একটি দুঃস্বপ্নের বিশ্বকাপ শেষ করল বাংলাদেশ। এবারের বিশ্বকাপে যে ফল করেছে বাংলাদেশ- এটি প্রত্যাশায় ছিল না। যেখানে সেমিফাইনালে খেলার স্বপ্ন ছিল, অন্তত চার-পাঁচটি জয় পাওয়ার আশা ছিল- সেই লক্ষ্য পূরণ হয়নি। টুর্নামেন্টে একের পর এক ম্যাচ হেরে কোণঠাসা হয়ে পড়ে বাংলাদেশ। লিগ পর্বে ৯টি ম্যাচ খেলে মাত্র দুটিতে জয় পেয়েছে টাইগাররা। শুধুমাত্র আফগানিস্তান ও শ্রীলঙ্কাকে হারাতে পেরেছে তারা।
নেদারল্যান্ডসসহ বাকি সাতটি দলের কাছেই হারের হতাশায় পুড়েছে বাংলাদেশ। যেখানে বাছাই পর্ব পেরিয়ে আসা নেদারল্যান্ডসও দুটি জয় পেয়েছে। পয়েন্ট টেবিলের তলানিতে থাকলেও ১২ বছর পর বিশ্বকাপে খেলতে এসে দক্ষিণ আফ্রিকা ও বাংলাদেশকে হারানোর গৌরব অর্জন করেছে ডাচরা।
বলা যায়, নেদারল্যান্ডসের চেয়ে বেশি ভালো কিন্তু করতে পারেনি বাংলাদেশ। আবার যদি শ্রীলঙ্কার সঙ্গে তুলনা করা হয়, তাহলে এ দলটির ভরাডুবি হলেও দুটি জয় পেয়েছে তারাও। বাংলাদেশের চেয়ে অনেক ভালো পারফরম্যান্স করেছে আফগানিস্তান দল। তিন বিশ্ব চ্যাম্পিয়ন- ইংল্যান্ড, পাকিস্তান ও শ্রীলঙ্কাকে হারিয়েছে তারা। অপর তাদের জয়টি ছিল নেদারল্যান্ডসের বিপক্ষে।
ক্রিকেট ইতিহাসে তৃতীয় বিশ্বকাপ খেলতে এসেই সেমিফাইনালে খেলার সম্ভাবনা জাগিয়ে তোলে আফগান-যোদ্ধারা। তারা যে ক্রিকেটে দিন দিন উন্নতি করছে- সেটি দেখাল বিশ্বকাপে। কিন্তু দীর্ঘ দিন ধরে বিশ্বকাপে খেলা বাংলাদেশের পারফরম্যান্সের গ্রাফটা কিন্তু নিম্নমুখী। এ নিয়ে সপ্তম ওয়ানডে বিশ্বকাপ খেলল বাংলাদেশ। শতকরা হিসেবে এবারের বিশ্বকাপে তাদের সাফল্যের হার (ম্যাচ জয়ের ভিত্তিতে) ২২.২২ শতাংশ।
এর আগে যে ছয়টি বিশ্বকাপ খেলেছে বাংলাদেশ- এর মধ্যে ২০০৩ সালের আসর বাদ দিলে এবারের মতো বাজে বিশ্বকাপ আগে কাটেনি টাইগারদের। ১৯৯৯ সালের বিশ্বকাপ আসরে বাংলাদেশের সাফল্যের হার ছিল ৪০ শতাংশ। ২০০৭ সালে ৩৩.৩৩ শতাংশ, ২০১১ সালে ৫০ শতাংশ, ২০১৫ সালে ৫০ শতাংশ ও ২০১৯ সালে ছিল ৩৭.৫০ শতাংশ। এতেই পরিষ্কার যে ২০১৫ সালের বিশ্বকাপে কোয়ার্টার ফাইনালে খেলে যে ইতিহাস গড়েছিল বাংলাদেশ- এরপর থেকে তাদের পারফরম্যান্সের গ্রাফ নিচের দিকেই নামছে।
এবারের বিশ্বকাপের শুরুর আগে দল থেকে তামিম ইকবালের বাদ পড়ার ঘটনায় বিতর্ক তৈরি হয়। কোনো ‘ব্যাকআপ’ ওপেনার ছাড়াই বিশ্বকাপে খেলতে যায় বাংলাদেশ। ধর্মশালায় আফগানিস্তানকে ৬ উইকেটে হারিয়ে শুরুটা ভালো হয়েছিল টাইগারদের। কিন্তু পরের ম্যাচ থেকেই ছন্দপতন ঘটে তাদের। টানা ছয় ম্যাচ হারের বৃত্ত পূরণের পর শ্রীলঙ্কাকে ৩ উইকেটে হারিয়ে আবার জয়ে ফেরে বাংলাদেশ। কিন্তু এই দুই জয়ের মাঝখানে সব হারিয়ে ফেলে দলটি। সেমিফাইনালে খেলার স্বপ্ন ভঙ্গ হয়। কোনো ম্যাচেই সেই অর্থে প্রতিদ্বন্দ্বিতা জমিয়ে তুলতে পারেনি। বিশ্বকাপের মাঝে নতুন করে আইসিসির দেয়া চ্যাম্পিয়ন্স ট্রফিতে খেলার যোগ্যতা অর্জনের চ্যালেঞ্জও সামনে এসে দাঁড়ায়। লিগ পর্বের শেষ ম্যাচে অস্ট্রেলিয়ার কাছে হেরে বিশ্বকাপ মিশন শেষ হয় বাংলাদেশের।
ব্যাটিং-বোলিং ও ফিল্ডিং- তিন বিভাগেই ব্যর্থ হয়েছে বাংলাদেশ। নিজেদের সামর্থ্য অনুযায়ী খেলতে পারেনি। ব্যাটিংয়ে সেভাবে কেউই আস্থা অর্জন করতে পারেননি। প্রায় প্রতি ম্যাচেই টপ অর্ডারে রদবদলের বিষয়টি বেশ আলোচিত ছিল। বিশ্বকাপের মতো বড় মঞ্চে টপ অর্ডারে অতটা পরীক্ষা-নিরীক্ষা করাটা ছিল খুবই দৃষ্টিকটু ব্যাপার। এতে অস্বস্তিতে পড়ে যান ব্যাটাররাও। কেউই নিজেদের সেরাটা খেলতে পারেননি। তবে ব্যতিক্রম ছিলেন মাহমুদউল্লাহ রিয়াদ। খুবই আত্মবিশ্বাসী ব্যাটিং করেছেন। দলের পক্ষে সর্বোচ্চ ৩২৮ রান করেন তিনি। অথচ বিশ্বকাপে খেলা নিয়েই তার শঙ্কা ছিল।
বিশ্বকাপে নিজেদের প্রথম ম্যাচে আফগানিস্তানের বিপক্ষে খেললেও ইংল্যান্ড ম্যাচে একাদশ থেকে বাদ পড়ে যান এই অভিজ্ঞ অলরাউন্ডার। সেই রিয়াদই বিশ্বকাপে সবচেয়ে ভালো ব্যাটিং উপহার দিলেন। সেঞ্চুরির ইনিংস খেলেছেন। বিশ্বকাপে অভিজ্ঞতার যে মূল্য আছে, সেটি বুঝিয়ে দিলেন রিয়াদ। তার সঙ্গে আত্মবিশ্বাসী ব্যাটিং করতে দেখা গেছে মেহেদী হাসান মিরাজকে। কিন্তু উদ্বোধনী জুটি খুবই হতাশ করেছে। ৯ ম্যাচে লিটন দাস করেন ২৮৪ রান। তানজিদ তামিম সম্ভাবনা জাগিয়েও আস্থার প্রতিদান দিতে পারেননি। ৯টি ম্যাচের মধ্যে উদ্বোধনী জুটি থেকে মাত্র দুটি ম্যাচে কিছুটা স্বস্তিদায়ক ব্যাটিং দেখেছে বাংলাদেশ। কিন্তু বাকি ম্যাচগুলোয় হতাশার ছবিই এঁকেছেন দুই ওপেনার লিটন ও তানজিদ।
ব্যাটিং অর্ডারের রদবদলে বেশি ভুক্তভোগী তাওহিদ হৃদয় ব্যাট হাতে সম্ভাবনার বার্তা দিয়েছেন। দলের সবচেয়ে বড় তারকা সাকিব আল হাসানও ব্যাটিংয়ে জ্বলে উঠতে পারেননি। বিশ্বকাপের মাঝেই ব্যাটিংয়ে ভালো করার জন্য ঢাকায় উড়ে এসে শৈশবের কোচের কাছ থেকে পরামর্শ নিতে দেখা যায় সাকিবকে। ব্যাট হাতে টুর্নামেন্টের শেষ দিকে স্বরূপে ফেরার ইঙ্গিত দিলেও আঙুলের চোটের কারণে অস্ট্রেলিয়ার বিপক্ষে ম্যাচটি খেলা হয়নি তার। এর আগে ইনজুরির কারণে ভারতের বিপক্ষে ম্যাচও মিস হয়েছে সাকিবের। অথচ এই সাকিব গত বিশ্বকাপে ব্যাটে-বলে ছিলেন অনন্য।
বোলিংয়েও বাংলাদেশের দুর্দশা দেখা গেছে। পেস ইউনিট প্রত্যাশা অনুযায়ী বোলিং করতে পারেনি। হতাশ হয়েছেন স্পিনাররাও। পেসার শরিফুল ইসলাম ও স্পিনার মেহেদী হাসান মিরাজ দলের পক্ষে সর্বোচ্চ ১০টি করে উইকেট শিকার করেন। সাকিব পান ৯টি উইকেট। ফিল্ডিংয়েও দুর্বল ছিল বাংলাদেশ। ক্যাচ মিস হয়েছে। গ্রাউন্ড ফিল্ডিং ভালো হয়নি। সর্বোচ্চ ৫টি ক্যাচ নেন মাহমুদউল্লাহ রিয়াদ। এসব মিলিয়ে বিশ্বকাপে বাংলাদেশের ব্যর্থতার গল্প রচিত হয়েছে। টাইগারদের সান্ত্বনার বিষয় হলো যে- অন্তত পয়েন্ট টেবিলের তলানিতে থেকে বিশ্বকাপ শেষ করতে হলো না তাদের।
এই বিশ্বকাপ থেকে অনেক কিছু শেখার আছে বাংলাদেশের। বিশ্বকাপের মতো মঞ্চে কীভাবে প্রস্তুতি নিয়ে যেতে হয়, কীভাবে স্পোর্টিং উইকেটে খেলতে হয়, ব্যাটিংয়ে দক্ষতা দেখাতে হয়, ইনিংস লম্বা করতে হয়, বোলিংয়ে নতুনত্ব এনে সফল হতে হয়- এই বিষয়গুলো শিক্ষা নেবে টাইগাররা। তরুণরা যে অভিজ্ঞতা অর্জন করল, তা ভবিষ্যতে কাজে লাগবে। এবার হয়তো নিজেদের শেষ বিশ্বকাপ খেলে ফেলেছেন সাকিব আল হাসান, মুশফিকুর রহিম ও মাহমুদউল্লাহ রিয়াদ। এই সিনিয়র তিন ক্রিকেটারকে হয়তো সামনের ওয়ানডে বিশ্বকাপে আর দেখা যাবে না। আশা করা যায়, বিশ্বকাপে ভরাডুবির পর নতুন করে সবকিছু ঢেলে সাজাবে বাংলাদেশ ক্রিকেট বোর্ড এবং এই ব্যর্থতা থেকে উত্তরণের পথ খুঁজবে।