৫২ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি তিনি জেলে ছিলেন-

“আজ ঠিক পনের বৎসর পরেও এই দিনটাতে আমি কারাগারে বন্দি।” (রহমান, ২০১৭ : ২০৬)

বন্দিত্ব-আন্দোলন-সংগ্রাম ইত্যাদির পথ ধরে একুশের চেতনার মধ্য দিয়ে অবশেষে বঙ্গবন্ধু বাঙালিকে একটি স্বাধীন দেশ অর্জনের প্রেরণা ও নেতৃত্ব দিয়েছেন। রাষ্ট্রভাষা আন্দোলনকালে বঙ্গবন্ধুর উপস্থিতি আন্দোলনকে নতুন মাত্রায় নিয়ে যেতে পারতো বলে মনে করেন ভাষাসংগ্রামী গাজিউল হক। তিনি লিখেছেন-

“১৯৪৮ সালের ভাষা আন্দোলনের বলিষ্ঠ ভূমিকা ও নেতৃত্বদানের পর বাহান্নর ভাষা আন্দোলনের সময় শেখ মুজিব যদি কারাগারের বাইরে থাকতেন, তা হলে সেদিন (২০শে ফেব্রুয়ারি রাতে) সর্বদলীয় রাষ্ট্রভাষা কর্ম পরিষদের পক্ষে হরতাল প্রত্যাহার সংক্রান্ত সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা সম্ভবপর হতো না বলে বিশ্বাস করার যথেষ্ট কারণ রয়েছে।” (আজিজ, ১৯৯২ : ১৪)

অর্থাৎ রাষ্ট্রভাষা আন্দোলনকালে কর্মসূচি ও সিদ্ধান্ত নিয়ে নেতাদের মধ্যে যে তীব্র মতবিরোধ দেখা দিয়েছিল, বঙ্গবন্ধু জেলে না থাকলে তার সঠিক নেতৃত্বে এই বিরোধ সৃষ্টির অবকাশ হতো না বলেই গাজিউল হক মনে করেন। তবে, এম আর আখতার মুকুলের এই কথাই শেষ অবধি সত্য-

“১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলনের পটভূমিতে এর পরবর্তী অধ্যায়ে শুরু হলো বাঙালি সংস্কৃতির উন্মেষ আন্দোলন। প্রায় একই সময়ে দ্রুত গড়ে উঠলো স্বায়ত্তশাসন, ৬ দফা ও স্বাধিকরের আন্দোলন এবং চরম পর্যায়ে একাত্তরের রক্তক্ষয়ী মুক্তিযুদ্ধ। সবই একসূত্রে গাঁথা। কিন্তু সর্বত্রই বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের প্রচেষ্টায় সংগঠিত জাতীয়তাবাদীদের হাতে।” (মুকুল, ২০০০ : ৪৫)

১৯৭১ সালের ১৫ ফেব্রুয়ারি সৈয়দ মুর্তাজা আলির সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত বাংলা একাডেমির একুশের অনুষ্ঠানের উদ্বোধনী ভাষণে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বলেন, ‘আমি ঘোষণা করছি আমাদের হাতে যেদিন ক্ষমতা আসবে সেদিন থেকেই দেশের সর্বস্তরে বাংলা ভাষা চালু হবে। বাংলা ভাষার পণ্ডিতরা পরিভাষা তৈরি করবেন তার পরে বাংলা চালু হবে, সে হবে না। পরিভাষাবিদেরা যত খুশি গবেষণা করুন আমরা ক্ষমতা হাতে নেওয়ার সঙ্গে সঙ্গে বাংলা ভাষা চালু করে দেবো, সে বাংলা যদি ভুল হয়, তবে ভুলই চালু হবে, পরে তা সংশোধন করা হবে।’ (রহমান, ১৯৯৭ : ২৯)

বিচারপতি মুহম্মদ হাবিবুর রহমান মনে করেন, এই বক্তব্যের মধ্যে ‘স্বাধিকার প্রতিষ্ঠার একটা ডাক’ (রহমান, ১৯৯৭ : ২৯) আছে। সত্যি, মাত্র তিন সপ্তাহ পরেই (৭ মার্চ) বঙ্গবন্ধু ঘোড়দৌড় মাঠে তার ঐতিহাসিক ভাষণে সেই ডাকটি দিয়েছিলেন। এর আগেই অবশ্য বঙ্গবন্ধু একুশের কথা স্মরণ করিয়ে জনগণকে পাকিস্তানিদের ষড়যন্ত্র সম্পর্কে সজাগ থাকতে বলেছেন এবং সাহসী হতে আহ্বান জানিয়েছেন।

১৯৭১ সালের ২১ ফেব্রুয়ারির প্রথম প্রহরে শহীদমিনার পাদদেশে দেওয়া বক্তৃতায় তিনি উল্লেখ করেন, বাংলাদেশের জনসাধারণের অধিকার প্রতিষ্ঠার সংগ্রামে শাসকগোষ্ঠীর চক্রান্তের মোকাবেলায় বাঙালি যাতে কাপুরুষের মতো পিছু না হটে। কারণ, শহিদের আত্মারা ভিক্ষা চাইছে বাঙালিরা সাহসী হোক। ভাষা আন্দোলনের সময় যেসব ষড়যন্ত্রকারীরা হত্যার জন্য দায়ী ছিলেন তারা তখন পর্যন্ত সক্রিয় ছিলেন, তা স্মরণ করিয়ে তিনি বলেন, অতীতে ষড়যন্ত্র হয়েছে, বর্তমানে তা অব্যাহত রয়েছে এবং ভবিষ্যতেও ষড়যন্ত্র হবে। তিনি দৃঢ়তার সঙ্গে বলেন,“সামনে আমাদের [বাঙালির] কঠিন দিন। আমি [বঙ্গবন্ধু] আপনাদের মাঝে নাও থাকতে পারি। মানুষকে তো একদিন মরতেই হয়। আমি জানি না, আবার কবে আপনাদের সামনে দাঁড়াতে পারবো। তাই আজ আমি আপনাদের এবং সারা বাংলার মানুষকে ডেকে বলছি, চরম ত্যাগের জন্যে প্রস্তুত হোন। বাঙালি যেন আর অপমানিত-লাঞ্ছিত না হয়। শহীদদের রক্ত যেন বৃথা না যায়।” (সালাহউদ্দিন, ২০১১ : ১১৮) এভাবেই একুশের চেতনার আলোকে বঙ্গবন্ধু বাঙালিকে লড়াইয়ে আহ্বান করেছেন এবং পরবর্তী সময় দেশের নেতৃত্ব দিয়েছেন। আর তার দৃঢ় নেতৃত্বের ধারাবাহিকতায় অবশেষে স্বাধীন হয় বাংলাদেশ, ১৯৭১ সালে।

বাংলা ভাষার জন্য মমতা ও আত্মত্যাগ বঙ্গবন্ধুর কম ছিল না। তিনি ১৯৪৮ সালেই বুঝেছিলেন, পশ্চিম পাকিস্তানিরা বাংলা ভাষার প্রতি সম্মান দেখাবে না। তাই, তিনি সে সময় থেকেই আন্দোলন আরম্ভ করেন এবং তারই ধারাবাহিকতায় ধীরে ধীরে বাঙালি স্বাধিকার থেকে স্বাধীনতা আন্দোলনে পৌঁছে এবং অবশেষে তারা লাভ করে স্বাধীন বাংলাদেশ। স্বাধীন বাংলাদেশের কর্ণধার হিসেবে বিদেশের মাটিতে বঙ্গবন্ধুর মূলত তিনটি বাংলা ভাষণ বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। প্রথমটি ১৯৭২ সালের ১০ জানুয়ারি দিল্লিতে; দ্বিতীয়টি ১৯৭২ সালের ৮ ফেব্রুয়ারি কলকাতায়; তৃতীয়টি ১৯৭৪ সালের ২৫শ সেপ্টেম্বর নিউইয়র্কে। এর আগে চায়নার শান্তি সম্মেলনে বঙ্গবন্ধু বাংলায় বক্তৃতা দিয়েছিলেন। কিন্তু তখন তিনি দেশের কর্ণধার ছিলেন না।

বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর পাকিস্তানের কারাগার থেকে বীরের মতো মুক্তি পান বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। তিনি এবার তার স্বাধীন দেশে প্রত্যাবর্তন করবেন। লন্ডন ও দিল্লি হয়ে তার ঢাকায় পৌঁছার কথা। বঙ্গবন্ধুকে রাষ্ট্রপতি হিসেবে গার্ড-অব-অনার প্রদান করা হয়। তিনি সেখানে রাষ্ট্রপতির বক্তব্যের পরিপ্রেক্ষিতে প্রতি-শুভেচ্ছা বক্তব্যও প্রদান করেন। তার সম্মানে দিল্লিতে আয়োজন হয় একটি জনসভার।

স্বাধীন বাংলাদেশের কর্ণধার হিসেবে বঙ্গবন্ধুর প্রথম রাজনৈতিক ভাষণ এটি। শীতের দিনে মূলত হিন্দিভাষী দিল্লিবাসীর সম্মুখে এই ভাষণ দেবার আগে একটি অভূতপূর্ব ঘটনা ঘটে।

করাচি থেকে লন্ডন হয়ে কূটনৈতিক প্রক্রিয়া সম্পন্ন করে অবশেষে দিল্লি পৌঁছেন বঙ্গবন্ধু। ১০ জানুয়ারি তার সেই প্রত্যাবর্তন দিবসটি স্মরণীয় করতে উদ্যোগ নেয় ভারত সরকার। রাষ্ট্রপতি ভিপি গিরিকে সঙ্গে নিয়ে সরাসরি বিমানবন্দরে গিয়ে ভারতের প্রধানমন্ত্রী স্বাগত জানান বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে। বিভিন্ন রাষ্ট্রের কূটনৈতিক প্রতিনিধিদের উপস্থিত করিয়ে বিশ্ববাসীকে চমক দেন ইন্দিরা গান্ধী। স্বাধীন বাংলাদেশের অভ্যুদয় ও তার নেতাকে এভাবেই সম্মান জানায় ভারত। একটি খোলা মঞ্চ আগে থেকেই প্রস্তুত ছিল। বঙ্গবন্ধুকে স্বাগত জানিয়ে ভারতের প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী তার ভাষণ শেষ করেন। তিনি বলেন, পাকিস্তানিরা বঙ্গবন্ধুর দেহকে আটক করেছিল কিন্তু তার আত্মাকে তারা আটক করতে পারেনি। সেই আত্মাই যুদ্ধের নেতৃত্ব দিয়েছে। এরপর বঙ্গবন্ধুর পালা, তার অভিব্যক্তি তিনি প্রকাশ করবেন। মাইকের সামনে দীর্ঘদেহী বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান দাঁড়ান। দিল্লির জনসভায় উপস্থিত জনতা উল্লাসে ফেটে পড়ে। সেদিনটি ইন্দিরা গান্ধীর ছিল না, ছিল বঙ্গবন্ধুর। ইন্দিরা গান্ধী প্রধানমন্ত্রী হিসেবে মঞ্চে আছেন কিন্তু জনতার মনোযোগ তিনি ছাড়া অন্য কারো প্রতি, সম্ভবত ইন্দিরা গান্ধীর ক্ষমতায় থাকা অবস্থায় এমন ঘটনা এই একবারই ঘটেছিল। বঙ্গবন্ধু দাঁড়িয়ে ইংরেজিতে বক্তব্য শুরু করেন: ‘প্রাইম মিনিস্টার শ্রীমতী গান্ধী, লেডিস অ্যান্ড জেন্টলম্যান, প্রেজেন্ট...’, এরপরেই জনতার মধ্য থেকে প্রবল দাবি ওঠে: ‘বাংলা... বাংলা...’। থেমে যান বঙ্গবন্ধু। পাশে দাঁড়ানো ইন্দিরা গান্ধী ও অন্য নেতারা বলেন, তিনি যেন বাংলাতেই বক্তৃতা করেন। মুচকি হেসে, ঘাড় এদিক ওদিক নাড়িয়ে বঙ্গবন্ধু আরম্ভ করেন বাংলায় তার বক্তৃতা-

“আমার ভাই ও বোনোরা”। বাংলাদেশে পা রাখার আগেই বিদেশের মাটিতে রাষ্ট্রপতি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের প্রথম ভাষণ বাংলায়! এটিও ইতিহাস। ভাষণে সম্বোধনের পর তিনি সৌজন্য ও কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করে বলেন-

আপনাদের প্রধানমন্ত্রী, আপনাদের সরকার, আপনাদের সৈন্যবাহিনী, আপনাদের জনসাধারণ যে সাহায্য এবং সহানুভূতি আমার দুঃখী মানুষকে দেখিয়েছেন চিরদিন বাংলার মানুষ তা ভুলতে পারবে না। ব্যক্তিগত অবস্থানের কথা উল্লেখ করে বঙ্গবন্ধু বলেন, দুদিন আগেও তিনি পশ্চিম পকিস্তানের অন্ধকার সেলে কারারুদ্ধ ছিলেন। তিনি ভাষণে বলেন, তার মুক্তির জন্য, তাকে রক্ষার জন্য শ্রীমতী গান্ধী পৃথিবীর এমন কোনো দেশ নেই, যেখানে চেষ্টা করেননি। ব্যক্তিগতভাবে ও দেশের মানুষের পক্ষ থেকে বঙ্গবন্ধু শ্রীমতী ইন্দিরা গান্ধী, তার সরকার, ভারতের জনগণের কাছে কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করেন। ভারতের মানুষও সবাই সচ্ছল নয়, কিন্তু তারপরও এক কোটি শরণার্থীকে তারা আহার ও বাসস্থান দিয়েছে- একথা উল্লেখ করেও বঙ্গবন্ধু ধন্যবাদ ও কৃতজ্ঞতা জানান। পাশাপাশি তিনি বিশ্বের সচেতন মানুষের সাহায্য ও সমর্থন কামনা করেন স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশের জন্য। আদর্শ, নীতি, মনুষ্যত্ব, বিশ্বশান্তির কথা উল্লেখ করে তিনি ধর্মনিরপেক্ষতা, গণতন্ত্র ও সমাজতন্ত্রে আস্থাশীল বলে সেই ভাষণে জানান। এভাবে স্বাধীন দেশে পদার্পণের পূর্বকালেই বঙ্গবন্ধু বাংলাদেশ রাষ্ট্রের মৌলকাঠামো কী হবে, বিশ্বের কাছে পরিষ্কারভাবে উল্লেখ করেন। বাংলাদেশ ও ভারতের সম্পর্ক নিয়ে প্রথম থেকেই যে অপজিজ্ঞাসা শুরু হয়েছিল, বঙ্গবন্ধুর ভাষণে তা পরিষ্কার। বঙ্গবন্ধু উল্লেখ করেছেন, তাকে অনেকে জিজ্ঞেস করেন, ইন্দিরা গান্ধীর সঙ্গে তার আদর্শের এত মিল কেন? এর উত্তর তিনি দৃঢ়তা ও ব্যক্তিত্বের সঙ্গে দেন; বলেন, নীতি, মনুষ্যত্ব, বিশ্বশান্তিতে তাদের আদর্শ অভিন্ন। বাংলাদেশ ও ভারতের সম্পর্ক নিয়ে পরে যে নানা তিক্ত প্রশ্ন বিভিন্নজন তোলে, তার সূচনা যে শুরু থেকেই বঙ্গবন্ধুর ভাষণেই সে উল্লেখ আছে। ভাগ্যিস কেউ বলে না, ভারতের আকাশ, বাতাস, বৃক্ষলতার সঙ্গে বাংলাদেশের এত মিল কেন!

পশ্চিমবঙ্গের মানুষ চেয়েছিল ১৯৭২-এর জানুয়ারির ১০ তারিখেই বঙ্গবন্ধু তাদের সঙ্গে একটু দেখা দিয়ে তবে ঢাকায় যান। কিন্তু তা হয়নি। ভারতের যে রাজ্যটি বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে কাছে থেকে এত ঘনিষ্ঠভাবে সাহায্য করেছে, সেই রাজ্যের মানুষের দাবিপূরণ করার জন্য বঙ্গবন্ধু তার প্রথম আনুষ্ঠানিক রাষ্ট্রীয় সফর করেন ভারতের পশ্চিমবঙ্গে। যে কলকাতার রাস্তার ধুলোতে ছাত্রাবস্থায় বঙ্গবন্ধুর পদসঞ্চালন ঘটেছে অগণিতবার, যে কলকাতার কলেজে তিনি পাঠ নিয়েছেন, হোস্টেলে থেকেছেন, তার সেই স্মৃতিময় কলকাতায় তিনি বাংলাদেশের রাষ্ট্রপ্রধান হিসেবে আসেন প্রথম রাষ্ট্রীয় সফরে ১৯৭২ সালের ৮ ফেব্রুয়ারি। কলকাতায় ব্রিগেড মাঠে দশ লক্ষাধিক মানুষের সামনে বঙ্গবন্ধু সেদিন বাংলাদেশের কর্ণধার হিসেবে তার দ্বিতীয় বাংলা ভাষণটি রাখেন। সভায় উপস্থিত ছিলেন ভারতের প্রধানমন্ত্রী শ্রীমতী ইন্দিরা গান্ধী। ভাষণের প্রথমেই বঙ্গবন্ধু মুক্তিযুদ্ধের সময় ভারতের জনগণের সহযোগিতার জন্য ধন্যবাদ জানান। কিন্তু কী আশ্চর্য, বাংলাদেশের সীমান্তবর্তী ভারতের একটি রাজ্যের নামও ভুল করে তিনি বাদ দেননি। এক নিঃশ্বাসে বলেন, পশ্চিমবঙ্গ, ত্রিপুরা, মেঘালয় ও আসামের নাম। তাদের জনগণ ও রাজ্য সরকারকেও ধন্যবাদ জানান।

বঙ্গবন্ধু কৃতজ্ঞতা চিত্তে আরও বলেন, “আপনাদের এই দান কোনো দিন আমরা শোধ করতে পারব না। স্বাধীনতা পেয়েছি, বড়ো রক্তের বিনিময়ে পেয়েছি। এত রক্ত কোনো জাতি, কোনো দেশে কোনো দিন দেয় নাই, যা আমার বাংলাদেশের মানুষ দিয়েছে। না হলেও ত্রিশ লক্ষ লোক জীবন দিয়েছে। শতকরা ৪০ খানা ঘর আমার বাংলাদেশে জ্বালিয়ে দেওয়া হয়েছে। কারফিউ আইন জারি করে আমার জ্ঞানী-গুণী, বৈজ্ঞানিক, শিক্ষাবিদদের হত্যা করা হয়েছে। আমার এক কোটি লোক ঘর-বাড়ি ছেড়ে ভারতে আশ্রয় নিয়েছে।” (বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের ওয়েব সাইটের ভিডিও থেকে) এরপর মুক্তিযুদ্ধে বাংলাদেশে কত সম্পদ ক্ষয় হয়েছে তার উল্লেখ করে তিনি বলেন, জাতি-ধর্ম নির্বিশেষে সংগ্রাম করে বাঙালি স্বাধীন হয়। তিনি এই ভাষণে বাঙালির সংগ্রামের ইতিহাস সংক্ষেপে তুলে ধরেন সেই ১৯৪৮ সাল থেকে। তারপর বলেন, পাকিস্তানিরা দেশের উন্নয়নে সময় না দিয়ে, দেশে দারিদ্র্য দূর না করে প্রতিহিংসা ছড়িয়েছে। তারা কাশ্মির নিয়ে, নেতাদের নিয়ে আর হিন্দুদের নিয়ে মিথ্যে কথা বলে জনগণকে বাস্তব থেকে দূরে রেখেছে। ভাষার অধিকার না দেয়া, অন্য অধিকার না দেয়ার কথাও তুলে ধরেন বঙ্গবন্ধু। পাকিস্তানিরা পরাজয়বরণ করে পালানোর আগে খাদ্যগুদাম থেকে শুরু করে কী কী ধ্বংস করে চলে গেছে, সে কথাও বলেন তিনি। এই ভাষণে বঙ্গবন্ধু বাঙালির স্বভাবের কথা উল্লেখ করেন। তিনি বলেন, বাঙালির স্বভাব যেমন কোমল, তেমনি কঠিনও। মুক্তিযুদ্ধের সময় সে প্রমাণ তারা রেখেছে। এই ভাষণের একটি উল্লেখযোগ্য দিক হলো, আমেরিকাকে স্মরণ করিয়ে দেয়া যে, মুক্তিযুদ্ধকালে তারা যথাযথ কাজ করেনি। তিনি বলেন, সারা বিশ্বের মানুষ বাঙালির মুক্তিযুদ্ধে সমর্থন দিয়েছে। আমেরিকার সাধারণ মানুষ, সাংবাদিকরা এ সময় সাহায্য করলেও আমেরিকার সরকার সমর্থন করেনি। তাই তিনি স্পষ্ট বলেন-

“আমি আমেরিকা সরকারকে কৃতজ্ঞতা জানাই না। কৃতজ্ঞতা জানাতে পারব না।” বরং তিনি তাদের স্মরণ করিয়ে দেন, গণতন্ত্রের কথা মুখে না বলে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠায় সমর্থন দিন। আমেরিকা সম্পর্কে দেশের বাইরের বক্তব্যে বঙ্গবন্ধুর এই অবস্থানটি ছিল অত্যন্ত উল্লেখযোগ্য। একদিকে তিনি রাশিয়াকে ধন্যবাদ দিচ্ছেন, অন্যদিকে আমেরিকাকে দিচ্ছেন না এবং তা স্পষ্ট করে আবার উল্লেখও করছেন। তার পররাষ্ট্রনীতির ক্ষেত্রে এই বক্তব্যের প্রভাব লক্ষ করা গেছে। আবার তিনি পাকিস্তানিদের উদ্দেশেও বলেছেন, পাকিস্তানের সাধারণ মানুষের উপর তার কোনো ক্ষোভ নেই। কিন্তু পাকিস্তানের সরকার যে বিদেশের মাটিতে বলছে, বাংলাদেশ এখনও তাদের অংশ- এর প্রতিবাদ করতে ছাড়েননি তিনি। বঙ্গবন্ধু ধর্মনিরপেক্ষতার ওপর জোর দিয়েছেন। তিনি বলেছেন, ভারতে সাম্প্রদায়িক ঘটনার প্রভাবে পাকিস্তান আমলে তার গড়া আন্দোলন ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। ধর্মনিরপেক্ষতার পক্ষে তিনি গভীর প্রত্যয় ব্যক্ত করেন। তিনি দিল্লির ভাষণের মতো এখানেও বলেন, জাতীয়তাবাদ, গণতন্ত্র, ধর্মনিরপেক্ষতা, সমাজতন্ত্র হবে তার সরকারের মূলস্তম্ভ। পরে দেখা গেছে, ১৯৭২ সালের সংবিধানে এগুলোই বাংলাদেশের মূলমন্ত্র হিসেবে গ্রহণ করা হয়। এই ভাষণে রবীন্দ্রনাথের একাধিক কাব্যপঙক্তি তিনি আবৃত্তি করেছেন এবং এর শেষদিকে বঙ্গবন্ধু বেশ আবগাপ্লুত হয়ে পড়েন। নিজের ভাষায় বক্তৃতার কারণে এই আবেগপ্রকাশ আরও গভীরভাবে প্রকাশ করা গেছে বলে মনে করা যায়।

বৈশ্বিক রাজনৈতিক কূটচক্রান্তে খানিকটা বিলম্বই হয়ে যায় জাতিসংঘে বাংলাদেশের সদস্যপদ প্রাপ্তি। বিশেষ করে ভেটোদানের শক্তিসম্মত দুটো পরাক্রমশালী দেশ আমেরিকা ও চায়না বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের বিপক্ষে অবস্থান করায় জাতিসংঘের সদস্যপদ লাভ করতে বাংলাদেশকে বেগ পেতে হয়। তবু শেষ পর্যন্ত বাংলাদেশের জয় হয় এবং ১৯৭৪ সালের ১৭ সেপ্টেম্বর জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদের সর্বসম্মত অনুমোদনক্রমে বাংলাদেশ জাতিসংঘের সদস্যপদ লাভ করে। এর কয়েক দিন পর ২৫ সেপ্টেম্বর জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদের ২৯তম অধিবেশনে প্রথমবারের মতো বাংলাদেশ অংশগ্রহণ করার জন্য আমন্ত্রণ পায় এবং বক্তৃতা করেন বাংলাদেশের সরকারপ্রধান হিসেবে প্রধানমন্ত্রী শেখ মুজিবুর রহমান। নির্দিষ্ট দিনে নিউইয়র্কসময় বিকেল ৪টায় তাকে বক্তৃতার জন্য আহ্বান জানানো হয়। এ সময় সাধারণ সভার সভাপতি আলজিরিয়ার পররাষ্ট্রমন্ত্রী আবদুল আজিজ ব্যুতফলিকা নিজ আসন থেকে উঠে এসে বঙ্গবন্ধুকে মঞ্চে তুলে এগিয়ে দিয়ে সম্মান প্রদর্শন করেন। বঙ্গবন্ধু বক্তৃতা মঞ্চে দাঁড়ান গলাবন্ধ কোট, কালো ফ্রেমের খুব চিরচেনা চশমা, আর ব্যাকব্রাশ করা চুলে অপরূপভাবে। এমন একজন সুদর্শন রাষ্ট্রপ্রধান বঙ্গবন্ধুর আগে বিশ্ব খুব কমই দেখেছে। দীর্ঘদেহী, চৌকস, সুদর্শন আর আভিজাত্যপূর্ণ এক সৌম্য ব্যক্তিত্ব শেখ মুজিবুর রহমানকে দেখে নিশ্চয়ই মুগ্ধ হয়েছিলেন সেদিনের বিশ্বনেতারা। এরপর তার ভরাটগলায় বাংলা উচ্চারণ! ১৯১৩ সালে এক বাঙালি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর প্রথমবারের মতো বাংলা ভাষাকে বিশ্বের দরবারে উঁচু আসনে তুলে ধরেছিলেন, তার একষট্টি বছর পরে আর এক বাঙালি বিশ্বসভায় বাংলা ভাষাকে উঁচু আসনে তুলে ধরেন।

১৯৯৯ সালের ২১ ফেব্রুয়ারিকে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস ঘোষণা করে জাতিসংঘের অঙ্গপ্রতিষ্ঠান ইউনেসকো। সেই পথও এভাবেই তৈরি হয় নিশ্চয়। মঞ্চে দাঁড়িয়ে বঙ্গবন্ধু তার দেহভঙ্গিমায় সকলকে সম্মান জানান এবং জাতিসংঘকে ‘মানবজাতির পার্লামেন্ট’ হিসেবে আখ্যায়িত করেন। বাংলাদেশের সাড়ে সাত কোটি মানুষের প্রতিনিধি হিসেবে তিনি সেই অধিবেশনে যোগদান করায় সবার মধ্যে সন্তুষ্টচিত্ত লক্ষ করেন বঙ্গবন্ধু। বাঙালির আত্মনিয়ন্ত্রণের সংগ্রামে এই অধিবেশনে যোগদান বিশেষ সফলতারই দ্যোতক। এই বক্তৃতায় বঙ্গবন্ধু শুধু ১৯৭১-এর বাংলাদেশকেই তুলে ধরেননি। বাংলাদেশ কেন সংগ্রামের পথ বেছে নিয়েছিল, কী তার ত্যাগ, কোন ধারাবাহিক প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে জন্ম হয় স্বাধীন সার্বভৌম রাষ্ট্রটির- এসব ইতিহাস চমৎকারভাবে উঠে আসে বক্তৃতায়। বক্তৃতার শুরুতে তিনি স্পষ্ট ভাষায় বলেছেন, বাঙালি ‘জাতি’র কথা। তিনি জানেন, বাঙালি জাতির বাস শুধু নবগঠিত দেশ বাংলাদেশেই নয়, পশ্চিমবঙ্গ, আসাম, ত্রিপুরা, বিহারসহ বহির্বিশ্বেও। এটি জেনেই তিনি বলেছেন, বহু শতাব্দী ধরে বাঙালি জাতি স্বাধীন দেশে স্বাধীনভাবে মুক্ত জীবনযাপনের জন্য যে সংগ্রাম করে এসেছে, তারই পরিপ্রেক্ষিতে বাংলাদেশের অভ্যুদয়। বাঙালির দীর্ঘসংগ্রামের ইতিহাস তুলে ধরে বঙ্গবন্ধু বলেন-

“স্বাধীনভাবে বাঁচবার অধিকার অর্জনের জন্য এবং একটি স্বাধীন দেশে মুক্ত নাগরিকের মর্যাদা নিয়ে বাঁচবার জন্য বাঙালি জনগণ শতাব্দীর পর শতাব্দীব্যাপী সংগ্রাম করেছে, তারা বিশ্বের সব জাতির সঙ্গে শান্তি ও সৌহার্দ্য নিয়ে বাস করবার জন্য আকাঙ্ক্ষিত ছিলেন। যে মহান আদর্শ জাতিসংঘ সনদে রক্ষিত আছে, আমাদের লক্ষ লক্ষ মানুষ সেই আদর্শের জন্য সর্বোচ্চ ত্যাগ স্বীকার করেছেন।” (হোসেন, ২০১২ : ৩৯৭)

বঙ্গবন্ধু তার ভাষণে বিশ্বমুদ্রাস্ফীতি, কৃষিযন্ত্রপাতির মূল্যবৃদ্ধি, বিশ্ব-অর্থনীতির বিপর্যয়কালের কথাও স্মরণ করে বলেন, এই পরিপ্রেক্ষিতে ন্যায়সঙ্গত বিশ্ব-অর্থনৈতিক ব্যবস্থা দ্রুত গড়ে তুলতে হবে। তিনি বাংলাদেশে নানা বিপর্যয়ে ক্ষতিগ্রস্ত অর্থনীতির কথাও উল্লেখ করেন তার ভাষণে। যুদ্ধে বিধ্বস্ত অর্থনীতি নিয়ে জন্ম হয় বাংলাদেশের। তারপর একাধিকবার বন্যা ও খরাসহ প্রাকৃতিক বিপর্যয়ের মুখেও পড়তে হয় দেশটিকে। এই বিপর্যয়ে সহায়তাদানের জন্য বঙ্গবন্ধু কৃতজ্ঞতা জানান জাতিসংঘের প্রতি। তবে তিনি এটা শুধু বাংলাদেশেরই নয়, বহু অনুন্নত দেশের অবস্থাও। বঙ্গবন্ধু বিশ্বের গরিব দেশগুলোর নেতার মতো বলেন, উন্নত বিশ্ব যদি সমন্বিতভাবে এগিয়ে না আসে তাহলে বিশ্বে এমন করুণ অবস্থার সৃষ্টি হতে যাচ্ছে, যার দৃষ্টান্ত মানব-ইতিহাসে খুঁজে পাওয়া যাবে না। তিনি পুঁজির পাহাড়গড়া কিছু মানুষের কথাও উল্লেখ করে বলেন, এরই মধ্যে কিছু মানুষ পুঁজির দাপটে বিত্তবৈভবের যে ভোগবাদী অবস্থান নিয়েছে, তারও উদাহরণ বিরল। বঙ্গবন্ধুর এই কথার মধ্যে কিন্তু তার জীবনদর্শনও প্রতিফলিত হয়। তিনি শোষিতের নেতা এবং শোষকশ্রেণির কারণেই যে সমাজে সব সংকটের সূচনা- এই কথা তিনি তার বিশ্ববক্তব্যে এভাবেই উল্লেখ করেন। আদতে বঙ্গবন্ধু তার এই বক্তৃতায় সমকালীন বিশ্বরাজনীতির একটি গুরুত্বপূর্ণ বিশ্লেষণ করেছেন। তিনি নিজের অভিজ্ঞতার আলোকে স্পষ্টভাষায় বলেছেন-

“একদিকে অতীতের অন্যায় অবিচারের অবসান ঘটাতে হয়েছে, অপর দিকে আমরা আগামী দিনের চ্যালেঞ্জের সম্মুখীন হচ্ছি। আজকার দিনের বিশ্বের জাতিসমূহ কোন পথ বেছে নেবে তা নিয়ে সংকটে পড়েছে। এই পথ বেছে নেওয়ার বিবেচনার উপর নির্ভর করবে আমরা সামগ্রিক ধ্বংসের ভীতি এবং আণবিক যুদ্ধের হুমকি নিয়ে এবং ক্ষুধা, বেকারত্ব ও দারিদ্র্যের কশাঘাতে মানবিক দুর্গতিকে বিপুলভাবে বাড়িয়ে তুলে এগিয়ে যাবো অথবা আমরা এমন এক বিশ্ব গড়ে তোলার পথে এগিয়ে যাবো যে বিশ্ব মানুষের সৃজনশীলতা এবং আমাদের সময়ের বিজ্ঞান ও কারিগরি অগ্রগতি আণবিক যুদ্ধের হুমকিমুক্ত উজ্জ্বলতর ভবিষ্যতের রূপায়ণ সম্ভব করে তুলবে এবং যে বিশ্ব কারিগরি বিদ্যা ও সম্পদের পারস্পরিক অংশীদারিত্বের মাধ্যমে সর্বক্ষেত্রে সুন্দর জীবন গড়িয়া তোলার অবস্থা সৃষ্টি করবে।” (হোসেন, ২০১২ : ৩৯৯)

বঙ্গবন্ধু এ ক্ষেত্রে তার নিজের নেতৃত্বে এগিয়ে আসা বাংলাদেশের অবস্থান তুলে ধরে বলেন যে, বাংলাদেশ প্রথম হতেই শান্তিপূর্ণ সহাবস্থান ও সকলের প্রতি বন্ধুত্ব এই নীতিমালার ওপর ভিত্তি করে জোট নিরপেক্ষ নীতি গ্রহণ করেছে। কেবল শান্তিপূর্ণ পরিবেশই কষ্টলব্ধ জাতীয় স্বাধীনতার ফল ভোগ করতে সক্ষম করে তুলবে বলে মত দেন তিনি। মানবিক ঐক্যবোধ, ভ্রাতৃত্ববোধের পুনর্জাগরণ, পারস্পরিক নির্ভরশীলতা ও বিশ্বশান্তি প্রতিষ্ঠা বর্তমান সমস্যার সমাধান করতে পারে বলে তিনি বক্তৃতায় দৃঢ়ভাবে বলেন; আর এর প্রতি তিনি সমর্থন ব্যক্ত করেন। বঙ্গবন্ধুর এই বাংলায় বক্তৃতার সূত্র ধরেই পরবর্তীকালে তার কন্যা বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা জাতিসংঘে বাংলায় বক্তৃতা প্রদান করার রীতি চালু করেন।

বাংলাদেশের বাইরে বিদেশের মাটিতে রাষ্ট্রের কর্ণধার হিসেবে বঙ্গবন্ধুর প্রদত্ত এই বাংলা বক্তৃতাগুলো জাতি হিসেবে বাঙালিকে বিশ্ববাসীর কাছে সগর্বে বিশেষভাবে তুলে ধরেছে। স্বাধীন বাংলাদেশের কর্ণধার হিসেবে বাংলায় প্রদত্ত বঙ্গবন্ধুর এই বক্তৃতা তিনটি ইতিহাসে মাইল ফলক হয়ে আছে।

লেখক: অধ্যাপক, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়

আরও পড়ুন:
সোশ্যাল মিডিয়ায় কি নজরদারি ছিল না?
মিয়ানমার কি আদৌ গণতন্ত্রের মুখ দেখবে?
মুক্তিসংগ্রামের মহানায়ক
জয়তু ভালোবাসা দিবস
একুশের চেতনা ধারণেই জাতির সমৃদ্ধি

মন্তব্য

আরও পড়ুন

বিশ্লেষণ
The Dogs of Khalishapur and Rakibs thesis is a fresh idea

‘খলিশাপুরের কুকুরগুলো ও রকিবের থিসিস’ একটি নতুন ভাবনা

‘খলিশাপুরের কুকুরগুলো ও রকিবের থিসিস’ একটি নতুন ভাবনা
লেখক চমৎকার বইটিতে নানা অণুগল্পের মধ্য দিয়ে ওই সব ভয়ঙ্কর কুকুর-মানবদের চরিত্র পাঠকদের সামনে উপস্থাপন করেছেন।

সাংবাদিক মুস্তফা মনওয়ার সুজনের ‘খলিশাপুরের কুকুরগুলো ও রকিবের থিসিস’ উপন্যাস নিয়ে কিছু কথা পাঠকদের সামনে তুলে ধরার খুব ইচ্ছা থেকেই লিখতে বসা। লেখকের সঙ্গে যোগাযোগে সুবাদে বইটি লেখার শুরুর আগেই আলোচনা এবং পরে পান্ডুলিপি থেকেই পড়ার সুযোগ হয়েছে। এতে আমাদের প্রত্যেকের জীবনের চিরন্তন সত্য কিছু ঘটনা উপস্থাপন করেছেন লেখক।

বইটি না পড়লে বা না ধরলে আসলে চমৎকার কিছু বিষয় জানা থেকে পাঠকরা বঞ্চিত হবেন। আমি মনে করি, বইটি সবারই পড়া উচিত।

আমরা যদি বইমেলা থেকে সবসময় শুধু বিখ্যাত লেখকদের বই কিনি আর পড়ি, তাহলে এতসব অসাধারণ লেখাগুলো অজানাই থেকে যাবে। নতুন লেখক বা আরেকজন হুমায়ুন আজাদ কিংবা হুমায়ূন আহমেদ অথবা তার চেয়ে বেশি কেউ সৃষ্টি হবে না।

তবে নিশ্চয়ই বলছি না, বিখ্যাত লেখকদের বই কেউ পড়বেন না। অবশ্যই কিনবেন এবং পড়বেন। পাশাপাশি নতুন লেখকদের ভালো ভালো বইগুলোও স্পর্শ করতে হবে, দেখতে হবে ভেতরে কী আছে। তবেই তারা লিখতে উৎসাহ পাবেন, নাহলে তো আর লেখক সৃষ্টি হবে না।

সাংবাদিক মুস্তফা মনওয়ার সুজনের খলিশাপুরের কুকুরগুলো ও রকিবের থিসিস বইটি পড়ে মনে হয়েছে, এটি পড়ে পাঠক মজা পাবেন এবং ভাববেন।

বইটিতে লেখক যা বলতে চেয়েছেন তা অনেকটা এরকম- আমরা প্রতিনিয়ত অসংখ্য মানুষ দ্বারা পরিবেষ্টিত। এরমধ্যে কিছু মানুষ থাকে মুখোশ পরা, মুখোশটা মুখের সেঙ্গ খুব কৌশলে নিখুঁতভাবে মেশানো, সহজে দেখা যায় না। চারপাশটা ঘিরে তাদের বিচরণ। আমরা খুব বেশি খেয়াল না করলে বুঝতে পারি না, এদের ভেতর হিংস্র এক কুকুরের বাস। তারা প্রতি মুহূর্তে বন্ধুবেশে মানুষের চরম ক্ষতি করার জন্য উন্মুখ হয়ে থাকে; অনেকটা অজগর সাপের মতো।

এ প্রসঙ্গে আমার বন্ধু শারমিন মিলির একটি গল্প বলি। গল্পটি এরকম- এক লোক একটি অজগর সাপ পোষেন। তো এক পর্যায়ে দেখা গেল, অজগরটি খাওয়া-দাওয়া বন্ধ করে দিয়েছে। এতে সাপের মালিক বেশ চিন্তিত হয়ে পড়লেন এবং চিকিৎসকের শরণাপন্ন হলেন। তিনি চিকিৎসককে জানালেন, সাপটি এরকম ছিল না, তাকে খুবই ভালোবাসত, সবসময় তাকে জড়িয়ে ধরে থাকত, কিন্তু এখন যেন কেমন হয়ে গেছে! তখন চিকিৎসক হেসে বলেন, সাপটি আসলে তাকে কখনোই ভালোবাসেনি। সারাক্ষণ যে জড়িয়ে থাকত, সেটি আসলে প্রতি মুহূর্তে সে দেখত- তিনি সাপটির খাওয়ার উপযোগী হয়েছেন কি না। বইটি অজগরের গল্প বার বার মনে করিয়ে দিয়েছে।

লেখক চমৎকার বইটিতে নানা অণুগল্পের মধ্য দিয়ে ওই সব ভয়ঙ্কর কুকুর-মানবদের চরিত্র পাঠকদের সামনে উপস্থাপন করেছেন। উপন্যাসটিতে রকিব, অংকন, কেয়া, ফাহমিদাসহ বেশ কিছু চরিত্র দাঁড়িয়েছে, সেসব বাংলা উপন্যাসে নতুন মাত্র। উপন্যাসটি পড়ে বারবার মনে হয়েছে- চরিত্র সৃষ্টির নয়া কারিগরের আবির্ভাব হলো।

আমি হলফ করে বলতে পারি, ‘খলিশাপুরের কুকুরগুলো ও রকিবের থিসিস’ পড়লে পাঠকের অবশ্যই অনেক ভালো লাগবে। বইটির শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত এক রকম আকর্ষণ বা মাদকতা আছে। অসাধারণ এক কাহিনী। আমি পাঠক হিসেবে, আহ্বান জানাই- পাঠকরা যেনো বইমেলায় গিয়ে মনোবৈজ্ঞানিক উপন্যাসটি সংগ্রহ করেন এবং সময় নিয়ে বইটি পড়েন।

‘খলিশাপুরের কুকুরগুলো ও রকিবের থিসিস’-এর প্রকাশক বেহুলা বাংলা। অমর একুশে বইমেলায় সোহরাওয়ার্দী উদ্যানের ২২৪ নম্বর স্টলে গেলেই মিলবে, এছাড়া রকমারি তো আছেই।

লেখক: সাংবাদিক

আরও পড়ুন:
ফটোগ্রাফি নিয়ে ভিন্নধর্মী বই ‘বিখ্যাত ছবির পেছনের গল্প’
বইমেলায় মীরাক্কেল খ্যাত রাশেদের ‘ফিলিং চিলিং’

মন্তব্য

বিশ্লেষণ
One of the ethos of Ekush is to protest injustice and end domination over the weak

একুশের অন্যতম চেতনা অন্যায়ের প্রতিবাদ ও দুর্বলের ওপর আধিপত্যের অবসান

একুশের অন্যতম চেতনা অন্যায়ের প্রতিবাদ ও দুর্বলের ওপর আধিপত্যের অবসান মো. শহীদ উল্লা খন্দকার
২১ শে ফেব্রুয়ারি রক্ত স্নাত ভাষা আন্দোলনের স্মৃতিবহ মহান শহীদ দিবস। একই সঙ্গে দিনটি আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস হিসেবেও পালিত হবে বিশ্বজুড়ে। আমাদের জাতীয় জীবনের অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ একটি দিন এটি।

প্রায় দুই হাজার কিলোমিটার দূরত্বে অবস্থিত দুটি ভূখণ্ডের দুটি ভিন্ন ভাষার জাতিসত্তাকে মিলিয়ে পাকিস্তান রাষ্ট্রের জন্ম থেকেই মাতৃভাষাকে কেন্দ্র করে সূচনা হয়েছিল আন্দোলনের। আর এই ভাষা আন্দোলনকেই বাংলাদেশ রাষ্ট্র সৃষ্টির পথে প্রথম পদক্ষেপ হিসেবে বিবেচনাযোগ্য । ১৯৪৭ সালে যখন দ্বিজাতি তত্ত্বের ভিত্তিতে ভারত ভাগ হয়েছিল তার আগ থেকেই আসলে শুরু হয়েছিল ভাষা নিয়ে বিতর্ক।পাকিস্তান রাষ্ট্র গঠন নিশ্চিত হওয়ার পর উর্দু-বাংলা বিতর্ক আবার মাথাচাড়া দিয়ে ওঠে।

২১ শে ফেব্রুয়ারি রক্ত স্নাত ভাষা আন্দোলনের স্মৃতিবহ মহান শহীদ দিবস। একই সঙ্গে দিনটি আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস হিসেবেও পালিত হবে বিশ্বজুড়ে। আমাদের জাতীয় জীবনের অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ একটি দিন এটি।

মহান আন্তজার্তিক মাতৃ ভাষা ২১ ফেব্রুয়ারীতে যারা বুকের তাজা রক্ত দিয়ে বাংলাকে মায়ের ভাষা ও রাষ্ট্রভাষা হিসেবে প্রতিষ্ঠা করে গেছেন তাদের প্রতি বিনম্র শ্রদ্ধা ও সশ্রদ্ধ সালাম জানাই।

১৯৪৭ সালে দেশবিভাগের পর থেকেই পাকিস্তানের পশ্চিমাঞ্চলের শাসকগোষ্ঠী পূর্বাঞ্চলের সংখ্যাগরিষ্ঠ বাঙালিকে তাদের অধীন করে রাখার পরিকল্পনা করেছিল। আজ আমরা গর্বিত স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশের বাসিন্দা।

১৯৫২ সালের এই দিনে মাতৃভাষা বাংলার মর্যাদা রাখতে গিয়ে বুকের রক্ত ঢেলে দিয়েছিল রফিক, সালাম, বরকত, সফিউর, জব্বাররা। তাদের রক্তে শৃঙ্খলমুক্ত হয়েছিল দুঃখিনী বর্ণমালা, মায়ের ভাষা। বাঙালি জাতিসত্তা বিকাশের যে সংগ্রামের সূচনা সেদিন ঘটেছিল, জাতির পিতা শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বে মুক্তিযুদ্ধের গৌরবময় পথ বেয়ে স্বাধীন বাংলাদেশের অভ্যুদয়ের মধ্য দিয়ে তা চূড়ান্ত পরিণতি লাভ করে। একুশে ফেব্রুয়ারি তাই বাঙালির কাছে চির প্রেরণার প্রতীকে পরিণত হয়েছে। এই হত্যাকাণ্ড মাতৃভাষার অধিকারের দাবিতে গড়ে ওঠা আন্দোলনকে দমিয়ে দেয়নি।

বায়ান্নর একুশে ফেব্রুয়ারি বাঙালির স্বাধিকার আন্দোলনে যোগ করে নতুন মাত্রা। শহীদদের রক্ত তাদের প্রতিজ্ঞাবদ্ধ হতে প্রেরণা জোগায়। এর পরের ইতিহাস পর্যায়ক্রমিক আন্দোলনের।

স্বাধীনতাসংগ্রাম, সশস্ত্র মুক্তিযুদ্ধসহ ইতিহাসের প্রতিটি গুরুত্বপূর্ণ পর্যায়ে আমাদের পথ দেখিয়েছে একুশে ফেব্রুয়ারি। তেমনি একুশ আজও পৃথিবীর বিভিন্ন জাতির ভাষার অধিকার অর্জনেরও পথিকৃৎ হয়ে আছে।

স্বাধীন বাংলাদেশের সংবিধানে বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়া হয়। বাংলা ভাষায় সংবিধান প্রণীত করেন বঙ্গবন্ধু। এটিই একমাত্র দলিল যা বাংলা ভাষায় প্রণীত হয়েছে। স্বাধীন বাংলাদেশের রাষ্ট্রপতি হিসেবে ১৯৭৪ সালের ২৫ সেপ্টেম্বর জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান, জাতিসংঘের সাধারণ অধিবেশনে প্রথম বাংলায় বক্তব্য দিয়ে বিশ্বসভায় বাংলাকে তুলে ধরেন। ’৫৪-র নির্বাচনে যুক্তফ্রন্টের বিজয়, আইয়ুব খানের সামরিক শাসনবিরোধী আন্দোলন, ’৬২-র শিক্ষা আন্দোলন, ’৬৬-র স্বাধিকার প্রতিষ্ঠার লড়াই, ’৬৯-র গণঅভ্যুত্থান, ’৭০-এর জাতীয় নির্বাচনে আওয়ামী লীগের জয়লাভ এবং ’৭১-এর মুক্তিযুদ্ধের মধ্য দিয়ে শেষ পর্যন্ত প্রতিষ্ঠা লাভ করে বাঙালির স্বাধীন-সার্বভৌম রাষ্ট্র বাংলাদেশ।

আর বাঙালি মুক্ত হয় ঔপনিবেশিক শাসন-শোষণ থেকে। বাঙালির স্বাধীনতা সংগ্রামের ইতিহাসের প্রতিটি পর্যায়ে ’৫২-র ভাষা আন্দোলন অনুপ্রেরণা হিসেবে কাজ করেছে। তাই একুশ আমাদের জাতীয় জীবনে এক অন্তহীন প্রেরণার উৎস।

ভাষা আন্দোলনের মধ্য দিয়ে বাঙালি জাতীয়তাবাদ প্রতিষ্ঠিত হয়। একুশের অন্যতম চেতনা ছিল রাষ্ট্রীয় জীবনে অসাম্য বৈষম্য, দুর্বলের ওপর সবলের আধিপত্য ইত্যাদির অবসান। বাঙালির ঐতিহ্য, কৃষ্টি, আবহমানকালের সংস্কৃতি ইত্যাদি সমুন্নত রাখা।

অমর একুশের চেতনা এখন বিশ্বের বিভিন্ন ভাষার মানুষের নিজস্ব ভাষা ও সংস্কৃতি রক্ষায় অনুপ্রেরণার উৎস। তবে বাংলা ভাষা ও সংস্কৃতির সঠিক চর্চা ও সংরক্ষণে আমাদের আরও বেশি পরিশ্রমী হতে হবে। তথ্যপ্রযুক্তির আশীর্বাদে আমরা এখন একই বৈশ্বিক গ্রামের বাসিন্দা। তাই উন্নত বিশ্বের সঙ্গে অগ্রগতির ধারা বজায় রাখতে আমাদের বর্তমান প্রজন্মকে বিভিন্ন ভাষায় প্রয়োজনীয় দক্ষতা অর্জন করতে হবে, যা আন্তর্জাতিক যোগাযোগ মাধ্যম হিসেবে স্বীকৃত।

আমি বিশ্বাস করি যে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস পালন আমাদের নিজস্ব ভাষার উন্নয়ন ও সংরক্ষণের পাশাপাশি বহুভাষিক শিক্ষার মাধ্যমে একটি টেকসই ভবিষ্যৎ গড়তে ইতিবাচক ভূমিকা পালন করবে- এটাই আমাদের প্রত্যাশা।

অমর একুশের চেতনাকে ধারণ করে বিশ্বের বিভিন্ন ভাষা ও সংস্কৃতির মানুষের মধ্যে পারস্পরিক শ্রদ্ধাবোধ জাগ্রত হোক, বৈষম্যহীন বর্ণিল পৃথিবী গড়ে উঠুক- শহীদ দিবস ও আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবসে এটাও আমাদের প্রত্যাশা।

জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের পদাঙ্ক অনুসরণ করে তার কন্যা শেখ হাসিনা সরকার প্রধান হিসেবে প্রতিবারই জাতিসংঘে বাংলায় ভাষণ দিয়ে যাচ্ছেন। তার সরকার বাংলাভাষাকে জাতিসংঘের দাপ্তরিক ভাষা হিসেবে স্বীকৃতি আদায়ের প্রচেষ্টা অব্যাহত রেখেছেন। বাংলাদেশে ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীরও ভাষার চর্চার ব্যাবস্থা করেছেন। আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা ইনস্টিটিউট গড়ে তুলেছেন, যেখানে হারিয়ে যাওয়া মাতৃভাষা নিয়ে গবেষণা হচ্ছে।

অমর একুশে গ্রন্থমেলাসহ প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা, ‘আমাদের শিল্প, কলা, সাহিত্য, সংস্কৃতিকে আরো উন্নতমানের করে শুধু আমাদের দেশে না, বিশ্বদরবারে পৌঁছে দিতে চান। ‘আমাদের সাহিত্য আরো অনুবাদ হোক। বিশ্বের বিভিন্ন ভাষাভাষী মানুষ আমাদের সাহিত্যকে জানুক, আমাদের সংস্কৃতিকে জানুক, সেটাই আমরা চাই।

বাঙালি জাতীয়তাবাদ ও জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবের আদর্শ অনুসরণ করে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী বাংলাদেশকে বিশ্বের কাছে উন্নয়নের রোল মডেলে পরিণত করেছেন। প্রধানমন্ত্রী জননেত্রী শেখ হাসিনা’র অসাধারণ নেতৃত্বে বাংলাদেশ উন্নত সমৃদ্ধশালী দেশের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে। বাংলাদেশের জন্য ধারাবাহিক অগ্রগতি আর সম্মানের পথটি দিন দিন প্রশস্ত করে চলেছেন বঙ্গবন্ধু কন্যা শেখ হাসিনা। তিনি দায়িত্ব পাওয়ার পর থেকে তিনি নিষ্ঠার সঙ্গে দেশ ও মানুষের উন্নয়নের কাজে নিজেকে পুরোপুরি সঁপে দিয়েছেন। বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার রাজনৈতিক কর্মজীবন প্রায় চার দশকের। তারই নেতৃত্বে বাংলাদেশে চলমান উন্নয়নের ধারাকে অব্যাহত রাখতে হবে। তাহলে প্রকৃত অর্থে বঙ্গবন্ধু’র স্বপ্নের সোনার বাংলা প্রতিষ্ঠা হবে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সুযোগ্য নেতৃত্বে বাংলাদেশ চতুর্থ শিল্প বিপ্লবে নেতৃত্ব দিবে। ২০৪১ সালের মধ্যে উন্নত সমৃদ্ধ দেশ তথা জাতির জনকের স্বপ্নের সোনার বাংলা স্মার্ট বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠিত হবেই।

সব মাতৃ ও আঞ্চলিক ভাষাকেই সমান মর্যাদা দিয়ে সংরক্ষণের দায়িত্ব রয়েছে বিশ্ববাসীর। একুশের শহীদদের প্রতি জানাই গভীর শ্রদ্ধা। শহীদ স্মৃতি অমর হোক।

লেখক: সাবেক সচিব ও প্রধানমন্ত্রীর নির্বাচনি এলাকার মনোনীত প্রতিনিধি।

মন্তব্য

বিশ্লেষণ
Awami Leagues manifesto has a special commitment to protect the interests of minorities

আওয়ামী লীগের ইশতেহারে সংখ্যালঘুর স্বার্থ রক্ষায় বিশেষ অঙ্গীকার

আওয়ামী লীগের ইশতেহারে সংখ্যালঘুর স্বার্থ রক্ষায় বিশেষ অঙ্গীকার
আওয়ামী লীগের নির্বাচনি ইশতেহারে নিম্ন আয়ের প্রান্তিক-সুবিধাবঞ্চিত মানুষের কথাই ঘুরে-ফিরে এসেছে। প্রবীণ, সমাজের পিছিয়ে পড়া মানুষ এমনকি সংখ্যালঘু জাতিসত্তার ক্ষমতায়নের প্রসঙ্গও এসেছে। বিশেষত সংখ্যালঘু জাতিসত্তার মানুষের জন্য আলাদা কমিশন গঠন করার বিষয়টি গুরুত্বপূর্ণ। দেশের পিছিয়ে পড়া জনগোষ্ঠীর ক্ষমতায়নে এই প্রতিশ্রুতি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে।

দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন সামনে রেখে আওয়ামী লীগের ইশতেহারে সংখ্যালঘুদের স্বার্থ সুরক্ষায় বিশেষ অঙ্গীকারের কথা ঘোষণা করা হয়েছে। এবারের ইশতেহারের স্লোগান- ‘স্মার্ট বাংলাদেশ: উন্নয়ন দৃশ্যমান বাড়বে এবার কর্মসংস্থান’।

ইশতেহারে স্মার্ট বাংলাদেশ গড়ার অঙ্গীকার করে ১১টি বিষয়কে অগ্রাধিকার দিয়েছে আওয়ামী লীগ। কর্মসংস্থান সৃষ্টি, দ্রব্যমূল্য ক্রয়ক্ষমতার মধ্যে রাখা, আয়ের মধ্যে সঙ্গতি প্রতিষ্ঠা, দেশের রূপান্তর ও উন্নয়নে তরুণ এবং যুব সমাজকে সম্পৃক্ত রাখা, পুঁজি পাচারকারীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণ, ঘুষ-দুর্নীতি উচ্ছেদ, ঋণ-কর-বিলখেলাপি ও দুর্নীতিবাজদের বিচারের আওতায় এনে তাদের অবৈধ সম্পদ বাজেয়াপ্ত করার প্রতিশ্রতি দিয়েছে দলটি। এছাড়া গুরুত্ব পেয়েছে কৃষি, সেবা, অর্থনৈতিক ও শিল্প উৎপাদন খাত এবং তৃতীয় লিঙ্গের মানুষদের মৌলিক অধিকার নিশ্চিত করা।

আওয়ামী লীগের ২০০৮ সালের নির্বাচনি ইশতেহারের শিরোনাম ছিলো ‘দিন বদলের সনদ’, ২০১৪ সালের ‘এগিয়ে যাচ্ছে বাংলাদেশ’, ২০১৮ সালের ‘সমৃদ্ধি ও অগ্রযাত্রায় বাংলাদেশ’। এটিতে ২১টি বিশেষ অঙ্গীকার ছিলো।

আওয়ামী লীগ সভাপতি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ২৭ ডিসেম্বর ইশতেহার ঘোষণা করেন। নির্বাচনি ইশতেহারের সারাংশ তুলে ধরেন তিনি।

ইশতেহারে ডিজিটাল থেকে স্মার্ট বাংলাদেশে উত্তরণ প্রসঙ্গে তিনি বলেন, চতুর্থ শিল্প বিপ্লবের যুগে বিশ্ব প্রতিযোগিতায় টিকে থাকার জন্য প্রযুক্তি সক্ষমতা একান্ত প্রয়োজন। এজন্য ‘স্মার্ট নাগরিক’, ‘স্মার্ট সরকার’, ‘স্মার্ট অর্থনীতি’ ও ‘স্মার্ট সমাজ’- এই চারটি স্তম্ভের সমন্বয়ে ‘স্মার্ট বাংলাদেশ’ গড়ার ঘোষণা দেয়া হয়। স্মার্ট বাংলাদেশ বাস্তবায়নে প্রতিটি ক্ষেত্রে কাজের কথা উল্লেখ করা হয়।

জনগণের ভোটে নির্বাচিত হলে ২০৪১ সালের মধ্যে বাংলাদেশকে ক্ষুধা-দারিদ্র্যমুক্ত স্মার্ট সোনার বাংলা হিসেবে গড়ে তোলার অঙ্গীকার করা হয়েছে।

ইশতেহারে আওয়ামী লীগ যে ১১টি বিষয়কে বিশেষ অগ্রাধিকার দিয়েছে তা হলো- দ্রব্যমূল্য সবার ক্রয়ক্ষমতার মধ্যে রাখার জন্য সর্বাত্মক প্রচেষ্টা চালিয়ে যাওয়া; কর্মোপযোগী শিক্ষা ও যুবকদের কর্মসংস্থান নিশ্চিত করা; আধুনিক প্রযুক্তিনির্ভর স্মার্ট বাংলাদেশ গড়ে তোলা; লাভজনক কৃষির লক্ষ্যে সমন্বিত কৃষিব্যবস্থা, যান্ত্রিকীকরণ ও প্রক্রিয়াজাতকরণে বিনিয়োগ বৃদ্ধি; দৃশ্যমান অবকাঠামোর সুবিধা নিয়ে এবং বিনিয়োগ বৃদ্ধি করে শিল্পের প্রসার ঘটানো; ব্যাংকসহ আর্থিক খাতে দক্ষতা ও সক্ষমতা বৃদ্ধি করা; নিম্ন আয়ের মানুষদের স্বাস্থ্যসেবা সুলভ করা; সর্বজনীন পেনশন ব্যবস্থায় সবাইকে যুক্ত করা; আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর কার্যকারিতা ও জবাবদিহি নিশ্চিত করা; সাম্প্রদায়িকতা এবং সব ধরনের সন্ত্রাস ও জঙ্গিবাদ রোধ করা, সর্বস্তরে গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা সুরক্ষা ও চর্চার প্রসার ঘটানো।

‘স্মার্ট বাংলাদেশ’ গড়ার প্রত্যয় নিয়ে টানা তিনবার ক্ষমতায় থাকা দল আওয়ামী লীগ তার নির্বাচনী ইশতেহারে ক্ষুদ্র জাতিসত্তা, নৃ-গোষ্ঠী ও ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের নিয়ে কী পরিবল্পনা আছে তা তুলে ধরেছে ইশতেহারে। নতুন করে সরকার গঠন করতে পারলে আওয়ামী লীগ কী কী পদক্ষেপ গ্রহণ করবে তা স্পষ্ট করে জানিয়েছে ইশতেহারে।

বর্তমানে বাংলাদেশে পাহাড় ও সমতল মিলে প্রায় ৪৫টি ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীর ৩০ লাখের বেশি মানুষ বসবাস করছে। বাংলাদেশের সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িত রয়েছে তাদের জীবন, ঐতিহ্য, সংস্কৃতি, ইতিহাস ও আশা-আকাঙ্ক্ষা।

জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বাংলাদেশের সংবিধানে ক্ষুদ্র জাতিসত্তা, নৃ-গোষ্ঠী, ধর্মীয় সংখ্যালঘুসহ সব সম্প্রদায়ের মানুষের সম-অধিকার ও মর্যাদার স্বীকৃতি দিয়েছিলেন। সেই আলোকে আওয়ামী লীগ ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠী ও ধর্মীয় সংখ্যালঘু জনগোষ্ঠীর প্রতি বৈষম্যমূলক আচরণের অবসান ঘটানো; তাদের জীবন, সম্পদ, উপাসনালয় ও স্বাতন্ত্র্য রক্ষায় এবং জীবনমানের উন্নয়নে অগ্রাধিকার ভিত্তিতে বিভিন্ন কার্যক্রম অব্যাহত রেখেছে। সাম্প্রদায়িকতা যেন মাথাচাড়া দিয়ে উঠতে না পারে। ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্র বাংলাদেশ। প্রত্যেকে নিজ নিজ ধর্ম পালন করবে স্বাধীনভাবে। তাতে কেউ বাধা প্রদান করতে পারবে না।

বাংলাদেশ সারা বিশ্বের কাছে সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির এক উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত। এই বাংলাদেশে ঈদুল ফিতর, ঈদুল আজহা, ঈদে মিলাদুন্নবী, জন্মাষ্টমী, শারদীয় দুর্গোৎসব, বুদ্ধপূর্ণিমা, বড়দিন ইত্যাদি ধর্মীয় অনুষ্ঠান কোনো বিশেষ ধর্মের গণ্ডিতে সীমাবদ্ধ থাকে না। জাতি-ধর্ম-বর্ণ-গোষ্ঠী নির্বিশেষে সর্বস্তরের মানুষের অংশগ্রহণ ও উপস্থিতিতে সম্প্রীতি ও সৌহার্দ্যপূর্ণ পরিবেশে এসব উদযাপিত হয়।

জাতীয় চেতনায় ও শান্তির প্রেরণায় উদ্বুদ্ধ হয়ে সৌহার্দ্যপূর্ণ সম্পর্ক বজায় রেখে প্রধানমন্ত্রীর আহ্বানে ‘ধর্ম যার যার উৎসব সবার’ স্লোগান সামনে রেখে সব ধর্ম-বর্ণ-গোষ্ঠীর মানুষ সাড়ম্বরে পালন করে প্রতিটি ধর্মীয় উৎসব। এ বছর ৩২ হাজার পূজামণ্ডপে অত্যন্ত শান্তিপূর্ণ পরিবেশে পূজা উদযাপিত হয়েছে। প্রধানমন্ত্রী বলেছেন আমাদের দেশের সব ধর্মের মানুষ একসঙ্গে মুক্তিযুদ্ধ করে দেশ স্বাধীন করেছেন, তাই সকলে সমান অধিকার নিয়ে এদেশে বাস করবেন।

ধর্মীয় ও জাতিগত সংখ্যালঘুদের জমি, বসতভিটা, উপাসনালয়, বনাঞ্চল, জলাভূমি ও অন্যান্য সম্পদের সুরক্ষার ব্যবস্থা করা হয়েছে। ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীর জমি ও বন এলাকায় অধিকার সংরক্ষণের জন্য ভূমি কমিশনের কার্যক্রম অব্যাহত আছে এবং তা থাকবে। ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীর জনগণকে সমাজের ও উন্নয়নের মূলস্রোতে আনার জন্য সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচিসহ বিভিন্ন কার্যক্রম বাস্তবায়ন হচ্ছে। অনগ্রসর ও অনুন্নত ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠী ও চা-বাগান শ্রমিকদের সন্তানদের শিক্ষা ও চাকরি ক্ষেত্রে বিশেষ কোটা এবং সুযোগ-সুবিধা অব্যাহত আছে।

ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীর মানুষের জন্য শিক্ষা ও স্বাস্থ্য পরিষেবাগুলো প্রত্যন্ত অঞ্চলে সম্প্রসারণ করা হয়েছে। রাস্তাঘাট, বিদ্যুৎসহ অন্যান্য অবকাঠামোগত সুযোগ-সুবিধা বৃদ্ধি করা হয়েছে। ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠী সম্প্রদায়গুলোর বৈচিত্র্যময় রীতিনীতি ও ঐতিহ্যগুলোকে সংরক্ষণ এবং প্রদর্শন করার জন্য সরকারের তরফ থেকে উৎসাহিত করা হচ্ছে।

বৃহত্তর রাজনৈতিক প্রতিনিধিত্ব ও সামাজিক অন্তর্ভুক্তি নিশ্চিত করতে সরকার সিদ্ধান্ত গ্রহণ প্রক্রিয়ায় জাতিগত সংখ্যালঘুদের অংশগ্রহণ বাড়ানোর জন্য ইতিবাচক পদক্ষেপ নিয়েছে। পার্বত্য চট্টগ্রাম শান্তিচুক্তির বিভিন্ন ধারা অনুযায়ী বিভিন্ন বিষয় আঞ্চলিক পরিষদ এবং জেলা পরিষদের কাছে ন্যস্ত করা হয়েছে। ফলে স্থানীয়, ভৌগোলিক, আর্থ-সামাজিক পরিবেশ বিবেচনায় নিয়ে উন্নয়ন কর্মকাণ্ড প্রণয়ন ও বাস্তবায়ন করা হচ্ছে।

তিন পার্বত্য জেলায় পর্যটনশিল্প, খাদ্য প্রক্রিয়াজাতকরণসহ ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্প, ঐতিহ্যবাহী কুটির শিল্পের বিকাশে বিশেষ ব্যবস্থা গ্রহণ করার পরিকল্পনা নেয়া হয়েছে। উচ্চ মূল্যের মসলা চাষ, কফি-কাজু বাদাম চাষ, তুলা চাষ, সৌরবিদ্যুৎ ইত্যাদি জনমুখী পদক্ষেপ বাস্তবায়ন করা হচ্ছে। মন্দির, শ্মশান, প্যাগোডা, গির্জা, সিমেট্রির উন্নয়নে অনুদান প্রদান ও উন্নয়ন কার্যক্রম অব্যাহত আছে। হিন্দু, বৌদ্ধ ও খ্রীষ্টান ধর্মীয় কল্যাণ ট্রাস্টসমূহের মাধ্যমে সংশ্লিষ্ট ধর্মাবলম্বীদের সার্বিক কল্যাণ সাধনে নিয়মিত কার্যক্রম অব্যাহত আছে।

সংবিধানের অনুচ্ছেদ ২৩(ক) তে বলা আছে, রাষ্ট্র বিভিন্ন উপজাতি, ক্ষুদ্র জাতিসত্তা, নৃ-গোষ্ঠী ও সম্প্রদায়ের অনন্য বৈশিষ্ট্যপূর্ণ আঞ্চলিক সংস্কৃতি এবং ঐতিহ্য সংরক্ষণ, উন্নয়ন ও বিকাশের ব্যবস্থা গ্রহণ করবে। সংবিধানের এই ধারা সুরক্ষায় উদ্যোগ অব্যাহত থাকবে।

আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে জাতীয় সংসদে অর্পিত সম্পত্তি আইন সংশোধন করা হয়েছে এবং অর্পিত সম্পত্তি সংশ্লিষ্ট সমস্যা নিষ্পত্তির ব্যবস্থা নেয়া হয়েছে। আইন প্রয়োগে বাধা দূর করা হবে।

সংখ্যালঘুদের স্বার্থ সুরক্ষার জন্য জাতীয় সংখ্যালঘু কমিশন গঠন এবং সংখ্যালঘু বিশেষ সুরক্ষা আইন প্রণয়ন করা হবে। আওয়ামী লীগ ধর্মীয় সংখ্যালঘু, ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠী ও অনগ্রসর সম্প্রদায়ের জীবন ও জীবিকার নিরাপত্তা নিশ্চিত করার লক্ষ্যে আবশ্যক পদক্ষেপ নেয়া অব্যাহত রাখবে।

বিএনপি-জামায়াত জোট সরকারের ‘এথনিক ক্লিনজিং’ অপনীতির কবলে পড়ে দেশের ধর্মীয় সংখ্যালঘু সম্প্রদায় এবং ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠী হিংস্র আক্রমণ ও বৈষম্যের শিকার হয়। ধর্মীয় সংখ্যালঘু ও ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীর অসংখ্য নর-নারী নিহত হয়েছে; অসংখ্য নারী হয়েছে ধর্ষণের শিকার; তাদের ঘরবাড়ি, জমি, ব্যবসা প্রতিষ্ঠান দখল ও লুণ্ঠিত হয়েছে। আওয়ামী লীগ এ অমানবিক ঘটনাগুলোর বিচারকার্য সম্পন্ন করবে এবং তার পুনরাবৃত্তি হতে দেবে না।

বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ ধর্মীয় সংখ্যালঘু, ক্ষুদ্র জাতিসত্তা ও চা-বাগানে কর্মরত শ্রমজীবী জনগোষ্ঠীর ওপর সন্ত্রাস, বৈষম্যমূলক আচরণ এবং মানবাধিকার লঙ্ঘনের চির অবসান, তাদের জীবন, সম্পদ, সম্ভ্রম, মান-মর্যাদার সুরক্ষা এবং রাষ্ট্র ও সমাজ জীবনের সর্বক্ষেত্রে সমান অধিকার নিশ্চিত করার নীতি অব্যাহত রাখবে। বস্তি, চর, হাওর, বাওড়, উপকূলসহ দেশের সব অনগ্রসর অঞ্চলের সুষম উন্নয়ন এবং ওইসব অঞ্চলের জনগণের জীবনের মানোন্নয়ন অগ্রাধিকার পাবে।

বাংলাদেশের সুবিধাবঞ্চিত মোট জনসংখ্যার একটি অংশ দলিত, হরিজন ও বেদে সম্প্রদায়। সমাজে চরমভাবে অবহেলিত, বিচ্ছিন্ন, উপেক্ষিত এ জনগোষ্ঠী। তাদের জীবনমান উন্নয়ন এবং তাদের মূল স্রোতে নিয়ে আসার কর্মসূচি বাস্তবায়নে আওয়ামী লীগ অঙ্গীকারবদ্ধ।

দলিত, হরিজন সম্প্রদায়ের জন্য ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোররেশনে ফ্ল্যাট নির্মাণ করে দেয়া হয়েছে। মুন্ডা, ট্রান্সজেন্ডার, কুষ্ট রোগীদের অর্থ সহায়তা দেয়া হচ্ছে। ২ কাঠা জমিতে তাদেরকে ঘর করে দেয়া হয়েছে।

২০১২-২০১৩ অর্থবছরে পাইলট কর্মসূচির মাধ্যমে ৭টি জেলায় বেদে ও অনগ্রসর জনগোষ্ঠীর জীবনমান উন্নয়ন কার্যক্রম শুরু হয়। ২০১৫-১৬ অর্থবছরে এই কর্মসূচি সম্প্রসারণ করে মোট ৬৪ জেলায় এই কার্যক্রম চালু রাখা হয়েছে। ২০১৯-২০ অর্থবছরে বেদে জনগোষ্ঠীর জীবনমান উন্নয়ন কর্মসূচি ও অনগ্রসর জনগোষ্ঠীর জীবনমান উন্নয়ন কর্মসূচি স্বতন্ত্র দুটি কর্মসূচিতে বিভক্ত করা হয়। দুটো কর্মসূচিই সম্প্রসারিত করা হয়েছে।

অনগ্রসর জনগোষ্ঠীর জীবনমান উন্নয়ন কার্যক্রমে উপকারভোগীর সংখ্যা ৮২ হাজার ৫০৩ জনে উন্নীত হয়েছে। বিশেষ ভাতাভোগীর সংখ্যা ৫৪ হাজার ৩০০ জনে উন্নীত হয়েছে। শিক্ষার্থীদের জন্য উপবৃত্তি দেয়া হয়েছে। বেদে ও সমাজের পিছিয়ে পড়া জনগোষ্ঠীর জীবনমান উন্নয়নে সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচি অব্যাহত রাখা হবে। বৃত্তিমূলক প্রশিক্ষণের মাধ্যমে বেদে ও সমাজের পিছিয়ে পড়া জনগোষ্ঠীর দক্ষতা বৃদ্ধি করা হবে, যাতে তারা আয়বর্ধনমূলক কর্মকাণ্ডে সম্পৃক্ত হয়ে সমাজের মূল স্রোতোধারায় আসতে পারে। সমাজের পিছিয়ে পড়া জনগোষ্ঠীর জন্য নগদ অর্থ সাহায্য ও বাসস্থান প্রদান কর্মসূচি সারা দেশে সম্প্রসারিত করা হবে।

ট্রান্সজেন্ডার সম্প্রদায় বাংলাদেশের মোট জনসংখ্যার একটি ক্ষুদ্র অংশ। আবহমানকাল থেকেই এ জনগোষ্ঠী সমাজ ও রাষ্ট্রজীবন থেকে বিচ্ছিন্ন ও উপেক্ষিত, মানবেতর জীবনযাপন করছে। আওয়ামী লীগ সরকার এই সম্প্রদায়ের মৌলিক অধিকার সংরক্ষণ ও সামাজিক ন্যায়বিচার নিশ্চিত করে তাদেরকে সমাজের মূল স্রোতধারায় সম্পৃক্ত করার লক্ষ্যে নানা কল্যাণমুখী কর্মসূচি গ্রহণ করেছে।

সামাজিক নিরাপত্তা কার্যক্রমের আওতায় ২০১২-১৩ অর্থবছরে ট্রান্সজেন্ডার জনগোষ্ঠীর জীবনমান উন্নয়ন কর্মসূচি বাস্তবায়ন শুরু হয়। ট্রান্সজেন্ডার জনগোষ্ঠীর ভাতাভোগীর সংখ্যা ২০০৬ সালে ১ হাজার ১২ জন ছিল, যা ২০২২-২৩ সালে ৬ গুণ বৃদ্ধি পেয়ে ৬ হাজার ৮৮৪ জন হয়েছে। বিশেষ ভাতা পান ৫ হাজার ৬২০ জন। ২০১৪ সালে ট্রান্সজেন্ডার জনগোষ্ঠীকে ‘তৃতীয় লিঙ্গ’ হিসেবে স্বীকৃতি দেয়া হয়েছে। ২০১৯ সালে এই সম্প্রদায়ের লোকজন স্বতন্ত্র লৈঙ্গিক পরিচয়ে ভোটাধিকার লাভ করে।

আওয়ামী লীগ নির্বাচনি ইশতেহারে সমান অধিকার ও মর্যাদার বিষয়গুলোকে তুলে ধরেছে। সবার বিশ্বাস নতুন সরকার গঠনের পর সংখ্যালঘুদের স্বার্থরক্ষায় যেসব অঙ্গীকার করা হয়েছে সেগুলো বাস্তবায়ন করা হলে তা সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের সামগ্রিক স্বার্থ রক্ষায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করবে।

নিম্নবিত্ত ও নিম্ন আয়ের মানুষদের জন্য নিত্যপণ্যের দাম বৃদ্ধি গুরুতর সমস্যা। তাদের সামাজিক নিরাপত্তা নিশ্চিতকল্পে নানা সময়োপযোগী পদক্ষেপ নেয়ার বিষয়েও আভাস দেয়া হয়েছে আওয়ামী লীগের ইশতেহারে।

মধ্যবিত্ত, নিম্নবিত্ত ও স্বল্প আয়ের মানুষদের সামাজিক সুরক্ষা নিশ্চিত করার বিষয়ে অনেক কথা বলা হয়েছে। নিত্যপণ্যের দাম ক্রমেই বাড়ছে। অভ্যন্তরীণ বাজারে স্থিতিশীলতা ফিরিয়ে আনতে শুধু দ্রব্যমূল্য নিয়ন্ত্রণই যথেষ্ট নয়।

আওয়ামী লীগের নির্বাচনি ইশতেহারে নিম্ন আয়ের প্রান্তিক, সুবিধাবঞ্চিত মানুষের কথাই বার বার ঘুরেফিরে এসেছে। সুবিধাবঞ্চিত মানুষের অধিকার, সুযোগ-সুবিধার কথা উঠে এসেছে। প্রবীণ, সমাজের পিছিয়ে পড়া মানুষ এমনকি সংখ্যালঘু জাতিসত্তার ক্ষমতায়নের প্রসঙ্গও এসেছে। বিশেষত সংখ্যালঘু জাতিসত্তার মানুষের জন্য আলাদা কমিশন গঠন করার বিষয়টি গুরুত্বপূর্ণ। দেশের পিছিয়ে পড়া জনগোষ্ঠীর ক্ষমতায়নে এই প্রতিশ্রুতি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে।

লেখক: প্রাবন্ধিক ও গবেষক

মন্তব্য

বিশ্লেষণ
How many lives were sacrificed?
বঙ্গবন্ধুর ‘বড়ভাই’ শহীদ ডা. জিকরুল হক স্মরণে

কত প্রাণ হলো বলিদান

কত প্রাণ হলো বলিদান সত্তরের নির্বাচনের আগে সৈয়দপুরে এক জনসভায় বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের পাশে শহীদ ডা. জিকরুল হক। তার পেছনে দাঁড়ানো তাজউদ্দীন আহমদ। ছবি: সংগৃহীত
অনেক ত্যাগ-তিতিক্ষা ও এক সাগর রক্তের বিনিময়ে অর্জিত হয় বাঙালি জাতির মহান স্বাধীনতা। জাতি আজ গভীর শ্রদ্ধাভরে স্মরণ করছে মুক্তিযুদ্ধে আত্মোৎসর্গকারী সেই সব বীর শহীদের। স্বাধীনতার ওই লাল সূর্য ছিনিয়ে আনার পেছনে রয়েছে সন্তান হারানো লাখো মায়ের আর্তনাদ, পিতা হারানো সন্তানের চিৎকার, সম্ভ্রম হারানো নারীর আহাজারি, অগণিত মানুষের স্বজন হারানোর বেদনা। যাদের ঋণ স্বাধীন বাংলাদেশ কোনো দিন শোধ করতে পারবে না।

‘পৃথিবীর এক প্রান্ত থেকে অন্য প্রান্তে জলন্ত/ঘোষণার ধ্বনি-প্রতিধ্বনি তুলে/ নতুন নিশান উড়িয়ে, দামামা বাজিয়ে দিগ্বিদিক/ এই বাংলায়/ তোমাকেই আসতে হবে, হে স্বাধীনতা’।

বাংলাদেশের যুদ্ধকালীন সময়ে লেখা কবি শামসুর রাহমানের কবিতাটি একাত্তর সালের এই দিনে সত্যি হয়ে দেখা দিয়েছিল বাঙালি জাতির জীবনে। আজ থেকে ৫২ বছর আগে ৩০ লাখ শহীদের রক্তের বিনিময়ে ১৯৭১ এর ১৬ ডিসেম্বরে এসেছিল কাঙ্ক্ষিত স্বাধীনতা। যে রেসকোর্স ময়দানে (বর্তমান সোহরাওয়ার্দী উদ্যান) জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান একাত্তরের ৭ মার্চ ‘এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম’ বলে পরোক্ষভাবে স্বাধীনতার ঘোষণা দিয়েছিলেন, সেই রেসকোর্স ময়দানেই পরাজয় মেনে মাথা নত করে ৯৩ হাজার পাকিস্তানি সৈন্য আত্মসমর্পণ করেছিল। পৃথিবীর মানচিত্রে অভ্যুদয় ঘটল স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশের।

অনেক ত্যাগ-তিতিক্ষা ও এক সাগর রক্তের বিনিময়ে অর্জিত হয় বাঙালি জাতির মহান স্বাধীনতা। জাতি আজ গভীর শ্রদ্ধাভরে স্মরণ করছে মুক্তিযুদ্ধে আত্মোৎসর্গকারী সেই সব বীর শহীদের। স্বাধীনতার ওই লাল সূর্য ছিনিয়ে আনার পেছনে রয়েছে সন্তান হারানো লাখো মায়ের আর্তনাদ, পিতা হারানো সন্তানের চিৎকার, সম্ভ্রম হারানো নারীর আহাজারি, অগণিত মানুষের স্বজন হারানোর বেদনা। যাদের ঋণ স্বাধীন বাংলাদেশ কোনো দিন শোধ করতে পারবে না।

বিজয়ের ৫২ বছর পেরিয়ে এসেছে জাতি। কিন্তু স্বাধীনতার দীর্ঘ সময় পেরিয়েও আজও অনেকের ত্যাগ ও বীরত্বগাথা অজানাই রয়ে গেছে। মুক্তিযুদ্ধে এমনই একজন ত্যাগী বীর ছিলেন শহীদ ডা. জিকরুল হক।

জিকরুল হক ১৯৭০ সালের সাধারণ নির্বাচনে পূর্ব পাকিস্তান প্রাদেশিক পরিষদে আওয়ামী লীগের প্রার্থী হিসেবে এমপিএ (মেম্বার অব প্রভিনশিয়াল অ্যাসেম্বলি) নির্বাচিত হয়েছিলেন। তার নির্বাচনী এলাকা ছিল অবাঙালি-অধ্যুষিত। তা সত্ত্বেও তিনি বিপুল ভোটে জয়ী হয়েছিলেন। মূলত জনসেবা, শিক্ষা বিস্তার ইত্যাদি কাজে জড়িত থাকার কারণে। তিনি একজন চিকিৎসক, শিক্ষানুরাগী, সমাজসেবী ও রাজনীতিবিদ হিসেবে নীলফামারী জেলার সৈয়দপুরে খ্যাতিমান ছিলেন।

জিকরুল হকের ছেলে বীর মুক্তিযোদ্ধা ও সৈয়দপুর উপজেলা আওয়ামী লীগের সহসভাপতি মো. মোনায়মুল হক দৈনিক বাংলাকে জানান, “বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বাবাকে ‘বড়ভাই’ বলে সম্বোধন করতেন। একাত্তরের ২৩ মার্চ বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের সঙ্গে বিকেল ৩/৪টার দিকে ফোনে কথা হয় তার বাবার। বঙ্গবন্ধু সৈয়দপুর শহরের রাজনৈতিক পরিস্থিতি তার কাছ থেকে জানার পর আত্মগোপনে যেতে বলেছিলেন। বাবা তা করেননি।”

২৫ মার্চ রাতেই সৈয়দপুর সেনানিবাসে অবস্থানরত পাকিস্তানি সেনাদের একটি দল জিকরুল হককে তার নতুন বাবুপাড়ার বাড়ি থেকে ধরে সেনানিবাসে নিয়ে যায়। এরপর ১২ এপ্রিল রংপুর ক্যান্টনমেন্টের নিসবেতগঞ্জে এক বধ্যভূমিতে জিকরুল হকসহ মোট ১৫০ বাঙালিকে হত্যা করা হয়। এদের মধ্যে বেশ কয়েকজন রাজনৈতিক সহচরও ছিলেন।

মোনায়মুল হক আরও জানান, মুক্তিযুদ্ধের সময় জিকরুল হকের আপন দুই ভাই জহুরুল হক ও আমিনুল হক এবং ভাইপো কুদরত-ই-এলাহীসহ আট আত্মীয় শহীদ হন। তার দুই ভাইয়ের একজনকে জুন মাসের মাঝামাঝি এবং আরেকজনকে ১৪ ডিসেম্বর অবাঙালিরা হত্যা করে। ১৯৯৬ সালে শহীদ বুদ্ধিজীবী দিবসে ডাক বিভাগে তার নামে স্মারক ডাক টিকিট প্রকাশ করা হয়। ২০০১ সালে বাংলাদেশ সরকার তাকে মরণোত্তর স্বাধীনতা পুরস্কারে ভূষিত করেন।

পাকিস্তানি শাসনামলে এক অবাঙালি ম্যাজিস্ট্রেটের সহায়তায় স্থানীয় অবাঙালিরা সৈয়দপুর উচ্চবিদ্যালয়ের সামনে খেলার মাঠে উর্দু স্কুল নির্মাণের উদ্যোগ নিয়েছিলেন। অবাঙালি অধ্যুষিত একই এলাকায় পাশাপাশি দুটি স্কুল নির্মাণ হলে সহিংসতার শঙ্কা ছিল। জিকরুল হক স্থানীয় নেতা ও বাঙালিদের সহযোগিতায় উর্দু স্কুল নির্মাণ বন্ধ করে দিয়েছিলেন।

জিকরুল হকের জন্ম ১৯১৪ সালের ১ সেপ্টেম্বর, সৈয়দপুরে। তার আদি পৈতৃক নিবাস দিনাজপুর জেলার চিরিরবন্দর উপজেলার পলাশবাড়ীতে। বাবা শেখ জিয়ারতউল্লাহ আহমদ, মা খমিউননেছা চৌধুরানী। চার ভাই ও দুই বোনের মধ্যে তিনি ছিলেন দ্বিতীয়। জিকরুল হক নয় ছেলে ও দুই মেয়ের জনক।

১৯৩৩ সালে সৈয়দপুর বাংলা উচ্চবিদ্যালয় থেকে দ্বিতীয় বিভাগে ম্যাট্রিক পাস করেন। ১৯৩৯ সালে কলকাতার ক্যাম্বেল মেডিকেল স্কুল থেকে এলএমএফ পাস করেন। মেডিকেল স্কুলে পড়ার সময় সক্রিয় রাজনীতিতে জড়িয়ে পড়েন।

কলকাতা ক্যাম্বেল মেডিকেল স্কুলে অধ্যয়নকালে তিনি এ কে ফজলুল হক এবং হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দীর সাহচর্যে আসেন এবং ভারত ভাগের পর তাদের অনুপ্রেরণায় রাজনীতিতে অংশ নেন। তিনি ১৯৩০ থেকে ১৯৪০ সাল পর্যন্ত মুসলিম ছাত্র ফেডারেশনের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। এরপর তিনি মুসলিম লীগে যোগ দেন। জিকরুল হক থানা মুসলিম লীগের সেক্রেটারি ও পরে সভাপতি এবং পরবর্তীতে জেলা আওয়ামী লীগের আমরণ সভাপতি ছিলেন। ১৯৫৪ সালে যুক্তফ্রন্টের মনোনয়ন না পেয়ে স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে নির্বাচন করে বিপুল ভোটে জয়ী হয়েছিলেন।

মন্তব্য

বিশ্লেষণ
Awami League is not responsible for dialogue

সংলাপের দায় আওয়ামী লীগের নয়

সংলাপের দায় আওয়ামী লীগের নয় খায়ের মাহমুদ। ছবি: সংগৃহীত
বিগত দুটো নির্বাচনের মতো এই নির্বাচনের আগেও যে সহিংস পরিস্থিতি বিএনপি-জামায়াত তৈরি করেছে তাতে তাদের সঙ্গে সংলাপের দায় কোনোভাবেই বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের নয়। বরং তাদের উচিত সহিংসতা পরিহার করে সরকারের সঙ্গে সংলাপের জন্য সরাসরি প্রস্তাব দেয়া, কোনো বিদেশি প্রভুর মাধ্যমে নয়।

যুক্তরাষ্ট্রের দক্ষিণ এশিয়াবিষয়ক সহকারী পররাষ্ট্রমন্ত্রী ডোনাল্ড লু দ্বাদশ সংসদ নির্বাচনের তফসিল ঘোষণার ঠিক আগে আগে দুটি দলকে চিঠি দিয়ে যে শর্তহীন সংলাপের আমন্ত্রণ জানিয়েছেন তা কোনো ভাবেই কাকতালীয় বা সাধারণ কোনো ঘটনা নয়, বরং গভীর কোনো ষড়যন্ত্রের আভাস বলেই মনে হচ্ছে ।

নির্বাচন কমিশন ওয়েবসাইট অনুযায়ী দেশে মোট নিবন্ধিত রাজনৈতিক দলের সংখ্যা ৪১, তার মধ্যে ফরমায়েশি চিঠি পেলো মাত্র দুটো দল, আওয়ামী লীগ এখনও আনুষ্ঠানিকভাবে চিঠি প্রাপ্তির কথা জানায়নি। আওয়ামী লীগ, বিএনপি এবং জাতীয় পার্টির মধ্যে যে নিঃস্বার্থ সংলাপ মোড়লরা চাচ্ছেন, তাহলে বাকি ৩৮টি নিবন্ধিত দল কী দোষ করল?

তারা দেশে প্রচলিত আইন মেনে নিবন্ধিত হয়েছে, গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় যেকোনো দল নির্বাচিত হয়ে সরকার গঠন করতে পারে, তাহলে কি যুক্তরাষ্ট্র ধরে নিচ্ছে এই ৩ দলের বাইরে দেশে আর কোনো দল নেই বা তাদের হিসেবে তারা দল নয়? শর্তহীন সংলাপ চাইলেন ভালো কথা একটিবার চিঠিতে সহিংসতা বন্ধের কথা বললেন না কোনো? নাকি সহিংসতা, আগুন সন্ত্রাস, রাষ্ট্রীয় সম্পদের ধ্বংস আপনাদের আইনের শাসনের বাইরে?

ফায়ার সার্ভিসের তথ্য অনুযায়ী, গত ২৮ অক্টোবর থেকে গত ১৭ দিনে বিএনপির হরতাল-অবরোধে সারা দেশে অগ্নিসংযোগের ১৫৪টি ঘটনা ঘটেছে। এর মধ্যে ১৩৫টি ঘটনায় পোড়ানো হয়েছে যানবাহন। আগুনে ৯৪টি বাস, ৩টি মাইক্রোবাস, ২টি প্রাইভেটকার, ৮টি মোটরসাইকেল, ১৩টি ট্রাক, ৮টি কাভার্ড ভ্যান, ১টি অ্যাম্বুলেন্স, ২টি পিকআপ, ২টি সিএনজি, ১টি নছিমন, ১টি লেগুনা, ফায়ার সার্ভিসের ১টি পানিবাহী গাড়ি, ১টি পুলিশের গাড়ি, বিএনপির ৫টি অফিস, আওয়ামী লীগের ১টি অফিস, ১টি পুলিশ বক্স, ১টি কাউন্সিলর অফিস, ২টি বিদ্যুৎ অফিস, ১টি বাস কাউন্টার এবং ২টি শোরুম পুড়ে যায়।

গত ১৭ দিনে গড়ে প্রতিদিন ৫টি করে বাস পোড়ানো হয়েছে। বিএনপি কার্যত মাঠে নেই, আন্দোলনের নামে তারা চোরাগোপ্তা হামলা চালিয়ে, গাড়িতে আগুন লাগিয়ে পালিয়ে যাচ্ছে। এই চোরাগোপ্তা হামলা এবং আগুন সন্ত্রাসের মধ্যে কী করে সংলাপ হতে পারে? আপনি যদি রাজনৈতিক সচেতন হন, একটু খেয়াল করলেই দেখবেন গত এক কয়েক মাসে বিএনপির আল্টিমেটাম আর দফার শেষ নেই। একবার ২৭ দফা, একবার ৩১ দফা, সর্বশেষ ১ দফাসহ নানা কথা বলছে দলটি।

একবার বলছে সংসদ ভেঙ্গে দিতে হবে। একবার বলছে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের কথা। একবার বলছে শেখ হাসিনার অধীনে নির্বাচন হবে না। এখন পিটার হাসের সংলাপের ওপর ভর করেছে তারা। বিএনপি আসলে কী চায়? বিএনপির সর্বশেষ ঘোষিত কমিটিতে চেয়ারপার্সনের ৭৩ জন উপদেষ্টা আছেন, আমার কৌতূহল হয় তারা আসলে কি উপদেশটা দেন ! যে দলটি একসময় রাষ্ট্র ক্ষমতায় ছিল তাদের দুর্নীতিগ্রস্ত অপরিপক্ব নেতৃত্ব দেখে একজন সচেতন নাগরিক হিসেবে আমার সত্যি কষ্ট হয়।

বিএনপির সঙ্গে সংলাপের ইতিহাস সুখের নয়, তাদের সঙ্গে যখনই সংলাপের কথা এসেছে, তখনই হয় সংলাপ বর্জন করেছে অথবা শর্ত জুড়ে দিয়ে তা বানচাল করে দিয়েছে। এরা ২০১৪-তে সংলাপে অংশ নেয়নি অন্যদিকে ২০০৭ ও ২০১৮ তে সংলাপে বসলেও শর্ত জুড়ে দিয়ে মিথ্যাচার করে সংলাপগুলোকে প্রশ্নবিদ্ধ করেছে।আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের কিন্তু ১৫ অক্টোবরেই শর্তহীন সংলাপের কথা বলেছিলেন। কিন্তু বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল তা নাকচ করে দিয়ে বলেছিলেন, শর্তহীন সংলাপে রাজি নয় বিএনপি।

স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীও বলেছেন, সংবিধানের কাঠামোর মধ্যে ‘শর্তহীন সংলাপ’ হতে পারে। তিনি বলেছেন, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সব সময় আলাপ-আলোচনা করার জন্য নির্দেশ দেন, বিএনপি তার প্রতিক্রিয়া জানায়নি। ইলেকশন কমিশন দ্বাদশ জাতীয় নির্বাচনের প্রস্তুতি শুরু করার পর ধারাবাহিক ভাবে সকল রাজনৈতিক দলের সঙ্গে আলোচনার জন্যে বসেছে, বিএনপি নির্বাচন কমিশনের ডাকে একবারও সভায় যোগদান করেনি।

তারা সেখান গেলে নির্বাচন কমিশনকে পরামর্শ দিলে, কমিশন যদি না শুনতো বা না বাস্তবায়ন করতো তারা তখন সেটা নিয়ে প্রতিবাদ বা আন্দোলন করতে পারতো কিন্তু কোনো গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ায় অংশগ্রহণ না করে শুধু দোষারোপের রাজনীতি করলে তো আপনি জনগণের সমর্থন পাবেন না । মানুষকে বোকা বানানো এখন আর সহজ না, গ্রামের চায়ের দোকানে বসে তারা মেগাবাইট গিগাবাইটের হিসেবে করে, নির্বাচনে কারচুপির জন্যে ক্যাপিটল হিলের ভাঙচুরের বিষয়ে তারা তর্ক করে।

সুতরাং আপনার আন্দোলনের বিষয়বস্তুর খবর ডিজিটাল বাংলাদেশের কল্যাণে তারা একমুহূর্তেই পাচ্ছে , আপনি জনগণের মনে স্থান করে নিতে পারছেন না, কারণ জনগণের আস্থা অর্জন করার মতো কিছু আপনি করেনি, এখনও করতে পারছেন না। আপনাদের ২০১০ সালের ডিসেম্বর মাসের আরব বসন্তের কথা মনে আছে নিশ্চই, তখন বিবিসিতে একটা প্রোগ্রাম দেখাতো ‘হাউ ফেসবুক চেঞ্জ দা ওয়ার্ল্ড’ অর্থাৎ ফেসবুক তথা সোশ্যাল মিডিয়া কীভাবে পৃথিবীকে পরিবর্তন করে দিচ্ছে, আরব বসন্তের সময়ই প্রথম ফেসবুকে গ্রুপ খুলে মানুষকে একত্রিত করার মতো বিষয় ঘটেছিল।

আর তার একযুগ পর এখন পৃথিবীতে সোশ্যাল মিডিয়াতে যোগাযোগের অসংখ্য মাধ্যম বর্তমান আর তাতে বিএনপি জামাতের কর্মীরা খুব সক্রিয়, মানুষ যদি তাদের বিশ্বাস করতো বা আন্দোলনে সমর্থন দিতো তাহলে কোনো বাধাই আর বাধা হতো না তাদের জন্যে। মানুষ আরব বসন্তের মতো রাস্তায় নেমে আসতো। আসলে মিথ্যা বা ষড়যন্ত্রের উপরে হওয়া আন্দোলন খুব বেশিদূর যেতে পারে না। নেতৃত্বহীন-ভেঙে পড়া বিএনপির এখন একমাত্র ভরসা বিদেশি প্রভুরা, জনগণ নয়। ডোনাল্ড লু আপনি সংলাপ চাইলেন একবার বিএনপির দণ্ডিত নেতৃত্বের পরিবর্তন চাইলেন না কেন? সংলাপ কার সঙ্গে করা সম্ভব?

যে দলের চেয়ারপার্সন দুর্নীতির মামলায় ১৭ বছরের কারাদণ্ডপ্রাপ্ত অপরাধী, ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান ৭৮ বছরের কারাদণ্ডপ্রাপ্ত অপরাধী সে দলের সঙ্গে? ২১ আগস্ট গ্রেনেড হামলা ও হত্যা মামলায় যাবজ্জীবন এবং দুর্নীতি ও অপরাধের অন্য চারটি মামলায় ২৮ বছরের কারাদণ্ড সহ মোট ৫৮ বছরের কারাদণ্ডপ্রাপ্ত পলাতক আসামি বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান। ২১ আগস্টে ২৭ জন মানুষ হত্যা তো আছেই, তা ছাড়া বার বার জননেত্রী শেখ হাসিনাকে হত্যার চেষ্টা করেছে বিএনপি। এমন একটি দলের সঙ্গে কী করে সংলাপ হতে পারে?

নির্বাচনের ট্রেন এখন প্লাটফর্মে, বিএনপি দল হিসেবে উঠতে না পারলে, তরুণ-প্রবীণ নেতৃত্বের অনেকেই সেই ট্রেনে উঠার জন্যে প্রস্তুত। বিএনপিকে কোনো গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ায় আসতে হলে অবশ্যই দণ্ডিত অপরাধীদের দল থেকে বের করে তারপর অন্য আরেকটি গণতান্ত্রিক দলের সঙ্গে সংলাপের কথা বলতে হবে।

বিগত দুটো নির্বাচনের মতো এই নির্বাচনের আগেও যে সহিংস পরিস্থিতি বিএনপি-জামায়াত তৈরি করেছে তাতে তাদের সঙ্গে সংলাপের দায় কোনোভাবেই বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের নয়। বরং তাদের উচিত সহিংসতা পরিহার করে সরকারের সঙ্গে সংলাপের জন্য সরাসরি প্রস্তাব দেয়া, কোনো বিদেশি প্রভুর মাধ্যমে নয়।

লেখক: সহযোগী অধ্যাপক, আইন বিভাগ, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়

আরও পড়ুন:
মেয়র, চেয়ারম্যান, মেম্বার পদে থেকে সংসদ নির্বাচন করা যাবে না
সরকারি বদলি নিয়োগে লাগবে ইসির অনুমতি
নারায়ণগঞ্জে বাম গণতান্ত্রিক জোটের মিছিলে পুলিশের লাঠিচার্জ
নির্বাচনে আন্তর্জাতিক মহলের ‘হস্তক্ষেপে’ উদ্বেগ জাবির ৫ শতাধিক শিক্ষকের
জাতির উদ্দেশে ভাষণে যা বললেন সিইসি

মন্তব্য

বিশ্লেষণ
Sheikh Hasina is a leader and a warrior

শেখ হাসিনা- একজন নেতা, একজন যোদ্ধা

শেখ হাসিনা- একজন নেতা, একজন যোদ্ধা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। ফাইল ছবি
বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বাংলাদেশকে বিশ্বের বুকে শুধু একটি বিরল মাত্রাই দেননি, দেশে বৈশ্বিক উন্নয়ন কর্মকাণ্ডকেও জোরদার করেছেন তিনি। বাংলাদেশের সাধারণ মানুষ প্রায়ই তাকে শুধু জাতীয় দৃষ্টিকোণ থেকে দেখে এবং সেই দৃষ্টিকোণ থেকে মূল্যায়ন করতে অভ্যস্ত, যা নিঃসন্দেহে প্রয়োজনীয়, কিন্তু যথেষ্ট নয়। বৈশ্বিক নেতৃত্ব তার অভ্যন্তরীণ নেতৃত্বের মতোই অতুলনীয় এবং তার অতুলনীয় নেতৃত্বের সম্পূর্ণ বিস্তৃতি তার প্রশংসা ছাড়া বোঝা যায় না।

বঙ্গবন্ধু কন্যা শেখ হাসিনা বাংলাদেশের জনগণের সার্বিক কল্যাণ, উন্নয়ন ও মুক্তির অগ্রদূত হিসেবে কাজ শুরু করেছিলেন। তিনি প্রমাণ করেছেন যে, বাংলাদেশে গণতন্ত্রের উন্নয়নে তার কোনো বিকল্প নেই। শেখ হাসিনার সততা, নিষ্ঠা, যৌক্তিক মানসিকতা, দৃঢ় মনোবল, প্রজ্ঞা ও অসাধারণ নেতৃত্ব বাংলাদেশকে বিশ্ব দরবারে এক ভিন্ন উচ্চতায় প্রতিষ্ঠিত করেছে এবং তিনি এখন বিশ্বখ্যাত নেতা হিসেবে পরিচিত।

আওয়ামী লীগ সব ধরনের শোষণ, বঞ্চনা, অবিচার ও নিপীড়নের বিরুদ্ধে রাজনৈতিকভাবে সোচ্চার, প্রতিরক্ষামূলক ভূমিকা পালন করেছে এবং অব্যাহত রেখেছে। প্রতিষ্ঠালগ্ন থেকেই এটি জনগণের অর্থনৈতিক, সামাজিক, রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক মুক্তির জন্য কাজ করে আসছে। এই দল যখন ক্ষমতায় থাকে, তখন মানুষের ভাগ্যের উন্নতি হয়। এই দলের প্রতিষ্ঠার পর থেকে ৭৪ বছরের ইতিহাস এই সত্যের সাক্ষ্য দেয়।

জাতির পিতা বঙ্গবন্ধুর সাহসী কন্যা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার গতিশীল নেতৃত্বে আওয়ামী লীগ ১৫ বছর ধরে ক্ষমতায় রয়েছে এবং তিনি জনগণের কল্যাণে নিবেদিতভাবে কাজ করে যাচ্ছেন। শেখ হাসিনার অদম্য শক্তি, সাহস, মনোবল ও বলিষ্ঠ নেতৃত্বে বিশ্ব বিস্মিত। বাংলাদেশ ২০৩০ সালের মধ্যে বিশ্বের ২৯তম এবং ২০৪০ সালের মধ্যে ২০তম বৃহত্তম অর্থনীতিতে পরিণত হবে বলে আশা করা যাচ্ছে। এদিকে বাংলাদেশকে ২০২৬ সাল থেকে ‘মধ্যম আয়ের দেশ’ হিসেবে এবং ২০৪১ সালে ‘উন্নত দেশ’ হিসেবে আত্মপ্রকাশ করবে বলে ঘোষণা করা হয়েছে।

বাংলাদেশ যে এগিয়ে যাচ্ছে তার বড় প্রমাণ হলো গত কয়েক বছরে দেশের মানুষের মাথাপিছু আয় বেড়েছে। বর্তমানে মাথাপিছু আয় ২ হাজার ৭৬৫ ডলার। অর্থনৈতিক অগ্রগতির দিক থেকে বাংলাদেশ আজ বিশ্বের অন্যতম শীর্ষ স্থানীয় দেশ।

শেখ হাসিনা ৪টি মাইলফলক দিয়েছেন। প্রথমটি হচ্ছে ডিজিটাল বাংলাদেশ, যা ইতোমধ্যে একটা ধাপ পর্যন্ত বাস্তবায়িত হয়েছে। দ্বিতীয়টি হচ্ছে ২০৩০ সালের মধ্যে টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা (এসডিজি), তৃতীয়টি ২০৪১ সালের মধ্যে উন্নত বাংলাদেশ গড়ে তোলা এবং চতুর্থটি হচ্ছে ২১০০ সালের মধ্যে ডেল্টা প্ল্যান বাস্তবায়ন করা।

গত ১৫ বছরে দেশ পেয়েছে পদ্মা সেতু ও রেল সেতু। ঢাকা মেট্রোরেল, আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের আধুনিক তৃতীয় টার্মিনাল, পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র, কর্ণফুলী টানেল এবং এলিভেটেড এক্সপ্রেস ওয়ের প্রতিশ্রুতি তিনি অসম্পূর্ণ রাখেননি।

এরমধ্যে রাস্তাঘাটের ব্যাপক উন্নতি হয়েছে। কোভিড-১৯ মহামারির কারণে সমগ্র বিশ্বের অর্থনীতি মন্থর হয়ে পড়লেও তিনি এর প্রভাব বাংলাদেশে পড়তে দেননি। নতুন সেতু ও সড়কের মাধ্যমে অবকাঠামোর ব্যাপক উন্নতি হয়েছে। বাংলাদেশ আজ খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণ। কোভিড-১৯ মহামারিতে দলের অগণিত নেতা-কর্মী সবার পাশে দাঁড়িয়েছেন। নৌকা দ্রুত গতিতে দেশকে এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছে। বাংলাদেশ অন্ধকার থেকে এখন আলোর পথে।

শেখ হাসিনা এমন একজন নেতা যিনি বিশ্বের কাছে আলোর আলোকবর্তিকা। বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বাংলাদেশকে শুধু একটি বিরল মাত্রাই দেননি, দেশে বৈশ্বিক উন্নয়ন কর্মকাণ্ডকেও জোরদার করেছেন। বাংলাদেশের সাধারণ মানুষ প্রায়ই তাকে শুধু জাতীয় দৃষ্টিকোণ থেকে দেখে এবং সেই দৃষ্টিকোণ থেকে মূল্যায়ন করতে অভ্যস্ত, যা নিঃসন্দেহে প্রয়োজনীয়, কিন্তু যথেষ্ট নয়। বৈশ্বিক নেতৃত্ব তার অভ্যন্তরীণ নেতৃত্বের মতোই অতুলনীয় এবং তার অতুলনীয় নেতৃত্বের সম্পূর্ণ বিস্তৃতি তার প্রশংসা ছাড়া বোঝা যায় না।

অনেকের হয়তো মনে নেই যে, ২০২০ সালে শেখ হাসিনাসহ ১৮৯ জন রাষ্ট্র ও সরকার প্রধান মিলেনিয়াম ঘোষণাপত্রে বাংলাদেশের পক্ষে স্বাক্ষর করেন। তিনি কেবল সেই ঐতিহাসিক দলিলের স্বাক্ষরকারী হিসাবে ইতিহাসে নিজের জন্য একটি স্থান তৈরি করেননি। এই পদক্ষেপের মাধ্যমে তিনি বাংলাদেশকে একটি বৈশ্বিক অঙ্গীকারের অংশীদার করে তুলেছেন। সেই অঙ্গীকারের ওপর ভিত্তি করে তিনি বাংলাদেশের দৃষ্টিকোণ থেকে ৮টি সহস্রাব্দ লক্ষ্যমাত্রা অর্জনের অঙ্গীকার গ্রহণ করেন। তার নেতৃত্বে বাংলাদেশ দারিদ্র্যের হার ১৯৯০ সালের ৫৮ শতাংশ থেকে ২০১৯ সালের মধ্যে ২০ শতাংশে নামিয়ে আনতে সক্ষম হয়েছে। এই সময়ের মধ্যে বাংলাদেশের মানুষের গড় আয়ু ৫৮ বছর থেকে বেড়ে ৭৩ বছর হয়েছে। প্রাপ্তবয়স্কদের সাক্ষরতার হার ৩৫ শতাংশ থেকে বেড়ে ৭৫ শতাংশে দাঁড়িয়েছে। শিশু মৃত্যুর হার প্রতি হাজারে ১০০ থেকে কমে প্রতি হাজারে ২১ হয়েছে।

১৯৯০ সাল থেকে ২০১৯ সাল পর্যন্ত বাংলাদেশের ৩৫ বিলিয়ন ডলারের অর্থনীতি ৩৩০ বিলিয়ন ডলারে উন্নীত হয়েছে। মানুষের মাথাপিছু আয় প্রায় ৭ গুণ বৃদ্ধি পেয়েছে।

প্রধানমন্ত্রীর দক্ষ ব্যবস্থাপনায় বাংলাদেশের বিভিন্ন আর্থ-সামাজিক উন্নয়ন অর্জন প্রতিবেশী দেশগুলোকে ছাড়িয়ে গেছে। উদাহরণস্বরূপ, বাংলাদেশে গড় আয়ু ৭৩ বছর, ভারতে ৬৯ বছর এবং পাকিস্তানে ৬৭ বছর। বাংলাদেশে পাঁচ বছরের কম বয়সী দের মৃত্যুর হার প্রতি হাজারে ৩১ জন, ভারতে ৩৮ জন, পাকিস্তানে ৬৭ জন।

২০১৫ সালে প্রধানমন্ত্রীর নেতৃত্বে বাংলাদেশ ২০৩০ সালের মধ্যে টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা অর্জনের অঙ্গীকার ব্যক্ত করে এবং এই লক্ষ্যগুলি তার অষ্টম পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনার সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ। বাংলাদেশের উন্নয়ন কর্মকান্ড এই লক্ষ্য অর্জনের দিকে পরিচালিত হয়। পাশাপাশি পরিবেশ ও জলবায়ু পরিবর্তন, নারী অধিকার, শিশু সুরক্ষা, মানবাধিকার প্রভৃতি বিষয়ে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্ব ও অঙ্গীকার আন্তর্জাতিক অঙ্গনে স্বীকৃত ও অভিনন্দন। আমরা সবসময় তাকে উন্নয়নশীল বিশ্বের স্বার্থে কথা বলতে দেখেছি। বাংলাদেশের উন্নয়ন কর্মকান্ড এই লক্ষ্য অর্জনের দিকে পরিচালিত হয়। পাশাপাশি পরিবেশ ও জলবায়ু পরিবর্তন, নারী অধিকার, শিশু সুরক্ষা, মানবাধিকার প্রভৃতি বিষয়ে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্ব ও অঙ্গীকার আন্তর্জাতিক অঙ্গনে স্বীকৃত ও অভিনন্দন। আমরা সবসময় তাকে উন্নয়নশীল বিশ্বের স্বার্থে কথা বলতে দেখেছি।

প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার শাসনামলে বাংলাদেশ নিম্ন আয়ের দেশ থেকে মধ্যম আয়ের দেশে উন্নীত হয়েছে এবং স্বল্পোন্নত দেশ থেকে বেরিয়ে আসার প্রক্রিয়ায় রয়েছে। আজ আমরা ২০৪১ সালের দিকে তাকিয়ে আছি, যখন আমরা বিশ্ব দরবারে উন্নত বিশ্বের অংশ হতে চাই। ভবিষ্যতের দুনিয়া দ্রুত বদলে যাচ্ছে। আজ আমরা যে বিশ্বে বাস করছি, সেখানে বৈষম্য, অস্থিতিশীলতা এবং অপর্যাপ্ততা বাড়ছে। সুযোগ যেমন আছে, তেমনি দুর্বলতাও তৈরি হচ্ছে। এই পরিস্থিতিতে আমাদের এমন একজন নেতা দরকার, যিনি শুধু তার দেশের জন্য নয়, সমগ্র বিশ্বের জন্য অপরিহার্য। বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এমন একজন নেতা- বিশ্বের আলো।

শেখ হাসিনার সরকার শিক্ষার্থীদের বিনামূল্যে বই দিচ্ছেন। দরিদ্র ও মেধাবী শিক্ষার্থীরা বৃত্তি পাচ্ছে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা আন্তরিকভাবে চান শিক্ষার্থীরা শুধু মনোযোগ দিয়ে পড়াশোনা করুক, বাকিটা সরকারের দায়িত্ব। সুতরাং, শিক্ষার্থীদের পড়াশোনার সময় অর্থ নিয়ে চিন্তা করতে হবে না। প্রধানমন্ত্রী চান বাংলাদেশের শিশুরা শিক্ষা, জ্ঞান ও বিজ্ঞানের দিক দিয়ে বিশ্বের সঙ্গে তাল মিলিয়ে চলতে সক্ষম হোক। উপযুক্ত শিক্ষা অবকাঠামো গড়ে তোলার মাধ্যমে তিনি সবাইকে সত্যিকারের শিক্ষিত শিশু হিসেবে গড়ে তোলার সুযোগ করে দিচ্ছেন। শেখ হাসিনার মূলমন্ত্র হলো, মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় বাংলাদেশ এগিয়ে যাবে। তিনি অসাম্প্রদায়িক চেতনায় বিশ্বাসী। বঙ্গবন্ধুর আদর্শকে ধারণ করে তিনি সংখ্যালঘুদের কল্যাণে কাজ করে যাচ্ছেন। প্রতিবেশীদের সঙ্গে বন্ধুত্ব বজায় রেখে উন্নয়নের বিভিন্ন সূচকে ভারতকে টপকে যাচ্ছে বাংলাদেশ।

শেখ হাসিনা দেশবাসীর সেই স্বপ্ন সঠিক পথে বাস্তবায়নে বদ্ধপরিকর। আওয়ামী লীগের নৌকাকে দৃঢ় করে দেশের মানুষ আজ সুখ-সমৃদ্ধির নতুন দিগন্তে প্রবেশ করেছে। আওয়ামী লীগ সরকার জনগণের কল্যাণে কাজ করে যাচ্ছে। তাই বাংলাদেশে বয়স্ক ভাতা, বিধবা ভাতা, মাতৃত্বকালীন ভাতা, কর্মজীবী নারীদের বুকের দুধ সরবরাহকারী ভাতা ইত্যাদি চালু করা হয়েছে।

সবার কল্যাণই শেখ হাসিনা সরকারের ঘোষিত নীতি। ১৪ হাজার ৫০০ কমিউনিটি ক্লিনিক স্থাপন করা হয়েছে। সেখান থেকে ৩০ ধরনের ওষুধ বিনামূল্যে দেওয়া হচ্ছে। নৌকার কারণে স্বাস্থ্য অবকাঠামোর ব্যাপক উন্নতি হয়েছে। চলতি বছরের মে মাসে জাতিসংঘে প্রথমবারের মতো কমিউনিটি ভিত্তিক স্বাস্থ্যসেবা সংক্রান্ত একটি রেজুলেশন সর্বসম্মতিক্রমে গৃহীত হয়। ওই রেজুলেশনের মাধ্যমে বাংলাদেশে কমিউনিটি ক্লিনিকভিত্তিক প্রাথমিক স্বাস্থ্যসেবার মডেল প্রতিষ্ঠায় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার অসামান্য উদ্ভাবনী নেতৃত্ব আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত হয়েছে বলে বাংলাদেশে জাতিসংঘের স্থায়ী মিশন জানিয়েছে। জনগণের দোরগোড়ায় স্বাস্থ্যসেবা পৌঁছে দিতে কমিউনিটি ক্লিনিক মডেল তৈরি করায় জাতিসংঘের স্বীকৃতির পর প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে বিশেষ সম্মাননায় ভূষিত করেছে ব্রাউন ইউনিভার্সিটি।

শুধু স্বাস্থ্যখাত নয়, ভূমিহীনদেরও বিনামূল্যে ঘর দিচ্ছে সরকার। সরকার শুধু ঘর নির্মাণ ের মাধ্যমে তার দায়িত্ব পালন করছে না, সরকারি প্রকল্পগুলো তাদের জীবন ও জীবিকাও প্রদান করছে। এ পর্যন্ত ২১টি জেলাকে গৃহহীনমুক্ত ঘোষণা করা হয়েছে। ২০২১ সালের ২৩ জানুয়ারি মুজিববর্ষে প্রথম ধাপে ৬৩ হাজার ৯টি, দ্বিতীয় ধাপে ২০ জুন ৫৩ হাজার ৩৩০টি এবং তৃতীয় ধাপে ২ দফায় মোট ৫৯ হাজার ১৩৩টি ঘর বিতরণ করা হয়। আরও ২২ হাজার ১০১টি ঘর বিতরণের মাধ্যমে আশ্রয়ণ প্রকল্পের আওতায় মোট সংখ্যা দাঁড়াল ৫ লাখ ৫৫ হাজার ৬১৭টি।

প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার হাত ধরে করোনাভাইরাস মহামারির সময় বাংলাদেশের জনগণ বিনামূল্যে কোভিড-১৯ টিকা পেয়েছে। বাংলাদেশ সরকার বিভিন্ন দেশের সঙ্গে দৃঢ় সম্পর্ক তৈরি করে দেশের মানুষের জন্য সঠিক সময়ে টিকা আনতে পারে। এই সাফল্যের মূল কারিগর প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। কোভিড-১৯ মোকাবেলার পাশাপাশি তিনি সে সময় অর্থনীতির চাকা সচল রাখতে সক্ষম হয়েছিলেন। শেখ হাসিনার নেতৃত্বে বাংলাদেশের সাফল্যে বিস্ময় প্রকাশ করেছে বিশ্ব। সে সময় বেশ কয়েকটি আন্তর্জাতিক সংস্থায়ও বাংলাদেশের প্রশংসা করা হয়েছিল।ওয়ার্ল্ড ইকোনমিক ফোরামসহ বিশ্বের বিভিন্ন সংগঠন। করোনা মহামারি ও ইউক্রেন-রাশিয়া যুদ্ধের পর বিশ্বের অধিকাংশ দেশই অর্থনৈতিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। এমন পরিস্থিতিতেও বাংলাদেশ এগিয়ে যাচ্ছে। করোনার কারণে বাংলাদেশ একটি ব্যর্থ রাষ্ট্রে পরিণত হবে বলে মন্তব্য করা সমালোচকদের মুখে বাংলাদেশের উন্নয়ন ছিল একটি থাপ্পড়। শেখ হাসিনার হাত ধরেই ডিজিটাল বাংলাদেশ আজ বাস্তবে পরিণত হয়েছে। এখন আমরা স্মার্ট বাংলাদেশের দিকে এগিয়ে যাচ্ছি। যেখানে সকল নাগরিক সেবা হাতের নাগালে পাওয়া যাবে। এই ডিজিটাল ও স্মার্ট বাংলাদেশে কেউ ক্ষুধার্ত থাকতে পারবে না। আওয়ামী লীগ সরকার সবার জন্য খাদ্য, বস্ত্র, বাসস্থানের পাশাপাশি সুশিক্ষার ব্যবস্থা করেছে। শেখ হাসিনার নেতৃত্বে বিগত ১৫ বছরের সাফল্যই নৌকার বিজয়ের আসল হাতিয়ার।

যখন বাংলাদেশের সংকট তীব্র হয়, সবকিছু যখন অনিশ্চয়তাকে ঘিরে ঘোরে, বাংলার আকাশে কালো মেঘ জমে থাকে, তখন শেখ হাসিনা আমাদের শেষ ভরসা হয়ে দাঁড়ান। একজন মানুষ অদম্য সংকল্প ও নিষ্ঠার সাথে ভয়ের কালো মেঘ মুছে দেয় এবং দেশের মানুষ আশার আলো দেখতে পায়। যখনই মনে হয় যে সবকিছু শেষ হয়ে যাচ্ছে, আমরা একটি খারাপ সময়ের মুখোমুখি হই, একমাত্র ত্রাণকর্তা যিনি দক্ষতার সাথে খারাপ দুঃস্বপ্নদূর করেন তিনি হলেন আমাদের মাননীয় প্রধানমন্ত্রী। তার পরিচয় একজন প্রধানমন্ত্রী বা রাজনৈতিক নেতার চেয়েও বেশি, তিনি একজন অদম্য সাহসী মানুষ। তিনি একজন যোদ্ধা এবং একজন অভিভাবক। তিনি সাহসের সাথে কোভিড-১৯ মহামারী মোকাবেলা করেছেন, তবুও, এখন তিনি বিশ্বের সেরা উদাহরণ এবং বিশ্ব নেতারা বৈশ্বিক সংকট পরিচালনায় তার উদ্যোগের প্রশংসা করেছেন।

লেখক একজন কলামিস্ট ও গবেষক

আরও পড়ুন:
জেদ্দা থেকে ঢাকায় প্রধানমন্ত্রী
গাজায় অবিলম্বে যুদ্ধবিরতির আহ্বান প্রধানমন্ত্রীর
দ্বিতীয় জয়ের খোঁজে ২৮০ রানের লক্ষ্য পেল বাংলাদেশ
ওমরাহ করলেন প্রধানমন্ত্রী
সৌদি আরবে পৌঁছেছেন প্রধানমন্ত্রী

মন্তব্য

বিশ্লেষণ
The four national leaders were not traitors

জাতীয় চার নেতা বিশ্বাসঘাতক ছিলেন না

জাতীয় চার নেতা বিশ্বাসঘাতক ছিলেন না অধ্যাপক ড. কামালউদ্দীন আহমদ। ছবি: সংগৃহীত
একটি বিষয় লক্ষণীয় যে ৭৫ সালের ১৫ আগস্টের পরে অনেকেই অনেকভাবে, যেটা ভয়ে হোক কিংবা আতঙ্কে হোক আত্মগোপনে ছিল। অনেকেই প্রতিরোধ গড়ে তোলার চেষ্টা করেছিল। বঙ্গবন্ধু হত্যা পরবর্তী সময়ে জাতীয় চার নেতাসহ অনেককেই নানাভাবে প্রলোভন দেখানো হয়েছিলো খুনী মোশতাকের স্বৈরশাসিত সরকারের কেবিনেটে যোগদানের জন্য। কিন্তু তাঁরা ঘৃণাভাবে সেটা প্রত্যাখ্যান করেছিলেন। তখন থেকেই তারা জিয়া এবং মোশতাকের কুনজরে পড়েন।

১৯৭৫ সালের ৩ নভেম্বর ‘জেল হত্যা দিবস’ জাতীয় জীবনে একটি বেদনাদায়ক দিন। সেদিন নির্মমভাবে হত্যা করা হয় জাতীয় চার নেতাকে-যার নজির পৃথিবীর কোনো সভ্য সমাজে আছে কিনা তা আমার জানা নেই। তবে আমার মনে হয় এ ধরনের দৃষ্টান্ত কোথাও নেই।

সেদিন জাতীয় চার নেতার মধ্যে ছিলেন প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদ যিনি বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধকে এগিয়ে নেয়ার ক্ষেত্রে যুদ্ধকালীন সময়ে দীর্ঘ নয় মাস গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব পালন করেন। তাঁকেও নির্মমভাবে হত্যা করা হয়। এছাড়াও ক্যাপ্টেন মুনসুর আলী যিনি বঙ্গবন্ধুর আজীবন সৈনিক ছিলেন, স্বাধীনতার পরে স্বরাষ্টমন্ত্রীর দায়িত্বপালন করেন, কামরুজ্জামান বঙ্গবন্ধুর খুবই কাছের নেতা ছিলেন এবং সৈয়দ নজরুল ইসলাম বাংলাদেশের স্বাধীনতার সময় ভাইস প্রেসিডেন্ট ছিলেন যিনি মেহেরপুরের আম্রকাননে গার্ড অব অনার পরিদর্শন করেন, তাদেরকেও হত্যা করা হয়।

যারা বঙ্গবন্ধুর হত্যাকারী তাদের দীর্ঘদিনের পরিকল্পনা ছিল বঙ্গবন্ধুর সঙ্গের কারোরই চিহ্ণ রাখা যাবে না। সেই লক্ষ্যকে সামনে রেখে স্বাধীনতা বিরোধী পাকিস্তানি গোষ্ঠী বঙ্গবন্ধুকে সপরিবারে ৭৫ এর ১৫ আগস্ট হত্যা করেছিল এবং আওয়ামী লীগ যাতে নেতৃত্বশূন্য হয়ে যায় সে কারণে জাতীয় চার নেতার হত্যাযজ্ঞ।

এখানে একটি বিষয় লক্ষণীয় যে ৭৫ সালের ১৫ আগস্টের পরে অনেকেই অনেকভাবে, যেটা ভয়ে হোক কিংবা আতঙ্কে হোক আত্মগোপনে ছিল। অনেকেই প্রতিরোধ গড়ে তোলার চেষ্টা করেছিল। বঙ্গবন্ধু হত্যা পরবর্তী সময়ে জাতীয় চার নেতাসহ অনেককেই নানাভাবে প্রলোভন দেখানো হয়েছিলো খুনী মোশতাকের স্বৈরশাসিত সরকারের কেবিনেটে যোগদানের জন্য। কিন্তু তাঁরা ঘৃণাভাবে সেটা প্রত্যাখ্যান করেছিলেন। তখন থেকেই তারা জিয়া এবং মোশতাকের কুনজরে পড়েন।

মোশতাক-জিয়া গংরা প্রতিশোধ নেয়ার জন্য তেসরা নভেম্বরে তাদের নির্মমভাবে হত্যাকাণ্ড ঘটায়। এখানে আরেকটা উল্লেখযোগ্য বিষয় হলো- বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে অনেকেই তার ঘনিষ্ঠজন ছিলেন। তাদের মধ্যে অন্যতম খন্দকার মোশতাক যে ছিল বেইমান, খুনী মোশতাক।

সে যে কাজটি করেছে সে কাজটি সায় দেয়ার জন্য কিংবা উদ্বুদ্ধ করার চেষ্টা চালিয়েছিল। উপরন্তু জেলখানায়ও জাতীয় চার নেতার কাছে নানান সময়ে বিভিন্ন প্রস্তাব পাঠানো হয়। যেন মোশতাকের কেবিনেটেই তারা যোগদান করেন। কিন্তু তাঁরা তা ঘৃণাভরে প্রত্যাখান করেন।

হত্যার ঘটনা জাতির জন্য চরম বিপর্যয়কর ছিল। যারা মুক্তিযুদ্ধকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার ক্ষেত্রে এবং বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বকে শক্তিশালী করার ক্ষেত্রে অগ্রণী ভূমিকা পালন করেছিলেন, তাদের ইতিহাস থেকে মুছে ফেলার জন্য হত্যাকারীরা তেসরা নভেম্বর ঘটায়। সে কাজে তারা কতটুকু সফল হয়েছে আজকের প্রজন্ম তা বিচার করবে।

আমাদের মনে আছে তাজউদ্দীন আহমদ স্বাধীনতা যুদ্ধের সময় স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রে কথা বলতেন। আমরা তখন তাঁর বক্তব্য শুনতাম। রণাঙ্গন থেকে তিনি বিভিন্ন সাক্ষাতকার দিতেন এবং এগুলো আমাদের কাছে অনুপ্রেরণামূলক ও যুদ্ধে যোগদানের জন্য উৎসাহের কারণ ছিল। আমাদের কাছে মনে হতো প্রবাসী সরকার যেন বাংলাদেশের মধ্য থেকেই দেশ পরিচালনা করছেন এবং মুক্তিযোদ্ধা ও গেরিলা সকলের জন্যও একটা সাহস সঞ্চারী আইকন।

তাজউদ্দীন আহমদ কোথায় যাননি? কলকাতা থেকে শুরু করে মেঘালয়, আসাম সব জায়গায় তিনি ঘুরে বেড়িয়েছিলেন। মুক্তিযুদ্ধ সংগঠিত করার জন্য, বেগবান করার জন্য তৎকালীন ভারতীয় প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীর সাথে যে যোগাযোগ সেটা তাজউদ্দীন আহমদের সংযোগেই হয়েছিল। তিনি অনেক সাহসী ও আত্মবিশ্বাসী ছিলেন। বাংলাদেশের যোদ্ধা ছিলেন। সম্মুখসারির সমর বিশেষজ্ঞ ছিলেন। আর আমরা মাঝে মধ্যেই তৎকালীন বেতারে তাজউদ্দীনের ইংরেজি বক্তব্য শুনতাম। তাঁর যে উচ্চারণ ছিল তার দ্বারা আমরা অনেকেই অনুপ্রাণিত হতাম।

একটি বিষয় সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ, সেটা হচ্ছে, বিপদ তো বলে কয়ে আসে না। যেমন আমাদের জাতির পিতা বঙ্গবন্ধুকে হত্যা করার জন্য স্বাধীনতা যুদ্ধের আগে থেকেই একটা ষড়যন্ত্র চলছিল এবং সেই গোষ্ঠীরা স্বাধীনতা যুদ্ধের পরে ৭৫ সালে বঙ্গবন্ধু ও তাঁর পরিবারের সদস্যদেরকে নির্মমভাবে হত্যা করে মোশতাকের নেতৃত্বে।

আমরা শুনেছিলাম এই মোশতাক গোপনীয়ভাবে চীনের সঙ্গে যোগাযোগ রক্ষা করে দেশবিরোধী ষড়যন্ত্র করতো। সে কারণে তার ক্ষমতা অনেকটা খর্ব করে দিয়েছিলেন তাজউদ্দীন। আর এসব কারণেই ঈর্ষাপরায়ণ হয়ে ৩ নভেম্বর হত্যাকাণ্ড ঘটে। খন্দকার মোশতাক স্বাধীনতার পরেও তার মুখোশ উম্মোচন করেনি, দলের মধ্যে থেকেই তার ষড়যন্ত্র চালিয়ে গিয়েছিল।

সেনাবাহিনীর তৎকালীন উপ-প্রধান যাকে বঙ্গবন্ধুই সেনাবাহিনীদের ডেপুটি চিফ অফ স্টাফ করেছিলেন, এই পদতো আর সেনাবাহিনীতে ছিল না, বঙ্গবন্ধু জিয়াকে খুশি করার জন্যই এমনটা করেছিলেন। অথচ তারাই ষড়যন্ত্র করে বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ড ঘটিয়েছে।

আমি বলতে চাই এরাই বিশ্বাসঘাতক; যেটা আমি মনে করি দল যারা করেন, বিশেষ করে বঙ্গবন্ধুর আদর্শের যারা, তারা সকলে এই বিশ্বাসঘাতককতার নমুনা ১৯৭৫ সালেই দেখেছেন। আমরা পরবর্তীতেও আরও দেখেছি এই ধরনের বিশ্বাসঘাতকতা। তারা আবার জিয়া ও জেনারেল এরশাদ-এর সাথে হাত মিলিয়েছিল, বেগম জিয়ার সঙ্গে কেউ কেউ দল করেছিল।

বর্তমানে সময়েও বিশ্বাসঘাতকতা রয়েছে এবং এ বিষয়ে আমাদের সচেতন থাকতে হবে। এখনতো আমাদের মাননীয় প্রধানমন্ত্রী বঙ্গবন্ধু কন্যা দীর্ঘ ত্যাগ-তিতিক্ষার বিনিমিয়ে ক্ষমতায়। আজকে তিনি যদি ক্ষমতায় না থাকতেন আপনারা দেখতেন যেকোনো ক্রাইসিসে কত উৎকন্ঠা জন্মাত।

আজকে উন্নয়ন বলেন আর জয়বাংলা বলেন সবকিছুই এই বঙ্গবন্ধুর আদর্শ অনুযায়ী এবং আদর্শকে বাস্তবে রূপায়ণ করার ক্ষেত্রে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার দীর্ঘদিন ক্ষমতায় থাকার ফলেই সম্ভব হয়েছে।

আসলে বিশ্বাসঘাতকতা কোনো ‍কিছুর ক্রাইসিস হলেই বেশি দেখা যায়। যেমন ২০১৪ সালের নির্বাচনে, ২০১৮ সালের নির্বাচনে এবং ২০০১ সালে যে নির্বাচনটিতে সংবিধানকে শ্রদ্ধা করে শেখ হাসিনা অংশগ্রহণ করেছিলেন এবং বিশ্বাসঘাতকরা বাংলাদেশ আওয়ামীলীগকে পরাজিত করে। তার ফলে কি ভয়ঙ্কর ঘটনা ঘটেছিল সকলে আমরা তা জানি। বাংলাদেশের উন্নয়ন স্তব্ধ হয়ে গিয়েছিল। ২০১৪ কিংবা ২০১৮ এর কথা অনুযায়ী যখন কোনো ক্রাইসিস আসে তখনই একটি গোষ্ঠী নড়াচড়া শুরু করে। নানান ধরনের ষড়যন্ত্র শুরু করে। যেমন আমরা উত্তরা ষড়যন্ত্র দেখেছি।

গত ২৮ অক্টোবর (২০২৩)-এর যে ঘটনা সেটাও দেখুন। একটি দেশের সেনাবাহিনীর যিনি নাইন ডিভিশনের জিওসি ছিলেন, সেনাবাহিনীর দায়িত্বশীল ব্যক্তি, মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার কল্যাণেই আস্থার সঙ্গে তাকে এই দায়িত্ব দিয়েছিলেন। কিন্তু দেখেন দেশের যখন ক্রাইসিস পিরিয়ড তখনই এই বিশ্বাসঘাতকতা। আর এই ধরনের বিশ্বাসঘাতকতা জাতীয় নেতারা করেননি। এ ধরনের বিশ্বাসঘাতকদের ‍বিরুদ্ধে আমাদের রুখে দাঁড়াতে হবে। সচেতন থাকতে হবে। সেটা আমাদের কর্মক্ষেত্র হোক আর অন্য যেখানেই হোক না কেন? এদের ‍বিরুদ্ধে সোচ্চার হতে হবে।

বাংলাদেশ যার হাত ধরে স্বাধীন হয়েছিল তাকে কোনভাবেই অপমান করা, অশ্রদ্ধা করা- এ ধরনের ঘটনা বাংলাদেশে হতে দেয়া যাবে না। এই বিষয়ে আমাদের সবসময় সকল ষড়যন্ত্রের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তুলতে হবে।

আর আমরা যারা শিক্ষকতা করি এটাতো কোনো রাজনীতির পর্যায়ে পড়ে না। রাজনৈতিক মত তো সকলেরই আছে। কিন্তু দেশের যে মূল আদর্শ স্বাধীনতা ও মুক্তিযুদ্ধ এগুলোর বিরোধীদের সঙ্গে আপোস হওয়া উচিত নয়। যতদিন বাংলাদেশ থাকবে, এই বিশ্বাসঘাতকদের বিরুদ্ধে আমাদের সোচ্চার হতে হবে। এরা যেন বাংলাদেশের উন্নয়নে বাঁধা হয়ে না দাঁড়ায় এবং সে ধরনের সুযোগ যাতে না পায়, সচেতন থাকতে হবে। বিশ্বাসঘাতকদের বিরুদ্ধে সোচ্চার হতে হবে- আজকের বেদনাদায়ক ৩ নভেম্বর ‘জেল হত্যা দিবসে’র অঙ্গীকার এটা হলে বাংলাদেশের মুক্তিযোদ্ধাদের ত্যাগ সফল হবে। জয় বাংলা।

লেখক: অধ্যাপক, কলামিস্ট এবং ট্রেজারার-জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়

মন্তব্য

p
উপরে