বহুল প্রচলিত একটি কথা আছে- শেষ ভালো যার, সব ভালো তার। অর্থাৎ শুরুটা কেমন হলো না হলো সেটি কিন্তু বড় বিষয় নয়। শ্রেষ্ঠত্বের মঞ্চে দাঁড়িয়ে আপনার শেষের পারফরম্যান্সই সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। তুলির শেষ আঁচড়টি ঠিকমতো দিতে পারলেন কি না- সেটাই আসল।
শেষ কাজটিই করে দেখাল অস্ট্রেলিয়া। ফাইনালের সেরা মঞ্চ মাতিয়ে আবারও বিশ্বকাপের শিরোপা ঘরে তুলল তারা। কিন্তু এই শিরোপা জয়ের পথ অতটা মসৃণ ছিল না তাদের জন্য। ১০ দলের লম্বা টুর্নামেন্টে প্রত্যেক দল প্রত্যেকের বিপক্ষেই খেলেছে।
ভারতবর্ষের ১০টি আলাদা শহরে টুর্নামেন্টের খেলা অনুষ্ঠিত হয়। ফলে ভ্রমণ-ক্লান্তি, কন্ডিশনের সঙ্গে মানিয়ে নেয়া, ইনজুরি সমস্যাসহ নানা চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করে টুর্নামেন্টে চ্যাম্পিয়ন হওয়ার গৌরব অর্জন করেছে অস্ট্রেলিয়া। আগামী চার বছরের জন্য বিশ্ব ক্রিকেটের শ্রেষ্ঠত্বের রাজমুকুট পরল তারা। আমি মনে করি, যোগ্য দল হিসেবেই চ্যাম্পিয়ন হয়েছে দলটি।
ক্রিকেটের সবচেয়ে বড় ভেন্যু নরেন্দ্র মোদি স্টেডিয়ামে লাখো দর্শকের সামনে ফাইনাল ম্যাচে সেরা পারফরম্যান্স করাটা খুবই কঠিন ছিল অজি ক্রিকেটারদের জন্য। স্বাভাবিকভাবেই স্নায়ুচাপে ভুগেছে তারা। সেই চাপ কাটিয়ে সফলতার মুখ দেখেছে চ্যাম্পিয়ন দল।
স্বাগতিক ভারত ও অস্ট্রেলিয়া সেমিফাইনালে খেলা একাদশ নিয়েই ফাইনালের মহাযুদ্ধে নামে। মূলত জয়ের যে মোমেন্টাম ছিল, সেটি দুদলের কেউই হারাতে চায়নি। টানা জয়ের আত্মবিশ্বাস কাজে লাগিয়ে সফলতার লক্ষ্য ছিল দুদলেরই। তবে আমি শুরুতেই বলব, টস ছিল খুবই গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। ফাইনালের দিন টস ভাগ্য ভারতের পক্ষে ছিল না।
অস্ট্রেলিয়া টস জিতে আগে ভারতকে ব্যাটিংয়ে পাঠায়। যদিও ভারতীয় অধিনায়ক রোহিত শর্মা বলেছেন, টস জিতলেও তিনি আগে ব্যাটিংয়ে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিতেন। কেননা ফাইনালের বড় ম্যাচে স্কোর বোর্ডে বেশি রান জমা করতে পারলেই তো জয়ের সম্ভাবনার দরজা খুলে যায়।
ম্যাচের শুরুতেই আমরা দেখলাম, টস জিতে বোলিং করে ভারতকে বেশ চাপে ফেলে দেয় অস্ট্রেলিয়ানরা। কিন্তু পাওয়ার প্লেতে যে রোহিত শর্মার ব্যাটিং-বিস্ফোরণ, সেটি কিন্তু থামানো যায়নি। ফাইনালেও তার মারমুখী ব্যাটিংয়ের প্রদর্শনী দেখা গেছে। ৩১ বল খেলে ৪৭ রানের ঝড়ো ইনিংস খেলে পাওয়ার প্লেতে অস্ট্রেলিয়াকে চাপে ফেলার চেষ্টা করেছেন ভারতীয় অধিনায়ক।
অস্ট্রেলিয়ার ফিল্ডিং ভালো হওয়ায় বেশ কিছু রান সেভ হয়েছে। তারপরও ইনিংসের প্রথম ১০ ওভারে ৮০ রান তোলে ভারত। কিন্তু পাওয়ার প্লেতে ২ উইকেট পতনের পর উল্টো চাপে পড়ে যায় স্বাগতিকরা।
এক প্রান্তে রোহিত আক্রমণাত্মক ব্যাটিং করলেও অপর প্রান্তে উইকেট ধরে রাখতে পারেননি শুভমান গিল। মিচেল স্টার্কের বলে জাম্পার হাতে সহজ ক্যাচ দেন এই ওপেনার। যার ব্যাটের দিকে তাকিয়ে ছিল পুরো ভারতবাসী। বিশ্বকাপের শুরুর দিকে জ্বরে ভুগে বেশ কিছু ম্যাচ মিস করেছেন। ধারণা করা হয়েছিল, ফাইনালের মঞ্চের জন্য সেরা খেলাটা জমিয়ে রেখেছেন গিল! কিন্তু তা হলো না।
অন্যদিকে, অজি পার্ট-টাইমার ম্যাক্সওয়েলের স্পিনে যে রোহিত ধরা খাবেন, সেটিও কিন্তু ধারণার বাইরে ছিল। অবশ্য এ জন্য প্রশংসা প্রাপ্য ট্রাভিস হেডের। অসাধারণ দক্ষতায় কাভার থেকে দৌড়ে গিয়ে রোহিতের যে ক্যাচ ধরলেন, তা ছিল মুগ্ধতা ছড়ানোর মতো ব্যাপার।
প্রথম পাওয়ার প্লেতে ২ উইকেট হারিয়ে বিপদে পড়া ভারত আরও চাপে পড়ে যায় যখন শ্রেয়াস আইয়ার কামিন্সের বলে কিপারের হাতে ক্যাচ দেন। গুরুত্বপূর্ণ তিন উইকেট হারিয়ে বিপাকে পড়া ভারতের স্কোর বোর্ডে রান তোলার গতি খুবই শ্লথ হয়ে যায়। আর এখানেই পিছিয়ে পড়ে দলটি।
১৫ দশমিক ৫ ওভারে দলীয় শত রানে পৌঁছায় ভারত। তিন নম্বরে নামা বিরাট কোহলি বিপর্যয়ের মুহূর্তে ধৈর্যশীল ব্যাটিং করে দলের হাল ধরার চেষ্টা করেন। কোনো বাউন্ডারির দিকে নজর না দিয়ে সিঙ্গেল-ডাবলসে দলকে এগিয়ে নেন। টানা ৬১ বল পর্যন্ত কোনো বাউন্ডারি কিংবা ওভার বাউন্ডারি হাঁকাতে পারেনি ভারত। তাতেই স্পষ্ট বোঝা যায়, কতটা চাপের মুখে ছিল দলটি।
কোহলিদের এই সংগ্রাম করার পেছনে বড় কারণ ওই তিন উইকেটের পতন। অবশ্য ৫৬ বলে ফিফটি পূরণ করে আত্মবিশ্বাসী হয়ে ওঠেন ভারতের ব্যাটিংয়ের মহাতারকা। কিন্তু তার ইনিংসও আর লম্বা হয়নি। কামিন্সের বলে বোল্ড হয়ে সাজঘরমুখী হন। তারপর জাদেজাও ব্যাটিং পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হতে পারলেন না।
১৭৮ রানে ৫ উইকেট হারানোর পরই পুরোপুরি ব্যাকফুটে চলে যায় ভারত। আর ঘুরে দাঁড়াতে পারেনি তাদের ব্যাটিং। এরপর রাহুল আউট হওয়ার পর বিষয়টি এমন দাঁড়ায় যে কত রানে গিয়ে থেমে যায় ভারত।
বিশ্বকাপের শুরু থেকে দুর্দান্ত ক্রিকেটের প্রদর্শনী দেখিয়ে আসা ভারত ফাইনালের মঞ্চে এসে দিকভ্রান্ত হয়েছে। ব্যাটিংয়ে তাদের এতোটা দুর্গতি হবে ভাবা যায়নি। আমি মনে করি, লিগ পর্ব ও সেমিফাইনালে টপ অর্ডার ব্যাটার ভালো করায় ভারতের লোয়ার মিডল অর্ডার ব্যাটারদের পরীক্ষা দিতে হয়নি। তাই তারাও ফাইনালে চাপে পড়ে উইকেট হারান।
স্কোর বোর্ডে যে রান তোলে ভারত, অত অল্প পুঁজি নিয়ে শিরোপা জয় করা সত্যিই অনেক কঠিন কাজ। ফাইনালে সেই অস্ট্রেলিয়া রাজত্ব করেছে। প্রথম দিকে ৩ উইকেট হারিয়ে বিপর্যয়ে পড়লেও ট্রাভিস হেডের অসাধারণ ব্যাটিং নৈপুণ্যে ষষ্ঠ বিশ্বকাপ শিরোপা জয়ের বন্দরে পৌঁছে যায় অস্ট্রেলিয়া।
ফাইনালের মতো বড় মঞ্চের বড় দল অস্ট্রেলিয়া বোলিংয়েও তাদের শক্তি দেখিয়েছে। ফাইনালের আগে কামিন্স যে ঘোষণা দিয়েছিলেন, গ্যালারির লাখো ভারতীয় দর্শককে চুপ করিয়ে দিতে চান- বল হাতে সেই কথা রেখেছেন অস্ট্রেলিয়ার অধিনায়ক। বোলিংয়ে খুবই ডিসিপ্লিন ছিলেন কামিন্স।
আরেকটি বিষয়, খেলার শুরু থেকেই খেয়াল করেছি যে অনেক চাপ অনুভব করছিলেন রোহিত শর্মারা। সেটি লুকানোর কোনো সুযোগ ছিল না।
অন্যদিকে, মাঠে শরীরী ভাষা খুবই আত্মবিশ্বাসী ছিল অস্ট্রেলিয়ানদের। তারা চনমনে ও ফুরফুরে মেজাজে থাকায় ফাইনালের যে চাপ সেটি বেশ ভালোভাবেই কাটিয়ে উঠেছে। আর সেটি প্রভাব ফেলেছে পারফরম্যান্সেও। ফলে আরেকটি বিশ্বকাপ শিরোপা জিতল অস্ট্রেলিয়া। তাদের অভিনন্দন জানাই।