স্বাধীনতার পরপর অবকাঠামতোগত কারণে আন্তর্জাতিক ক্রীড়া ক্ষেত্রে সাফল্য পেতে কিছুটা সময় লাগে বাংলাদেশের। ১৯৭১ সালের আগে যারা ছিলেন মাঠের তারকা, স্বাধীনতা পরবর্তী সময়ে তাদের সাংগঠনিক দক্ষতা ও দূরদর্শিতায় ধীরে ধীরে আন্তর্জাতিক অঙ্গনে প্রতিযোগিতা করার প্রস্তুতি শুরু হয়।
সত্তর ও আশির দশকে তুমুল জনপ্রিয় হয়ে ওঠে ফুটবল। খেলার প্রতি আগ্রহের পারদ চড়তে থাকে এ দুই দশকে। আশির দশকে বিশ্বকাপ ফুটবল ও ক্রিকেট সরাসরি সম্প্রচারের কারণে মানুষের বসার ঘরে চলে আসেন বিশ্ব তারকারা।
সত্তর দশক থেকে আঞ্চলিক ও মহাদেশীয় নানা টুর্নামেন্টে অংশ নেন বাংলাদেশের ক্রীড়াবিদেরা। সাফল্য আসা শুরু করে আশির দশকে।
১৯৮৪ সালে সাফে প্রথম স্বর্ণ
স্বাধীনতার পর ক্রীড়া ক্ষেত্রে প্রথম আন্তর্জাতিক অর্জন ১৯৮৪ সালের সাফ গেমসের প্রথম আসরে স্বর্ণ জয়। কাঠমান্ডুতে এই স্বর্ণ আসে মুজিবর রহমান মল্লিকের হাত ধরে। ট্রিপল জাম্পে প্রতিবেশী দেশের অ্যাথলিটদের টেক্কা দিয়ে ছিনিয়ে আনেন স্বর্ণপদক। এটি স্বাধীন বাংলাদেশের ক্রীড়া ক্ষেত্রে প্রথম সফলতা ও অর্জন।
১৯৮৭ সালে দাবায় গ্র্যান্ড মাস্টার
আঞ্চলিক সাফল্য ছাড়িয়ে দেশের ক্রীড়া ক্ষেত্র বিশ্ব পর্যায়ে পৌঁছায় নিয়াজ মোর্শেদের হাত ধরে। কিশোর বয়স থেকেই দাবার বিস্ময়কর প্রতিভা হিসেবে নিজেকে প্রতিষ্ঠা করা নিয়াজ প্রথম গ্র্যান্ড মাস্টার নর্ম অর্জন করেন ১৯৮৪ সালে। দ্বিতীয় নর্ম আসে ১৯৮৬ সালে। ধারাবাহিকভাবে সাফল্য অর্জনের পুরস্কার হিসেবে ১৯৮৭ সালে মাত্র ২১ বছর বয়সে গ্র্যান্ড মাস্টারের খেতাব পান নিয়াজ।
বাংলাদেশ তো বটেই পুরো দক্ষিণ এশিয়ার ভেতর প্রথম গ্র্যান্ড মাস্টার তিনি। পাশাপাশি এশিয়ার পঞ্চম।
১৯৯৭ সালে আইসিসি ট্রফি জয়
১৯৯৭ সালে ইভেন্ট আইসিসি ট্রফি শিরোপা জয়ের স্বাদ পায় বাংলাদেশ। এটিই ছিল বাংলাদেশের ক্রিকেটের প্রথম কোনো শিরোপা।
মালয়েশিয়ায় অনুষ্ঠিত টুর্নামেন্টটির গ্রুপ পর্বে বাংলাদেশ অপরাজিত থেকে গ্রুপ চ্যাম্পিয়ন হয়েছিল ডেনমার্ক, আরব আমিরাত, মালিয়েশিয়া, পশ্চিম আফ্রিকা ও আর্জেন্টিনাকে পরাজিত করার মধ্য দিয়ে।
দ্বিতীয় পর্বের তিন খেলায় বাংলাদেশ জয় পায় দুটিতে। একটি পরিত্যক্ত হয়।
আর ফাইনালে বৃষ্টি আইনে কেনিয়াকে দুই উইকেটে হারানোর মধ্য দিয়ে প্রথমবারের মতো শিরোপার স্বাদ পায় বাংলাদেশ। নিশ্চিত করে ১৯৯৯ সালের বিশ্বকাপে অংশগ্রহণ।
সে ধারাবাহিকতায় ১৯৯৯ সালে আসে ওয়ানডে স্ট্যাটাস ও পরের বছর টাইগাররা পায় টেস্ট স্ট্যাটাস।
২০০২ সালে কমনওয়েলথে আসিফের ইতিহাস
২০০২ সালে ম্যানচেস্টার কমনওয়েলথ গেমসে বাংলাদেশকে প্রথম স্বর্ণপদক এনে দেন আসিফ হোসেন খান। ১০ মিটার এয়ার রাইফেলে ভারতের অভিনব বিন্দ্রাকে হারিয়ে ঝুলিতে পোরেন নিজের এবং দেশের প্রথম স্বর্ণ। ২০০৪ সালের সাফ গেমসে তিনি তার ধারাবাহিকতা ধরে রেখে বাগিয়ে নেন স্বর্ণপদক।
আঞ্চলিক টুর্নামেন্টের সীমানা ছাড়িয়ে এটিই ছিল বৈশ্বিক আসরে জেতা বাংলাদেশের প্রথম স্বর্ণ।
২০০৩ সালে ফুটবলের অধরা সাফ শিরোপা
স্বাধীনতার পর বাংলাদেশের সবচেয়ে জনপ্রিয় খেলা ফুটবলে প্রথম আন্তর্জাতিক সাফল্য আসে ২০০৩ সালের সাফ চ্যাম্পিয়নশিপে। আশির দশকে ফুটবলের শিরোপা খরা ঘুচে যায় সাফের শিরোপা জয়ের মধ্য দিয়ে।
জানুয়ারিতে অনুষ্ঠিত হওয়া এই টুর্নামেন্টের আয়োজক ছিল বাংলাদেশ। টুর্নামেন্টের ফাইনালে নির্ধারিত ৯০ মিনিটে ও অতিরিক্ত সময়ে ১-১ গোলে ড্র থাকায় ম্যাচটি গড়িয়েছিল পেনাল্টিতে।
পেনাল্টি শ্যুট আউটে ইসলাম, মুহিফুল মিয়াঁ, হাসান আল মামুন, মাহমুদুল হাসান ও মোহাম্মদ সুজনের গোলে ৫-৩ ব্যবধানে মালদ্বীপকে হারায় লাল সবুজের প্রতিনিধিরা। সেই সুবাদে বাংলাদেশ প্রথমবারের মতো দক্ষিণ এশিয়ার শ্রেষ্ঠত্বের মুকুট মাথায় দেয়।
২০০৯ সালে বিশ্বসেরা সাকিব
এর পরের অর্জনটি বাংলাদেশের ক্রীড়া ইতিহাসের সবচেয়ে বড় নামের। ক্রিকেটের বরপুত্র ও বাংলাদেশের ক্রিকেটের পোস্টারবয় সাকিব আল হাসানের।
ক্রিকেটের আধুনিক গ্রেট ও সর্বকালের অন্যতম সেরা অলরাউন্ডার সাকিব ২০০৯ সালের জানুয়ারিতে প্রথমবারের মতো বিশ্ব র্যাঙ্কিংয়ের শীর্ষে ওঠেন।
এর ছয় বছর পর ক্রিকেট ইতিহাসের একমাত্র অলরাউন্ডার হিসেবে তিন ফরম্যাটের সেরা অলরাউন্ডার হন বাংলাদেশের গর্ব সাকিব।
সাকিবের সঙ্গে তামিম ইকবাল, মুশফিকুর রহিম, মাশরাফি মোর্ত্তজা ও মাহমুদুল্লাহর হাত ধরে বাংলাদেশের ক্রিকেট দল হয়ে ওঠে বিশ্বের অন্যতম সেরা।
দেশ ও বিদেশে আসে একের পর এক সাফল্য। দ্বিপাক্ষিক সিরিজ জয়ের পাশাপাশি চ্যাম্পিয়নস ট্রফি সেমিফাইনাল খেলা ও এশিয়া কাপের ফাইনাল খেলার মতো সাফল্য অর্জন করে টাইগাররা।
২০১৮ সালে নারী ক্রিকেটারদের শিরোপা জয়
বিংশ শতাব্দীতে আইসিসি ও এসিসি ট্রফি ছেলেদের হাত ধরে এলেও দেশের হয়ে প্রথম আন্তর্জাতিক শিরোপা আসে নারী ক্রিকেটারদের হাত ধরে।
২০১৮ সালের জুনে টানা ছয়বারের চ্যাম্পিয়ন ভারতকে তিন উইকেটে হারিয়ে বাংলাদেশকে প্রথম আন্তর্জাতিক কোনো শিরোপার স্বাদ দেন জাহানারা-রুমানারা। জয়টা ছিল বেশ শ্বাসরুদ্ধকর।
শিরোপার হাতছানি পেতে থাকা এশিয়া কাপের ফাইনালে শেষ বলে বাংলাদেশের প্রয়োজন ছিল দুই রান। তার করা শেষ বলটি মিড উইকেটে ঠেলে দিয়ে দুইবার জায়গা পরিবর্তন করেন জাহানারা ও সালমা খাতুন। আর তাতে রচিত হয় অনন্য এক ইতিহাস। বাংলাদেশ পায় প্রথমবারের মতো আন্তর্জাতিক শিরোপা জয়ের স্বাদ।
২০১৮ সালে নারীদের বয়সভিত্তিক ফুটবলে সাফল্য
পুরুষদের ফুটবলে ক্রমাবনতির উল্টো পিঠে ছিল নারী ফুটবলে অবিশ্বাস্য উত্থান। বয়সভিত্তিক ফুটবলে অনূর্ধ্ব ১৪, ১৫, ১৬তে সাফল্যের ধারাবাহিকতা ধরে রাখে দল। জিতে নেয় ২০১৮ সাফ অনূর্ধ্ব ১৮ চ্যাম্পিয়নশিপ।
অনূর্ধ্ব ১৪ থেকে একই দলে খেলে মারিয়া, সাবিনা, তহুরারা পরবর্তীতে জাতীয় দলের হয়েও সুনাম কুড়িয়েছেন।
২০১৯ আর্চারিতে নতুন তারকা রোমান
২০১৯ সালে স্বল্প পরিচিত খেলা আর্চারি দিয়ে বিশ্ব মঞ্চে আবির্ভূত হন আর্চার রোমান সানা। সে বছর বিশ্ব আর্চারি চ্যাম্পিয়নশিপের পুরুষ একক ইভেন্টে এই আর্চার ব্রোঞ্জ পদক লাভ করেন। প্রথম বাংলাদেশি হিসেবে এই প্রতিযোগিতার পদক পান সানা।
একই বছর ফিলিপাইনে অনুষ্ঠিত এশিয়া কাপে স্বর্ণ জেতেন। এটি তার ক্যারিয়ারের সেরা সাফল্য। একই সঙ্গে বাংলাদেশেরও।
২০২০ সালে জুনিয়র টাইগারদের বিশ্ব জয়
স্বাধীনতা পরবর্তী বাংলাদেশের ক্রীড়ায় সবচেয়ে বড় সাফল্য আসে ২০২০ সালে। ২০২০ সালে অনূর্ধ্ব-১৯ বিশ্বকাপের শিরোপা জিতে নেয় বাংলাদেশ। সাউথ আফ্রিকায় অনুষ্ঠিত টুর্নামেন্টের ফাইনালে ভারতের যুবাদের মুখোমুখি হয় আকবর আলির দল।
বৃষ্টিবাধায় বিঘ্নিত সেই ম্যাচে জয়ের জন্য বাংলাদেশের সামনে লক্ষ্য ছিল ৪৬ ওভারে ১৭০ রান। তিন উইকেটে ভারতকে হারিয়ে বাংলাদেশকে প্রথমবারের কোনো বিশ্বকাপ শিরোপা এনে দেয় জুনিয়র টাইগাররা।