বিলুপ্ত হোমিনিনের (মানুষের আদি নিকটাত্মীয়) জিনগত সঞ্চার এবং মানব বিবর্তনের সম্পর্ক আবিষ্কারের জন্য চিকিৎসায় নোবেল জয় করেছেন সুইডেনের বিজ্ঞানী এসভান্তে পেবো। প্রায় দুই দশকের গবেষণায় পেবো উদ্ঘাটন করেছেন অতীতে বিলুপ্ত হোমিনিনগুলোর চেয়ে আমাদের হোমো সেপিয়েন্স কীভাবে আলাদা।
তবে বিলুপ্ত হোমিনিনের কিছু জিন সঞ্চারিত হয়েছে হোমো সেপিয়েন্সে যা এখনও সক্রিয়।
নোবেল কমিটি বলেছে, ‘মানুষ সব সময়েই তার শেকড় অনুসন্ধান করছে। আমরা কোথা থেকে এসেছি এবং আমাদের আগে যারা এসেছিল তাদের সঙ্গে আমাদের সম্পর্ক কী?
‘তাৎপর্যপূর্ণ গবেষণার মাধ্যমে এসভান্তে পেবো আপাতদৃষ্টিতে অসম্ভব কিছু উদ্ঘাটন করেছেন। তিনি বর্তমান সময়ের মানুষের বিলুপ্ত নিকটাত্মীয় নিয়ান্ডারথালের জিন মানচিত্র তৈরি করেছেন। তিনি আমাদের অজানা হোমিনিন ডেনিসোভার অস্তিত্বও আবিষ্কার করেছেন।’
পেবো প্রমাণ করেছেন, প্রায় ৭০ হাজার বছর আগে আফ্রিকা থেকে অভিবাসনের পর আন্তঃপ্রজননের মাধ্যমে হোমো সেপিয়েন্সে বিলুপ্ত হোমিনিনের জিনগত স্থানান্তর ঘটে।
এসভান্তে পেবোর আবিষ্কারের গুরুত্ব নিয়ে নোবেল পুরস্কারের ওয়েবসাইটে প্রকাশিত নিবন্ধ ভাষান্তর করা হয়েছে নিউজবাংলার পাঠকদের জন্য।
আধুনিক মানুষের উদ্ভব কীভাবে
বর্তমান মানুষের উদ্ভব কীভাবে, সেই প্রশ্নে নোবেল কমিটি বলছে, ‘আমাদের উদ্ভবের উৎস এবং কী কারণগুলো আমাদের অনন্য করছে সেই প্রশ্ন প্রাচীনকাল থেকেই মানব মনকে আচ্ছন্ন রেখেছে।
‘জীবাশ্মবিদ্যা এবং প্রত্নতত্ত্ব মানব বিবর্তনের গবেষণার জন্য গুরুত্বপূর্ণ। গবেষণায় প্রমাণ মিলেছে আধুনিক মানুষ বা হোমো সেপিয়েন্সের শারীরবৃত্তীয় রূপটি এখন থেকে আনুমানিক ৩ লাখ বছর আগে আফ্রিকায় প্রথম বিকশিত হয়।
‘অন্যদিকে আমাদের নিকটতম আত্মীয় নিয়ান্ডারথাল আফ্রিকার বাইরে বিকশিত হয়েছিল ৪ লাখ বছর আগে। এখন থেকে ৩০ হাজার বছর আগে পর্যন্ত তারা ইউরোপ এবং পশ্চিম এশিয়ার জনবসতি গড়ে তুলেছিল এবং এই সময়ের মধ্যেই তারা বিলুপ্ত হয়ে যায়।
‘প্রায় ৭০ হাজার বছর আগে হোমো সেপিয়েন্সের দল আফ্রিকা থেকে মধ্যপ্রাচ্যে অভিবাসিত হয় এবং সেখান থেকে তারা বাকি বিশ্বে ছড়িয়ে পড়ে। হোমো সেপিয়েন্স এবং নিয়ান্ডারথালরা এভাবে হাজার হাজার বছর ধরে ইউরেশিয়ার বিশাল অংশে সহাবস্থান করেছিল।’
নোবেল কমিটি বলছে ‘জিনগত তথ্য থেকে বিলুপ্ত নিয়ান্ডারথালদের সঙ্গে আমাদের সম্পর্কের বিষয়ে সূত্র পাওয়া যেতে পারে। ১৯৯০ এর দশকের শেষের দিকে প্রায় সমগ্র মানবজাতির জিন মানচিত্র তৈরি করা গেছে। এটি ছিল এক উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি, যার মাধ্যমে বিভিন্ন মানব জনগোষ্ঠীর মধ্যে জিনগত সম্পর্ক নিয়ে পরবর্তী গবেষণার পথ খুলে যায়।
‘বর্তমান সময়ের মানুষ এবং বিলুপ্ত নিয়ান্ডারথালদের মধ্যে সম্পর্ক বিশ্লেষণের জন্য প্রত্নতাত্ত্বিক নমুনা থেকে উদ্ধার হওয়া জিনগত ডিএনএর পর্যায়ক্রমিক সজ্জা তৈরির প্রয়োজন ছিল।’
আপাতদৃষ্টিতে অসম্ভব এক কাজ
দৃশ্যত সেই অসম্ভব কাজটিই করেছেন সুইডেনের বিজ্ঞানী এসভান্তে পেবো। কর্মজীবনের গোড়ার দিকে তিনি নিয়ান্ডারথালদের ডিএনএ বিশ্লেষণে আধুনিক জেনেটিক পদ্ধতি ব্যবহারের সম্ভাবনা দেখে মুগ্ধ হয়েছিলেন। তবে শিগগিরই চরম প্রযুক্তিগত চ্যালেঞ্জের মুখে পড়েন। কারণ সময়ের সঙ্গে সঙ্গে ডিএনএ রাসায়নিকভাবে পরিবর্তীত হয় এবং টুকরো টুকরো হয়ে যায়।
হাজার হাজার বছর পরে ডিএনএ-র সামান্য পরিমাণ অবশেষ থাকে এবং এই অবশেষ ব্যাকটেরিয়া এবং আধুনিক মানুষের ডিএনএ দ্বারা ব্যাপকভাবে পরিবর্তিত হয়।
হাজারো বছরের ব্যবধানে ক্ষয়প্রাপ্ত হয় ডিএনএ
পোস্টডক্টরাল ছাত্র হিসেবে এসভান্তে পেবো এ পর্যায়ে বিবর্তনীয় জীববিজ্ঞানের ক্ষেত্রে অগ্রগামী গবেষক অ্যালান উইলসনের সঙ্গে যোগ দেন। তারা কয়েক দশকের চেষ্টায় নিয়ান্ডারথাল থেকে পাওয়া ডিএনএ অধ্যয়নের পদ্ধতি আবিষ্কার করেন।
পেবো ১৯৯০ সালে মিউনিখ বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যাপক হিসেবে যোগ দেয়ার পরেও প্রাচীন ডিএনএ বিশ্লেষণের গবেষণা অব্যাহত রাখেন। তিনি নিয়ান্ডারথালের মাইটোকন্ড্রিয়া থেকে ডিএনএ বিশ্লেষণের সিদ্ধান্ত নেন। কোষের পাওয়ার হাউজ হিসেবে পরিচিত মাইটোকন্ড্রিয়া নিজস্ব ডিএনএ ধারণ করে।
মাইটোকন্ড্রিয়াল জিন আকারে ছোট এবং এটি কোষের জিনগত তথ্যের ভগ্নাংশ ধারণ করে। তবে এই ডিএনএর হাজার হাজার কপি থাকে বলে এগুলোর বিশ্লেষণ তথ্য পাওয়ার সম্ভাবনা বাড়িয়ে দেয়।
এসভান্তে পেবো তার পরিমার্জিত পদ্ধতির সাহায্যে ৪০ হাজার বছরের পুরানো একটি হাড় থেকে মাইটোকন্ড্রিয়াল ডিএনএ বিশ্লেষণ করেন। এভাবে প্রথম হোমো সেপিয়েন্সের একটি বিলুপ্ত নিকটাত্মীয়ের জিন মানচিত্র তৈরি করা সম্ভব হয়। এরপর সেটির সঙ্গে বর্তমান মানুষ ও শিম্পাঞ্জির জিন মানচিত্র তুলনা করে প্রমাণিত হয় নিয়ান্ডারথালরা ছিল জিনগতভাবে আলাদা।
নিয়ান্ডারথালের জিন মানচিত্র তৈরি
নিয়ান্ডারথালের মাইটোকন্ড্রিয়ালের জিন থেকে সীমিত তথ্য পাওয়ার কারণে এসভান্তে পেবো আরও সামনে এগোনোর চ্যালেঞ্জ নেন। তিনি নিয়ান্ডারথালের পারমাণবিক জিনোম সিকোয়েন্সিংয়ের কঠিন পথে এগোতে থাকেন।
এ সময়ে তিনি জার্মানির লিপজিগে ম্যাক্স প্ল্যাঙ্ক ইনস্টিটিউট প্রতিষ্ঠার সুযোগ পান। নতুন এই ইনস্টিটিউটে পেবো ও তার দল প্রাচীন হাড়ের অবশেষ থেকে ডিএনএ বিচ্ছিন্ন করে সেগুলো বিশ্লেষণের পদ্ধতিকে ক্রমাগত উন্নত করেন।
গবেষণায় শেষ পর্যন্ত চূড়ান্ত সাফল্য আসে। পেবো আপাতদৃষ্টিতে অসম্ভব কাজটি সম্ভব করে তোলেন এবং ২০১০ সালে প্রথম নিয়ান্ডারথালের পূর্ণাঙ্গ জিন মানচিত্র তৈরিতে সক্ষম হন। তুলনামূলক বিশ্লেষণে দেখা গেছে, নিয়ান্ডারথাল এবং হোমো সেপিয়েন্সের সবশেষ সাধারণ পূর্বপুরুষ প্রায় ৮ লাখ বছর আগে এই পৃথিবীতে বসবাস করত।
পেবো ও তার সহকর্মীরা এখন বিশ্বের নানা প্রান্তে নিয়ান্ডারথাল এবং আধুনিক মানুষের মধ্যে সম্পর্ক অনুসন্ধানে সক্ষম। তুলনামূলক বিশ্লেষণে দেখা গেছে, আফ্রিকা থেকে উদ্ভূত বর্তমান মানুষের তুলনায় ইউরোপ বা এশিয়া থেকে উদ্ভূত মানুষের ডিএনএ বিন্যাসের সঙ্গে নিয়ান্ডারথালদের ডিএনএ বিন্যাসের বেশি মিল রয়েছে। এর অর্থ, নিয়ান্ডারথাল এবং হোমো সেপিয়েন্স তাদের হাজার বছরের সহাবস্থানের সময়ে আন্তঃপ্রজনন করেছে।
ইউরোপ বা এশীয় বংশোদ্ভূত মানুষের জিনের প্রায় ১-৪ শতাংশ এসেছে নিয়ান্ডারথাল থেকে।
চাঞ্চল্য জাগানো আবিষ্কার ‘ডেনিসোভা’
সাইবেরিয়ার দক্ষিণাঞ্চলে ডেনিসোভা গুহায় ২০০৮ সালে ৪০ হাজার বছরের পুরোনো একটি আঙুলের হাড়ের খণ্ডাংশ আবিষ্কৃত হয়। এই হাড়ের ডিএনএ ছিল প্রায় অপরিবর্তীত।
এসভান্তে পাবোর দল এটির জিন মানচিত্র তৈরির পর চমকে যায়। নিয়ান্ডারথাল এবং আধুনিক মানুষের সমস্ত ডিএনএ বিন্যাসের তুলনায় ওই পূর্বপুরুষের ডিএনএ বিন্যাস ছিল আলাদা।
এর মাধ্যমে পেবো একটি অজানা হোমিনিন (আদি নিকটাত্মীয়) আবিষ্কার করেন, যাদের নাম দেয়া হয় ডেনিসোভা। বিশ্বের বিভিন্ন অংশের মানুষের ডিএনএর সঙ্গে তুলনা করে দেখা গেছে, ডেনিসোভা এবং হোমো সেপিয়েন্সের মধ্যেও জিন আদান-প্রদান হয়েছে।
হোমো সেপিয়েন্সের সঙ্গে নিয়ান্ডারথাল ও ডেনিসোভার জিন আদান-প্রদান হয়েছে
এই আন্তঃসম্পর্কটি প্রথমে মেলানেশিয়া (দক্ষিণ-পশ্চিম প্রশান্ত মহাসাগরের ওশেনিয়ার একটি উপ-অঞ্চল। এই অঞ্চলে চারটি স্বাধীন দেশ হলো ফিজি, ভানুয়াতু, সলোমন দ্বীপপুঞ্জ এবং পাপুয়া নিউ গিনি) অঞ্চলে দেখা যায়। এছাড়া, দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার অন্যান্য অংশের জনগোষ্ঠীর মধ্যেও ডেনিসোভার জিনের সঞ্চার লক্ষ্য করা গেছে। এসব অঞ্চলের মানুষ সর্বোচ্চ ৬ শতাংশ পর্যন্ত ডেনিসোভা ডিএনএ ধারণ করছেন।
পেবোর আবিষ্কারগুলো আধুনিক মানুষের বিবর্তনীয় ইতিহাস সম্পর্কে নতুন তথ্য উন্মোচন করেছে। প্রমাণ হয়েছে হোমো সেপিয়েন্স আফ্রিকা থেকে অভিবাসিত হওয়ার সময় ইউরেশিয়ায় অন্তত দুটি বিলুপ্ত হোমিনিন জনগোষ্ঠীর বসবাস ছিল।
নিয়ান্ডারথালরা পশ্চিম ইউরেশিয়ায় বাস করত, আর ডেনিসোভাদের আবাস ছিল মহাদেশের পূর্ব অংশে। আফ্রিকার বাইরে হোমো সেপিয়েন্সদের সম্প্রসারণের সময় তারা শুধু নিয়ান্ডারথালদের সঙ্গেই নয়, ডেনিসোভাদেরও মুখোমুখি হয়েছিল।
প্যালিওজেনোমিক্স কেন যুগান্তকারী
এসভান্তে পাবো তার যুগান্তকারী গবেষণার মাধ্যমে প্যালিওজেনোমিক্স নামে বিজ্ঞানের সম্পূর্ণ নতুন একটি শাখা প্রতিষ্ঠা করেন। প্রাথমিক আবিষ্কারের পর তার দল বিলুপ্ত হোমিনিন থেকে আরও বেশ কিছু জিন মানচিত্র তৈরি ও বিশ্লেষণ করেছে।
তার উদ্ভাবিত পদ্ধতিগুলোর মাধ্যমে জানা গেছে, প্রাচীন হোমিনিনগুলো আফ্রিকার হোমো সেপিয়েন্সের সঙ্গে আন্তঃপ্রজনন ঘটিয়েছে।
এখন পরিষ্কারভাবে বলা যায়, বিলুপ্ত নিকটাত্মীয়দের কাছ থেকে পাওয়া প্রাচীন জিন বর্তমানের আধুনিক মানুষের শরীরের ওপরে প্রভাব রাখছে। যেমন ইপিএএসওয়ান জিনটি এসেছে ডেনিসোভাদের কাছ থেকে। এটি অতিরিক্ত উচ্চতায় মানুষকে টিকে থাকতে সাহায্য করে, তিব্বতের জনগোষ্ঠীর মধ্যে এই জিনের অস্তিত্ব রয়েছে। এছাড়া, নিয়ান্ডারথালের জিন বিভিন্ন ধরনের সংক্রমণ ঠেকাতে মানুষের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতাকে প্রভাবিত করে।
মানুষ কেন অনন্য
নিয়ান্ডারথাল বা ডেনিসোভারা বিলুপ্ত হয়ে গেলেও বিশ্বব্যাপী এখন দাপটের সঙ্গে টিকে রয়েছে হোমো সেপিয়েন্স।
নিয়ান্ডারথাল বা ডেনিসোভারা বিলুপ্ত হলেও বিশ্ব দাপিয়ে বেড়াচ্ছে হোমো সেপিয়েন্স
হোমো সেপিয়েন্স বা আধুনিক মানুষ জটিল সংস্কৃতির পাশাপাশি একের পর এক উন্নত উদ্ভাবন ঘটিয়ে নিজেদের অনন্য করে তুলেছে। সেই সঙ্গে সব বাধা অতিক্রম করে পৃথিবীব্যাপী ছড়িয়ে পড়ার বিস্ময়কর ক্ষমতা রয়েছে মানুষের।
নিয়ান্ডারথালরাও দলবদ্ধভাবে বাস করত এবং তাদের মস্তিষ্কের আকার ছিল বড়। তারাও জীবনযাপনের ক্ষেত্রে বিভিন্ন সরঞ্জামের সাহায্য নিয়েছে, তবে কয়েক হাজার বছর ধরে সেগুলো উন্নত করার গতি ছিল তুলনামূলক অনেক কম। ফলে হোমো সেপিয়েন্সের লাখখানেক বছর আগে উদ্ভব হলেও শেষ পর্যন্ত বিলুপ্তির পথে হাঁটতে হয়েছে নিয়ান্ডারথালদের।