বাংলাদেশ

মতামত

খেলা

বিনোদন

জীবনযাপন

তারুণ্য

কিড জোন

অন্যান্য

রেস-জেন্ডার

ফ্যাক্ট চেক

স্বাস্থ্য

আন্তর্জাতিক

শিক্ষা

অর্থ-বাণিজ্য

বিজ্ঞান-প্রযুক্তি

বাংলাদেশে ‘ব্রাজিল-আর্জেন্টিনা’ দ্বৈরথ

  •    
  • ২২ নভেম্বর, ২০২২ ০০:১৫

চার বছর পরপর ফুটবল বিশ্বকাপ এলেই বাংলাদেশিরা কেমন যেন পাল্টে যায়। বলতে গেলে দুই ভাগে ভাগ হয়ে যায় জাতি; একদল ব্রাজিল, অন্যদল আর্জেন্টিনা।

যে কোনো ক্রীড়া দলের চেয়ে বাংলাদেশে ব্রাজিল ও আর্জেন্টিনার ফুটবল দলের ভক্ত সংখ্যা বেশি এ কথা নির্দ্বিধায় বলা যেতে পারে। আর বিশ্বকাপ এলে এই ভক্তি পরিণত হয় উন্মাদনায়। কেন হাজার মাইল দূরের দুটো দেশের ফুটবল দল বাংলাদেশে এতো জনপ্রিয় সেটা নিয়ে একটি বিশ্লেষণ প্রকাশ করেছে যুক্তরাষ্ট্রের দৈনিক দ্য ওয়াশিংটন পোস্ট। সেটির অবলম্বনে নিউজবাংলার পাঠকদের জন্য তুলে ধরা হলো বিশেষ এ প্রতিবেদন।

বিশ্বকাপে ব্রাজিল-আর্জেন্টিনা ম্যাচ মানে বাংলাদেশে বাড়তি উত্তেজনা। ঢাকা থেকে ৯ হাজার ৫০৩ মাইল দূরের রিও ডি জেনেইরো ও ১০ হাজার ৪২০ মাইল দূরের বুয়েনোস আইরেসের উন্মাদনা টের পাওয়া যায় দক্ষিণ এশিয়ার ছোট্ট এই দেশটিতে।

বিশ্বের অষ্টম জনবহুল দেশ বাংলাদেশ ক্রিকেটপাগল হিসেবে পরিচিত। তবে চার বছর পরপর ফুটবল বিশ্বকাপ এলেই বাংলাদেশিরা কেমন যেন পাল্টে যায়। বলতে গেলে দুই ভাগে ভাগ হয়ে যায় জাতি; একদল ব্রাজিল, অন্যদল আর্জেন্টিনা। জার্মানি, ইতালি, ফ্রান্সের ভক্তও কিছু আছে। তবে তারা ব্রাজিল-আর্জেন্টিনার সমর্থকদের মতো নয়।

প্রজন্মের পর প্রজন্ম ধরে আর্জেন্টিনা ও ব্রাজিলকে তীব্র আবেগ নিয়ে সমর্থন করে আসছে বাংলাদেশিরা। বিশ্বকাপের মৌসুমে এক ধরনের প্রতিযোগিতায় নেমে পড়েন দুই দলের সমর্থকরা।

বাসার ছাদে তারা পছন্দের পতাকা ওড়ান, পতাকার আদলে বারান্দা সাজান। চায়ের কাপে চলে তুমুল বিতর্ক। এমন দৃশ্য নেইমার বা মেসিদের দেশেও হয়ত খুব একটা দেখা যায় না। মাঝে-মধ্যে দুই দলের সমর্থকদের ইট-পাথর ছুঁড়তেও দেখা যায়। মজার বিষয় হলো, এসব সমর্থকদের বেশিরভাগই ব্রাজিল বা আর্জেন্টিনার কোনো নাগরিককে কখনও সরাসরি দেখেনই নি।

আকিদ কাদের চৌধুরী একজন ব্রাজিলভক্ত। কাজ করেন টেলিকমিউনিকেশনে, থাকেন ঢাকায়। ওয়াশিংটন পোস্টকে তিনি বলেন, ‘এটা একটা উন্মাদনা। এক কথায় বলতে গেলে এটি এমন একটি বিষয়, যা গোটা দেশকে নাড়িয়ে দেয়।’

আর্জেন্টিনাভক্ত নোফেল ওয়াহিদের কাছে বিশ্বকাপ একটা ‘বিশাল আয়োজন’। ঢাকার বাসিন্দা নোফেল কাজ করেন ফিন্যান্সে।তিনি বলেন, ‘জনসংখ্যার দিক থেকে বাংলাদেশ একটি বড় দেশ, ১৭ কোটি মানুষ। আর্জেন্টিনা এবং ব্রাজিল ভক্তদের নিয়ে দেশকে প্রায় দুই ভাগে ভাগ করা যায়। বিষয়টা আসলে বেশ মজার। দক্ষিণ আমেরিকা থেকে এত দূরে এশিয়ার মাঝামাঝি এক দেশে কেন ফুটবল নিয়ে এতো মাতামাতি? এটা ব্যাখ্যা করা আসলে কঠিন।’

বাংলাদেশে আশির দশকের দিকে ব্রাজিল-আর্জেন্টিনা নিয়ে উন্মাদনা শুরু হয় বলে একমত আকিদ ও ওয়াহিদ দুজনেই। ৭১ সালে স্বাধীনতা অর্জনের পর সাধারণ বাংলাদেশিদের মধ্যে স্বচ্ছলতা আসতে শুরু করে। রঙিন টেলিভিশন কিনে মানুষ বিশ্বকাপ ফুটবল দেখা শুরু করে।রঙিন পর্দায় ব্রাজিলের হলুদ-সবুজ জার্সি আর হালকা নীল জার্সিতে আর্জেন্টাইন কিংবদন্তি ডিয়েগো ম্যারাডোনা যেন জীবন্ত হয়ে ওঠেন।

ওয়াহিদ বলেন, ‘আমি একেবারেই মন্ত্রমুগ্ধ হয়ে গিয়েছিলাম।’

১৯৮৬ বিশ্বকাপের কোয়ার্টার ফাইনালে ম্যারাডোনা ইংল্যান্ডের বিপক্ষে ‘হ্যান্ড অফ গড’ ও ‘শতাব্দীর সেরা গোল’ হিসেবে অখ্যায়িত দুইটি গোল করেন। বিশ্বকাপ জেতার পাশাপাশি ম্যারাডোনা ওই আসরে করেন ৫ গোল; সতীর্থদের দিয়ে করান আরও ৫ গোল।

পরের আসরে অর্থাৎ ১৯৯০ বিশ্বকাপের আসর বসে ইতালিতে। সে আসরের ফাইনালে আর্জেন্টিনাকে হারিয়ে শিরোপা ঘরে তোলে জার্মানি। বাংলাদেশিদের শৈশবের অমোচনীয় স্মৃতিতে পরিণত হয় দিনটি।

ওই আসরের শেষ ষোলোতে মুখোমুখি হয় আর্জেন্টিনা- ব্রাজিল। আকিদ তখন ১০ বছরের শিশু।

তিনি বলেন, ‘সেদিন বাড়িতে চমৎকার খাওয়া-দাওয়ার আয়োজন করা হয়েছিল। বাবার বন্ধু এবং সহকর্মী মিলিয়ে ৫০ জনকে দাওয়াত দেয়া হয়েছিল।

‘হাজার মাইল দূরে থাকার পরও এই দল দুটি আমার পরিবারকে যেভাবে প্রভাবিত করেছে, সেটা মেনে নেয়া আমার পক্ষে সহজ ছিল না। আমি আনন্দ, হাসি-কান্না দেখতে পাচ্ছিলাম।’

সে ম্যাচে ব্রাজিলকে ১-০ গোলে হারিয়েছিল আর্জেন্টিনা। ম্যারাডোনার অ্যাসিস্ট থেকে ৮২ মিনিটে গোল করেন ক্লদিও কানিজ্জিয়া।ম্যাচের পর আকিদের ব্রাজিলভক্ত বাবা মাহবুব তার বন্ধুদের বলেছিলেন, ‘আমরা ভাল খেলেছি... তবে জিতেছেন আপনারা।’

আকিদ বলেন, ‘৩২ বছর আগের দিনটির কথা আমার মনে থাকার কথা না। তারপরও দিনটি আমার স্মৃতিতে গেঁথে আছে। কারণ ১০ বছরের এক শিশু সেদিন তার আত্মীয়দের প্রিয় দলের জন্য বারবার লাফিয়ে উঠতে দেখছিল। এটা কি ভোলা যায়।’

বিশ্বকাপ ঘিরে ঢাকার একটি রাস্তার পাশের দোকান থেকে এক খুদে ভক্ত আর্জেন্টিনার জার্সি কিনছে।

ওই বিশ্বকাপের ফাইনালে পশ্চিম জার্মানির কাছে ১-০ গোলে হারে আর্জেন্টিনা। ৮৫ মিনিটে পাওয়া পেনাল্টি নিয়ে অনেক বিতর্কও আছে। ম্যাচটি ৬ বছরের এক শিশুর (ওয়াহিদ) মনেও ভীষণ দাগ কাটে।

ওয়াহিদ বলেন, “দিনটার কথা আমার স্পষ্ট মনে আছে। পেনাল্টি স্পষ্টতই আর্জেন্টিনার বিপক্ষে গিয়েছিল। ম্যারাডোনা যখন হেরে যাওয়া অধিনায়ক হিসেবে পদক নিতে মঞ্চে ওঠেন, তখন তিনি কাঁদছিলেন। দৃশ্যটা দেখেছিলাম, তখন আমার চোখ দিয়েও পানি পড়ছিল। মা তখন আমাকে জড়িয়ে ধরে বলেছিল, ‘চিন্তা করো না, আর্জেন্টিনা আবার জিতবে’।”

সে দিনটির কথা স্মরণ করে হেসে ওয়াহিদ বলেন, ‘তখন থেকেই অপেক্ষায় আছি।’

একটা বিশ্বকাপ শেষ হওয়ার পরের তিন বছর সবকিছু যেন সবাই ভুলে যায়। ওয়াহিদ বলেন, ‘আমার মা আর্জেন্টিনার পাঁড় ভক্ত। তবে ২০১১ সালে আর্জেন্টিনার যে দলটি ঢাকা সফরে এসেছিল, সে দলের মেসি ছাড়া আর কাউকে তিনি চিনতেন না।

‘আমার মনে হয় না ২০২১ সালে কোপা আমেরিকার ফাইনালে ব্রাজিল-আর্জেন্টিনার ম্যাচটি নিয়ে বেশিরভাগ বাংলাদেশি খুব বেশি জানত। তারপরও আমাদের মধ্যে উন্মাদনার কমতি ছিল না।’

সংঘর্ষের আশঙ্কায় সেবার ব্রাহ্মণবাড়িয়া শহরের বড় পর্দায় সে ম্যাচটি দেখানো হয়নি। ২০১৪ সালে বিশ্বকাপের সময় বরিশালের একটি বিশ্ববিদ্যালয়ে খেলা নিয়ে হাতাহাতিতে ১১ জন আহত হয়েছিলেন। ডাইনিং হলে বসে থাকা এক ব্রাজিল ভক্ত ‘হ্যান্ড অফ গড’-কে ‘অবৈধ’ বলেছিলেন। তা নিয়েই বিপত্তি।

২০১৮ বিশ্বকাপের সময় ভারতীয় অনলাইন সংবাদমাধ্যম scroll.in- বাংলাদেশের ফুটবল ভক্তদের ইঙ্গিত করে একটি খবর ছাপে, যেটির শিরোনাম ছিল- ‘অস্ত্রে শান দেয়া হচ্ছে’।

চলতি বছরের জুনে, ব্রাজিল-আর্জেন্টিনা ম্যাচ নিয়ে ঢাকার বাইরে সংঘর্ষের খবর প্রকাশ করে ফরাসি বার্তা সংস্থা- এএফপি। এতে অন্তত ৭ জন আহত হন।

ব্রাজিল-আর্জেন্টিনা নিয়ে যে বাংলাদেশে সবসময় ঝগড়া-বিবাদ হয়, তা কিন্তু না। প্রিয় দলের খেলা নিয়ে অনেক মজাও হয়।

আকিদ বলেন, ‘২০১৮ বিশ্বকাপের সময় আমি ও কয়েকজন সহকর্মী ব্রাজিলের জার্সি পরে অফিসে গিয়েছি। অফিসের দেয়ালে ব্রাজিলের পতাকা লাগিয়েছি। এক-দুইজন আর্জেন্টিনা সমর্থককে ধরে ছবিও তুলেছি।

‘এই ট্রেন্ডটা শুরু হয় ২০১৪ বিশ্বকাপে। সেবার সেমিফাইনালে জার্মানির কাছে ব্রাজিলের ৭-১ গোলে হেরে যাওয়ার পর আর্জেন্টিনা সমর্থকরা এটা শুরু করেছিলেন। তারা আমাদের সামনে সেভেন আপ কিনে খেত। যা পরে আর্জেন্টিনা সমর্থকদের কাছে দারুণ জনপ্রিয় হয়ে ওঠে।’

ওয়াহিদ জানান, ‘আমিও এমনটা করেছি।’

বাংলাদেশি এক চিত্রশিল্পী ঢাকার একটি রাস্তায় ম্যুরাল তৈরি করছেন।

এবারের আয়োজক কাতার। বিশ্বকাপ ঘিরে সেই চিরচেনা উন্মাদনাও শুরু হয়ে গেছে বাংলাদেশে। প্রিয় দলের জার্সি বেচা-কেনা হচ্ছে দেদার। অনেকেই নিজেদের বাড়িকে পছন্দের দলের পতাকার আদলে রাঙিয়ে নিচ্ছেন। রাস্তা-ঘাট, যানবাহনেও পড়েছে এসবের প্রভাব। যে কোনো স্টলে বসে চায়ে চুমুক দিতে গিয়ে হঠাৎ শুনতে পাবেন ব্রাজিল-আর্জেন্টিনা নিয়ে ভক্তদের তুমুল আড্ডা।

নতুন প্রজন্মরা অবশ্য এই দুই দল থেকে বেরিয়ে আসছে।

আকিদ বলেন, ‘আমি এবং আমার স্ত্রী ব্রাজিলের পক্ষে। কিন্তু শ্বশুরবাড়ি আর্জেন্টিনার সমর্থক। এসবের মধ্যে আমার ১০ বছরের ছেলে বেলজিয়াম বেছে নিয়েছে।

ওয়াহিদ বলেন, ‘আমার এক কাজিন জার্মানির ভক্ত। জার্মানির ভক্ত হয়ে কী মজা পাবে?’

এ বিভাগের আরো খবর