ইলন মাস্ক টুইটার কিনে নেয়ার পর জনপ্রিয় এই মাইক্রো ব্লগিং সাইট ব্যবহারকারীদের মধ্যে তৈরি হয়েছে অস্থিরতা। বিকল্প নতুন প্ল্যাটফর্মের সন্ধান করছেন অনেকে।
টুইটার ব্যবহারকারীদের একটি অংশ ঝুঁকছে ম্যাস্টোডন-এর দিকে। ছয় বছরের পুরোনো ম্যাস্টোডন সোশ্যাল মিডিয়া প্ল্যাটফর্মে বাম ঘেঁষা একটি ব্যবহারকারী গোষ্ঠী রয়েছে। হাতি ও ম্যামথের আদি প্রাণী ম্যাস্টোডনের নামে তৈরি হয় সাইটটি। এর বিশেষত্ব হচ্ছে একে নির্দিষ্ট কোনো প্রতিষ্ঠান বা ব্যক্তি নিয়ন্ত্রণ করে না। এর নিয়ন্ত্রণ বহুকেন্দ্রিক।
টেকজায়ান্টদের একচ্ছত্র আধিপত্যের বিপরীতে এ বিষয়টি ম্যাস্টোডনকে অনেকের কাছে আকর্ষণীয় করে তুলেছে। মাস্ক টুইটার কেনার ঘোষণার পরদিনই ম্যাস্টোডনে ৭০ হাজার নতুন ব্যবহারকারী যুক্ত হন।
অবশ্য টুইটারের ৪৫ কোটি অ্যাকটিভ ব্যবহারকারীর তুলনায় এ সংখ্যা নগণ্য। ম্যাস্টোডনের জন্য বড় সমস্যা হচ্ছে তাদের বহুকেন্দ্রিক সফটওয়্যার যেটি সাধারণ ব্যবহারকারীদের জন্য বেশ কঠিন।
ম্যাস্টোডনে অন্য প্ল্যাটফর্ম থেকে বেশ কিছু বিষয় আলাদা। যেমন, এখানে টুইটের বদলে ‘টুট’ করতে হয়।
প্রযুক্তিগত দিক থেকেও জটিলতা রয়েছে। ম্যাস্টোডন কোনো একটা নির্দিষ্ট ওয়েবসাইট নয়। হাজারো সংযুক্ত ওয়েবসাইটের নেটওয়ার্ক। এ ধরনের সাইটকে বলা হয় ইনস্ট্যানস।
এগুলো মূলত আলাদা আলাদা সার্ভার থেকে পরিচালিত। সার্ভারগুলো ফেডারেটেড অর্থাৎ এগুলো আলাদাভাবে বিভিন্ন ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠান দিয়ে পরিচালিত তবে নিজেদের মধ্যে যোগাযোগে সক্ষম। এ জন্য তাদের নির্দিষ্ট কোনো কেন্দ্রীয় সিস্টেমের মধ্যে দিয়ে যেতে হয় না। তাদের যোগাযোগের জায়গাটি ফেডিভার্স বা ফেডি নামে পরিচিত।
ম্যাস্টোডনে সাইন আপ করার পর আপনাকে একটি সার্ভার বেছে নিতে হবে। যেগুলোর মধ্যে ম্যাস্টোডন ডটকমের মতো সাধারণ সার্ভার থেকে শুরু করে কেপপ ডটসোশ্যাল বা লিনাক্সরকস ডটঅনলাইন এর মতো নির্দিষ্ট ব্যবহারকারীদের জন্য সার্ভারও রয়েছে।
একবারে নিছক মজার জন্য ডলফিন ডটটাউন নামের সার্ভারও আছে, যেখানে ব্যবহারকারীরা শুধু ইংরেজি ‘ই’ অক্ষরটি লিখতে পারেন। যে সার্ভারটি নির্বাচন করা হয় সেটি ব্যবহারকারীর অ্যাকাউন্টের নামের শেষে যুক্ত হয়ে যায়, যেমন rubaid@kpop.social।
আপনি যে টুট বা পোস্টগুলো দেখতে পান সেগুলো একই সার্ভার ব্যবহারকারীদের পোস্ট, পুরো ফেডিভার্সের নয়। তবে, চাইলে অন্য সার্ভার ব্যবহারকারীদেরও টুট করা যায় এবং তাদের টুটকে বুস্ট করা যায়।
এভাবেই ম্যাস্টোডন একক কারও অধীনে না থেকে একটি একত্রিত বৈশ্বিক প্ল্যাটফর্ম তৈরি করে। ম্যাস্টোডনের প্রতিষ্ঠাতা ও অন্যতম প্রোগ্রামার জার্মানির ইউজেন রচকো ব্রিটিশ দৈনিক গার্ডিয়ানকে বলেন, ‘সার্ভারগুলো আদতে সেবাদাতা হিসেবে কাজ করে। যেমন হটমেইল ও জিমেইল আমরা ই-মেইলের জন্য ব্যবহার করি। তবে স্কুল ফোরামের মতো সার্ভারগুলো একে অপর থেকে বিচ্ছিন্ন নয়। একটি অ্যাকাউন্ট দিয়েই আপনি এ বৈশ্বিক বহুকেন্দ্রিক সোশ্যাল নেটওয়ার্কের মধ্যে থাকা যে কারও সঙ্গে যোগাযোগ করতে পারবেন।’
ম্যাস্টোডনের মডেলের ঝামেলা হলো, যে সার্ভারে আপনি যুক্ত হয়েছেন সেটি অকেজো হয়ে পড়লে আপনার অ্যাকাউন্টে থাকা সবকিছু হারাতে হবে। ম্যাস্টোডনের সার্ভার অ্যাডমিনের হাতে আপনি যা করেন তার নিয়ন্ত্রণ থাকছে।
উদাহরণ হিসেবে বলা যায়, কেপপ ডটসোশ্যালের মালিক যদি দেখেন তার সার্ভার ব্যবহারকারী ডলফিন ডটটাউন থেকে করা কোনো পোস্ট বা টুট বুস্ট করেছেন তাহলে তিনি চাইলে সেটি মুছে দিতে পারেন। এমনকি সার্ভারকে আলাদা করে রাখতে পারেন, যাতে ডলফিন থেকে কোনো ব্যবহারকারীর কেপপের সার্ভারে ঢুকতে না পারেন। সার্ভার অ্যাডমিন চাইলে একজন ব্যবহারকারীর ব্যক্তিগত টুট দেখতে পারেন এবং চাইলে তার অ্যাকাউন্ট মুছে ফেলতে পারেন।
রচকোর মতে, একজন নতুন ব্যবহারকারীর উচিত কোনো সার্ভারে যোগ দেয়ার আগে সেটি সম্বন্ধে খোঁজ নেয়া এবং সেটি কে চালাচ্ছে জানার চেষ্টা করা।
তিনি বলেন, ‘সার্ভার পরিচালনাকারী কোনো প্রতিষ্ঠান নাকি ব্যক্তি, তার অতীত রেকর্ড কেমন, নির্ভরযোগ্য কিনা, দীর্ঘস্থায়ী হবে কিনা, মডারেশনের নীতিমালা আছে কিনা সেগুলো দেখে নেয়া উচিত।
‘ঘৃণামূলক বার্তার বিরুদ্ধে নিয়ম রয়েছে ও সার্ভারের মালিকের কিছু হলে যেন সার্ভারের কিছু না হয় সে কারণে ব্যাকআপের মতো প্রয়োজনীয় সার্ভিস যাদের রয়েছে সেগুলোই মূলত নির্ভরযোগ্য।’
রচকো আরও বলেন যে, ম্যাস্টোডনের হোমপেজে পরীক্ষিত সার্ভারের একটা তালিকা আছে। তবে নতুন ব্যবহারকারীদের জন্য সেটা ব্যবহার করা ঝক্কির ব্যপার।
ম্যাস্টোডনের সঙ্গে টুইটারের মতো কোনো সাইটের পার্থক্য নাটকীয় মনে হতে পারে। জার্মান প্রবাসী ব্রাজিলিয়ান ট্রান্সনারী এলাইলা দ্য গার্ডিয়ানকে জানান তার কাছে ম্যাস্টোডনক অনেক বেশি নিরাপদ মনে হয়।
কারণ হিসেবে তিনি মনে করেন, ইনস্ট্যানসগুলোকে এখানে খুব কঠোরভাবে নিয়ন্ত্রণ করা হয়। ব্যবহারকারীরা নিজেদের মতামত অজান্তে বা দুর্ঘটনাবশত প্রকাশ হয়ে যাওয়ার ভয়ে থাকেন না।
তিনি বলেন, ‘ভাইরাল হিসেবে যে পোস্টগুলো বিবেচিত হয় সেগুলোতে সাধারণত ৫০ থেকে ১০০টি বুস্ট থাকে। আমার অধিকাংশ টুটে দুই থেকে ২০টি লাইক রয়েছে। সেখানে যখন ২০টি লাইক আসে তখনও আমি যারা লাইক দিয়েছে তাদের সবার নাম, রুচি ও আগ্রহের বিষয় জানতে পারি। পারস্পরিকতার যে অনুভূতি সেটা আমি টুইটারে কখনও পাই না। এখানে কেউ সেলেব্রিটি না। সবার মতামতই পড়া হয়।’
এ কারণে এলাইলা এখানে একটি কমিউনিটি তৈরি করতে পেরেছেন, যার মাধ্যমে তিনি বন্ধুত্ব, রোমান্টিক সম্পর্ক এমনকি চাকরিও খুঁজে পেয়েছেন। যৌনতাপূর্ণ পোস্ট করার সময়েও তিনি ঘৃণা বা বিদ্বেষের শিকার হননি। টুইটারের মতো সাইটের ক্ষেত্রে এলাইলা মনে করেন এমনটা ঘটা অভাবনীয়।
তিনি বলেন, ‘ফেডিভার্স আমাকে শিখিয়েছে কমিউনিটিতে থাকতে কেমন লাগে আর কমিউনিটি আমাকে শিখিয়েছে একজন ট্র্যান্স হওয়ার আনন্দ।’
দুর্ভাগ্যবশত মাস্টোডনের বিকেন্দ্রীকরণের খারাপ একটি দিক হলো নিজেদের স্বার্থে কেউ এটিকে ব্যবহার করতে পারে।
২০১৯ সালে শেতাঙ্গ আধিপত্যবাদীদের সামাজিক নেটওয়ার্ক ‘গ্যাব’ ম্যাস্টোডনের ফ্রি সফটওয়্যারের একটি সংস্করণ ব্যবহার করা শুরু করে। ম্যাস্টোডন গ্যাবকে এটি থেকে বিরত রাখতে পারেনি, তবে ম্যাস্টোডনের প্রধান সার্ভারগুলো গ্যাব সার্ভারগুলোকে ‘ডি-ফেডারেট’ করেছে, যাতে তারা যোগাযোগ করতে না পারে। ট্রাম্পের সামাজিক নেটওয়ার্ক ট্রুথ সোশ্যালকে শক্তিশালী করতে ম্যাস্টোডনের কোড ব্যবহার করা হয়েছে।
যুক্তরাষ্ট্রের ইউনিভার্সিটি অফ কলোরাডোর প্রযুক্তি বিষয়ক গবেষক নেইথান স্নাইডারের মতে, ম্যাস্টোডনের প্রভাব ক্রমবর্ধমান হলেও ডিজাইনের কারণে এর তহবিল পাওয়া কঠিন এবং এ কারণে টুইটারের মতো একটি ওয়েবসাইটের বিকল্প হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হওয়া কার্যত অসম্ভব।
তিনি বলেন, “ম্যাস্টোডন মূলত একটি স্বেচ্ছাসেবী প্রকল্প যা আদতে একজন ব্যক্তির দ্বারা তৈরি। টুইটার দৃশ্যত ৪৪ বিলিয়ন ডলারের একটি কোম্পানি। যদি একদল ব্যবহারকারী একত্রিত হন ও বলেন, ‘আমরা একসঙ্গে কাজ করতে ও একটি বিকল্প তৈরি করতে চাই’ তাহলেও তাদের তহবিল পাওয়ার ক্ষমতা ইলন মাস্কের তহবিল সংগ্রহের ক্ষমতার চেয়ে অনেক কম হবে।”
প্রযুক্তি সমালোচক ও টেক ওন্ট সেইভ আস পডকাস্টের হোস্ট প্যারিস মার্কস জানান, তিনি ম্যাস্টোডন ব্যবহারের চেষ্টা করেছেন কিন্তু তেমন কোনো দর্শক পাননি। যেখানে টুইটারে তার ৩৫ হাজার ফলোয়ার রয়েছে এবং তার পোস্ট প্রায়ই ভাইরাল হয়।
তিনি বলেন, ‘এটি (টুইটার) এখনও একটি প্রভাবশালী সামাজিক মিডিয়া প্ল্যাটফর্ম। আদতে যার সমতুল্য কেউ নেই। তাই টুইটারে আর কী কী আসছে সেটা জানতে অনেকেই এখানে আটকে আছেন।’
মার্কস টুইটার ব্যবহার বন্ধ করতে না পেরে বেশ কিছু পদক্ষেপ নিয়েছেন। তিনি বলেন, ‘যেসব অ্যাকাউন্ট থেকে আমাকে বিজ্ঞাপন পাঠানো হয় আমি সেগুলো ব্লক করে দেই। আমি টুইটারের ব্লু টিকের জন্য অর্থ দিইনি। আমাকে তারা আর্থিকভাবে যেন খুব বেশি মূল্যবান মনে না করে সে বিষয়টি আমি নিশ্চিত করতে চাই।’