করোনাভাইরাস প্রতিরোধে বিশ্বের প্রথম প্লাজমিড ডিএনএ টিকা জরুরি অনুমোদন পেয়েছে ভারতে। অন্তর্বর্তী গবেষণায় তিন ডোজের টিকাটি উপসর্গমূলক করোনার বিরুদ্ধে ৬৬ দশমিক ৬ শতাংশ কার্যকারিতা দেখিয়েছে।
ওষুধ প্রস্তুতকারক ভারতীয় প্রতিষ্ঠান জাইডাস ক্যাডিলার গবেষণালব্ধ এ টিকা। উৎপাদন করবে ক্যাডিলা হেলথকেয়ার। ভারত বায়োটেকের কোভ্যাক্সিনের পর ছোঁয়াচে করোনা প্রতিরোধে ভারতীয় গবেষকদের উদ্ভাবিত দ্বিতীয় টিকা ক্যাডিলার জাইকভ-ডি।
বিবিসির প্রতিবেদনে বলা হয়, এর আগে কয়েকটি করোনা প্রতিরোধী ডিএনএ টিকা পশুদেহে কার্যকারিতা দেখালেও মানবদেহে কাজ করেনি। এ ছাড়া ভারতে ১২ বছর থেকে ১৮ বছর বয়সীদের দেহে করোনা প্রতিরোধী কোনো টিকার পরীক্ষাও প্রথম করেছে ক্যাডিলা।
এক হাজার শিশু-কিশোরের দেহে টিকাটি ‘নিরাপদ ও সহজে সয়ে গেছে’ বলে দাবি করেছে গুজরাটের আহমেদাবাদভিত্তিক প্রতিষ্ঠানটি। বছরে টিকাটির ১২ কোটি ডোজ উৎপাদন করতে চায় ক্যাডিলা।
১৯ আগস্ট পর্যন্ত সাড়ে সাত মাসে ভারতে ৫৭ কোটির বেশি মানুষ করোনার এক বা দুই ডোজ টিকা নিয়েছে। কোভ্যাক্সিন, অক্সফোর্ড-অ্যাস্ট্রাজেনেকার গবেষণালব্ধ কোভিশিল্ড, রাশিয়ার স্পুৎনিক ভি টিকা দেয়া হয়েছে তাদের। এ ছাড়া যুক্তরাষ্ট্রের মডার্না ও জনসনের টিকাতেও অনুমোদন দিয়েছে ভারত সরকার।
ভারতে চলতি বছরের জানুয়ারিতে করোনা প্রতিরোধী টিকা কার্যক্রম শুরুর পর থেকে প্রাপ্তবয়স্কদের প্রায় ১৩ শতাংশ দুই ডোজ ও ৪৭ শতাংশ প্রথম ডোজ নিয়েছে।
ক্যাডিলার তথ্য অনুযায়ী, ভারতে করোনা টিকার সবচেয়ে বড় ক্লিনিক্যাল ট্রায়াল পরিচালনা করেছে প্রতিষ্ঠানটি। অর্ধশতাধিক কেন্দ্রে টিকার পরীক্ষামূলক প্রয়োগে অংশ নিয়েছিলেন ২৮ হাজার স্বেচ্ছাসেবক।
এ ছাড়া মহামারির ভয়াবহ দ্বিতীয় ঢেউ চলার সময় টিকাটির তৃতীয় পর্যায়ের পরীক্ষা চালানোর দাবি করেছে ক্যাডিলা। প্রতিষ্ঠানটির দাবি, রূপ পরিবর্তনকারী অধিক সংক্রামক করোনার বিভিন্ন ভ্যারিয়েন্টের বিরুদ্ধেও কার্যকর তাদের টিকা; বিশেষ করে ডেল্টার বিরুদ্ধে।
প্রখ্যাত ভাইরাসবিশেষজ্ঞ অধ্যাপক শাহিদ জামিল বলেন, ‘টিকাটি নিয়ে আমার খুব আগ্রহ আছে। কারণ এর বেশ কিছু সম্ভাবনাময় দিক আছে। টিকা কাজ করলে করোনা প্রতিরোধে ভবিষ্যৎ টিকা কার্যক্রম পরিচালনা অনেক সহজ হবে।’
কিভাবে কাজ করে এ টিকা
মানুষসহ যে কোনও জীব ও উদ্ভিদের জীবনের কাঠামো নিয়ন্ত্রিত হয় ডিঅক্সিরাইবোনিউক্লিক অ্যাসিড (ডিএনএ) ও রাইবোনিউক্লিক অ্যাসিডের (আরএনএ) মাধ্যমে। বংশানুক্রমে মা-বাবা থেকে সন্তানদের মধ্যে জিনগত তথ্য স্থানান্তরিত হয় ডিএনএ ও আরএনএর মাধ্যমে।
যে কোনও টিকারই মতো মানবদেহে একবার প্রবেশ করলে দেহের রোগ প্রতিরোধী ক্ষমতাকে ক্ষতিকর ভাইরাসের বিরুদ্ধে লড়াই করতে শিখিয়ে দেয়। ডিএনএভিত্তিক টিকাও এর ব্যতিক্রম নয়।
জাইকভ-ডি টিকা রোগ প্রতিরোধে প্লাজমিড, অর্থাৎ ছোট ছোট চক্রাকার ডিএনএ ব্যবহার করে। প্লাজমিডে লুকানো থাকে জিনগত তথ্য।
ত্বকের দুটি স্তরের মাঝখানে টিকাটি প্রয়োগ করা হয়। এরপর প্লাজমিডের মাধ্যমে সে তথ্য পৌঁছে যায় কোষে। কোষের সুচালো বহিঃ আবরণ আংশিক তৈরিতে সাহায্য করে তা।
মানবদেহে প্রবেশের পর কোষের ‘স্পাইক প্রোটিন’ বা সুচালো বহিঃ আবরণে আটকে থেকে বংশবিস্তার করে করোনাভাইরাস। করোনা প্রতিরোধী বেশির ভাগ টিকাই কোষে স্পাইক প্রোটিনের খণ্ডাংশ তৈরির বার্তা পৌঁছে দেয়। এর মাধ্যমে ব্যক্তির রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা দেহে অ্যান্টিবডি উৎপাদন শুরু করে এবং সেগুলোকে ভাইরাসের বিরুদ্ধে লড়াই করতে শেখায়।
জাইকভ-ডির বিশেষত্ব ও অন্য টিকার সঙ্গে পার্থক্য
প্রথম ডোজ গ্রহণের ২৮ দিন পর দ্বিতীয় এবং ৫৬ দিন পর তৃতীয় ডোজ দেয়া হয়।
ভারতের প্রথম সুচমুক্ত করোনা টিকা এটি। সুচবিহীন ইনজেকশন ফার্মাজেট ব্যবহার করে টিকাটি প্রয়োগ করা হয়। ত্বকের দুই স্তরের মাঝখানে এটি প্রয়োগের প্রক্রিয়া ব্যথামুক্ত।
সুচবিহীন ইনজেকটরের মাধ্যমে চাপ প্রয়োগ করে তরলের সরু প্রবাহ দেহে প্রবেশ করানো হয়। প্রবেশের পর ত্বকের ভেতরে নির্ধারিত টিস্যুতে টিকা পৌঁছে যায়।
দুই থেকে আট ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রায় এ টিকা সংরক্ষণ করা হয়। ২৫ ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রার মধ্যেও এটি ভালো থাকে কমপক্ষে তিন মাস।
ফলে উপমহাদেশের আবহাওয়ার উপযোগী টিকাটি। প্রত্যন্ত অঞ্চলে এটি পরিবহন ও সংরক্ষণও বেশ সহজ।
অন্য টিকার তুলনায় ডিএনএ টিকা সস্তা ও নিরাপদ।
ডিএনএ টিকা অপ্রচলিত কেন
যুক্তরাষ্ট্রে বেশ কয়েকটি ডিএনএ টিকা অনুমোদন পেয়েছে। তবে এগুলো শুধু প্রাণীদেহে ব্যবহারযোগ্য। এর মধ্যে একটি টিকা ঘোড়ার রোগ এবং আরেকটি কুকুরের ত্বকের ক্যানসার প্রতিরোধে কাজ করে।
তবে যুক্তরাষ্ট্রে মানবদেহে পরীক্ষামূলক পর্যায়ে আছে ১৬০টির বেশি ডিএনএভিত্তিক টিকা। বেশির ভাগ টিকাই বিদ্যমান ক্যানসার ও একটি এইচআইভি ভাইরাসবাহী এইডস রোগের চিকিৎসার জন্য।
বিপরীতে করোনাভাইরাসের বিরুদ্ধে কার্যকর বিশ্বের প্রথম মানব ডিএনএভিত্তিক টিকা জাইকভ-ডি।
বিশেষজ্ঞদের মতে, অতীতে কয়েকবার মানবদেহে বিভিন্ন সংক্রামক রোগ প্রতিরোধে ডিএনএ টিকা উদ্ভাবনের চেষ্টা করা হলেও ব্যর্থ হয়েছে সেসব প্রচেষ্টা। প্রাণীদেহে এ ধরনের টিকা ভালো কাজ করলেও মানবদেহে সুরক্ষায় খুব একটা কার্যকারিতা দেখায়নি।
মানবকোষে প্লাজমিড ডিএনএ টিকা কিভাবে প্রয়োগ করলে তা রোগ প্রতিরোধে কার্যকর হবে, সে পথ উদঘাটনই ছিল বড় চ্যালেঞ্জ।
এ ছাড়া অন্যান্য টিকার তুলনায় জাইকভ-ডির সুরক্ষা গড়ে তুলতে এক ডোজ বেশি লাগছে। এ অবস্থায় যদিও অন্য সব টিকার মতো জাইডাসের টিকার দুই ডোজে করোনা প্রতিরোধে সাফল্যের হারও বিশ্লেষণ করে দেখছে প্রতিষ্ঠানটি।