বঙ্গোপসাগরে চলতি মাসের মাঝামাঝি সময়ের দিকে সৃষ্ট লঘুচাপ ঘূর্ণিঝড়ে রূপ নেবে। এরপর সেটি সুপার সাইক্লোন হিসেবে ঘণ্টায় সর্বোচ্চ ২১০ থেকে ২৫০ কিলোমিটার গতিতে উপকূলে আঘাত হানতে পারে। এমন একটি পোস্ট ছড়িয়েছে ফেসবুকে।
তবে আবহাওয়া অধিদপ্তর বলছে, চলতি মাসে সাগরে লঘুচাপ তৈরি হওয়ার সম্ভাবনা থাকলেও সেটি প্রবল ঘূর্ণিঝড়ে রূপ নেবে কিনা তা সুনির্দিষ্ট করে এখনও বলা সম্ভব নয়।
কানাডার সাসকাচুয়ান বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক সহকারী ও আবহাওয়াবিদ মোস্তফা কামাল পলাশ রোববার বাংলাদেশ সময় বেলা সাড়ে ১১টার দিকে ফেসবুকে 'ব্রেকিং নিউজ’ হিসেবে একটি পোস্টে প্রথম সুপার সাইক্লোনের আঘাতের সম্ভাবনা জানান।
ওই পোস্টের বরাতে দেশের মূলধারার কয়েকটি সংবাদমাধ্যম প্রতিবেদন প্রকাশ করে। সেসব প্রতিবেদনের লিংকও নিজের ওয়ালে দিয়েছেন পলাশ। এরপর সোমবার সন্ধ্যা পর্যন্ত বিষয়টি নিয়ে তিনি আরও তিনটি পোস্ট দিয়েছেন। এগুলো শেয়ার করেছেন অসংখ্য ফেসবুক ব্যবহারকারী।
সুপার সাইক্লোনের আশঙ্কা জানিয়ে মোস্তফা কামাল পলাশের প্রথম পোস্ট
বাংলাদেশ সময় সোমবার বিকেল ৪টা ৫৮ মিনিটে দেয়া সবশেষ পোস্টে মোস্তফা কামাল পলাশ লেখেন (বাক্য ও বানান অপরিবর্তিত), “আমেরিকার আবহাওয়া পূর্বাভাস মডেল হতে প্রাপ্ত সর্বশেষ পূর্বাভাস (১০ই অক্টোবর দুপুর ১২টার মডেল রান) অনুসারে আগামী সপ্তাহে বঙ্গোপসাগরে সৃষ্ট সম্ভব্য ঘূর্ণিঝড় ‘সিত্রাং’ সরাসরি বাংলাদেশ ও ভারতের পশ্চিম বঙ্গের উপকূলে আঘাত হানার সম্ভাবনা নির্দেশ করতেছে সুপার সাইক্লোন হিসাবে। ঘূর্ণিঝড় আম্পানের স্থল ভাগে আঘাত হেনেছিল সর্বশেষ পূর্বাভাস অনুসারে সম্ভব্য ঘূর্ণিঝড় সিত্রাং প্রায় একই স্থানে আঘাত করার সম্ভাবনা নির্দেশ করতেছে আমেরিকার আবহাওয়া পূর্বাভাস মডেল।
“ঘূর্ণিঝড়টির কারণে সমুদ্র পৃষ্ঠের বায়ুচাপ ৯৪১ মিলিবার পর্যন্ত নেমে যেতে পারে সেই সাথে বাতাসের গতিবেগ ঘণ্টায় সর্বোচ্চ ২১০ থেকে ২৫০ কিলোমিটার পর্যন্ত উঠতে পারে। এই গতিবেগে উপকুলে আঘাত করলে ক্ষয়-ক্ষতির পরিমাণ ঠিক একই পরিমাণ হবে যেমনটি হয়েছিল ঘূর্ণিঝড় সিডর এর কারণে ২০০৭ সালে খুলনা বিভাগের উপকূলীয় জেলাগুলোতে।”
‘আমেরিকার আবহাওয়া পূর্বাভাস মডেল’ হিসেবে পলাশ যে ওয়েবসাইটের তথ্য দিয়েছেন তার নাম ট্রপিকালটিডবিটস ডটকম। ড. লেভি কাওয়ান নামের একজন ‘স্বাধীন আবহাওয়াবিদ’ হিসেবে ব্যক্তিগতভাবে ওয়েবসাইটটি পরিচালনা করছেন।
ওয়েবসাইটে ড. লেভি সম্পর্কে বলা হয়েছে, তিনি ২০০২ সাল থেকে ট্রপিক্যাল সাইক্লোন পর্যবেক্ষণ করছেন। যুক্তরাষ্ট্রের ফ্লোরিডা স্টেট ইউনিভার্সিটি থেকে আবহাওয়াবিদ্যা নিয়ে পিএইচডি করেছেন তিনি।
ওয়েবসাইটের ল্যান্ডিংপেজে বলা হয়েছে গত এক সপ্তাহে কোনো ব্লগ পোস্ট করা হয়নি। আটলান্টিক অঞ্চলে ট্রপিকাল সাইক্লোন সক্রিয় থাকার সময়ে সাধারণত নিয়মিত পোস্ট করা হয়।
ট্রপিকাল টিডবিটসের ল্যান্ডিং পেজ
তবে সাইটের ফোরকাস্ট মডেলস সেকশনে গিয়ে ‘সুপার সাইক্লোন সিত্রাং’ এর সম্ভাব্য গতিপথের অ্যানিমেশন দেখা গেছে।
ড. লেভি বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার সময়ে ২০১২ সালে নিজের হোস্টেল কক্ষ থেকে ব্যক্তিগত ব্লগ হিসেবে সাইটটি প্রতিষ্ঠা করেন। তিনি নিজেই লিখেছেন, তার সাইক্লোন পূর্বাভাস মডেল কোনো আনুষ্ঠানিক বা সরকারি সংস্থার পূর্বাভাস নয়। পুরো সাইটটি নিছক শখের বশে করা এবং ক্রাউডফান্ডিং-এ চলছে।
ট্রপিকাল টিডবিটসের ফোরকাস্ট মডেলস সেকশনে ‘সুপার সাইক্লোন সিত্রাং’
এই ‘নিছক শখের বশে’ করা ওয়েবসাইটের মডেলের ভিত্তিতেই অক্টোবরের তৃতীয় সপ্তাহে দেশে ‘সুপার সাইক্লোনের’ আঘাতের সম্ভাবনা জানাচ্ছেন কানাডাপ্রবাসী মোস্তফা কামাল পলাশ।
আমেরিকান টেকজায়ান্ট আইবিএম-এর সহযোগী প্রতিষ্ঠান দ্য ওয়েদার চ্যানেলের ওয়েদার ডটকমে প্রকাশিত একটি নিবন্ধে ঘূর্ণিঝড় তৈরির আগেই এভাবে পূর্বাভাস দেয়ার মডেলের সীমাবদ্ধতা নিয়ে সতর্ক করা হয়েছে।
এই নিবন্ধে বলা হয়, সরকারি সংস্থা ও ব্যক্তিখাতের প্রতিষ্ঠানের দেয়া আবহাওয়া পূর্বাভাসের মডেলের তথ্য এখন ইন্টারনেটে ব্যাপক সহজলভ্য। তার মানে এই নয় যে, এক সপ্তাহ বা তার বেশি সময় আগেই কোনো হারিকেনের উপকূলে আঘাতের পূর্বাভাস মডেল আপনার সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে পোস্ট করা একটি ভালো ধারণা৷
এই নিবন্ধে এ ধরনের পূর্বাভাসের ত্রুটি তুলে ধরতে ড. লেভির ওয়েবসাইটেরই একটি বিভ্রান্তিকর মডেল জিআইএফ আকারে দেয়া হয়েছে।
ড. লেভির ওয়েবসাইটের একটি মডেলের জিআইএফ
এতে বলা হয়, ‘নিচের অ্যানিমেশনটিতে আলাদা করে মডেলটি আটবার চালানোর ফল দেখা যাচ্ছে। এটি মূলত গ্লোবাল ফোরকাস্ট সিস্টেমের (জিএফএস) মডেল যেটিকে ২২ আগস্ট থেকে ২৪ আগস্ট সকাল পর্যন্ত ৬ ঘণ্টা পরপর চালানো হয়েছে। প্রতিটি পূর্বাভাসই ৩১ আগস্ট রাত ২টার সময়কার।
‘অ্যানিমেশনে গাঢ় লালকে ঘিরে থাকা কালো বৃত্তগুলোর মাধ্যমে বোঝা যায় যে মডেলটি ক্রমশ তৈরি হতে থাকা পূর্ণাঙ্গ উপকূলীয় ঘূর্ণিঝড়গুলো কোথায় তৈরি সেগুলো দেখাচ্ছে।’
তবে প্রতিবারই মডেলটি চালানোর সময় ঘূর্ণিঝড়ের অবস্থানে ভিন্নতা দেয়া যায়।
ওয়েদার ডটকম বলছে, প্রতিদিন সুপারকম্পিউটারে জটিল অ্যালগরিদমের মাধ্যমে একাধিকবার পূর্বাভাসের মডেলগুলো চালানো হয়। তাপমাত্রা, চাপ, বাতাসের গতি ও বৃষ্টিপাতের সম্ভাবনা বিচার করে অ্যালগরিদমে একেকবার একেক সূচকে পরিবর্তন ঘটে।
আবহাওয়া অধিদপ্তর কী বলছে
আবহাওয়া অধিদপ্তরের কর্মকর্তারা বলছেন, চলতি মাসের দীর্ঘমেয়াদি পূর্বাভাস অনুযায়ী সামনে একটি লঘুচাপ তৈরি হতে পারে। তবে সেটি ঘূর্ণিঝড়ে রূপ নেবে কিনা তা এখনও পরিষ্কার নয়।
সাগরে লঘুচাপ তৈরির পর সেটি ঘূর্ণিঝড়ে পরিণত হতে অন্তত তিন থেকে পাঁচ দিন সময় লাগে। আবহাওয়া অধিদপ্তরের পূর্বাভাস বলছে, ১৭ অক্টোবর পর্যন্ত বাংলাদেশে মৌসুমী বায়ুর সক্রিয় থাকার কথা। এর মধ্যে লঘুচাপ তৈরি হলেও মৌসুমী বায়ুর কারণে সেটি ঘূর্ণিঝড়ে পরিণত হতে পারবে না।
আর মৌসুমী বায়ুর সক্রিয়তা কেটে যাওয়ার পর সাগরে লঘুচাপ তৈরি হলেও ২০ অক্টোবরের মধ্যে সেটির ঘূর্ণিঝড়ে পরিণত হওয়া বা উপকূলে আঘাতের সম্ভাবনা বেশ কম।
আবহাওয়া অধিদপ্তরের আবহাওয়াবিদ ওমর ফারুক নিউজবাংলাকে বলেন, ‘আমাদের একমাসের পূর্বাভাসে ঘূর্ণিঝড়ে পরিণত হতে পারে এমন একটি লঘুচাপের কথা বলা আছে। তবে এত আগে এই সম্ভাবনা নিশ্চিত করে বলা যায় না।’
তিনি বলেন, ‘দেশে এখনও মৌসুমী বায়ু সক্রিয়। মৌসুমী বায়ু বিদায় নিতে এক সপ্তাহ লাগবে। আর এর মধ্যে কোনো লঘুচাপ ঘূর্ণিঝড়ে রূপান্তরিত হবে না। মৌসুমী বায়ু চলে যাওয়ার পর হয়ত এমন হতে পারে, তবে সে সম্ভাবনা এখনও তৈরি হয়নি।’
মোস্তফা কামাল পলাশের সতর্কতার বিষয়ে মন্তব্য জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘এটা যার যার ব্যক্তিগত মতামত তিনি কী বলবেন। আমাদের এখানে এখনও ঘূর্ণিঝড়ের এমন কোনো সম্ভাবনা নেই।’
আবহাওয়ার বর্তমান অবস্থা
দেশের তাপমাত্রা এখন কম জানিয়ে আবহাবিদ ওমর ফারুক বলেন, ‘দেশে এখন গড় তাপমাত্রা ৩৫ ডিগ্রি সেলসিয়াসের এর নিচে আছে। আগামী দুই-একদিন বৃষ্টি হতে পারে। তবে সেটি অনেক কম।’
আবহাওয়া অধিদপ্তরের বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়েছে, সোমবার সকাল ৯টার পর দেশের সর্বোচ্চ তাপমাত্রা ছিল রাজশাহীতে ৩৫.৭ ডিগ্রি সেলসিয়াস আর সর্বনিম্ন তেঁতুলিয়াতে ২২.৩ ডিগ্রি সেলসিয়াস। রোববার সন্ধ্যা ৬টা থেকে সোমবার ভোর ৬টা পর্যন্ত দেশে সর্বোচ্চ বৃষ্টি হয়েছে তেঁতুলিয়াতে ৯১ মিলিমিটার।