বাবা ছিলেন ফুটবলের পাঁড় ভক্ত। খেলতেনও বিভিন্ন জেলার লিগে। বাবা ফুটবলার হওয়ায় ছোটবেলা থেকেই বেড়ে ওঠা ফুটবলের সঙ্গে।
নিজের পছন্দও ছিল ফুটবল, কিন্তু ক্রিকেটটা ছিল অস্থিমজ্জায়। আর তাই সেটি চেপে রাখা যায়নি।
একদিন পাড়ার ক্রিকেটে তার পারফরম্যান্স নজরে আসে এক আম্পায়ারের। সেখান থেকেই ফুটবলার থেকে বনে যান পুরোদস্তুর ক্রিকেটার। বলছি জাতীয় দলের অলরাউন্ডার সাকিব আল হাসানের কথা।
আম্পায়ারের নজরে আসা সাকিবের আর পেছনে ফিরে তাকাতে হয়নি। নিজের গতিতে সেখান থেকে এগিয়েই গেছেন দিনকে দিন। দেখতে দেখতে পারফরম্যান্সের গুণে হয়েছেন বিশ্বসেরা অলরাউন্ডার; বনে গেছেন দেশের ক্রিকেটের পোস্টারবয়।
১৯৮৭ সালের ২৪ মার্চ মাগুরায় জন্ম নেন সাকিব। বাবা মাশরুর রেজা ছিলেন কৃষি ব্যাংকের কর্মকর্তা। চাকরির পাশাপাশি স্থানীয় ফুটবল খেলতেন তিনি।
তার ছেলে সাকিবের ক্রিকেট খেলাটা শুরু হয় মাগুরার ইসলামপুর পাড়া ক্লাবে। পরে ৬ মাসের কোর্স করার জন্য বিকেএসপিতে ভর্তি হয়েছিলেন তিনি। সেখান থেকে সাকিব জায়গা করে নেন অনূর্ধ্ব-১৯ দলে।
সে সময় তার বয়স ছিল ১৫ বছর। যুব দলের হয়ে করা পারফরম্যান্সেই সবার নজর কাড়েন সাকিব।
২০০৫ থেকে ২০০৬ সালের মধ্যে অনূর্ধ্ব-১৯ দলের হয়ে ১৮টি ওয়ানডে খেলেন সাকিব। ৩৫.১৮ গড়ে সংগ্রহ করেন ৫৬৩ রান। একই সঙ্গে ২০.১৮ গড়ে নেন ২২টি উইকেট।
একই সঙ্গে জাতীয় লিগে খুলনা বিভাগের হয়ে খেলার জন্য তাকে নির্বাচন করা হয়।
২০০৬ সালের জিম্বাবুয়ে সফরে সাকিব প্রথমবারের মতো বাংলাদেশ জাতীয় দলে খেলার সুযোগ পান। ওই সিরিজেই হারারেতে জিম্বাবুয়ের বিপক্ষে মাঠে নামার মধ্য দিয়ে লাল-সবুজের জার্সি গায়ে আন্তর্জাতিক ওয়ানডে ক্রিকেটে অভিষেক হয় সাকিবের।
সে বছরই জিম্বাবুয়ের বিপক্ষে টি-টোয়েন্টি ক্রিকেটে অভিষেক হয় তার। পরের বছরই ভারতের বিপক্ষে চট্টগ্রামে বনেদি ফরম্যাটের ক্রিকেটে অভিষেক হয় সাকিবের।
২০০৯ সালে ওয়েস্ট ইন্ডিজ সফরে মাশরাফির ইনজুরির কারণে ভারপ্রাপ্ত অধিনায়ক হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন সাকিব। ২০১০ সালে নিউজিল্যান্ডের বিপক্ষেও একইভাবে দায়িত্ব পান বাঁহাতি এ ক্রিকেটার। এরপর তার নেতৃত্বেই ২০১১ সালে ঘরের মাঠে বিশ্বকাপ খেলে বাংলাদেশ।
সাকিবের নেতৃত্বে দেশের বাইরে প্রথম টেস্ট সিরিজে জয় পায় লাল সবুজের প্রতিনিধিরা। ২০০৯ সালে প্রথম বাংলাদেশি হিসেবে ওয়ানডে অলরাউন্ডার র্যাঙ্কিংয়ের শীর্ষে উঠে আসেন তিনি।
এরই ধারাবাহিকতায় টেস্টেও সেরা অলরাউন্ডারের আসন দখল করেন সাকিব। ২০১৫ সালের জানুয়ারিতে প্রথম ক্রিকেটার হিসেবে তিন ফরম্যাটেই সেরা অলরাউন্ডার হন তিনি। আর তাতেই বিশ্বের একমাত্র ক্রিকেটার হিসেবে তিন ফরম্যাটেই সেরা হওয়ার গৌরব অর্জন করেন নাম্বার সেভেনটি ফাইভ।
ক্যারিয়ারের শুরু থেকেই নানা বিতর্কে জড়িয়েছেন সাকিব। চলেছে তাকে নিয়ে বেশ কানাঘুষাও। সবকিছুর জবাব নিজের পারফম্যান্স দিয়ে দিয়েছেন তিনি। যেখানেই দেখেছেন অন্যায়, সেখানেই করেছেন প্রতিবাদ; পেয়েছেন শাস্তিও।
বেশ কিছু ভুলও করেছেন সাকিব। সবচেয়ে বড় ভুলটা ছিল তার জুয়াড়ির তথ্য গোপনের। এর ফলে ফিক্সিং না করেও এক বছর ক্রিকেট থেকে নির্বাসনে থাকতে হয়েছিল বাংলাদেশের ক্রিকেটের এই পোস্টার বয়কে।
নির্বাসন শেষ করে সাকিব ফিরে এসেছিলেন সদর্পেই। এখন পর্যন্ত তার ওয়ানডে অলরাউন্ডারের র্যাঙ্কিংয়ের সেরা জায়গাটি ছিনিয়ে নেয়া সম্ভব হয়নি কারোর পক্ষে। বোলিং ফিগার, সর্বোচ্চ রান, সর্বোচ্চ উইকেট, সব আসন একাই দখলে রেখেছেন সাকিব।
বিশ্বের প্রায় সব ফ্র্যাঞ্চাইজি লিগ খেলা একমাত্র বাংলাদেশি হিসেবেও নাম লিখিয়েছেন সাকিব। ২২ গজে নাম্বার সেভেন্টি ফাইভের ক্রিকেট ক্যারিয়ার বেশ ঝলমলে।
এখন পর্যন্ত দেশের জার্সিতে সাকিব খেলেছেন ৫৯ টেস্ট, ২২১ ওয়ানডে ও ৯৬ টি-টোয়েন্টিতে। এর মধ্যে টেস্টে তার ব্যাট থেকে এসেছে ৪ হাজার ২৯ রান।
তিনি ওয়ানডেতে ৬ হাজার ৭৫৫ ও টি-টোয়েন্টিতে ১ হাজার ৯০৮ রান করেন। তিন সংস্করণ মিলিয়ে এ তারকা সেঞ্চুরি করেছেন ১৪টি।
এদিকে বল হাতে এ বাঁহাতি ওয়ানডেতে নিয়েছেন ২৮৫ উইকেট। টেস্টে তার শিকার করা উইকেটের সংখ্যা ২১৫; টি-টোয়েন্টিতে ১১৯।
ক্যারিয়ারজুড়ে শত সমালোচনা, উত্থান, পতন, বিতর্ক কোনো কিছুই ব্যাঘাত ঘটাতে পারেনি এ ক্রিকেটারের পারফরম্যান্সে। প্রতিবারই সমালোচকদের মুখে কুলুপ এঁটে দিয়েছেন নিজ পারফরম্যান্স দিয়ে। আঘাত পেয়ে প্রতিবারই ফিরে এসেছেন বিপুল বিক্রমে; জানান দিয়েছেন নিজের সামর্থ্যের।
আজ ২৪ মার্চ দেশের ক্রিকেটের এ রাজপুত্রের জন্মদিন। ৩৪ পেরিয়ে ৩৫-এ পা রাখলেন তিনি।
সাকিবের জন্মদিনে শুভেচ্ছা জানিয়েছেন তার সতীর্থরা। মুশফিকুর রহিম নিজের ফেসবুক পেইজে লিখেন, ‘শুভ জন্মদিন আমাদের সর্বকালের সেরা সাকিব আল হাসান। আমরা গর্বিত তোমার দেশের জন্য সকল অর্জনে। আমি আশাবাদী অর্জনের তালিকা আরও লম্বা হবে। আরও এগিয়ে যাও চ্যাম্পিয়ন।’
জাতীয় দলের স্পিনার মেহেদি হাসান মিরাজ লেখেন, ‘সেরা দলের পেছনে সবসময়ই একজন সেরা খেলোয়াড় থাকেন। আমি আশা করব আপনি আরও ১০০ বছর দলকে এভাবেই অনুপ্রেরণা দিয়ে যাবেন।
‘শুভ জন্মদিন খেলার কিংবদন্তি সাকিব আল হাসান ভাই। আপনার ও আপনার পরিবারের জন্য দোয়া রইল।’