বিশ্বকাপের ঠিক মাঝামাঝিতে দাঁড়িয়ে পাকিস্তান ও দক্ষিণ আফ্রিকা দুই দলের মধ্যে ভিন্ন দুই রকমের দৃশ্য দেখতে পাচ্ছি। এক দল দুর্দান্ত পারফরম্যান্স শো করে সেমিফাইনালের পথে এক পা দিয়ে রেখেছে। আরেক দল আদৌ শেষ চারে জায়গা করে নিতে পারবে কি না- তা নিয়ে ঘোর সংশয়ের মধ্যে আছে। এমন পরিস্থিতিতে শুক্রবার চেন্নাইয়ের মাঠে ক্রিকেট-যুদ্ধে নামবে দুই দল।
টানা তিন ম্যাচ হেরে দেয়ালে পিঠ ঠেকে গেছে পাকিস্তানের। এখন তাদের সামনে আগানো ছাড়া গতি নেই; সব রাস্তা বন্ধ। সেমিফাইনালে খেলার যে আশার আলো, সেটি জ্বালিয়ে রাখতে হলে জয় পেতেই হবে। আমি মনে করি, এ অবস্থায় এদিন চেন্নাইয়ে জয়ের পথেই ছুটতে পারে ‘পাকিস্তান-এক্সপ্রেস’।
অন্যদিকে, যদি দক্ষিণ আফ্রিকার কথা বলি, যে উচ্চপর্যায়ের পাওয়ার ক্রিকেট খেলছে তারা, তাদের জয়রথ থামানো অনেক কঠিন হবে। সবদিক থেকেই পাকিস্তানের চেয়ে এগিয়ে আফ্রিকানরা। জয় তুলে নিয়ে পয়েন্ট টেবিলের শীর্ষে ওঠার লক্ষ্য থাকবে তাদেরও। ফলে পাকিস্তান ও দক্ষিণ আফ্রিকার মধ্যে যে একটি হাইভোল্টেজ ম্যাচ হতে যাচ্ছে- সেটি বলার অপেক্ষা রাখে না।
এবারের বিশ্বকাপে চেনা পাকিস্তানকে দেখছি না। টুর্নামেন্টে কেমন যেন অগোছালো লাগছে দলটিকে। ব্যাটিং, বোলিং কিংবা ফিল্ডিং- কোনো বিভাগেই সুবিধা করতে পারছে না।
ভারতের মাটিতে বিশ্বকাপ হওয়ায় অনেক আশা ছিল- ভালো কিছু করার সম্ভাবনার ক্ষেত্র তৈরি করবে তারা। কিন্তু গত তিন ম্যাচে মুদ্রার উল্টো পিঠই দেখাল পাকিস্তান। বড় টুর্নামেন্টে ভারতের কাছে সহজভাবে হারের যে চিরন্তন দৃশ্য- সেটি এবারও বদলাল না।
চিরপ্রতিদ্বন্দ্বীদের কাছে হারের পর যে মানসিকভাবে চাপে পড়েছিল বাবর আজমরা, সেখান থেকে কিছুতেই বের হয়ে আসতে পারেনি। যে কারণে অস্ট্রেলিয়ার কাছে অসহায় হার মেনে নিতে হয়েছে তাদের। এরপর আফগানিস্তানের কাছে হেরে গিয়ে খাদের কিনারায় এখন তারা।
মোটা দাগে বেশ কিছু জায়গায় পাকিস্তান দলের দুর্বলতা ও ব্যর্থতা ফুটে উঠেছে। বিশেষ করে দলের বিশ্বসেরা ব্যাটার বাবর আজম যে রান করেছেন, তা গড়পড়তা ব্যাটারের স্কোর। যে নিজ দলের ব্যাটিং স্তম্ভ হিসেবে বিবেচিত, তার নামের পাশে এমন স্কোর বড্ড বেমানান। এর চেয়ে লক্ষণীয় ব্যাপার হলো- খুব বাজেভাবে আউট হচ্ছেন বাবর। স্পিন খেলতে গিয়েই বেশি ভুগতে দেখা গেছে তাকে।
অজি স্পিনার অ্যাডাম জাম্পার গুড লেংথের বল মিড উইকেট দিয়ে পাঠানোর সময় ক্যাচ দেন পাকিস্তান অধিনায়ক। ভারতের ম্যাচে অর্ধশত রান করার পরপরই সিরাজের বলে বোল্ড হয়ে ফেরেন। নেদারল্যান্ডস ম্যাচে রীতিমতো তাকে উইকেটে হাঁসফাঁস করতে দেখা যায়। শেষ পর্যন্ত অ্যাকারম্যানের বল পুল করতে গিয়ে ক্যাচ দিয়েছেন।
যে আউটটি বাবরকেও পোড়াচ্ছে, সেটি হলো শ্রীলংকার ম্যাচে লেগ স্টাম্পের বলে খোঁচা দিয়ে কিপারের হাতে সহজ ক্যাচ দেন। অফস্পিনার দিলশান মাদুশানাকার নিরীহ প্রকৃতির বলে তার উইকেট বিলিয়ে দেয়ার দৃশ্য দেখা খুবই হতাশাজনক।
আমি মনে করি, এই আউটের ধরন বিশ্লেষণ করে ভুল শুধরে যদি মাঠে নামেন বাবর, তাহলে তার কাছ থেকে সুপার ক্ল্যাসিক ব্যাটিংটাই দেখা যেতে পারে।
চলতি বিশ্বকাপে পাকিস্তানের সবচেয়ে বড় দুর্বলতার জায়গা হলো বোলিং বিভাগ। তাদের যে বিধ্বংসী পেস অ্যাটাক, সেটি কার্যকর ভূমিকা রাখছে না। পেস বোলিংয়ে ধার যেন কমে গেছে! প্রায় প্রতি ম্যাচেই প্রতিপক্ষ দল সাড়ে তিনশর মতো স্কোর গড়ছে। এ জন্য তাদের স্পিন বিভাগও সমানভাবে দায়ী।
শাদাব খান, নাওয়াজরা মাঝের ওভারগুলোতে প্রচুর রান দিচ্ছেন। কিন্তু উইকেট পাচ্ছেন না। স্পিনে তারা বিবর্ণ। তবে চেন্নাইয়ের মাঠে স্পিন ধরার যে ঐতিহ্য রয়েছে, সেটি কার্যকর হলে ঘুরে দাঁড়াতে পারেন পাকিস্তানের স্পিনাররা। প্রতিপক্ষকে কম রানে থামাতে হলে বোলারদেরই দায়িত্ব নিতে হয়।
আফ্রিকান ব্যাটাররা যে ফর্মে আছেন, তাদের ব্যর্থ করতে হলে বোলিংয়ে নতুনত্ব আনতেই হবে শাহিন আফ্রিদিদের।
শুধু ব্যাটিং ও বোলিংয়ে প্রাণবন্ত থাকলেই হয় না, ফিল্ডিংয়ের কারণে ম্যাচে পিছিয়ে যেতে হয়। কিন্তু ফিল্ডিংয়ে বরাবরের মতোই ব্যর্থ পাকিস্তান, যা গত কয়েক ম্যাচে দেখা গেছে। অস্ট্রেলিয়া ও আফগানিস্তানের বিপক্ষে ম্যাচে তাদের ফিল্ডিং পারফরম্যান্স ছিল খুবই বাজে। এ নিয়ে তাদের ভাবতে হবে এবং উন্নতি করতে হবে।
মোট কথা, আত্মবিশ্বাসের যে তলানিতে অবস্থান করছে পাকিস্তান, হতাশা পেছনে ফেলে দৃঢ় মানসিকতা নিয়ে স্বাভাবিক ক্রিকেট খেলতে পারলে বদলে যাবে দলটি।
বিশ্বকাপে দক্ষিণ আফ্রিকাকে আগে এমন আগ্রাসী ও মারকুটে দেখা যায়নি। এবার ভিন্ন এক আফ্রিকাকে দেখছি আমরা। ব্যাটিংয়ে নেমে প্রতিপক্ষ বোলারদের তুলোধুনো করছেন ডি কক, ক্লাসেনরা। পাওয়ার ব্যাটিং কাকে বলে, সেটি দেখিয়ে দিচ্ছেন তারা। ব্যাটিংয়ের পাশাপাশি তাদের ধারালো পেস অ্যাটাকও ধ্বংসাত্মক।
গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো- প্রতিবার টুর্নামেন্টের শুরুতে দক্ষিণ আফ্রিকার পারফরম্যান্স দেখা যায় দুর্দান্ত। কিন্তু শেষদিকে গিয়ে ‘চোকার্স’ শব্দটা গায়ে এঁটে বিদায় নেয় তারা। কিন্তু এবার তাদেরকে এমন দেখা যাচ্ছে না। বিশ্বকাপ জয়ের এক অভিন্ন মিশন নিয়ে খেলছে দলটি। গত পাঁচ ম্যাচ তাদের পারফরম্যান্স যা দেখলাম, তাতে নেদারল্যান্ডস ম্যাচ বাদ দিয়ে এক অপ্রতিরোধ্য দুরন্ত দল দক্ষিণ আফ্রিকা। এই স্পিরিট ধরে রাখতে পারলে অনেকদূর এগিয়ে যাবে আফ্রিকানরা।