২০১৯ সালের ওয়ানডে বিশ্বকাপের পর স্টিভ রোডসকে বিদায় করে দুই বছরের চুক্তিতে টাইগারদের হেড কোচের দায়িত্ব তুলে দেয়া হয়েছিল রাসেল ডমিঙ্গোর হাতে। অক্টোবরের ২১ তারিখ তিনি আনুষ্ঠানিকভাবে বুঝে নেন জাতীয় দলের হেড কোচের দায়িত্ব।
মূলত জাতীয় দলের হাই পারফরম্যান্স ইউনিট (এইচপি) দলের কোচ হিসেবে যোগ দেয়ার কথা ছিল তার। কিন্তু বিসিবি কর্তারা সাকিব-মুশফিকদের কোচিংয়ের দায়িত্ব সঁপে দিয়েছিলেন এই প্রোটিয়ার হাতে।
দায়িত্ব বুঝে নিয়েই ব্যর্থতার প্রমাণ দেয়া শুরু করেন এই প্রোটিয়া। ঘরের মাঠে নবাগত টেস্ট খেলুড়ে দল আফগানিস্তানের কাছে লাল বলের খেলায় হেরে বসে বাংলাদেশ দল। এরপর ভারত ও পাকিস্তান সফর থেকেও ফিরতে হয়েছে শূন্য হাতে।
এরপর করোনার প্রভাবে লম্বা সময় খেলা গড়ায়নি মাঠে। করোনার বিরতি কাটিয়ে মাঠে খেলা ফিরলেও ভাগ্য খুব একটা বদলায়নি টাইগারদের। হারতে হয় ওয়েস্ট ইন্ডিজ ও নিউজিল্যান্ডের বিপক্ষেও।
এরপর নতুন এক ‘থিওরি’ বের করেন প্রোটিয়া এই কোচ। ঘরের মাঠ শেরে বাংলায় নিজের ইচ্ছেমতো ক্রিকেটের অযোগ্য পিচ বানিয়ে শুরু করেন খেলা। আর তাতেই দেখতে পান সাফল্যের মুখ। শ্রীলঙ্কার বিপক্ষে ওয়ানডে সিরিজ জয় আর জিম্বাবুয়ে সফরের পারফরম্যান্সের পর কিছুটা স্বস্তি ফেরে।
সবশেষ মিরপুরের বধ্যভূমিতে দুই পরাশক্তি অস্ট্রেলিয়া আর নিউজিল্যান্ডকে হারিয়ে আকাশে উড়তে থাকেন ডমিঙ্গো। আর উড়তে উড়তেই দলকে নিয়ে যান বিশ্বকাপের মঞ্চে।
কিন্তু শেরে বাংলার বাজে উইকেটে খেলার পরিণামটা বিশ্বকাপে বেশ বাজেভাবেই দিতে হয়েছে বাংলাদেশকে। আফ্রিকান কোচের ‘দুর্দান্ত ফর্মের’ সার্টিফিকেট নিয়ে বাছাইপর্বে টেনেটুনে পাস করলেও, বাংলাদেশ ফেল করেছে বিশ্বকাপের মূল পর্বে গিয়ে। একটি ম্যাচেও জয়ের মুখ দেখা হয়নি ডমিঙ্গো শিষ্যদের।
জাতীয় দলের দায়িত্ব বুঝে নেয়ার পর কোচ হিসেবে তার অধীনে এখন পর্যন্ত তামিম-মাহমুদুল্লাহরা মাঠে নেমেছেন ৬০টি ম্যাচে। এই ৬০ ম্যাচের ভেতর মাত্র ২৯ ম্যাচে জয়ের মুখ দেখেছে বাংলাদেশ। শতকরার হিসাবে সেটি ৫০ শতাংশেরও কম।
১০ টেস্টে ৭টি, ১৫ ওয়ানডেতে ৪টি আর ৩৫ টি-টোয়েন্টির ১৮টিতেই হারতে হয়েছে বাংলাদেশকে।
সবশেষ সদ্য বিশ্বকাপ মিশন শেষ করে দেশে ফেরার আগে বাছাইপর্বের ম্যাচসহ মোট আট ম্যাচ খেলেছে বাংলাদেশ। যেখানে ব্যর্থতার চরম দৃষ্টান্ত স্থাপন করে ৬ ম্যাচেই হারতে হয়েছে লাল সবুজের প্রতিনিধিদের।
জাতীয় দলের দায়িত্ব নিয়ে কোচ হিসেবে এক প্রকারে ব্যর্থই বলা চলে ডমিঙ্গোকে। ব্যর্থতার বেড়াজালে আটকে থাকার পরও কোনো এক অজানা কারণে ডমিঙ্গোকে ছাড়তে চাইছে না বাংলাদেশ ক্রিকেট বোর্ডের কর্তারা।
ব্যর্থতার পাশাপাশি অভিযোগের কমতি নেই ডমিঙ্গোর বিপক্ষেও। এর ভেতর বহুল আলোচিত অভিযোগটি ছিল দলের ভেতর সিনিয়র-জুনিয়রদের মধ্যে বিদ্বেষ সৃষ্টি করার। একই সঙ্গে অভিযোগ রয়েছে সিনিয়র ক্রিকেটারদের প্রতি বিমাতাসুলভ আচরণের।
বিশ্বকাপের আগে থেকে বোর্ড সভাপতি চুক্তি বাড়ানোর কথা জানিয়ে দেয়ার পর বিশ্বকাপের মাঝপথে আনুষ্ঠানিকভাবে প্রোটিয়া এই কোচের সঙ্গে দুই বছর চুক্তি বাড়িয়েছে বোর্ড। তাও আবার সেই চুক্তিতে শর্ত জুড়ে দিয়েছেন ডমিঙ্গো।
চুক্তি অনুযায়ী আগামী এক বছর বিসিবি তাকে চাইলেই চাকরিচ্যুত করতে পারবেন না। যদি কোনো কারণে চুক্তি ভাঙতে হয় তাহলে প্রায় দুই কোটি টাকা তাকে বাধ্যতামূলকভাবে দিয়ে বিদায় জানাতে হবে।
আর এই বিষয়টিই পুরোপুরি অযৌক্তিক মনে করছেন বাংলাদেশ ক্রিকেট বোর্ডের সাবেক পরিচালক খন্দকার জামিল উদ্দিন।
জামিল বলেন, ‘ডমিঙ্গোর সঙ্গে যেই ছয় মাসের ক্লজ রয়েছে, সেটা বিসিবি কেন করল সেটাই আমি বুঝতে পারছি না। এই শর্তটাসহ বিসিবি কেন চুক্তিটা করল সেটাই আমার বোধগম্য হচ্ছে না। এই শর্তটার কারণে ব্যর্থতার পরও তাকে বাদ দেয়া যাচ্ছে না। এটাই হচ্ছে মূল সমস্যা।’
বিশ্বকাপের মিশন শেষ করে জাতীয় দলের ক্রিকেটাররা দেশে ফেরার দিন থেকেই গুঞ্জন উঠতে থাকে টিম ম্যানেজমেন্টে বড় পরিবর্তনের। গুঞ্জন ওঠে ডমিঙ্গোকে সরিয়ে দিতে যাচ্ছে বিসিবি, তার স্থলাভিষিক্ত করা হবে জনপ্রিয় কোচ মোহাম্মদ সালাহউদ্দিনকে।
সেই ঘটনার দিন দুয়েক পর সালাহউদ্দিনকে সহকারী কোচ হিসেবে দায়িত্ব দেয়ার প্রস্তাবনা পাঠানো হয় বিসিবির পক্ষ থেকে। যদিও সালাহউদ্দিন আরও কয়েকটি দলের কোচ হিসেবে চুক্তিবদ্ধ থাকায় নাকচ করে দেন বোর্ডের প্রস্তাব।
কেন নাকচ করেছেন সেটি না জানালেও সালাহউদ্দিনের সিদ্ধান্তের সঙ্গে একাত্মতা প্রকাশ করে জামিল জানান, এখনই দেশীয় কোচের হাতে দায়িত্ব তুলে দেয়াটা যুক্তিযুক্ত হবে না। তাদের আগে জাতীয় দলের পরিবেশটা বুঝতে হবে। শুরুতে সহকারী কোচের দায়িত্ব দিয়ে তারপর হেড কোচের পদে বসানোটাই উপযুক্ত হবে বলে মনে করছেন তিনি।
জামিল বলেন, ‘আমি অনেক আগে থেকেই বলে আসছিলাম, দেশীয় কোচদের আস্তে আস্তে তৈরি করতে হবে। অনেক আগে থেকেই তাদের জাতীয় দলে অ্যাসিসট্যান্ট কোচ হিসেবে রাখলেও তো কোনো সমস্যা ছিল না। এই প্রক্রিয়াটা তো আমরা অনুসরণ করছিলাম না। এখন হুট করে তাদের দায়িত্ব দিয়ে দিলে সেটা কতটা যুক্তিযুক্ত হবে সেখানে কিন্তু সন্দেহ থেকেই যায়।’
তিনি আরও বলেন, ‘এতদিন ধরে তো বিদেশি স্টাফ দিয়ে চালানো হচ্ছিল, হঠাৎ করেই জাতীয় দলের গুরুত্বপূর্ণ একটি দায়িত্ব একজন দেশি কোচকে দিলে ফলাফল কতটা পজিটিভ হবে সেটা বলা আসলেই মুশকিল। আমরা যেটা বলে আসছিলাম, সেই প্রক্রিয়াটা যদি বিসিবি অনুসরণ করত, তাহলে সহজেই কিন্তু সালাহউদ্দিনের হাতে দায়িত্ব তুলে দেয়া যেত।’
সাবেক এই বোর্ড পরিচালক মনে করেন দেশীয় কোচ দিয়ে জাতীয় দলের ক্রিকেটারদের কোচিংয়ের সুযোগ এখনই শেষ হয়ে যায়নি। দেশীয় কোচদের ধীরে ধীরে জাতীয় দলের সঙ্গে সম্পৃক্ত করারও তাগিদ দেন তিনি।
এ প্রসঙ্গে জামিল বলেন, ‘এখনও সুযোগ আছে। সুজন টিম ডিরেক্টর হয়েছে। এখন যদি ডমিঙ্গোকে রাখতেই হয়, সালাহউদ্দিনকে সহকারী কোচ হিসেবে রাখা যেতে পারে, যাতে সে আস্তে আস্তে দায়িত্ব বুঝে নিতে পারে। এ রকম একটা প্রক্রিয়ার ভেতর দিয়ে গেলে সেটা আমি মনে করি ভালো হবে।’
নতুন চুক্তিমতে ২০২৩ বিশ্বকাপ পর্যন্ত বাংলাদেশের কোচ হিসেবে থাকবেন ডমিঙ্গো। ফলে আরও দুটি বিশ্বকাপ তার অধীনে খেলা লাগবে টিম টাইগার্সের। এখন দেখার বিষয় ডোমিঙ্গো কি পারবেন জাতীয় দলের ভাগ্য ফেরাতে? পারবেন কি তার নামের অভিযোগগুলো মেটাতে? প্রশ্নটা তোলা থাকল।