পানি ও মাটিতে লণাক্ততার মাত্রা বেড়ে চলায় সুন্দরবনের মাটির উপাদানগত বৈশিষ্ট্য বড় ধরনের পরিবর্তন ঘটে চলেছে। বনে কমে যাচ্ছে সুন্দরীর মতো বড় গাছের সংখ্যা। এর পরিবর্তে গেওয়া, গরানের মতো ছোট ছোট ম্যানগ্রোভ উদ্ভিদ বেশি জন্মাচ্ছে। গবেষকদের আশঙ্কা এ অবস্থা চলতে থাকলে ২০৫০ সালের মধ্যে সুন্দরবনের প্রতিবেশব্যবস্থা মারাত্মকভাবে বিপর্যস্ত হবে।
জার্মানি, সিঙ্গাপুর, ঘানা ও বাংলাদেশের বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষকদের একটি যৌথ গবেষণায় এমন তথ্য পাওয়া গেছে। তাদের গবেষণা নিবন্ধটি গত ২০ ডিসেম্বর বিজ্ঞানবিষয়ক আন্তর্জাতিক জার্নাল সায়েন্স অফ দ্য টোটাল এনভায়রনমেন্ট প্রকাশিত হয়।
জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বেড়ে যাওয়ায় দেশের উপকূলীয় অঞ্চলের নদনদী ও খালে লবণাক্ততার মাত্রা বাড়ছে। এই লবণাক্ত পানি বিশ্বের বৃহত্তম ম্যানগ্রোভ বন সুন্দরবনের গঠনগত পরিবর্তনে কতটা ভূমিকা রাখছে সেটি অনুসন্ধান করা হয়েছে গবেষণায়।
খুলনা বিশ্ববিদ্যালয় ও জার্মানির টেকনিক্যাল ইউনিভার্সিটি অব মিউনিখের গবেষক শামিম আহমেদ, শাহাজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের ফরেস্ট্রি ও এনভায়রনমেন্টাল সায়েন্স বিভাগের অধ্যাপক ড. স্বপন কুমার সরকার, ন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি অফ সিঙ্গাপুরের অধ্যাপক ড. ড্যানিয়েল ফ্রিয়েসসহ মোট ১২ গবেষক সুন্দরবনের ওপর লবণাক্ততার প্রভাব নিয়ে গবেষণাটি চালিয়েছেন।
এতে দেখা গেছে, ক্রমবর্ধমান লবণাক্ততায় গত কয়েক দশকে সুন্দরবনের সামগ্রিক বৈশিষ্ট্য ও মাটির উপাদানে পরিবর্তন ঘটছে। স্থানভেদে গাছের প্রজাতিগত বৈচিত্র্যও হুমকির মুখে।
গবেষণায় দেখা গেছে লবণাক্ততা গাছের উচ্চতা বৃদ্ধির জন্য প্রতিবন্ধকতা তৈরি করায় বিভিন্ন প্রজাতির উদ্ভিদের সালোকসংশ্লেষণে সমস্যা হচ্ছে, এতে সুন্দরীর মতো বড় গাছ মরে যাওয়ার হার বেড়েছে। এসব গাছের জায়গায় জন্মাচ্ছে গেওয়া ও গরানের মতো ছোট ছোট ম্যানগ্রোভ উদ্ভিদ। এতে সুন্দরবনের সামগ্রিক কার্বন পুল এবং মোট প্রোডাকটিভিটি বা কার্যক্ষমতা কমে আসছে।
বিশ্বের সবচেয়ে বড় ম্যানগ্রোভ বন সুন্দরবনের পানি ও মাটিতে বাড়ছে লবণাক্ততা
গবেষক দলের সদস্য অধ্যাপক ড. স্বপন কুমার সরকার নিউজবাংলাকে বলেন, ‘বৈশ্বিক জলবায়ু পরিবর্তনের দরুন সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বৃদ্ধির কারণে সুন্দরবনের মাটি, নদী এবং খালে লবণাক্ততা বেড়ে চলেছে। বন সংরক্ষণ ও বন ব্যবস্থাপনার জন্য এই ক্রমবর্ধমান লবণাক্ততা বড় ধরনের হুমকি।’
গবেষক দলের সদস্যরা ২০১৮ সালের এপ্রিলে সুন্দরবনের স্বল্প লবণাক্ত, মধ্য লবণাক্ত ও উচ্চ লবণাক্ত এলাকা থেকে ২০টি করে মোট ৬০টি স্থায়ী নমুনা প্লটের ১ হাজার ৩৭৮টি উদ্ভিদের তথ্য সংগ্রহ করেন। এসব গাছের মধ্যে ছিল সুন্দরী, গেওয়া, গরান, পশুর, বাইন, সিংড়া, কেওড়া। একই জায়গা থেকে ২০২০ সালের ডিসেম্বরে গাছগুলোর তথ্য সংগ্রহের পর ম্যানগ্রোভের সামগ্রিক বৃদ্ধির ধারা যাচাই করা হয়।
গবেষণায় বিভিন্ন ম্যানগ্রোভ গাছের কাঠামোগত বৈশিষ্ট্য (উচ্চতা ও বেড়), কার্যকরী বৈশিষ্ট্য ও কার্যক্ষমতা (সালোক সংশ্লেষণ ক্ষমতা, সামগ্রিক বৃদ্ধি, কাঠের ঘনত্ব) এবং মাটির উপাদানগত বৈশিষ্ট্যের (এমোনিয়াম, ফসফরাস, পটাশিয়াম, লবণাক্ততা, অম্লতা, পলি জমার মাত্রা) ওপর কী প্রভাব ফেলছে তা নিরুপণের চেষ্টা করা হয়েছে।
অধ্যাপক স্বপন কুমার সরকার জানান, গবেষণায় দেখা গেছে উচ্চ লবণাক্ত এলাকার মাটির পুষ্টিগুণ নিম্নমানের হওয়ায় সেখানে বড় সুন্দরী গাছের সংখ্যা দিন দিন কমে যাচ্ছে। এসব জায়গায় তুলনামূলকভাবে ছোট কিন্তু লবণসহিষ্ণু গেওয়া ও গরানগাছের একচ্ছত্র আধিপত্য দেখা যাচ্ছে।
তিনি বলেন, ‘সুন্দরীগাছ মূলত অন্য গাছের তুলনায় লবণাক্ততা সহ্য করার ক্ষমতা কম রাখে। এ কারণে সুন্দরবনের এই প্রজাতির অবস্থা সবচাইতে সংকটাপন্ন। সুন্দরবনের উত্তর ও পূর্বাঞ্চলের অবস্থা তুলনামূলকভাবে অন্য অঞ্চলের চেয়ে ভালো, লবণাক্ততা কম, অপেক্ষাকৃত অধিক প্রোডাক্টিভ বা কার্যক্ষম এবং সর্বোচ্চ উচ্চতার গাছগুলো এখানেই পাওয়া যায়।’
গবেষকেরা বলছেন, উপকূলীয় এলাকার বনাঞ্চলের গাছ কীভাবে জলবায়ু পরিবর্তন ও পরিবর্তিত লবণাক্ত পরিবেশের সঙ্গে খাপ খাইয়ে বেড়ে ওঠে, সেটা জানা না থাকলে বন ব্যবস্থাপনা করা মুশকিল। পাশাপাশি গাছকে যে ধরনের শারীরবৃত্তীয় বৈশিষ্ট্য নিয়ে বেঁচে থাকতে হয় এর এর সঙ্গে আশপাশের পরিবেশের বিভিন্ন উপাদানের সম্পর্ক কেমন সেটি জানাও জরুরি। গবেষণায় পাওয়া তথ্য সুন্দরবন ব্যবস্থাপনা যথাযথভাবে করতে সাহায্য করবে।
গবেষকদের আশঙ্কা, সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা যে হারে বাড়ছে তাতে অদূরভবিষ্যতে বনের সমুদ্র উপকূলবর্তী এলাকাগুলো সারা বছর স্থায়ীভাবে পানিতে নিমজ্জিত থাকবে। বন ব্যবস্থাপনার ক্ষেত্রে লবণাক্ততাকে প্রশমিত করার তাগিদ দিয়ে নদীর নাব্যতা টিকিয়ে রাখা ও পলি জমার মাত্রা নিয়ন্ত্রণের পরামর্শ দেয়া হয়েছে।