ওয়ানডে ক্রিকেটে সম্প্রতি ভারত-বাংলাদেশ ম্যাচ খুবই আকর্ষণীয় হয়ে উঠছে। এই দুই দলের মাঠের লড়াইয়ে যেমন প্রতিদ্বন্দ্বিতার আলাদা ঝাঁঝ ছড়ায়, তেমনি দর্শক-সমর্থকদের মাঝেও উত্তাপ-উত্তেজনা ছড়ায়। এই দ্বৈরথের আবেদন দিন দিন বাড়ছে। আর সেটি বাড়িয়ে দিয়েছে বাংলাদেশই।
গত এশিয়া কাপে ভারতকে হারিয়েছে টাইগাররা। এর আগে ঘরের মাঠে ভারতের বিপক্ষে সিরিজ জয়ের কীর্তি তাদের। সাম্প্রতিক টাইগারদের এই পারফরম্যান্সের কারণেই মূলত বিশ্বকাপে বৃহস্পতিবারের ভারত-বাংলাদেশ ম্যাচটি বিশেষভাবে আকর্ষণীয় হয়ে উঠেছে। এই ম্যাচে কেউই কাউকে দুর্বল বা সবল ভাবার সুযোগ নেই।
আমি মনে করি, দুই দলের মধ্যে মাঠে যাদের শরীরী ভাষা থাকবে আগ্রাসী, থাকবে শক্ত মনোবল আর জয়ের প্রচণ্ড ক্ষুধা এবং পারফরম্যান্সে দ্যুতি ছড়াবে- তারাই ম্যাচটিতে জয়লাভ করবে।
ভারত ম্যাচের আগে বাংলাদেশের ব্যাটিংটাই সবচেয়ে বেশি উদ্বেগের কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। বিশ্বকাপে এখনও ব্যাটাররা ঠিকঠাক মতো ক্লিক করতে পারছেন না। যাদের কাছ থেকে ভালো কিছু আশা করেছিলাম, তারা হতাশ করেছেন।
প্রথম ম্যাচ থেকেই ব্যাটিংয়ে ধুঁকছে বাংলাদেশ। অবশ্য বাংলাদেশের এই ব্যাটিংয়ের রোগটা পুরনো। নিকট অতীতে বেশির ভাগ ম্যাচ বোলাররাই বের করে নিয়ে এসেছেন। ব্যাটারদের পারফরম্যান্স ছিল গৌন।
বিশ্বকাপে গত ম্যাচগুলোয় বাংলাদেশের বিবর্ণ ব্যাটিংয়ের পর ঘন ঘন ব্যাটিং অর্ডারে অদল-বদলকে সামনে এনে কাঠগড়ায় দাঁড় করান অনেকে। আমি মনে করি, প্রতি ম্যাচে ব্যাটিং অর্ডারে পরিবর্তন এনে ব্যাটারদের অস্থির একটা পরিস্থিতিতে ফেলা হলে তাদের ‘কামব্যাক’ করাটা সত্যিই কঠিন হয়ে যায়। যেটা নাজমুল হোসেন শান্ত, মেহেদী হাসান মিরাজ, তাওহিদ হৃদয়দের বেলায় দেখা গেছে। আসল পারফরম্যান্সটা বের করে আনতে হলে ব্যাটিং অর্ডারে তাদের একটি স্থায়ী জায়গা করে দিতে হবে। যেখানে তারা স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করে এবং আগাম প্রস্তুতি নিতে পারে।
এটা সত্য, আমাদের যে ব্যাটিং-শক্তি রয়েছে, তা অমিয় সম্ভাবনার। ব্যাটারদের দেয়ার অনেক কিছু আছে। ভারতের বিপক্ষে যে বড় ম্যাচ খেলতে যাচ্ছে বাংলাদেশ, জয় পেতে হলে সেখানে পূর্ণ ব্যাটিং শক্তিটাই দেখাতে হবে টাইগারদের।
ভারতের পেস ইউনিট খুবই আতঙ্কের কারণ হতে পারে। বুমরাহ, পান্ডিয়া, সিরাজ, শামিদের তুফানগতির ধারালো ও দুর্ধর্ষ বোলিংয়ের বিরুদ্ধে স্কোরবোর্ডে রান তুলতে হলে ব্যাটিংয়ে কারুকার্য ও নিপুণ দক্ষতা দেখাতে হবে ব্যাটারদের। কেননা বুমরাহদের বল খেলা খুবই দুর্বোধ্য কাজ। অবশ্য অতীতে তাদের বিরুদ্ধে খেলেছে বাংলাদেশ। সফলও হয়েছেন ব্যাটাররা। আশা করি, সেই অভিজ্ঞতা কাজে লাগিয়ে নৈপুণ্য দেখাতে সক্ষম হবেন তারা।
সিম বোলিংয়ের পাশাপাশি ভারতের স্পিনত্রয়ী- অশ্বিন, জাদেজা ও কুলদীপ বিশ্বকাপে রাজত্ব করছেন। তাদের মায়াবীতে ঘূর্ণির বোলিং সামলানোটাও হবে কঠিন চ্যালেঞ্জের। এ ক্ষেত্রে আমি বলব যে, ভারতের বোলারদের সামনে কোনোভাবেই ছাড় পাবেন না বাংলাদেশের ব্যাটাররা। ভারতীয়দের ব্যর্থ করতে হলে নিজেদের সেরা ব্যাটিংটাই উপহার দিতে হবে আমাদের।
বিশ্ব ক্রিকেটে ব্যাটিংয়ে অনেক বড় নাম বিরাট কোহলি ও রোহিত শর্মারা। ভারতীয় ব্যাটিংয়ের মূল স্তম্ভ হলেন তারা। বোলিংয়ে নতুনত্ব না এনে তাদের বিপক্ষে বোলিং করতে গেলে মার খেতেই হবে। কেননা দুর্দান্ত ফর্মে আছেন তারা। কার বল কীভাবে খেলতে হবে- দক্ষতা ও কৌশলের দিক দিয়ে অন্যদের চেয়ে বহুগুণ এগিয়ে তারা। ফলে তাদের ব্যর্থ করার চ্যালেঞ্জটা পরিকল্পনামাফিক নিতে হবে তাসকিন, মোস্তাফিজদের।
বিশ্বকাপে এ পর্যন্ত বাংলাদেশের পেস ইউনিট পারফরম্যান্স ‘আপ টু দ্য মার্ক’ হচ্ছে না। গত কয়েক বছর ধরে এই পেসাররা দারুণ পারফরম্যান্স দেখিয়ে যাচ্ছেন। বিশ্বকাপে যেন সেই উজ্জ্বলতায় ভাটা পড়ে গেল! চলতি বছর বাংলাদেশের হয়ে সর্বোচ্চ উইকেট শিকারি তাসকিনের বিশ্বকাপ ভালো কাটছে না। এর মধ্যে তার বলে কমে যাওয়া পেস ও লেংথ নিয়ে কথা শুরু হয়ে গেছে। সেখান থেকে ঘুরে দাঁড়ানোর সেরা সুযোগ তার সামনে। যে ভারতের বিপক্ষে ম্যাচ দিয়ে তাসকিনের আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে স্বপ্নের পথচলা শুরু, সেই দলের বিপক্ষে স্বরূপে ফেরাটা প্রত্যাশিতই হতে পারে। তার সঙ্গে মোস্তাফিজও ভয়ংকর হয়ে উঠতে পারেন।
কথা হলো- বিরাট-রোহিতদের সমন্বয়ে গড়া ভারতের শক্ত ব্যাটিং-দেয়াল ভেঙে দিতে হবে, গুঁড়িয়ে দিতে হবে। এ ক্ষেত্রে পেসারদের পাশাপাশি স্পিনাররাও কার্যকরি ভূমিকা রাখতে পারেন। আগের ম্যাচগুলোয় সাকিব ব্রেক থ্রু এনে দিয়েছেন। তার সঙ্গে মিরাজও আছেন। বাড়তি স্পিনারের অপশন হিসেবে নাসুম ও শেখ মেহেদীকে রাখা যেতে পারে। এ ক্ষেত্রে বাঁ-হাতি ও ডানহাতি ব্যাটারের কম্বিনেশন বিবেচনায় আসবে।
একাদশে ব্যাটিং গভীরতার পাশাপাশি বিধ্বংসী বোলিং লাইনআপও রাখতে হবে। নিয়মিত তিন পেসার নিয়ে খেলছে বাংলাদেশ। মাহমুদউল্লাহ দলে জায়গা পাওয়ায় ব্যাটিং গভীরতা থাকছে আট নম্বর পর্যন্ত। গত ম্যাচে তার পারফরম্যান্স সেই জায়গা আরও পাকপোক্ত করেছে।
পুনের মাঠে খেলা হবে। শুনেছি, মাঠটির বাউন্ডারি ছোট। যদি সত্যি তাই হয়, তা হলে বড় শট খেলা ব্যাটাররা বেশি রান পাবেন। চার-ছক্কা হবে বেশি। স্কোরবোর্ডে রান উঠবে। অর্থাৎ বড় স্কোর হবে নিঃসন্দেহে।
আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো- ছোট মাঠে গোছানো ফিল্ডিং দিতে হয়। গত ম্যাচে ফিল্ডিংয়ে আমাদের দুর্বলতা দেখা গেছে। এখানে কোনো সুযোগ নষ্ট করা যাবে না। ভারতের মতো দলকে হারাতে হলে সব বিভাগে সমানভাবে ভালো খেলতে হবে। তা না হলে ফল হবে আগের মতোই হতাশার। বাংলাদেশ ঘুরে দাঁড়াক, জেগে উঠুক নতুন শক্তিতে, বিশ্বকাপে প্রাণ ফিরে পাক বাংলাদেশ ক্রিকেট- এমন আশাই করছি।