বিশ্বকাপের শুরু থেকেই সম্পূর্ণ এক নতুন ধারার ক্রিকেট খেলছে দক্ষিণ আফ্রিকা। এ দলটি দুর্ধর্ষ ও দুর্দান্ত। পাওয়ার ক্রিকেটের জন্য যেসব উপাদান থাকা দরকার, সব রকমের মসলাই দলটির মধ্যে আছে।
সর্বশেষ ভারতের বিপক্ষে ৮৩ রানে অলআউট হওয়ার ঘটনা এবং নেদারল্যান্ডসের কাছে হারের অঘটনটি বাদ দিলে দক্ষিণ আফ্রিকা কিন্তু অপ্রতিরোধ্য একটি দল। তাদের চারিত্রিক বৈশিষ্ট্যই হলো আগ্রাসী ও ধুন্ধুমার ক্রিকেট খেলা। এরই মধ্যে তারা সেটি প্রদর্শন করেছে। কিন্তু দুরন্ত গতিতে এগিয়ে যাওয়া দলটি কিন্তু গুরুত্বপূর্ণ ম্যাচে গিয়ে আর পারে না! অর্থাৎ যেখানে তাদের সেরাটা খেলার কথা, সেখানে গিয়ে ‘চোক’ করতে দেখা যায় তাদের। অতীতে তাদের এমন অহরহ ঘটনা দেখেছি। এজন্য তাদের ‘চোকার্স’ বলে সম্বোধন করা হয়।
আমি মনে করি, দীর্ঘ দিন ধরে পুনঃপুন ঘটে যাওয়া ঘটনায় সৃষ্ট সেই হতাশার জায়গা থেকে বেরিয়ে আসতে পারে দলটি। এবার তাদের জন্য সামনে সুবর্ণ সুযোগ। এ কথা বলার কারণ হচ্ছে সেমিফাইনালের টিকিট কনফার্ম তাদের। প্রতিপক্ষ কারা, সেটিও জানা হয়ে গেছে। তাই সেমিফাইনালের আগে পরিকল্পনা ও কৌশল নির্ধারণের জন্য হাতে যথেষ্ট সময় পাচ্ছে তারা।
আরও গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো, আজ আফগানিস্তানের বিপক্ষে ম্যাচে নিজেদের ভালোভাবে যাচাই করে নেয়ার দারুণ সুযোগ তাদের। নিজেদের জন্য এই ম্যাচটি স্রেফ আনুষ্ঠানিকতার হলেও আত্মবিশ্বাস বাড়িয়ে নেয়া, ইতিবাচক দৃঢ় মানসিক শক্তি অর্জন, জয়ের মোমেন্টামে থাকাসহ নানা কারণে বাড়তি গুরুত্ব দিয়েই খেলবে দক্ষিণ আফ্রিকা। ডাচদের কাছে হেরে যাওয়ার যে ক্ষত হয়েছে তাদের, এটি মনে রেখেই আফগানদের বিপক্ষে খুবই সতর্ক ও সাবধান হয়ে খেলবে প্রোটিয়ারা।
নিঃসন্দেহে আফগান-যোদ্ধাদের জয়ের প্রচণ্ড রকমের ক্ষুধা থাকবে। সেই অনুযায়ী আজ নিজেদের সেরা পারফরম্যান্স শো করতে পারে তারা। নকআউট ম্যাচ মনে করে অলআউট ক্রিকেট খেলবে আফগানিস্তান। যুদ্ধবিধ্বস্ত একটি দেশ নিজেদের সুসংগঠিত করে ঐক্যবদ্ধ হয়ে দলবদ্ধ ক্রিকেট খেলে বড় দলগুলো একের পর এক ম্যাচে হারিয়ে দেয়ার যে বীরত্ব দেখাচ্ছে, পৃথিবী যেন অবাক তাকিয়ে রয়!
তিন বিশ্ব চ্যাম্পিয়ন দল- ইংল্যান্ড, পাকিস্তান ও শ্রীলঙ্কাকে হারিয়ে আলোড়ন সৃষ্টি করেছে তারা। এই বড় বড় জয় পেয়ে তাদের যে অভিজ্ঞতা সঞ্চয় হয়েছে, তা কাজে লাগিয়ে সফল হতে চাইবে আফগানরা। রশিদ, মুজিব, নবিরা আফগান-রূপকথা জন্ম দেয়ার মূল নায়ক। এবার সেমিফাইনালে চোখ তাদের। তাই আরেকটি রূপকথার জন্ম দেয়ার জন্য চোয়ালবদ্ধ প্রতিজ্ঞা নিয়ে সর্বশক্তি নিংড়ে দিয়ে ক্রিকেট-যুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়বে তারা।
আমার মতে, টুর্নামেন্টের শেষ দিকে এসে আজ আমরা অন্যতম আকর্ষণীয় ও উপভোগ্য ম্যাচ দেখার সুযোগ পাব বলে আশা করি। এই ম্যাচে আমি দক্ষিণ আফ্রিকাকেই বেশি এগিয়ে রাখছি। তবে কৌশলে নতুনত্ব এনে যদি চমক দেয় আফগানরা, তাহলে অবাক হওয়ার কিছু থাকবে না।
চ্যাম্পিয়ন দলের মতো হতে হলে দক্ষিণ আফ্রিকাকে বেশ কিছু জায়গায় উন্নতি করতে হবে। এ ক্ষেত্রে শুরুতেই বলব, পাওয়ার প্লের কথা। গত ম্যাচে দক্ষিণ আফ্রিকান বোলারদের বিরুদ্ধে পাওয়ার প্লের প্রথম ১০ ওভারে এক উইকেট হারিয়ে ৯১ রান তোলে ভারত। অর্থাৎ নতুন বলে যে তাদের পেসাররা অতটা ধারালো কিংবা কার্যকর ভূমিকা পালন করতে পারেনি, এটি তার প্রমাণ। এই জায়গায় সফল হতে হবে। বোলিংয়ে বৈচিত্র্য আনতে হবে এবং দ্রুত কিছু উইকেট শিকার করে প্রতিপক্ষকে চাপে ফেলতে হবে।
বিপরীতে চিন্তা করলে, ইনিংসের শুরুতে পাওয়ার প্লেতে দ্রুতগতিতে স্কোর বোর্ডে রান তোলার দক্ষতাও দেখাতে হবে ব্যাটারদের। প্রথম ১০ ওভারে যদি ব্যাটিং কিংবা বোলিংয়ে এগিয়ে যাওয়া যায়, তাহলে ম্যাচ সহজ হয়। নতুন কৌশলে এগোতে হবে আফ্রিকানদের। এই পাওয়ার প্লের যথার্থ সদ্ব্যবহার কীভাবে করা যায়, সেটির ‘ড্রেস রিহার্সেল’ আজ দিতে পারে দক্ষিণ আফ্রিকানরা।
আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো, মনঃসংযোগ হারানো যাবে না। পূর্ণ মনোযোগী হয়ে ধীরস্থিরভাবে ঠাণ্ডা মাথায় বুদ্ধি খাটিয়ে খেলা উচিত তাদের। গত ম্যাচে তাসের ঘরের মতো ভেঙে পড়েছে তাদের ব্যাটিং। যা দক্ষিণ আফ্রিকার ইতিহাসে মহা ব্যাটিং বিপর্যয়ে পড়া লজ্জার রেকর্ড। সেমিফাইনাল সামনে রেখে সেখান থেকে তাদের বেরিয়ে আসাটা জরুরি।
জানা গেছে, মনোবিদের দ্বারস্থ হয়েছে দক্ষিণ আফ্রিকা। এটি তাদের জন্য ইতিবাচক দিক। এ ছাড়া আফ্রিকানদের স্পিন খেলায় আরও দক্ষতার পরিচয় দিতে হবে। ফিল্ডিংয়ে এগিয়ে থাকতে হবে তাদের। হাফ-চান্সকে ফুল চান্সে রূপ দিতে হবে। কোনো প্রকার ভুল করা যাবে না। গুরুত্বপূর্ণ সময়ে ছোট একটি ভুলের কারণে বড় মাশুল গুনতে হয়। আমি মনে করি, আফগানদের বিপক্ষে সব দিক থেকে দক্ষিণ আফ্রিকা দলটি নিজেদের সব ধরনের দুর্বলতাগুলো কাটিয়ে ওঠার চেষ্টা করবে।
সর্বশেষ ম্যাচে এক ম্যাক্সওয়েলের কাছেই হার মানতে হয়েছে আফগানিস্তানকে। ম্যাক্সওয়েলের ক্যাচ মিস করেছিলেন মুজিব। অস্ট্রেলিয়ার কাছে হেরে ওই ক্যাচ মিসের চড়া মূল্য দিতে হয়েছে তাদের। শুধু ব্যাটিং কিংবা বোলিং ভালো হলেই সফল হওয়া যায় না। ফিল্ডিংও সমান গুরুত্বপূর্ণ। একটি ভুলের মাশুল দিতে হয় ম্যাচজুড়ে।
আমি মনে করি, গত ম্যাচটি অতীত মনে করেই আজ মাঠে নামবে আফগানরা। তাদের মূল শক্তির জায়গা হলো ধারালো বোলিং। স্পিনের সঙ্গে পেসের যে সমন্বিত শক্তি দাঁড়িয়েছে তাদের, সেই শক্তির বিপক্ষে ব্যাটিং করা কঠিন হতে পারে।
তবে খুবই শক্তিশালী ব্যাটিং লাইনআপ প্রোটিয়াদের। ডি কক, হাইনরিখস, ক্লাসেন, ইয়ানসেনরা ব্যাটিং-বিস্ফোরণ ঘটাতে পারেন। তাই দুদলের ম্যাচে দুর্ধর্ষ ব্যাটিং ও বিধ্বংসী বোলিংয়ের তুমুল লড়াই জমে উঠতে পারে। আর সেখানে কারা এগিয়ে যায়, সেটিই দেখার বিষয়।