আর্টেমিস ওয়ান মিশনের মাধ্যমে চাঁদে মানুষের বিজয় নিশান আরও সংহত হতে যাচ্ছে। তবে গোটা আর্টেমিস প্রোগ্রামের লক্ষ্য আরও উচ্চাভিলাষী।
পরিকল্পনা অনুযায়ী সব ঠিক থাকলে আনুষ্ঠানিকভাবে শুরু হয়ে গেছে মানুষের মঙ্গলগ্রহে পৌঁছানোর অভিযান। কারণ কয়েক ধাপের আর্টেমিস মিশনের চূড়ান্ত লক্ষ্য চাঁদের বুকে বসে মঙ্গলে পৌঁছানোর কৌশল নির্ধারণ।
আর্টেমিস প্রোগ্রাম বাস্তবায়ন হবে বেশ কয়েকটি ধাপে, যার মধ্যে মিশন ওয়ানের আওতায় বুধবার চাঁদের চারপাশের কক্ষপথের উদ্দেশে পাঠানো হয়েছে ওরিয়ন স্পেসক্রাফট।
সব ঠিক থাকলে ২৫ দিন পর পৃথিবীতে ফিরে আসবে এই স্পেসক্রাফট। এটি অবতরণ করবে যুক্তরাষ্ট্রের ক্যালিফোর্নিয়া উপকূলে প্রশান্ত মহাসগরের বুকে।
আর্টেমিস প্রোগ্রামের নেতৃত্ব দিচ্ছে যুক্তরাষ্ট্রের ন্যাশনাল অ্যারোনটিক্স অ্যান্ড স্পেস অ্যাডমিনিস্ট্রেশন (নাসা)। এতে সহায়তা করছে ইউরোপীয় স্পেস এজেন্সি (ইএসএ), জাপান অ্যারোস্পেস এক্সপ্লোরেশন এজেন্সি (জেএএক্সএ) এবং কানাডিয়ান স্পেস এজেন্সি (সিএসএ)।
চলমান আর্টেমিস ওয়ান মিশনে পাঠানো হয়েছে মানুষবিহীন স্পেসক্রাফট। তবে ২০২৪ সালে আর্টেমিস টু মিশনে যে স্পেসক্রাফট পাঠানো হবে, তাতে থাকবে মানুষ। ওই মিশনও ঘুরপাক খাবে চাঁদের চারপাশে। ফলে চন্দ্রপৃষ্ঠে পড়বে না মানুষের পায়ের ছাপ।
তবে পরিকল্পনা অনুযায়ী সব ঠিকঠাক থাকলে পরের বছর ২০২৫ সালে আর্টেমিস থ্রি মিশনে পাঠানো নভোচারীরা পা রাখবেন চাঁদের বুকে।
১৯৭২ সালে অ্যাপোলো সেভেন্টিন মিশনের পর আর্টেমিস থ্রি মিশনেই প্রথমবার চাঁদের বুকে মানুষ পাঠানোর পরিকল্পনা করছে নাসা। শুধু তা-ই নয়, ওই মিশনটি আরও দুটি কারণেও নতুন ইতিহাসের জন্ম দেবে।
আর্টেমিস থ্রি মিশনে স্পেসক্রাফটে থাকা একজন নারী এবং একজন অশ্বেতাঙ্গ নভোচারী অবতরণ করবেন চাঁদের বুকে। তারা সেখানে থাকবেন প্রায় সাড়ে ছয় দিন। এরপর ফিরে আসবেন মূল স্পেসক্রাফটে, যেখানে থাকবেন আরও দুই নভোচারী।
নাসা বলছে, আর্টেমিস মিশনের মাধ্যমে চাঁদে মানুষের দীর্ঘমেয়াদি অবস্থান নিশ্চিতের জন্য বাণিজ্যিক ও আন্তর্জাতিক অংশীদারদের সঙ্গে সহযোগিতামূলক প্রচেষ্টা চালানো হবে। এরপর চাঁদ ও এর চারপাশ থেকে পাওয়া অভিজ্ঞতা নভোচারীদের মঙ্গলে পাঠাতে ব্যবহার করা হবে। এই পরিকল্পনার অংশ হিসেবে এখন পর্যন্ত আর্টেমিস ফাইভ পর্যন্ত মিশনের ছক চূড়ান্ত হয়েছে।
প্রথম ধাপে বুধবার শুরু করা আর্টেমিস ওয়ানের মাধ্যমে স্পেস লঞ্চ সিস্টেম (এসএলএস) এবং মানুষবিহীন ওরিয়ন স্পেসক্রাফটের পরীক্ষামূলক যাত্রা করেছে।
কোনো স্পেসক্রাফকে মহাকাশে পাঠাতে বর্তমানে ব্যবহৃত যেকোনো লঞ্চ ভেহিকেলের মধ্যে এসএলএসকে সর্বোচ্চ ভরবহন ক্ষমতার বলে দাবি করছে নাসা। স্পেস শাটলের উত্তরসূরি এই এসএলএসে যুক্ত করা হয়েছে এখনকার সময় পর্যন্ত সবচেয়ে শক্তিধর রকেট।
এসএলএসের রকেটের ক্ষমতা সম্পর্কে নাসা বলছে, কোনো মহাকাশযানকে চাঁদে পৌঁছাতে হলে উৎক্ষেপণের সময় শক্তিশালী রকেটের প্রয়োজন, যাতে এটি পৃথিবীর মাধ্যাকর্ষণ শক্তিকে উপেক্ষা করে সুনির্দিষ্ট গতিপথে থাকতে পারে। আর্টেমিস ওয়ান মিশনের স্পেস লঞ্চ সিস্টেমে (এসএলএস) ব্যবহৃত রকেট সর্বোচ্চ ৮৮ লাখ পাউন্ড ধাক্কা (থ্রাস্ট) তৈরিতে সক্ষম।
আর্টেমিস মিশনে ২০৩০ সাল পর্যন্ত এসএলএস ব্যবহারের পরিকল্পনা রয়েছে নাসার। এর মধ্যে প্রথম চারটি মিশনের পর স্পেস লঞ্চ সিস্টেমের উৎপাদন ও উৎক্ষেপণ ব্যবস্থাপনা ডিপ স্পেস ট্রান্সপোর্ট এলএলসিতে হস্তান্তরের পরিকল্পনা রয়েছে। বোয়িং এবং নর্থরপ গ্রুম্যানের একটি যৌথ উদ্যোগ হলো এই ডিপ স্পেস ট্রান্সপোর্ট এলএলসি।
আর্টেমিস ওয়ান মিশন যেভাবে পরিচালিত হচ্ছে
আর্টেমিস ওয়ান মিশনের লক্ষ্য এসএলএসের কার্যকারিতা পরীক্ষা এবং চাঁদের চারপাশের কক্ষপথে ওরিয়ন স্পেসক্রাফটে ঘুরপাক খাইয়ে আবার পৃথিবীতে ফিরিয়ে আনা। ওরিয়ন ক্যাপসুল পৃথিবীতে ফিরে আসার সময় বায়ুমণ্ডলে ঢোকার আগেই সার্ভিস মডিউল থেকে আলাদা হবে, এরপর প্যারাসুট খুলে নামবে প্রশান্ত মহাসাগরের বুকে।
এরপর ২০২৪ সালের মে মাসে আর্টেমিস টু মিশনে ওরিয়ন মহাকাশযানে থাকবেন চারজন নভোচারী। ওই মিশনে মহাকাশযানটি চাঁদের চারপাশে ঘুরপাক খেয়ে ফিরে আসবে পৃথিবীতে।
পরের বছর আর্টেমিস থ্রি মিশনে চাঁদের বুকে পা রাখবেন দুই নভোচারী। মিশনটি পরিচালনার আগে চাঁদের কাছাকাছি একটি কক্ষপথে হিউম্যান ল্যান্ডিং সিস্টেম (এইচএলএস) স্থাপন করবে নাসা। সেই এনআরএইচওতে পৌঁছানোর পর ওরিয়নের চার নভোচারীর মধ্যে দুজন সেখান থেকে ক্যাপসুলের মাধ্যমে চাঁদে অবতরণ করবেন। বাকি দুজন থাকবেন মূল মহাকাশযানে।
পরিকল্পনা অনুযায়ী দুই নভোচারী চন্দ্রপৃষ্ঠে সাড়ে ছয় দিন থাকার পর ফিরে আসবেন ওরিয়নে। এরপর চার নভোচারী রওনা দেবেন পৃথিবীতে।
এর দুই বছর পর ২০২৭ সালের আর্টেমিস ফোর মিশনেও থাকবেন নভোচারীরা। তারা চাঁদের চারপাশের কক্ষপথে ঘূর্ণায়মান লুনার গেটওয়ে স্টেশনে অবতরণ করবেন। নভোচারীরা যাওয়ার আগেই এসএলএসের মাধ্যমে পাঠানো ওয়ানবি ব্লকের সাহায্যে তৈরি হবে দুটি গেটওয়ে মডিউল।
পরবর্তী সময়ে আর্টেমিস ফাইভ মিশন এবং তারপরের অন্য মিশনগুলোতেও থাকবেন নভোচারীরা। তারা চাঁদে আবাসস্থল নির্মাণ, বৈজ্ঞানিক যন্ত্রপাতি ব্যবহার এবং সম্পদ আহরণের সরঞ্জাম সক্রিয় করার দায়িত্ব পাবেন। একইসঙ্গে চাঁদ থেকে মঙ্গল অভিযানের প্রস্তুতিও শুরু হবে।
নাসার অ্যাপলো মিশনের মাধ্যমে ১৯৬৯ সাল থেকে ১৯৭২ সাল পর্যন্ত চাঁদে অবতরণ করেছিলেন নভোচারীরা। আর এবারের আর্টেমিস মিশনে চাঁদ পেরিয়ে মানুষকে মঙ্গল গ্রহে পৌঁছে দেয়ার চূড়ান্ত লক্ষ্য রয়েছে।
জানিয়ে রাখা ভালো, আর্টেমিস হলেন গ্রিক দেবতা অ্যাপোলোর জমজ বোন এবং গ্রিক পুরাণ অনুযায়ী চাঁদের দেবী।