ইন্দোনেশিয়ার বোর্নিও দ্বীপের ঘন জঙ্গল। সেখানকার পাহাড়ি গুহা লিয়াং তেবোতে ২০২০ সালে প্রত্নতাত্ত্বিক খননের সময় চমকে যান বিশেষজ্ঞরা। এক কিশোরের দেহাবশেষই তাদের এই বিস্ময়ের কারণ।
আজ থেকে ৩১ হাজার বছর আগে মারা যায় ওই কিশোর। তার দেহাবশেষে রয়েছে শল্যচিকিৎসার সুস্পষ্ট প্রমাণ। ছেলেটির বাম পা কেটে ফেলা হয়েছিল নিপুণ অস্ত্রোপচারের মাধ্যমে। আর সেই চিকিৎসার পর ছয় থেকে নয় বছর পর্যন্ত বেঁচে ছিল সে।
এই দেহাবশেষ আবিষ্কার বদলে দিচ্ছে শল্যচিকিৎসার প্রচলিত ইতিহাস। প্রত্নতাত্ত্বিকেরা বোর্নিয়ান ওই প্রত্নকিশোরের নাম দিয়েছেন বিটিওয়ান। তার অস্থি বিশ্লেষণ করে নিশ্চিত হওয়া গেছে, জীবনের শুরুর দিকে বড়সড় এক নিখুঁত অস্ত্রোপচারের মধ্যে দিয়ে যেতে হয়েছিল তাকে।
ওই অস্ত্রোপচারে বাম পা হারালেও জীবন রক্ষা পায় বিটিওয়ানের। লিয়াং তেবোতে ওই কিশোরের দেহাবশেষ খুঁজে পান অস্ট্রেলিয়ার গ্রিফিথ ইউনিভার্সিটির রিসার্চ ফেলো টিম ম্যালোনির নেতৃত্বে প্রত্নতাত্ত্বিকরা।
এর আগে সবচেয়ে প্রাচীন অস্ত্রোপচারের নিদর্শন পাওয়া গিয়েছিল এক ফরাসি কৃষকের দেহে, যিনি এখন থেকে সাত হাজার বছর আগে বেঁচে ছিলেন। তার কবজির নিচ থেকে একটি হাত কেটে ফেলা হয়েছিল।
ওই কৃষকের দেহাবশেষ আবিষ্কারের পর গবেষকেরা এতদিন ধারণা করতেন, জটিল অস্ত্রোপচারের কৌশল মানুষের আয়ত্বে এসেছে সর্বোচ্চ ১০ হাজার বছর আগে থেকে। তবে টিবিওয়ান প্রমাণ করছে এর অন্তত তিন গুণ বেশি সময় আগেই শল্যবিদ্যা জানা ছিল মানুষের।
ইন্দোনেশিয়ার বোর্নিও দ্বীপের লিয়াং তেবো গুহায় প্রত্নকিশোরের দেহাবশেষ খোঁজ পাওয়া গেছে
বিজ্ঞানসাময়িকী নেচারে গত বুধবার প্রকাশিত হয়েছে গবেষণা নিবন্ধটি। ম্যালোনি এবং তার সঙ্গীরা লিখেছেন, ‘একটি সফল অঙ্গ ব্যবচ্ছেদের এই বিস্ময়কর প্রাথমিক প্রমাণ থেকে বোঝা যায়, গ্রীষ্মমণ্ডলীয় এশিয়া অঞ্চলে অন্তত কিছু দক্ষ মানুষ চাষাবাদ যুগের বহু আগে অত্যাধুনিক চিকিৎসা জ্ঞান এবং দক্ষতা অর্জন করেছিল।
‘আমাদের অনুমান, টিবিওয়ান যে সম্প্রদায়ভুক্ত ছিল তারা দীর্ঘ সময় ধরে বিভিন্ন ভুলত্রুটি ও পরীক্ষা-নিরীক্ষার মধ্যে দিয়ে শারীরবিদ্যা ও অস্ত্রোপচারের কৌশলগুলো রপ্ত করতে সক্ষম হয়। এই জ্ঞান মৌখিকভাবে তাদের আন্তঃপ্রজন্মে ছড়িয়ে গিয়েছিল।’
নিবন্ধে বলা হয়েছে, ‘আমাদের ধারণা যে বা যেসব শল্যবিদ টিবিওয়ানের পায়ে অস্ত্রোপচার করেন তিনি বা তাদের অবশ্যই মানব অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ, পেশী এবং ধমনী সম্পর্কে বিশদ জ্ঞান ছিল। মারাত্মক রক্তক্ষরণ ও সংক্রমণ প্রতিরোধের উপায়ও তিনি বা তারা জানতেন।
বোর্নিও দ্বীপের সেই প্রত্নকিশোরের দেহাবশেষ
‘তিনি বা তারা টিবিওয়ানকে বাঁচানোর প্রয়োজনেই পা কেটে ফেলার দিকে গিয়েছিলেন। বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে, অস্ত্রোপচারের সময়, শিরা, ধমনী ও টিস্যুর প্রতি বিশেষ যত্ন নেয়া হয়েছে। সেগুলো এমনভাবে সারিয়ে তোলা হয় যাতে করে টিবিওয়ানের প্রাণই কেবল রক্ষা পায়নি, এক পা হারিয়েও বাকি জীবন সে বেশ সক্রিয় ছিল।‘
বিশেষ কোনো ক্ষতজনিত সংক্রমণের কারণে বিওয়ানের বাম পা কেটে ফেলতে হয় বলে ধারণা গবেষকদের। তার দেহাবশেষটি গুহার একটি সমাধি খনন করে পাওয়া যায়। এর মাধ্যমে প্রাচীন এই সভ্যতায় অন্ত্যেষ্টিক্রিয়ার প্রচলন থাকার বিষয়েও নিশ্চিত হয়েছেন প্রত্নতাত্ত্বিকেরা।