পৃথিবী সূর্যের চারদিকে ঘোরে এমন বৈজ্ঞানিক পর্যবেক্ষণকে ‘ভুল’ দাবি করে কয়েক মাস ধরে ব্যাপক আলোচিত চুয়াডাঙ্গার আমানত উল্লাহ। প্রাতিষ্ঠানিক কোনো ধরনের লেখাপড়ার সুযোগ না পাওয়া ৭০ বছর বয়সী আমানতের পাল্টা পর্যবেক্ষণ, সূর্যই ঘুরছে পৃথিবীর চারপাশে।
তার এই দাবি নিয়ে প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে বিভিন্ন সংবাদমাধ্যম, সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমেও চলছে আলোচনা। নানা ধরনের বিদ্রুপ ও রসিকতার মুখে পড়েছেন আমানত উল্লাহ।
তবে এই বৃদ্ধের দাবি, ২৮ বছর টানা পর্যবেক্ষণ করে পৃথিবীকেন্দ্রিক বিশ্বতত্ত্বের অনেক রহস্য অকাট্য প্রমাণসহ তিনি উন্মোচন করেছেন। তার মতে, পৃথিবী নিজ অক্ষে ঘুরছে, আর মানুষের বসতি এই পৃথিবীকে কেন্দ্র করে ঘুরছে সূর্য।
আমানত উল্লাহর পর্যবেক্ষণ বিস্তারিত জানার পাশাপাশি মহাকাশ বিজ্ঞানের আলোকে সেগুলোর সীমাবদ্ধতা বিশ্লেষণ করেছে নিউজবাংলা। সৌরজগৎ সম্পর্কিত বিজ্ঞানের ধারণা রাখা কয়েকজন বিশেষজ্ঞ খণ্ডন করেছেন আমানত উল্লাহর দাবি।
পৃথিবী থেকে সূর্যের দূরত্ব প্রায় ১৬ কোটি কিলোমিটার
আমানতের দাবি অনুসন্ধানের সময় মহাকাশবিদ্যার প্রতি তার তুমল আগ্রহ এবং নিবিড় পর্যবেক্ষণ প্রচেষ্টার প্রমাণ পাওয়া গেছে। দেখা গেছে, ব্যাপক বিদ্রুপের শিকার হলেও তিনি সৌরজগতের রহস্য ভেদ করার চেষ্টায় অনড় থেকেছেন। নিজের সীমিত সম্পদের পুরোটাই বিক্রি করে খরচ করেছেন গবেষণার কাজে। এ কাজে তাকে সাহায্য করা তিনজনও অত্যন্ত দরিদ্র।
চুয়াডাঙ্গার আলমডাঙ্গা উপজেলার পাইকপাড়া গ্রামের মৃত কিয়ামদ্দিন মালিতার ছেলে আমানত উল্লাহ। দুই ভাই-বোনের মধ্যে তিনি ছোট। দাম্পত্য জীবনে কোনো সন্তান হয়নি। আড়াই বছর আগে মারা গেছেন স্ত্রী রহিতন নেছা।
মহাকাশের রহস্য ভেদের নেশায় মেতে থাকা আমানত জীবনে কোনো দিন স্কুলে যাননি। আলমডাঙ্গা উপজেলার পাইকপাড়া গ্রামে একটি জরাজীর্ণ ঘরে বসে ২৮ বছর ‘গবেষণা’ করে পৃথিবীকেন্দ্রিক ‘বিশ্বতত্ত্বের মডেল’ আবিষ্কারের দাবি তার।
আলমডাঙ্গার ঘোলদাড়ী বাজারের একটি দোকানে তার বানানো সেই মডেল দেখতে দূর-দূরান্ত থেকে ছুটে আসছেন শিক্ষক, শিক্ষার্থী, এমনকি সাধারণ মানুষও। কেউ কেউ দিচ্ছেন উৎসাহ, আবার অনেকে করছেন উপহাস।
দীর্ঘ পর্যবেক্ষণের পর আমানতের তৈরি করা পৃথিবীকেন্দ্রিক বিশ্বতত্ত্বের মডেলটি শুরুতে ছিল অনেক বড়। পুরো ঘরে ছিল এর বিস্তৃতি। পরে তিনি সেই মডেলটি ছোট আকারে তৈরি করেন, যা এখন সহজেই বহনযোগ্য।
আমানত উল্লাহর পৃথিবীকেন্দ্রিক বিশ্বতত্ত্বের মডেল
আমানতের এই কর্মযজ্ঞে সহযোগিতা করছেন উপজেলার জাহাপুর গ্রামের ওয়েল্ডিং মিস্ত্রি বাদল কুমার কর্মকার, জোড়গাছা গ্রামের রেডিও মিস্ত্রি মতিয়ার রহমান ও ঘোলদাড়ি বাজারের বাইসাইকেল মিস্ত্রি মোহাম্মদ আব্দুল্লাহ।
তাদের মধ্যে আবদুল্লাহ গত বছর কোরবানির সময় ঢাকায় গরু বিক্রি করতে গিয়ে স্ট্রোকে মারা যান। আব্দুল্লাহর সাইকেলের দোকানেই এখন গবেষণার সরঞ্জাম রেখেছেন আমানত।
কী দাবি করছেন আমানত
দীর্ঘ গবেষণা শেষে নিজ অক্ষে ঘূর্ণায়মান পৃথিবীর চারপাশে সূর্য ঘুরছে- এমন সিদ্ধান্তে পৌঁছেছেন আমানত। এ ছাড়া জ্যোতির্বিজ্ঞানবিষয়ক যেকোনো প্রশ্নের জবাব দিচ্ছেন এই বৃদ্ধ। আমানতের দাবি, জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ডের ২০১৩ সালে প্রণীত মাধ্যমিক পর্যায়ের নবম-দশম শ্রেণির ‘ভূগোল ও পরিবেশ’ বিষয়ের পাঠ্যবইয়ে পৃথিবীর বার্ষিক গতির পাঁচটি প্রমাণে সীমাবদ্ধতা রয়েছে। এ ক্ষেত্রে নিজের কিছু যুক্তিও তুলে ধরেছেন তিনি।
ওই পাঠ্যবইয়ে পৃথিবীর বার্ষিক গতির প্রথম প্রমাণে বলা হয়েছে, বিভিন্ন সময়ে রাতের আকাশে পূর্ব থেকে পশ্চিমে নক্ষত্রগুলোর অবস্থান পরিবর্তন করতে দেখা যায়। মেঘমুক্ত আকাশে কয়েক দিন পর পর লক্ষ করলে নক্ষত্রের পূর্ব থেকে পশ্চিম আকাশে সরে যাওয়া বোঝা যায়। এরপর একদিন এরা অদৃশ্য হয়ে যায়। ঠিক এক বছর পর এরা আদি স্থানে ফিরে আসে। এ থেকে পৃথিবীর যে বার্ষিক গতি আছে তা বোঝা যায়।
আমানতের দাবি সৌরজগতের বিভিন্ন গ্রহের সঙ্গে পৃথিবীর বৈশিষ্ট্যের তফাত রয়েছে
তবে আমানত উল্লাহর দাবি, পূর্ব থেকে পশ্চিমে সাধারণ নক্ষত্রের অবস্থান পরিবর্তনের বিষয়টি পৃথিবীর বার্ষিক গতির কারণে নয়, সূর্যের বার্ষিক গতির কারণে ঘটছে।
বইটিতে পৃথিবীর বার্ষিক গতির দ্বিতীয় প্রমাণে বলা হয়েছে, বছরের বিভিন্ন সময়ে সূর্যকে বিভিন্ন অবস্থানে দেখা যায়। সূর্য প্রতিদিন পূর্ব আকাশে একই জায়গা থেকে ওঠে না এবং পশ্চিম আকাশে একই জায়গায় অস্ত যায় না। বছরের ছয় মাস সূর্য একটু একটু করে দক্ষিণ দিকে সরে গিয়ে পূর্ব আকাশে উদিত হয়। বাকি ছয় মাস সূর্য একটু একটু করে উত্তর দিকে সরে গিয়ে পূর্ব আকাশে উদিত হয়। পৃথিবী একই জায়গায় স্থির থেকে ঘুরলে প্রতিদিনই সূর্য একই জায়গায় উদিত হতো। পৃথিবীর বার্ষিক গতির কারণেই সূর্যের অবস্থান বদলে যেতে দেখা যায়।
আমানত উল্লাহর মতে, এমনটি পৃথিবীর বার্ষিক গতির কারণে নয়, বরং সূর্য একটু একটু করে সরছে বলেই ঘটছে। এ ঘটনাকে সূর্যের দক্ষিণায়ন ও উত্তরায়ণ বলা হয়। সূর্যের দক্ষিণায়ন ও উত্তরায়ণের কারণে পৃথিবীতে ঋতু পরিবর্তন হয়।
পৃথিবীর বার্ষিক গতির তৃতীয় প্রমাণে বলা হয়েছে, দুরবিনের সাহায্যে পৃথিবী থেকে দেখা গেছে সব গ্রহ সূর্যকে পরিক্রম করছে। পৃথিবীও একটি গ্রহ। সুতরাং এরও পরিক্রম গতি বা বার্ষিক গতি রয়েছে।
এ বিষয়ে আমানত উল্লাহর দাবি, ওই বর্ণনা পৃথিবীর পরিক্রমণ গতি প্রমাণ করে না। বর্ণনায় পরিক্রমণশীল গ্রহদের সঙ্গে পৃথিবীকে এক করে ফেলা হয়েছে। ব্যাপারটা এমন যে, সব গ্রহ যেহেতু সূর্যকে পরিক্রম করছে, আর পৃথিবীও একটি গ্রহ, তাই এরও পরিক্রমণ গতি রয়েছে বলে ধরে নেয়া হয়েছে।
বিষয়টিকে বোঝাতে একটি উদাহরণও দিয়েছেন আমানত। যেমন- কোনো হত্যা মামলায় প্রমাণিত ৫ আসামির ফাঁসি হচ্ছে। এ অবস্থায় একজন গ্রাম্য মোড়ল বিচারকের কাছে অভিযোগ করলেন, ‘হুজুর আসামিরা ৬ ভাই। ওদের আরও এক পালিত ভাই আছে। তাই এই হত্যায় সেও জড়িত। তাকেও সাজা দিন।’
পৃথিবীকেন্দ্রিক বিশ্বতত্ত্বের মডেল দিয়েছেন আমানত উল্লাহ
আমানতের মতে, সূর্যের চারদিকে পৃথিবী ঘোরার দাবি ওই গ্রাম্য মোড়লের অভিযোগের মতোই। ‘পৃথিবী গ্রহ নয়’ দাবি করে আমানত বলছেন, এর প্রমাণ মিলবে পৃথিবী ও গ্রহদের নামকরণের ইতিহাস থেকে।
এই আকাশ পর্যবেক্ষক মনে করছেন, মঙ্গল থেকে নেপচুন পর্যন্ত গ্রহগুলো শুধু সূর্যকে পরিক্রমণ করছে না, তারা পৃথিবীসহ সূর্যকে পরিক্রমণ করছে। তাদের কক্ষপথের মধ্যে রয়েছে সূর্য, এমনকি পৃথিবীও।
আমানত আরও দাবি করেন, পৃথিবী বাদ দিয়ে শুধু সূর্যকে পরিক্রমণ করছে বুধ ও শুক্র। গ্রহদের মতো বুধ ও শুক্রের কোনো চাঁদ নেই এবং গ্রহদের সঙ্গে অক্ষ আবর্তনকালেরও মিল নেই। তাই বুধ ও শুক্র গ্রহ নয়, এরা স্বতন্ত্র চাঁদ যা সূর্যের চারদিকে ঘুরছে।
এভাবে মাধ্যমিকের ‘ভূগোল ও পরিবেশ’ বিষয়ের পাঠ্যবইয়ে পৃথিবীর বার্ষিক গতির ৪ ও ৫ নং প্রমাণেরও সীমাবদ্ধতা চিহ্নিত করার দাবি করছেন আমানত উল্লাহ।
‘পৃথিবীকেন্দ্রিক বিশ্বতত্ত্ব’ শিরোনামে গত বছর ১১২ পৃষ্ঠার একটি বইও লিখেছেন তিনি। ওই বইয়ের ১০১ পৃষ্ঠায় ‘সূর্য পৃথিবীর চারদিকে ঘোরে’ দাবি করে ছয়টি যুক্তি দিয়েছেন আমানত। এই দাবির পক্ষে পরে আরও পাঁচটি প্রমাণ বের করার দাবি করছেন এই আকাশ পর্যবেক্ষক। তিনি বলছেন, বইটির দ্বিতীয় সংস্করণে এই ১১টি যুক্তির সবই তুলে ধরা হবে।
বিজ্ঞানের সঙ্গে আমানতের যুক্তির বিরোধ কোথায়
‘পৃথিবীর চারপাশে সূর্য ঘোরার’ দাবি প্রতিষ্ঠায় আমানত উল্লাহ যে ১১টি যুক্তি দিচ্ছেন সেগুলো নিয়ে বিশেষজ্ঞদের সঙ্গে কথা বলেছে নিউজবাংলা। তারা বলছেন, আমানত সাধারণ কিছু ধারণা থেকে এসব যুক্তি সত্যি বলে ধারণা করছেন। এগুলোর কোনো বৈজ্ঞানিক ভিত্তি নেই।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, আমানতের দাবি অতি সাধারণ মানের
আমানত উল্লাহর পর্যবেক্ষণ ও যুক্তির বিষয়ে জানতে চাইলে ইনডিপেনডেন্ট ইউনিভার্সিটির সহকারী অধ্যাপক ও জ্যোতির্বিজ্ঞান গবেষক খান আসাদ নিউজবাংলাকে বলেন, ‘পৃথিবী যে সূর্যের চারদিকে ঘোরে, এটা এখন আর কোনো তাত্ত্বিক গাণিতিক মডেল নয়, এটা পর্যবেক্ষণ করা সত্য। এ পর্যবেক্ষণ এখন শুধু পৃথিবী থেকে নয়, পৃথিবীর বাইরে কক্ষপথে স্থাপন করা স্যাটেলাইট ও মহাশূন্যে পাঠানো প্রোব থেকেও করা হয়ে থাকে। ফলে এ নিয়ে সংশয় তৈরি হওয়ার কোনো কারণ নেই।’
আমানত উল্লাহ দীর্ঘদিন ধরে নিজস্ব পদ্ধতিতে পর্যবেক্ষণ করেছেন বলে জানানো হলে খান আসাদ বলেন, ‘জ্যোতির্বিজ্ঞানের পর্যবেক্ষণ কেউ এখন আর এককভাবে বা ব্যক্তিগতভাবে করেন না, এটা করা সম্ভব নয়। বিশ্বজুড়ে বহু মানুষ জ্যোতির্বিজ্ঞানের পর্যবেক্ষণ পরিচালনা করেন। তাদের সম্মিলিত পর্যবেক্ষণ একত্র বা সংশ্লেষ করেই সার্বিকভাবে জ্যোতির্বিজ্ঞানের পর্যবেক্ষণ দাঁড় করানো হয়।
‘যে তত্ত্ব বা মডেল সব পর্যবেক্ষণকেই ব্যাখ্যা করতে পারে, সেটিকেই গ্রহণ করা হয়। সূর্যকেন্দ্রিক সৌরজগতের মডেল খারিজ করে দেয়ার মতো কোনো নতুন পর্যবেক্ষণ এখনও কোথাও দেখা যায়নি।’
খান আসাদ সৌরকেন্দ্রিক মডেলের পক্ষে অকাট্য যুক্তি তুলে ধরে বলেন, ‘নিউটনের মহাকর্ষ সূত্র অনুযায়ী যদি চিন্তা করা যায়, তাহলে এমনকি কোনো পর্যবেক্ষণ ছাড়াই চোখ বন্ধ করে বলে দেয়া যায়, সৌরজগতের সব গ্রহ সূর্যের চারদিকে ঘুরবে, ঘুরতে বাধ্য। কেননা মহাকর্ষ সূত্র অনুযায়ী, যে বস্তুটির ভর সবচেয়ে বেশি, সবাই সেই বস্তুটিকে ঘিরে ঘুরবে। সৌরজগতের মোট ভরের ৯৯ শতাংশই সূর্যের ভর। ফলে সৌরজগতের সব গ্রহ, এমনকি উল্কা ও গ্রহাণুগুলো সূর্যের চারদিকে ঘুরবে।
‘আরও সঠিকভাবে বললে বলা উচিত ঘুরবে পুরো সৌরজগতের ভরকেন্দ্রকে ঘিরে, যে ভরকেন্দ্রটি সূর্যের কেন্দ্রের খুব কাছাকাছি অবস্থিত এবং সৌরজগতের ওই ভরকেন্দ্রকে ঘিরে এমনকি সূর্য নিজেও ঘুরছে।’
প্রয়াত বন্ধুর সাইকেলের দোকানকে গবেষণাগারে পরিণত করেছেন আমানত
জ্যোতির্বিজ্ঞানের এই গবেষক বলেন, ‘সারা বিশ্বেই জ্যোতির্বিজ্ঞানের অ্যামেচার পর্যবেক্ষকরা চমক তৈরি করার জন্য নতুন তত্ত্ব হাজির করেন। তারা আসলে ভুল বা সীমিত পর্যবেক্ষণ দিয়ে ভুল সিদ্ধান্তে উপনীত হন। অনেকে সমতল পৃথিবী (ফ্ল্যাট আর্থ) তত্ত্বেও বিশ্বাস করেন। এগুলো শুনতে চিত্তাকর্ষক, কিন্তু ধোপে টেকে না।’
আমানতের যুক্তির দুর্বলতা
আমানত উল্লাহর দাবি নিয়ে পশ্চিমবঙ্গের জ্যোতির্বিদ ও বিজ্ঞান লেখক বিমান নাথ এবং বিজ্ঞান লেখক দীপেন ভট্টাচার্যের মন্তব্যও পেয়েছে নিউজবাংলা। আমানতের ১১টি যুক্তি ও সেগুলোর প্রেক্ষাপটে দুই জ্যোতির্বিজ্ঞান গবেষকের বক্তব্য নিচে তুলে ধরা হলো:
আমানতের যুক্তি ১: সূর্যের বার্ষিক গতির কারণে পৃথিবীর দুই মেরু প্রাকৃতিক নির্দিষ্ট দিকে সব সময় নির্দিষ্ট থাকে। এর ফলে ধ্রুব নক্ষত্র উত্তর মেরু বরাবর একই অবস্থানে স্থির থাকতে দেখা যায়। যদি পৃথিবীর বার্ষিক গতি থাকত, তাহলে কক্ষপথে পৃথিবী গতির নিয়ম অনুযায়ী ঘুরত। তাতে দুই মেরু প্রাকৃতিক নির্দিষ্ট দিকে নির্দিষ্ট থাকত না, চতুর্দিকে ঘুরত। যার ফলে, ধ্রুব নক্ষত্রকে ওই অবস্থায় সারা বছর একই অবস্থানে স্থির থাকতে দেখা যেত না।
বিমান নাথের জবাব: এটা ঠিক নয়। পৃথিবীর (সেই অর্থে যেকোনো ঘূর্ণমান বস্তুর) অক্ষরেখা বদলায় না— যদি না অক্ষরেখার দিক বদল করার জন্য সেটাকে ধাক্কা দেয়া হয়। দুই মেরুর ‘চতুর্দিকে’ঘোরার তো কোনো প্রশ্নই ওঠে না। এটা গতিবিদ্যার নিয়ম (কনজারভেশন অফ অ্যাঙ্গুলার মোমেন্টাম) মেনেই হচ্ছে।
দীপেন ভট্টাচার্যের জবাব: ধ্রুবতারা স্থির নয়। পৃথিবীর বার্ষিক গতির কারণে হিপারোকস স্যাটেলাইট ধ্রুবতারার প্যারালাক্স মেপেছে ৭.৫৪ মিলি আর্ক সেকেন্ড (৭.৫৪"), অর্থাৎ ছয় মাস পরের পর্যবেক্ষণে আকাশে ধ্রুবতারা এক কৌণিক সেকেন্ডের সাড়ে সাত সহস্রাংশের মতো সরে, যা কিনা এই তারাটির দূরত্ব দেয় ৪৩৩ আলোকবর্ষের মতো।
আমানতের যুক্তি ২: সূর্যের বার্ষিক গতির কারণেই কয়েক দিন পরপর আকাশে লক্ষ্য করলে সাধারণ নক্ষত্রের পূর্ব থেকে পশ্চিম দিকে অবস্থান পরিবর্তন হওয়া বোঝা যায়। যদি পৃথিবীর বার্ষিক গতি থাকত, তাহলে সাধারণ নক্ষত্রের পূর্ব থেকে পশ্চিম দিকে অবস্থান পরিবর্তন হওয়া বোঝা যেত না।
বিমান নাথের জবাব: নক্ষত্রের পূর্ব থেকে পশ্চিম দিকে যাওয়ার কারণ হলো পৃথিবীর আহ্নিক গতি। বার্ষিক গতি থাকলে যে আহ্নিক গতি থাকতে পারে না, এমন তো কোনো দায়বদ্ধতা নেই। দুই ধরনের ঘূর্ণনই থাকতে পারে।
দীপেন ভট্টাচার্যের জবাব: নক্ষত্রদের পূর্ব পশ্চিম গতির সঙ্গে সূর্যের কী সম্পর্ক? এটা পৃথিবী আহ্নিক গতির সঙ্গে জড়িত, বার্ষিক গতির সঙ্গে নয়। বার্ষিক গতির ভূমিকা হলো নতুন নক্ষত্রদের আকাশে নিয়ে আসা।
আমানতের যুক্তি ৩: সূর্যের বার্ষিক গতির কারণেই পর্যায়ক্রমে সূর্যের খাড়া কিরণ পৃথিবীর কর্কটক্রান্তি থেকে মকরক্রান্তি পর্যন্ত সব জায়গায় পড়ে। এর ফলে ঋতু পরিবর্তন হয়। যদি পৃথিবীর বার্ষিক গতি থাকত তাহলে সূর্যের খাড়া কিরণ পৃথিবীর কর্কটক্রান্তি থেকে মকরক্রান্তি পর্যন্ত সব জায়গায় পড়ত না। যেকোনো এক জায়গায় পড়ত। ফলে পৃথিবীতে ঋতু পরিবর্তন হতো না।
বিমান নাথের জবাব: পৃথিবীর অক্ষরেখা হেলানো- এই তথ্য এবং পৃথিবীর বার্ষিক গতির তথ্য মিলিয়েই ঋতু পরিবর্তন ব্যাখ্যা করা যায়।
দীপেন ভট্টাচার্যের জবাব: পৃথিবীতে ঋতুর পরিবর্তন হয় সৌরমণ্ডলের তলে পৃথিবীর ২৩.৫ ডিগ্রি হেলে থাকার ফলে। এর ফলে সূর্যের তাপ গ্রীষ্মকালে ঘন থাকে আর শীতকালে ছড়িয়ে পড়ে।
আমানতের যুক্তি ৪: সূর্যের বার্ষিক গতির কারণেই ৩৬৫ দিনে বছর হয়, লিপিয়ার ৩৬৬ দিনে। পৃথিবীর বার্ষিক গতি থাকলে ৩৬৬ দিনে বছর হতো, লিপিয়ার ৩৬৭ দিনে।
বিমান নাথের জবাব: বার্ষিক গতি থাকলে ৩৬৬ দিনে হতো সেটা বিজ্ঞানের কোন নিয়ম থেকে এসেছে? বছরের হিসাব নির্ভর করে কক্ষপথের দূরত্বের ওপর। সেটা যেখানে খুশি হতে পারে, তাই বছরের মাপেরও কোনো সীমাবদ্ধতা নেই। আর বছরের মাপ ৩৬৫ দিন নয়, সেখানে আরও ছয় ঘণ্টা, আরও কয়েক মিনিট যোগ করতে হবে।
দীপেন ভট্টাচার্যের জবাব: এর সঙ্গে লিপ ইয়ারের সম্বন্ধ কী? বছর তো ৩৬৫ দিনে হয় না, ৩৬৫.২৫ দিনে হয়- এটা তো তার বলতে হবে।
আমানতের যুক্তি ৫: সূর্যের বার্ষিক গতির কারণেই চাঁদের পর্যায়কাল পূর্ণ আর অমাবস্যা- এই দুটি দুই তারিখে হয়। যদি পৃথিবীর বার্ষিক গতি থাকত তাহলে চাঁদের পর্যায়কাল পূর্ণ আর অমাবস্যা এক তারিখেই হতো।
বিমান নাথের জবাব: এটা ছবি এঁকে বোঝাতে হবে— যা যেকোনো প্রাথমিক বইতেই পাওয়া যায়। বার্ষিক গতি না থাকলেই বরং পর্যায়কাল পূর্ণ আর অমাবস্যা এক তারিখে হতো। এটা একেবারে গোড়ায় গলদ।
দীপেন ভট্টাচার্যের জবাব: এটার অর্থ করা মুশকিল। তিনি কি চাঁদ যে পৃথিবীর চারদিকে ঘোরে সেটাও অস্বীকার করছেন?
আমানতের যুক্তি ৬: সূর্যের বার্ষিক গতির কারণে চান্দ্রমাসের হিসাবে প্রায় ৬ মাস পরপর গ্রহণ মৌসুম আসে। মৌসুমে এক বা একাধিক গ্রহণ হয়। যদি পৃথিবীর বার্ষিক গতি থাকত তাহলে গ্রহণ প্রচলিত নিয়মে হতো না।
বিমান নাথের জবাব: গ্রহণ মৌসুম বলে কিছু হয় না।
আমানতের যুক্তি ৭: সূর্যের বার্ষিক গতির কারণেই মঙ্গল ও পৃথিবী নিকটবর্তী হওয়ার তারিখে মঙ্গলকে সূর্যাস্তের পর হতে রাতের যেকোনো অংশে উদিত হতে দেখা যেতে পারে। যার ফলে পৃথিবীর কাছে আসার তারিখে মঙ্গলকে রাত ১২টায় পূর্ব দিগন্ত থেকে উদিত হতে দেখা গেছে। যদি পৃথিবীর বার্ষিক গতি থাকত তাহলে পৃথিবী মঙ্গলগ্রহের নিকটবর্তী হওয়ার তারিখে প্রতিবার মঙ্গলের পূর্ণিমা হতো। তাতে মঙ্গলকে চিরকাল ওই তারিখে সূর্যাস্তের পরপর সন্ধ্যায় পূর্ব দিগন্তে উদয় হতে দেখা যেত। এ ছাড়া রাতের অন্য কোনো অংশে উদিত হতে দেখা যেত না।
বিমান নাথের জবাব: ‘মঙ্গলের পূর্ণিমা’ বলে কিছু হয় না। মঙ্গল এবং পৃথিবী দুই গ্রহই সূর্যের চারদিকে ঘুরছে। তাই তাদের পারস্পরিক অবস্থানের ওপর নির্ভর করে রাতের যেকোনো অংশে মঙ্গলকে উদিত হতে দেখা যেতে পারে।
আমানতের যুক্তি ৮: সূর্যের বার্ষিক গতির কারণেই ১২ মাস মঙ্গলের অবস্থানে পরিবর্তন হতে দেখা যায়। যদি পৃথিবীর বার্ষিক গতি থাকত, তাহলে মঙ্গলের উত্তরায়ণের সময় পৃথিবীর উত্তরায়ণ হলে পৃথিবীর উত্তরায়ণের সাপেক্ষে মঙ্গলের দক্ষিণ দিকে সরে যাওয়া বোঝা যেত এবং মঙ্গলের দক্ষিণায়নের সময় পৃথিবীর দক্ষিণায়ন হলে পৃথিবীর দক্ষিণায়নের সাপেক্ষে মঙ্গলের উত্তরদিকে সরে যাওয়া বোঝা যেত।
বিমান নাথের জবাব: মঙ্গলের ‘উত্তরায়ণ-দক্ষিণায়ন’ বলে কিছু নেই। আগের উত্তর দেখুন। পৃথিবী ও মঙ্গলের পারস্পরিক অবস্থানের ওপর নির্ভর করছে দিগন্তের কোথায় মঙ্গলের উদয় হবে।
আমানতের যুক্তি ৯: সূর্যের বার্ষিক গতির কারণেই বৃহস্পতির উত্তরায়ণের সময় একটানা উত্তর দিকে এবং দক্ষিণায়নের সময় একটানা দক্ষিণ দিকে সরতে দেখা যায়। যদি পৃথিবীর বার্ষিক গতি থাকত তাহলে বৃহস্পতির উত্তরায়ণের সময় পৃথিবীর উত্তরায়ণ হলে পৃথিবীর উত্তরায়ণের সাপেক্ষে বৃহস্পতির দক্ষিণ দিকে সরে যাওয়া বোঝা যেত। আর বৃহস্পতির দক্ষিণায়নের সময় পৃথিবীর দক্ষিণায়ন হলে পৃথিবীর দক্ষিণায়নের সাপেক্ষে বৃহস্পতির উত্তর দিকে সরে যাওয়া বোঝা যেত।
বিমান নাথের জবাব: এর উত্তর আগের উত্তরের মতোই।
আমানতের যুক্তি ১০: সূর্যের বার্ষিক গতির কারণেই শনির উত্তরায়ণের সময় একটানা উত্তর দিকে এবং দক্ষিণায়নের সময় একটানা দক্ষিণ দিকে সরতে দেখা যায়। যদি পৃথিবীর বার্ষিক গতি থাকত, তাহলে শনির উত্তরায়ণের সময় পৃথিবীর উত্তরায়ণ হলে পৃথিবীর উত্তরায়ণের সাপেক্ষে শনির দক্ষিণ দিকে সরে যাওয়া বোঝা যেত এবং শনির দক্ষিণায়নের সময় পৃথিবীর দক্ষিণায়ন হলে পৃথিবীর দক্ষিণায়নের সাপেক্ষে শনির উত্তর দিকে সরে যাওয়া বোঝা যেত।
বিমান নাথের জবাব: এটির জবাবও আগের মতো।
আমানতের যুক্তি ১১: সূর্যের বার্ষিক গতির কারণেই শুক্রের পর্যায়কাল পূর্ণ আর সূর্য পৃথিবীর মাঝখান অতিক্রম করা- এই দুটি সমান সময়ে হয়। বুধের ক্ষেত্রেও একই হিসাব। যদি পৃথিবীর বার্ষিক গতি থাকত তাহলে শুক্রের পর্যায়কাল পূর্ণ আর সূর্য পৃথিবীর মাঝখান অতিক্রম দুটি বিষয় আলাদা সময়ে হতো।
বিমান নাথের জবাব: ‘সূর্য পৃথিবীর মাঝখান অতিক্রম করা’ কথাটির কোনো অর্থ হয় না।
থামবেন না আমানত
আমানত উল্লাহর গবেষণাকে আমল দিচ্ছেন না অনেকেই, তবে এতে দমবার পাত্র নন তিনি। বুয়েটের শিক্ষকসহ অনেকেই তার মডেল দেখতে এসেছেন জানিয়ে তিনি নিউজবাংলাকে বলেন, ‘আমি তাদের বিভিন্ন প্রশ্নের উত্তর দিয়েছি। যাওয়ার সময় তারা আমাকে ঢাকায় আমন্ত্রণ জানিয়েছেন। বলেছেন, জ্যোতির্বিজ্ঞানীদের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দেবেন।’
তিনি বলেন, “বিজ্ঞানে গবেষণার কোনো শেষ নেই। আমি যদি এত বছর পর ‘সূর্য পৃথিবীর চারদিকে ঘোরে’ প্রমাণ করতে পারি তাহলে মেনে নিতে সমস্যা কোথায়? আমাকে যে কেউ প্রশ্ন করতে পারেন। আমি যুক্তিসহ প্রমাণ দেব।”
এ বিষয়ে ঘোলদাড়ী বাজার মাধ্যমিক বালিকা বিদ্যালয়ের বিজ্ঞান বিভাগের সহকারী শিক্ষক উসমান গণি বলেন, ‘দীর্ঘদিন ধরে তিনি (আমানত) এই গবেষণা করছেন। পাঠ্যবইয়েরও ভুল ধরেছেন। আমরা তাকে বিভিন্নভাবে খুঁটিয়ে প্রশ্ন করলেও সব প্রশ্নের উত্তর দেন তিনি।’