বাংলাদেশ

মতামত

খেলা

বিনোদন

জীবনযাপন

তারুণ্য

কিড জোন

অন্যান্য

রেস-জেন্ডার

ফ্যাক্ট চেক

স্বাস্থ্য

আন্তর্জাতিক

শিক্ষা

অর্থ-বাণিজ্য

বিজ্ঞান-প্রযুক্তি

শব্দদূষণের সবচেয়ে বড় শিকার কারা

  •    
  • ২৮ এপ্রিল, ২০২২ ১৩:১৯

ট্রাফিক সার্জেন্ট সোহরাব হোসেন বলেন, ‘আমার ছয় বছরের চাকরি জীবনে আমি পরিবারের অন্যদের তুলনায় শব্দ কম অনুভব করি। বাসায় পরিবারের সঙ্গে যখন টিভি দেখি, তখন আমি দেখা যাচ্ছে ভলিউমটা একটু বাড়িয়ে দিই। তখন বাসার সবাই বলে এত সাউন্ড দিচ্ছি কেন।’

রাজধানীর মোহাম্মদপুর বাসস্ট্যান্ড ছাড়িয়ে একটু সামনে এগোলে বেড়িবাঁধ সিগন্যাল। চৌরাস্তার মোড়ে যানবাহনের শৃঙ্খলা রক্ষায় দৌড়ে গেলেন এক ট্রাফিক পুলিশ। নিজের বাঁশি বাজিয়ে এক হাত উঁচু করে গতিরোধ করলেন এক পাশের যানবাহনের, কিন্তু আগে যাওয়ার তাড়া সবার।

ক্রমাগত হর্ন বাজিয়ে যাচ্ছিলেন সেখানে থাকা গাড়ির চালকেরা। যানবাহনের আওয়াজ ছাপিয়ে হর্নের গগণবিদারী নিনাদ শুরু হয়ে গেল।

যানজটের শহরে সড়কে সারা দিনই অযথা হর্ন বাজতে থাকে। আর এই হর্নের যন্ত্রণা যাদের দিনভর সহ্য করতে হয়, তারা ট্রাফিক পুলিশ। বিকট শব্দের সমুদ্রে সারা দিন কাটে তাদের।

যৌক্তিক কারণ ছাড়া কেন হর্ন বাজান, মঙ্গলবার এমন প্রশ্ন করা হয় বিভিন্ন যানবাহনের চালককে।

প্রজাপতি বাসের চালক রবিউল ইসলাম নিউজবাংলাকে বলেন, ‘হর্ন বাজালে কানের ক্ষতি হয়, সেটা আমরা বুঝি, কিন্তু সিগন্যালে কতক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকা যায়? এ ছাড়া সামনে গাড়ি থাকলে হর্ন দিলেও গাড়ি সরতে চায় না। তা ছাড়া একই কোম্পানির বাস হওয়ায় একজন আরেকজকে সাইড না দিয়ে আটকে রাখে যাত্রী তোলে।’

যাদের উদ্দেশে হর্ন দিচ্ছেন তারা হর্ন ইচ্ছা করেই শুনতে চায় কি না, এমন প্রশ্ন করা হলে রবিউল ইসলাম বলেন, ‘তারা হর্ন শোনে। কিন্তু তারা তাদের প্রয়োজন মতো যাবে। কার ক্ষতি হলো, না হলো সেটা দেখে না।

‘ঢাকায় হাইড্রলিক হর্নের গাড়ি খুব কম। যারা হাইড্রলিক হর্ন ব্যবহার করে, প্রশাসন তাদের ধরতে পারলে ব্যবস্থা নেয়।’

হর্ন দিয়ে যাত্রীদের বাসে উঠতে ইশারা করা হয় জানিয়ে স্বাধীন পরিবহনের চালক মো. আকাশ বলেন, একই কোম্পানির বাস যখন সামনে থাকে, তখন যেতে সাইড না দিলে হর্ন দিয়ে যাত্রীদের এই বাসে উঠতে বলা হয়। অনেক সময় যানজটে থাকা অবস্থায় পেছনের চালক হর্ন দেন। কারণ তিনি সামনে দেখতে পান না।

অযথা হর্নের কারণে মানুষের শ্রবণশক্তি কমার বিষয়টি জানেন কি না, জানতে চাওয়া হলে আকাশ বলেন, ‘জানি। কিন্তু কী করা। আমি হর্ন না দিলে আরেকজন দেবে। সবাই ঠিক না হলে এক-দুইজন ঠিক হয়ে লাভ নাই।’

ট্রাফিক পুলিশ তার ডিউটির পুরাটা সময় রাস্তায় থাকেন। গাড়ি নিয়ন্ত্রণ করতে গিয়ে বেশিরভাগই শেষ বয়সে কানের সমস্যায় ভোগেন। অনেকে আবার চাকরি চলাকালীন ভোগেন শারীরিক ও মানসিক সমস্যায়।

কয়েকজন ট্রাফিক পুলিশের সঙ্গে এ নিয়ে কথা হয়। তাদের একজন মোহাম্মদপুর বেড়িবাঁধ এলাকায় দায়িত্বরত ট্রাফিক সার্জেন্ট সোহরাব হোসেন নিউজবাংলাকে বলেন, ‘ঢাকা শহরকে শব্দ দূষণের নগরী বলা যায়। শব্দ দূষণ খুব বেশি অনুভব করি আমরা ট্রাফিকে যারা আছি। যানবাহন চালকেরা অযথাই হর্ন দেন বেশিরভাগ সময়। তারা যানজটে বিরক্ত হয়ে হয়তো বা হর্ন দেন, কিন্তু তার সরাসরি প্রভাবটা পড়ছে আমাদের ট্রাফিক সদস্যদের ওপরে।

‘এ ছাড়া আমরা যারা ওয়্যারলেস সেট ব্যবহার করি, সব সময় এটা বাজতে থাকে। এটাও একটা সমস্যা।’

হর্নের কারণে শারীরিক ও মানসিক দুই ধরনের প্রভাব পড়ে জানিয়ে সার্জেন্ট সোহরাব হোসেন বলেন, ‘আমার ছয় বছরের চাকরি জীবনে আমি পরিবারের অন্যদের তুলনায় শব্দ কম অনুভব করি। বাসায় পরিবারের সঙ্গে যখন টিভি দেখি, তখন আমি দেখা যাচ্ছে ভলিউমটা একটু বাড়িয়ে দিই। তখন বাসার সবাই বলে এত সাউন্ড দিচ্ছি কেন।

‘তাদের কাছে এই শব্দ অস্বাভাবিক মনে হলেও আমার কাছে স্বাভাবিক মনে হয়। তাতে বোঝা যাচ্ছে, আমার শ্রবণশক্তি দিন দিন হ্রাস পাচ্ছে।’

সার্জেন্ট সোহরাব হোসেন বলেন, ‘শব্দদূষণের কারণে আমাদের মেজাজ খিটখিটে হয়ে যায়। অনেক সময় ডিউটি অবস্থায় কোনো চালককে কিছু নিষেধ করলে সেটা না শুনলে মেজাজ গরম হয়ে যায়। তখন একটু কড়া ভাষায় কথা বললে খারাপভাবে নেয় অনেকে। ‘বিষয়টা আসলে এমন না। আমরা চাইলেও অনেক সময় সুন্দর করে কথা বলতে পারি না। পরে বুঝি যে কড়া কথা বলে ফেলেছি।’

সোহরাব বলেন, ‘ট্রাফিক পুলিশরা শব্দদূষণের কারণে সাফার করছে। তাদের নিয়মিত চেকআপ করানো উচিত। এ ছাড়া ট্রাফিক পুলিশদের একটানা ট্রাফিকে রাখা ঠিক না। এটা একটা মানবিক বিষয়। সারা জীবন ট্রাফিকে চাকরি করলে শ্রবণশক্তি অনেকটাই হ্রাস পায়।’

চালকেরা কেন অযথা হর্ন দেন, জানতে চাইলে ট্রাফিক সার্জেন্ট সাহীন আলম বলেন, ‘যে সামনে যাচ্ছে না, তাকে হর্ন দিয়ে সামনে যেতে বলছে। সিগন্যাল একটু বেশি সময় আটকে থাকলে ট্রাফিক পুলিশের দৃষ্টি আকর্ষণ করা বা বিরক্ত করার জন্য হর্ন দেয়। তারা ভাবে বেশি হর্ন দিলে বিরক্ত হয়ে তাদের ছেড়ে দেব।’

সার্জেন্ট সাহীন আলম বলেন, ‘আমরা দিনের আট ঘণ্টার বেশি ডিউটি করি। বাসায় গেলে এক-দুই ঘণ্টা মনে হয় আমি সাউন্ডের ভেতরেই আছি। মেজাজ খিটখিটে হয়ে যায়। অযথা হর্ন বাজানোর কারণে আমরা অনেক সময় চালকদের সতর্ক করে দিই। যখন হাইড্রলিক হর্ন বাজালে ২০১৮ সালের সড়ক আইনে ১৫ হাজার টাকা জরিমানা করা হয়।’

ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের ইএনটি অ্যান্ড হেড নেক সার্জারি বিভাগের বিভাগীয় প্রধান অধ্যাপক ডা. শেখ নুরুল ফাত্তাহ রুমি নিউজবাংলাকে বলেন, ‘শূন্য থেকে ২৫ ডেসিবল পর্যন্ত স্বাভাবিক শ্রবণশক্তির শব্দ। ২৫ ডেসিবল থেকে ৪০ ডেসিবল শব্দের মধ্যে থাকলে শ্রবণশক্তি সামান্য হ্রাস হয়। ৪০ ডেসিবল থেকে ৬০ ডেসিবল মিডিয়াম শ্রবণের শব্দ।

‘এভাবে বাড়তে বাড়তে শব্দের মাত্রা যদি ১০০ থেকে ১২০ ডেসিবল হয়ে যায়, তখন কানের ভেতরে ব্যথা শুরু হয়। কেউ যদি উড়োজাহাজ বা জেট প্লেনের সামনে গিয়ে দাঁড়ায়, সেই শব্দে তার কানে ব্যথা হবে।’

উদাহরণ টেনে ডা. শেখ নুরুল ফাত্তাহ রুমি বলেন, ‘যেমন ধরেন যে ট্রাফিক পুলিশ শাহবাগের মোড়ে দাঁড়িয়ে থাকেন, সেখানে ৭০ থেকে ৮০ ডেসিবলের মতো শব্দ হচ্ছে। তিনি যদি সেখানে আট ঘণ্টার বেশি ডিউটি করেন এবং যদি পাঁচ বছর ডিউটি করেন, তাহলে তার শ্রবণশক্তি হ্রাস পাবে।

‘এ ছাড়া শব্দদূষণের কারণে মেজাজ খিটখিটে হয়ে যাবে। বাসায় গিয়ে বউকে বকা দেবে, বাচ্চাকে মারবে। কাজে মনোযোগ কমে যাবে। রক্তের চাপ বেড়ে যাবে। এ ছাড়া নানা সমস্য তৈরি হবে।’

তিনি আরও বলেন, ‘গর্ভবতী মা যদি নিয়মিত শব্দদূষণের মধ্যে থাকেন, তবে তার কানেরই ক্ষতি হবে না; গর্ভের বাচ্চাও জন্মগতভাবে কম শুনবে।’

এ বিভাগের আরো খবর