১৯৮৭ সালে ২১ বছর বয়সে উপমহাদেশে প্রথম গ্র্যান্ডমাস্টার খেতাব অর্জন করেন বাংলাদেশের নিয়াজ মোর্শেদ। সে সময় পুরো এশিয়ায় গ্র্যান্ডমাস্টার ছিলেন মাত্র চারজন।
এরপর দ্বিতীয় গ্র্যান্ড মাস্টারের জন্য অপেক্ষা করতে হয় ১৫ বছর। ২০০২ সালে দ্বিতীয় গ্র্যান্ডমাস্টার হন জিয়াউর রহমান। ২০০৬ সালে রিফাত বিন সাত্তার, ২০০৭ সালে আবদুল্লাহ আল রাকিব।
পঞ্চম গ্র্যান্ডমাস্টার এনামুল হোসেন রাজিব নর্ম অর্জন করেন ২০০৮ সালে। অথচ বাংলাদেশের প্রতিবেশী দেশ ভারতে বর্তমানে গ্র্যান্ডমাস্টারের সংখ্যা ৭৩।
১৪ বছরেও দেশে নতুন গ্র্যান্ডমাস্টার না পাওয়ার আক্ষেপ দিন দিন বেড়ে চলছে। ভারতের পাইপলাইনে যে পরিমাণ দাবাড়ু আছে, তার ছিটেফোঁটাও নেই বাংলাদেশে।
গত বছরের জুলাইয়ে বিশ্বকাপ দাবায় প্যারাগুয়ের গ্র্যান্ডমাস্টার নিউরিস দেলগাদো রামিরেসের বিপক্ষে খেলছেন বাংলাদেশের প্রথম গ্র্যান্ডমাস্টার নিয়াজ মোর্শেদ। ফাইল ছবি
নতুন গ্র্যান্ডমাস্টার তৈরি না হওয়ার পেছনে দাবাড়ুরা আর্থিক সহযোগিতা ও স্পন্সরশিপের অভাবকে মূল কারণ হিসেবে দেখছেন। আন্তর্জাতিক টুর্নামেন্টে স্পন্সরের অভাবে অংশগ্রহণ করতে পারছেন না দেশের খেলোয়াড়রা। এ কারণে আসছেন না নতুন গ্র্যান্ডমাস্টার।
আন্তর্জাতিক দাবা দিবস (২০ জুলাই) উপলক্ষে নিউজবাংলাকে দেয়া এক সাক্ষাৎকারে গ্র্যান্ডমাস্টার জিয়াউর রহমান বলেন, ‘টুর্নামেন্টে অংশগ্রহণ কমে যাওয়ায় গ্র্যান্ডমাস্টার নর্ম অর্জন করা কঠিন হয়ে পড়েছে। আন্তর্জাতিক নর্ম টুর্নামেন্ট না খেললে পয়েন্ট অর্জন করা কঠিন একজন দাবাড়ুর পক্ষে। আর আর্থিক সহায়তা না পেলে নিয়মিত দেশের বাইরে টুর্নামেন্ট খেলা কঠিন।’
জিয়া বলেন, ‘আমরা যে পাঁচ জন গ্র্যান্ডমাস্টার আছি, সবাই শুরু থেকে পরিবার থেকে একটা ভালো সহায়তা পেয়েছি। তখন আসলে সরকারি-বেসরকারি সমর্থন ও পরিবারের সহায়তায় এটা অর্জন করা সম্ভব হয়েছে।
‘এখনকার বেশিরভাগ খেলোয়াড়কে শুরুতে আর্থিক একটা সমস্যায় ভুগতে হয়। অনেকেই পরিবার থেকে অর্থিক সহযোগিতা পায় না। শুধু ফেডারেশনের সাপোর্ট নিয়ে খেলা চালিয়ে যেতে হয়। ১০ বছর ধরে আমি এই সমস্যাটা দেখছি।’
দাবার বোর্ডে ঘুঁটির চাল দিয়ে ‘জয়তু শেখ হাসিনা আন্তর্জাতিক গ্র্যান্ডমাস্টার্স দাবা টুর্নামেন্ট’-এর আনুষ্ঠানিক উদ্বোধন করছেন অতিথিরা। ছবি: নিউজবাংলা
ভারতের উঠতি খেলোয়াড়দের প্রসঙ্গ উল্লেখ করে জিয়া বলেন, তারা অনেক বেশি আন্তর্জাতিক ও নর্ম টুর্নামেন্টে অংশগ্রহণ করতে পারছে, যে কারণে তাদের জন্য নর্ম পয়েন্ট অর্জন সহজ হচ্ছে।
তিনি আরও বলেন, ‘যদি ভারতের দোমারাজু গুকেশের কথা বলি, সে বাংলাদেশে খেলতে ২০২১ সালে এসেছিল। ভারতের দ্বিতীয় সর্বকনিষ্ঠ গ্র্যান্ডমাস্টার সে। বয়স মাত্র ১৬। ২৫৫০ রেটিং পয়েন্ট নিয়ে সে বাংলাদেশে খেলতে এসেছিল। আর এখন ১ বছরের মধ্যে ওর রেটিং হয়েছে ২৭০০। পরিবার ও সরকার থেকে আর্থিকভাবে সহযোগিতা পাচ্ছে সে।’
বাংলাদেশের দাবা ফেডারেশনের এখনও নিজস্ব কোনো ভবন নেই। জাতীয় ক্রীড়া পরিষদের (এনএসসি) দেয়া অস্থায়ী ভবনে চলে কার্যক্রম। দাবা ফেডারেশন অনেক ‘ট্যালেন্ট হান্ট’ টুর্নামেন্ট আয়োজন করলেও সেটাকে যথেষ্ট মনে করছেন না গ্র্যান্ডমাস্টার জিয়া।
তিনি বলেন, ‘ফেডারেশন আসলে এই মুহূর্তে প্রতিভা অন্বেষণ কর্মসূচিতে বেশি আগ্রহী। তারা ব্যস্ত শুধু ছোট বাচ্চাদের কীভাবে দাবায় নিয়ে আসতে হয়, সেটায়, কিন্তু যারা বর্তমানে ভালো দাবাড়ু, তাদের উন্নতির দিকে খুব বেশি নজর নিচ্ছেন না।
‘গ্র্যান্ডমাস্টার তৈরিতে যে আর্থিক সহযোগিতা দরকার, সেটাও দেখা যাচ্ছে না। এটা যখন হবে, তখন নতুন জিএম (গ্র্যান্ডমাস্টার) পাওয়ার সম্ভাবনা বাড়বে।’
প্রাথমিক ধাপগুলোতে মনোযোগের আহ্বান
দাবার সর্বোচ্চ খেতাব গ্র্যান্ডমাস্টার হতে হয় কয়েকটি ধাপে। শুরুতে ক্যান্ডিডেট মাস্টার থেকে ফিদে মাস্টার। এরপর আন্তর্জাতিক মাস্টার ও সবশেষে নির্ধারিত নর্ম পয়েন্ট নিয়ে একজন দাবাড়ু গ্র্যান্ডমাস্টার খেতাব লাভ করেন।
গ্র্যান্ডমাস্টার তৈরি করতে হলে প্রাথমিক ধাপগুলোতে মনোযোগ দেয়ার আহ্বান জানান দেশের সবশেষ গ্র্যান্ডমাস্টার এনামুল হোসেন রাজীব।
তিনি নিউজবাংলাকে বলেন, ‘অন্যান্য দেশে গ্র্যান্ডমাস্টার থেকে ইন্টারন্যাশনাল মাস্টার বেশি থাকে। আবার ইন্টারন্যাশনাল মাস্টার থেকে ফিদে মাস্টার আরও বেশি থাকে। হঠাৎ করে তো কেউ একজন গ্র্যান্ডমাস্টার হতে পারবে না।
‘ওই ধাপগুলো পার করে তাকে আসতে হবে। আমাদের আসলে ফোকাস করতে হবে ওই জায়গাগুলোতে। দেখতে হবে আমাদের অনেক ইন্টারন্যাশনাল মাস্টার ও ফিদে মাস্টার তৈরি হচ্ছে কি না।’
জিয়ার সঙ্গে আন্তর্জাতিক টুর্নামেন্টের সংখ্যা বাড়ানোর বিষয়ে একমত রাজীব। উদাহরণ হিসেবে সুইজারল্যান্ডে চলমান দাবা চ্যাম্পিয়নশিপের কথা বলেন তিনি।
তিনি আরও বলেন, ‘এখন সুইজারল্যান্ডে একটি টুর্নামেন্ট চলছে, যেখানে অনেক ভারতীয় দাবাড়ু খেলছেন। বাংলাদেশ থেকে কিন্তু দাবাড়ুরা ওই টুর্নামেন্টে অংশগ্রহণ করতে পারছেন না।
‘আমার মতে, আমাদেরও প্রচুর প্রতিভা আছে, যারা বিভিন্ন খেতাব অর্জন করতে পারে, কিন্তু সুযোগ-সুবিধার অভাবে তারা সেটা পারছে না।’