বিশ্বকাপে লিগ পর্বের খেলা শেষ। এখন সেমিফাইনালের জন্য অপেক্ষা। তবে লিগ পর্বে বেশ কিছু দল যেমন আলোড়ন সৃষ্টি করেছে, আবার কিছু দল হতাশায় পুড়ে টুর্নামেন্ট থেকে বিদায় নিয়েছে। আমি মনে করি, এই বিশ্বকাপে যোগ্য চারটি দল সেমিফাইনালে জায়গা করে নিয়েছে। তবে টুর্নামেন্টে সবদিক থেকে অন্যদের চেয়ে আলাদা স্বাগতিক ভারত।
‘নাইন টু নাইন উইন’ নিয়েই বিশ্বকাপের লিগ পর্বের খেলা সম্পন্ন করেছে ভারতীয়রা। ঘরের মাটিতে আয়োজিত বিশ্বকাপে এই দলটি যে এতটা অপ্রতিরোধ্য হয়ে উঠবে, অন্য দলগুলোর সঙ্গে বড় পার্থক্য তৈরি করবে- তা অনুমানে ছিল না। কোনো ম্যাচেই প্রতিপক্ষ দল ভারতকে হারানো তো দূরের কথা, বড় ধরনের চাপেও ফেলতে পারেনি। তাদের দলের প্রতিটি খেলোয়াড় দুর্দান্ত ফর্মে আছেন। যে যেখানে খেলছেন, নিজের সেরাটা ঢেলে দিয়ে দলের সফলতায় কার্যকর ভূমিকা রাখছেন। জয়ের জন্য তাদের যে বাড়তি তাড়না, লড়াইয়ে ঝাঁপিয়ে পড়ার দৃঢ় মানসিকতা, মাঠে শরীরী ভাষা ও নিজেকে নিংড়ে দেয়ার আপ্রাণ প্রচেষ্টা- এসবের সমন্বয়েই অনন্য হয়ে উঠেছে ভারত দলটি।
সর্বশেষ নেদারল্যান্ডসের বিপক্ষে নিয়ম রক্ষার ম্যাচ খেলেছে ভারত। ওই ম্যাচটি যে গুরুত্ব সহকারে খেলেছে তারা, তাতেই পরিষ্কার- বহুদূর যাওয়ার লক্ষ্য তাদের। চ্যাম্পিয়ন হওয়ার মতো দলের যে ধরনের বৈশিষ্ট্য থাকা দরকার, সব রকমের গুণই এই ভারত দলটির মধ্যে আছে। জয়ের যে মোমেন্টাম পেয়েছে তারা, তা ধরে রেখে এগোতে পারলে কাঙ্ক্ষিত লক্ষ্যে পৌঁছাতে পারে রোহিত অ্যান্ড কোং।
অন্যদিকে, এবার বিশ্বকাপে নতুন ধারার ক্রিকেট খেলছে সাউথ আফ্রিকা। পাওয়ার ক্রিকেটের সেরা প্রদর্শনী দেখাচ্ছে দলটি। টুর্নামেন্টের শুরু থেকেই ব্যাটিং-বোলিংয়ে দুর্দান্ত প্রোটিয়ারা। এতে বোঝা যায়, নতুন ইতিহাস গড়ার লক্ষ্যে যুদ্ধে নেমেছে তারা। কিন্তু দলটির মূল সমস্যা হলো- ভালো খেলতে খেলতে এক পর্যায়ে গুরুত্বপূর্ণ ম্যাচে গিয়ে হঠাৎ ফর্ম হারিয়ে ফেলে। এই টুর্নামেন্টেও এমন উদাহরণ তৈরি করেছে তারা। অবশ্য এটি তাদের পুরোনো অভ্যাস। এসব জায়গা থেকে বেরোতে না পারলে আফ্রিকান দলটি এবারও বিপদে পড়তে পারে। তবে পারফরম্যান্স বিবেচনায় ভারতের পেছনে পেছনে ছুটছে অস্ট্রেলিয়া। টুর্নামেন্ট শুরুর দুই ম্যাচে ভারত ও দক্ষিণ আফ্রিকার কাছে হেরে যাত্রা শুরু হয় অজিদের। কিন্তু শুরুতেই টানা হারের পর কীভাবে দুর্দান্তভাবে ঘুরে দাঁড়াতে হয়, সেই দৃষ্টান্ত দেখাল টিম অস্ট্রেলিয়া। ওই দুই হারের পর অপ্রতিরোধ্য পারফরম্যান্স দেখিয়ে যাচ্ছে দলটি। ব্যাটিং, বোলিং কিংবা ফিল্ডিং- তিন বিভাগেই সমান ফর্মে আছে পাঁচবারের বিশ্ব চ্যাম্পিয়নরা। সেমিফাইনালে আরও ভয়ংকর রূপ ধারণ করতে পারে তারা। কেননা বড় ম্যাচে কীভাবে, কী ধরনের ক্রিকেট খেলতে হয়- সেটি বেশ ভালো করেই রপ্ত আছে তাদের। অন্যদিকে, অনেক সম্ভাবনাময় দল হলো নিউজিল্যান্ড। বর্তমান রানার্সআপ দলটি লিগ পর্বের প্রথম চার ম্যাচ জিতে যে রিদমে ছিল, সেটি পরে ধরে রাখতে পারেনি। টানা তিন ম্যাচে হারের কারণে তাদের সেমিফাইনালে ওঠার রাস্তা বন্ধ হওয়ার উপক্রম হয়। তবে শ্রীলঙ্কাকে হারিয়ে শেষ পর্যন্ত শেষ চারে জায়গা করে নেয় দলটি। মূলত ইনজুরি হানা দেয়ায় কিউই দল অগোছালো হয়ে যায়। কয়েকজন গুরুত্বপূর্ণ খেলোয়াড় ইনজুরিতে পড়ায় দলের ভারসাম্য হারিয়েছে। এ জন্য স্বরূপে ফেরাটা কিউইদের জন্য কঠিন হয়ে পড়ে।
এই বিশ্বকাপে সবচেয়ে বড় চমক হলো আফগানিস্তান। খুবই অল্প সময়ে বিশ্ব মঞ্চে জায়গা করে নিচ্ছে দলটি। এবার তিন বিশ্ব চ্যাম্পিয়ন দল- ইংল্যান্ড, পাকিস্তান ও শ্রীলঙ্কাকে হারিয়ে বিস্ময় উপহার দিয়েছে আফগান-যোদ্ধারা। একটি যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশ, যাদের ক্রিকেট কাঠামো ততটা শক্তিশালী নয়, নানা সীমাবদ্ধতা ও প্রতিকূলতার মধ্যে থেকেও দলটি যেভাবে সাহসী ক্রিকেট খেলেছে, তা উচ্চ প্রশংসার দাবিদার। বিশ্বকাপে আফগান-রূপকথার জন্ম দেয়ার নায়ক হলেন রশিদ খান, মোহাম্মদ নবি, মুজিব উর রহমান, ইব্রাহিম জারদান, ফজল হক ফারুকীরা। এ ছাড়া বাছাই পর্বের বৈতরণী পেরিয়ে ১২ বছর পর বিশ্বকাপে খেলতে এসে সাউথ আফ্রিকা ও বাংলাদেশকে হারিয়ে বীরত্ব দেখায় নেদারল্যান্ডস। বিশ্ব মঞ্চে ডাচরা বার্তা দিল যে, নিয়মিত শক্তিশালী দলের বিপক্ষে খেলার সুযোগ পেলে তারাও বড় দলে পরিণত হতে পারে। কিন্তু এবার ইউরোপের পরাশক্তি ইংল্যান্ড নামের প্রতি সুবিচার করতে পারেনি। টানা হারে লিগ পর্বে বিধ্বস্ত হয়েছে দলটি। বর্তমান চ্যাম্পিয়নদের এমন দুর্গতি হবে, কেউই ভাবতে পারেনি। আর যদি বলি পাকিস্তানের কথা, উপমহাদেশের দল হিসেবে ভারতের মাটিতে তাদের কাছ থেকে ভালো ক্রিকেট আশা করেছিলেন দর্শক-সমর্থকরা। কিন্তু আশাহত করেছেন বাবর আজমরা। টুর্নামেন্টে প্রথম দুই ম্যাচে জয় পেয়ে বিশ্বকাপ যাত্রা ছিল সুখকর। কিন্তু এরপর টানা চার ম্যাচে হারের চক্রে পড়ে দিশেহারা হয়ে পড়ে দলটি। সেখান থেকে ‘কামব্যাক’ করলেও বড্ড দেরি হয়ে যায় তাদের। যে কারণে সেমিফাইনালে ওঠার কোনো সমীকরণ মেলাতে পারেনি পাকিস্তান। উপমহাদেশের আরেক দেশ শ্রীলঙ্কাও হতাশায় পুড়েছে। টানা তিন হারে শুরুর পর সর্বশেষ চার হারে ইতি টানে লঙ্কানরা। এর মাঝে দুটি জয় পেলেও ২০২৫ সালের আইসিসি চ্যাম্পিয়ন্স ট্রফি টুর্নামেন্টে খেলার যোগ্যতা অর্জন করতে পারেনি লঙ্কানরা। সেমিফাইনালে খেলার উচ্চাকাঙ্ক্ষা নিয়ে বিশ্বকাপে গিয়ে মুদ্রার উল্টো পিঠ দেখায় বাংলাদেশ। বাংলাদেশের সান্ত্বনার জায়গা হলো পয়েন্ট টেবিলে আটে থেকে চ্যাম্পিয়ন্স ট্রফি টুর্নামেন্টে খেলা নিশ্চিত করা।