দৃশ্যটা মনে আছে সবার। ১৯৯৩ সালের ৪ জুন। ইংলিশ মাটিতে অ্যাশেজের প্রথম টেস্টে ওল্ড ট্র্যাফোর্ডে মুখোমুখি দুই চিরপ্রতিদ্বন্দ্বী ইংল্যান্ড ও অস্ট্রেলিয়া। ইংল্যান্ডের প্রথম ইনিংসে গুচের সঙ্গে ৭১ রানের জুটি গড়ে আউট হলেন মাইক আথারটন। ক্রিজে এলেন ইংল্যান্ড লেজেন্ড ও স্পিনের সেরা খেলোয়াড় মাইক গ্যাটিং।
তিন ওভার দেখেশুনে খেললেন গ্যাটিং। এক বাউন্ডারি মেরে চার রান তুলে নিয়ে সেট হওয়ার চেষ্টা চালাচ্ছেন। ঠিক সে সময়ই টেইলর বোলিংয়ে আনলেন এক উঠতি স্পিনারকে।
ইংলিশ প্রেস অ্যাশেজের আগে খুব একটা পাত্তা দেয়নি সোনালি চুল, কানে দুল পরা, কিছুটা স্বাস্থ্যবান এই স্পিনারকে। নিজের প্রথম ডেলিভারিতেই যা করলেন, তাতে সবাই চিনে নিল সর্বকালের সেরা স্পিনার হতে চলা ২৩ বছর বয়সী শেন ওয়ার্নকে।
গ্যাটিং ব্যাট করছেন। ওয়ার্ন এলেন স্বভাবজাত ধীরগতির রান আপে। লেগব্রেক ডেলিভারি পড়ল লেগ স্টাম্পের খানিকটা বাইরে। নিরীহ ডেলিভারি ভেবে গ্যাটিং খেলতে গেলেন ফ্রন্ট ফুটে।
অমনি প্রায় ৪৫ ডিগ্রি টার্ন করে বল আঘাত হানল গ্যাটিংয়ের অফ স্টাম্পে। পুরো ঘটনায় স্তম্ভিত হয়ে পড়লেন গ্যাটিং। এমনকি অস্ট্রেলিয়ার উইকেটকিপার ইয়ান হিলিও বলের লাইনে বোকা হয়ে গেলেন। তার গ্লাভস চলে গিয়েছিল লেগ সাইডে।
পুরো বিষয়টা ঘটল কয়েক সেকেন্ডের মধ্যে। ওল্ড ট্র্যাফোর্ডে উপস্থিত হাজার বিশেক দর্শক জায়ান্ট স্ক্রিন আর টিভি দর্শকরা রিপ্লেতে দেখে বুঝলেন ওয়ার্নের জাদু!
সেই থেকে শুরু। ওই ম্যাচে আটটিসহ পুরো অ্যাশেজে ৩৪টি উইকেট পান ওয়ার্ন। পরের এক যুগ ইংল্যান্ডের ওপর অস্ট্রেলিয়া ছড়ি ঘুরিয়েছে ওয়ার্নের স্পিন জাদুতে।
শেন কিথ ওয়ার্নের অভিষেক তার বছর দেড়েক আগে হলেও ‘বল অফ দ্য সেঞ্চুরি’ তকমা পাওয়া ওই ডেলিভারিটি তার খ্যাতি পৌঁছে দেয় দুনিয়ার সব প্রান্তে।
তার পর থেকে প্রায় দেড় দশক লেগ স্পিন শব্দের সমার্থক হয়ে ওঠেন ‘ওয়ান্ডারফুল ওয়ার্ন’। ১৪৫ টেস্টে ৭০৮ উইকেট নেয়া এ লেগ স্পিনার ওয়ানডেতে পেয়েছেন ২৯৩ উইকেট। জিতেছেন একটি বিশ্বকাপ ও অসংখ্য অ্যাশেজ সিরিজ।
উইজডেনের শতাব্দীর সেরা পাঁচ ক্রিকেটারের একজন হন তিনি।
তবে ওয়ার্নের মহিমা শুধু নম্বরে আটকে নয়, ক্রিকেট ইতিহাসের অন্যতম বর্ণিল চরিত্র ছিলেন ১৯৬৯ সালের ১৩ সেপ্টেম্বর অস্ট্রেলিয়ার ভিক্টোরিয়া রাজ্যে জন্ম নেয়া এই প্রতিভা।
শুধু পরিসংখ্যান, সংখ্যা বা ট্রফি দিয়ে ওয়ার্নের মাহাত্ম্য যাচাই করলে ভুল হবে। নব্বইয়ের দশকের শুরুতে যে লেগ স্পিনকে ধরা হতো টেস্ট ক্রিকেটের জন্য মৃত। সেটা শুধু নতুন জীবনই দেননি তিনি, পুরো এক শিল্পরূপে প্রতিষ্ঠা করেছেন।
ক্ল্যারি গ্রিমে, রিচি বেনো, ভগবত চন্দ্রশেখর ও আব্দুল কাদিরের হাতে যে লেগ স্পিন মাঝেমধ্যে খবরে আসত সেটা ওয়ার্ন করে তুললেন গ্ল্যামারাস ও দুর্ধর্ষ।
ক্রিকেট মাঠে ও মাঠের বাইরে ওয়ার্নের উপস্থিতি মানেই ছিল ভক্তদের জন্য বাড়তি আকর্ষণ। নারী, ড্রাগ, বেটিং এমন কোনো কেলেঙ্কারি নেই যেটা তার নামের পাশে নেই।
তবে সব ছাপিয়ে যখন বল ঘোরাতে নামতেন ক্রিকেট মাঠে, তখন হয়ে দাঁড়াতেন শুধু নিঁখুত এক শিল্পী।
তার আকস্মিক বিদায়ে ক্রিকেট বিশ্বে শোকের ছায়া। বর্তমান বিশ্বের প্রায় প্রতিটি দলে রয়েছেন একজন করে বিশ্বমানের লেগ স্পিনার, যাদের সবার আদর্শ ওয়ার্ন।
রাশিদ খান, ইউজবেন্দ্র চেহেল, ইয়াসির শাহ সবারই গুরু এ ক্ষণজন্মা ক্রিকেটার।
মাঠে তার বোলিংয়ে রহস্যের মতো চলে যাওয়াটা ঘিরেও থাকল রহস্য। হার্ট অ্যাটাকে থাইল্যান্ডে মারা গেছেন তিনি। পরিবারের পক্ষ থেকে তার মৃত্যুসংক্রান্ত তথ্য নিয়ে গোপনীয়তা চেয়ে বার্তা দেয়া হয়েছে।
তার পরও ক্রিকেট বিশ্বের শোকের মাতম থেমে নেই। বাংলাদেশ থেকে অস্ট্রেলিয়া, ভারত থেকে ক্যারিবিয়ান পুরো বিশ্ব ভেজা চোখে স্মরণ করছে তাকে।