অবশেষে অপেক্ষার অবসান। সকল হতাশা আর আক্ষেপের অবসান ঘটিয়ে উয়েফা চ্যাম্পিয়ন্স লিগ জিতল ম্যানচেস্টার সিটি। ২৩তম দল হিসেবে ইউরোপ সেরার খেতাব জিতল জোসেপ গার্দিওলার শিষ্যরা।
তুরস্কের ইস্তানবুলের আতাতুর্ক অলিম্পিক স্টেডিয়ামে ইন্টার মিলানের বিপক্ষে ১-০ গোলের জয়ে চলতি মৌসুমের চ্যাম্পিয়ন্স লিগ জিতেছে ইংলিশ প্রিমিয়ার লিগ ও এফএ কাপ চ্যাম্পিয়নরা।
বাংলাদেশ সময় রাত একটায় ম্যাচটি শুরু হয়। ম্যাচের শুরু থেকেই সতর্কতার সঙ্গে খেলতে থাকে দুই দল। ফলে মাঝমাঠে বল দখলের একটা তাড়না থাকলেও তা শেষ পর্যন্ত প্রতিপক্ষের ডি-বক্সের মধ্যে নিতে বেশ বেগ পেতে হচ্ছিল দুই দলকেই।
ম্যাচের প্রথম সুযোগটি পায় ম্যানচেস্টার সিটি। ম্যাচের ২৭তম মিনিটে জন স্টোনসের বাড়ানো বল পেয়ে ইন্টারের দুই ডিফেন্ডারকে কাটিয়ে ডি-বক্সের মধ্যে ঢুকে যান আর্লিং হলান্ড। কিন্তু প্রথম টাচটি জোরে লাগায় বল একটুখানি নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যায় তার। ফলে পরে বাঁ পা প্রসারিত করে গোলে শট নিলেও পা দিয়ে বল ঠেকিয়ে দেন ইন্টার মিলানের গোলরক্ষক আন্দ্রে ওনানা। এর দুই মিনিট পর মাঝমাঠ থেকে কয়েকজনকে কাটিয়ে ডি-বক্সের বাইরে থেকে জোরে শট নেন ডি ব্রুইনে। কিন্তু শটটি গোলপোস্টের বাইরে দিয়ে বেরিয়ে যায়।
প্রথমার্ধে দুই দলের কেউ আর তেমন কোনো সুযোগ তৈরি করতে না পারলেও বড় ধাক্কা খায় সিটি। খেলার ৩০তম মিনিটে হ্যামস্ট্রিংয়ে টান লাগে কেভিন ডি ব্রুইনের। তৎক্ষণাৎ মাঠের বাইরে নিয়ে তাকে প্রাথমিক চিকিৎসা দিয়ে আবার ফেরানো হয় মাঠে। কিন্তু খেলার ৩৬তম মিনিটে তিনি খেলতে না পারার ইঙ্গিত দিলে তাকে উঠিয়ে নিতে বাধ্য হন পেপ গার্দিওলা। এ সময় ডি ব্রুইনের পরিবর্তে ফিল ফোডেনকে নামান কোচ।
প্রথমার্ধে দুই দলের কেউই তেমন চমক জাগানো পারফর্ম্যান্স দেখাতে না পারলেও দুই ইন্টেরিয়রে ইন্টার মিলানের ডেনসেল ডুমফ্রিস ও ফেদেরিকো দিমারকোর পারফর্ম্যান্স ছিল চোখে পড়ার মতো। রাইট ব্যাক পজিশনে নেমে এসে একাই জ্যাক গ্রিলিশ ও আর্লিং হলান্ড আটকে রেখেছিলেন ডুমফ্রিস। অন্যপাশে বল উদ্ধার ও দারুণ কিছু পাস দিয়ে নিজের দক্ষতার জানান দেন দিমারকো।
তবে দুই দলের কেউই তেমন কোনো সুযোগ তৈরি করতে না পারায় গোলশূন্য অবস্থায় ড্রেসিং রুমে ফেরে খেলোয়াড়রা।
দ্বিতীয়ার্ধের শুরুর দশ মিনিটেই ইনজুরি পড়েন ইন্টার মিলানের স্ট্রাইকার এডিন জেকো। ফলে ম্যাচের ৫৭তম মিনিটে তাকে উঠিয়ে চেলসি থেকে ধারে খেলা রোমেলু লুকাকুকে মাঠে নামান সিমোনে ইনজাগি।
এক মিনিট পরই ম্যাচের সবচেয়ে বড় সুযোগ পান ইন্টারের লাউতারো মার্তিনেস। বেরনার্দো সিলভার ব্যাকপাস টের না পেয়ে তা রিসিভ করতে ব্যর্থ হন মানুয়েল আকাঞ্জি। ভুলের সুযোগ নিয়ে বল ধরে বাঁ পাশ দিয়ে এগিয়ে যান লাউতারো মার্তিনেস। কিন্তু খানিকটা সামনে এগিয়ে এসে লাউতারোর স্পেস কমিয়ে দেন সিটির গোলরক্ষক এদেরসন মোরায়েস। ফলে এদেরসনের পায়ের ফাঁক দিয়ে বল জালে পাঠানোর চেষ্টা করলেও তা ঠেকিয়ে দেন তিনি।
এসময় বল রিসিভ করে দ্রুত পাস দিলে বল ধরে এগোতে থাকেন ফোডেন। বিপদের শঙ্কায় ডি-বক্সের বাইরে ফোডেনকে প্রফেশনাল ফাউল করে এসময় হলুদ কার্ড দেখেন নিকোলো বারেল্লা।
খেলার ৬৮তম মিনিটে আসে সেই আকাঙ্খিত মুহূর্ত। একটি মজবুত গেম ডেভেলপমেন্টের পর মানুয়েল আকাঞ্জি পাস দেন ডান পাশ দিয়ে ফাঁকা হয়ে যাওয়া সিলভাকে। ডি-বক্সে পাঠানো সিলভার পাস ইন্টারের একজন ডিফেন্ডার ক্লিয়ার করলে তা গিয়ে পড়ে সিটির রদ্রির পায়ে। জোরালো সোজাসুজি শটে তিনি তা পাঠিয়ে দেন জালে। আর উল্লাসে ফেটে পড়ে সিটির সমর্থক, খেলোয়াড় ও কোচং স্টফরা। ১-০ গোলের ব্যবধানে এগিয়ে যায় সিটি।
এর কিছুক্ষণ পরেই ভাগ্যের ফেরে গোলবঞ্চিত হয় ইন্টার মিলান। ম্যাচের ৭১তম মিনিটে উড়ন্ত বল পেয়ে এদেরসনের মাথার উপর দিয়ে হেড দেন দিমারকো। কিন্তু বল গোলপোস্টে লেগে ফিরে আসলে আবারও মাথায় পেয়ে যান দিমারকো। এবার সর্বশক্তি প্রয়োগ করে হেড দিলেও বল সামনে দাঁড়িয়ে থাকা লুকাকুর শরীরে লেগে ফিরে আসে।
তার দুই মিনিট পর থ্রু বল পেয়ে দুইজন ডিফেন্ডারকে কাটিয়ে রুবেন দিয়াসের দুই পায়ের মাঝ দিয়ে শট দেন লুকাকু। কিন্তু বল গোলপোস্টের মধ্যে রাখতে ব্যর্থ হন তিনি।
ম্যাচের অতিরিক্ত সময়ে গোল দেয়ার দুটি ভালো সম্ভাবনা তৈরি করলেও শেষ পর্যন্ত আর তার দেখা পায়নি ইন্টার। ফলে অতিরিক্ত পাঁচ মিনিট শেষে বেজে ওঠে শেষের বাঁশি। আর মাঠে ভেঙে পড়ে সিটির আনন্দের বাঁধ।
নিজেদের প্রথম চ্যাম্পিয়ন্স লিগ শিরোপা জিতে আনন্দ ধরে রাখতে পারেনি অনেক খেলোয়াড়ই। মাঠের মধ্যেই কান্নায় ভেঙে পড়েন তারা। কাঁদেন এই আনন্দ ভাগ করে নিতে ইংল্যান্ড থেকে তুরস্কে আসা অসংখ্য সিটি সমর্থকও।
ঘরোয়া লিগে প্রতি মৌসুমে লিগ ও বিভিন্ন ঘরোয়া ট্রফি জিতলেও ইউরোপের মঞ্চে বার বার হোঁচট খাচ্ছিল পেপ গার্দিওলার ম্যানচেস্টার সিটি। ২০২১ সালে একবার ফাইনালে উঠেও লিগ প্রতিপক্ষ চেলসির কাছে হেরে সে বার স্বপ্নভঙ্গ হয় তাদের। তাই এবারের জয়টি আসলেই সিটির খেলোয়াড় ও সমর্থকদের কাছে বিশেষ কিছু।
এদিকে বার্সেলোনার হয়ে সবশেষ ২০১২ সালে চ্যাম্পিয়ন্স লিগ জেতার পর বায়ার্ন মিউনিখ ও পরে ম্যানচেস্টার সিটির কোচ হয়েও এতবছর ইউরোপ সেরার এই ট্রফিটি ছোঁয়া হয়নি পেপ গার্দিওলার। প্রতিবছর কাড়ি কাড়ি টাকা খরচ করে শক্তিশালী স্কোয়াড তৈরি করেও চ্যাম্পিয়ন্স লিগ থেকে ফিরে আসতে হয়েছে তাকে। এ জয়ে ফলে ১১ বছরের প্রতীক্ষার অবসান হলো তার।
চ্যাম্পিয়ন্স লিগ জয়ে বিরল এক মৌসুম শেষ করল ম্যানচেস্টার সিটি। স্যার অ্যালেক্স ফার্গুসনের ম্যানচেস্টার ইউনাইটেডের পর ইংলিশ প্রিমিয়ার লিগের দ্বিতীয় দল হিসেবে ট্রেবল জিতল পেপ গার্দিওলার ম্যানচেস্টার সিটি।
তাছাড়া দুইবার ট্রেবল জয়ের রেকর্ড এখন শুধুই স্প্যানিশ এ ম্যানেজারের। এর আগে ২০০৮-২০০৯ মৌসুমে বার্সেলোনার হয়ে ট্রেবল জিতেছিলেন তিনি।
শুধু তাই নয়, সবশেষ তিন সপ্তাহ একেবারে স্বপ্নের মতো কাটলো স্কাই ব্লুজদের। এ সময় প্রতি সপ্তাহে একটি একটি করে ট্রফি জিতে স্বপ্নীল এক মৌসুম শেষ করলো ‘ম্যানচেস্টার ইজ ব্লু’ স্লোগানের দলটি।